বাঙালির ধর্মসংস্কৃতির সঙ্কট
বশিষ্ঠদেব ঠাকুর
May 19, 2025 | | views :29 | like:2 | share: 0 | comments :0
প্রথম পর্ব:
গোখলের বিখ্যাত উক্তি - What bengal thinks today,India thinks tomorrow, এই কথাটি অন্যান্য ক্ষেত্রের মতই ধর্মক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বাঙালি প্রায় তেরশ বছর ধরে ধর্মনৈতিক ক্ষেত্রেও ভারতকে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে, কারণ অনেকেই মনে করেন আদি শঙ্করাচার্যের পরমগুরু, অদ্বৈক বেদান্তবাদের প্রথম প্রবক্তা গৌড়পাদ, বাঙালিই ছিলেন, এই গৌড়পাদের অদ্বৈতবাদের “ব্রহ্ম” আসলে ব্যক্তি ঈশ্বরকে,স্বর্গ নরককে অস্বীকারই করে এবং নাগার্জুনের শূন্যবাদের কাছাকাছি এক দর্শন। তাঁর মতবাদকেই শঙ্করাচার্য সমগ্র ভারতে প্রতিষ্ঠা করেন, এবং এই আচার্য শঙ্করই বৌদ্ধদের মতো মঠকেন্দ্রিক হিন্দুধর্মের সূচনা করেন।
এরপরের বাঙালি নাস্তিক পন্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান - যিনি তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের প্রচার করেন এবং বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন।
পরের সাধকও প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার কারণেই তৎকালীন শাসকদের চক্ষুশূল ছিলেন হয়ত এই কারণেই বাঙালি ও সারা ভারত তাঁকে ভুলে গেছে, অথচ তাঁর শিষ্য গুরু গোরক্ষনাথকে সকলেই চেনেন!
আনুমানিক 10ম থেকে 12শ শতকের মধ্যে, বাংলা ভাষার আদি কবিদের অন্যতম মৎস্যেন্দ্রনাথ (সিদ্ধাচার্য লুইপাদ) ছিলেন নাথ ধর্মের প্রবর্তক, তাঁর দুই শিষ্য হলেন, গুরু গোরখনাথ ও চৌরঙ্গিনাথ, - যিনি পালবংশের সন্তান ছিলেন!
এরপর ভক্তিযুগের অন্যতম ব্যক্তিত্ব হলেন চৈতন্যদেব, যিনি অন্যান্য ভক্তিবাদী সন্তদের মতো শুধুই ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ভক্তির কথাই বলেননি, একজন সমাজসংস্কারকও ছিলেন, যিনি বলেছিলেন, “চন্ডালোপি দ্বিজঃশ্রেষ্ঠ হরিভক্তি পরায়ণঃ”
তাঁর শিষ্য সনাতন গোস্বামীকে নির্দেশ দেন বৈষ্ণবস্মৃতিশাস্ত্র রচনা করতে, সুদীর্ঘ তন্ত্রধর্মের ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও বাংলা তাঁর প্রভাবে বৈষ্ণব ভক্তিপ্লাবনে ভেসে যায়। তাঁরই ভাবধারায় রচিত হয় বেদান্তের অচিন্ত্যভেদাভেদ তত্ত্ব।
এই সময় বাংলায় আরেকটি ধর্মসাহিত্য-ধারার সূচনা হয় যা সমগ্র ভারতে অভিনব - মঙ্গলসাহিত্যের ধারা, যা পুরাণসাহিত্যের আদলে রচিত হলেও এর মাধ্যমে বৈদিক, অবৈদিক এবং ঐশ্লামিক ধারার সংশ্লেষ শুরু হয়। ব্রাহ্মণ্যবাদী পৌরাণিক দেবদেবীদের বিরুদ্ধে লৌকিক ও স্থানীয় দেবদেবীদের মাহাত্ম্য এর মাধ্যমে প্রচার করা হয়,
এভাবেই উঠে এল ওলাবিবি, বনবিবি, ধর্মগাজন, সত্যপীর (যিনি পরবর্তীকালে সত্যনারায়ণ হন), ওলাইচন্ডী, যেখানে ওলাইকে চন্ডী হিসেবে মেনে নেওয়া হল, এভাবেই অন্ত্যজদের ধর্মসংস্কৃতিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, এই সংশ্লেষণের প্রক্রিয়াটা পূর্ববঙ্গে হয়নি, ফলে পূর্ববঙ্গে ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রভাবটা পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় কম থাকলেও সেখানকার নিম্নবর্গের অধিবাসীরা ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করেন!
তাই Richard M. Eaton পূর্ববঙ্গের মুসলিম প্রাধান্যের কারণ ধর্মান্তরণ না বলে Islamisation বা ইসলামিকরণ বলেছেন। এবং এটা তাদের অজান্তেই হয়েছে এটাও বলেছেন, অর্থাৎ সেখানকার অধিবাসীরা আল্লাহ্ কে অন্যান্য দেবতার মতোই আরেক দেবতা হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন প্রথমে। এই বিষয়ে পরবর্তী পর্বে বিস্তৃত আলোচনা করব।
বাংলার মঙ্গলকাব্যে দেবতার মানবায়ন হয়েছে যা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা” তাই এখানে দুর্গাপূজা আসলে দুর্গার (মেয়ের) বাপের বাড়িতে আসা। অথচ সেই সময় সারা ভারতের ভক্তিকবিদের কাছে দেবদেবীরা অনেকটা সামন্তপ্রভুর মত ছিলেন অর্থাৎ এক্ষেত্রেও বাংলা অন্যপথের পথিক!
একই সময়ে আরেক বাঙালি মধুসূদন সরস্বতী বারাণসীতে বসে বিশুদ্ধ জ্ঞানকাণ্ডের অদ্বৈতবাদকে জ্ঞানমিশ্রা ভক্তির দর্শনে পরিণত করেন, এই মধুসূদন সরস্বতীকেই সম্রাট আকবর অব্রাহ্মণদের সাধু করে মন্দির রক্ষা করার পরামর্শ দেন। যার ফলে নাগাসাধুদের সংগঠিত করা হয়। এক্ষেত্রেও বাঙালিই পথপ্রদর্শক!
বাংলার নবজাগরণের প্রাণপুরুষ রাজা রামমোহন রায় যিনি ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম সমাজই ভারতে সমাজ সংস্কারমুলক আন্দোলনের সূচনা করে,
রামমোহন একই সঙ্গে ছিলেন প্রগতিশীল আধুনিক ও যুক্তিবাদী ধ্যানধারণার সমর্থক।
রামমোহন ও বিবেকানন্দের মাধ্যমেই অদ্বৈত বেদান্ত আধুনিক যুগে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
বঙ্কিমচন্দ্রকে শুধুমাত্র আনন্দমঠের লেখক ও সাম্প্রদায়িক বলে উল্লেখ করাটা, তাঁর অসামান্য বহুমুখী সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখাটা ভুল তো বটেই তবে তিনিই প্রথম, যিনি মহাভারত রামায়ণ ও পৌরাণিক কাহিনি, থেকে অলৌকিকতা বাদ দিয়ে কাহিনিগুলোকে আধুনিক দৃষ্টিতে বিশ্লষণ করতে চেষ্টা করেন।
অন্যদিকে রামমোহন থেকে ইয়ং বেঙ্গল তা থেকে বিদ্যাসাগর অক্ষয়কুমার-দের প্রাচীন চার্বাকদের উত্তরসূরী হিসেবে বলা যেতেই পারে, যাঁরা ভারতীয় সমাজে যুক্তিবাদী ভাবধারার সূচনা করেন, যদিও এই ধারাটা বিভিন্ন কারণে জনপ্রিয় হয়নি বলেই বাংলার নবজাগরণ যা শুধুমাত্র সাহিত্যকেন্দ্রিক ছিল তা সমগ্র সমাজকে প্রভাবিত করতে পারেনি!
এবং এঁদের যুক্তিবাদী ভাবধারার জনপ্রিয়তার অভাবেই হিন্দু সংস্কার আন্দোলন শেষ পর্যন্ত হিন্দু পুনরুত্থানবাদী আন্দোলনে পর্রবসিত হয়।
এর বিপ্রতীপে হলেন রামকৃষ্ণ, যিনি আপাত অতি সাধারণ “যত মত তত পথ”-এর কথা বলেন, যেখানে বহুসম্প্রদায়ের সহ অস্তিত্বকে স্বীকার করতে বলেন।
এই সহিষ্ণুতারই আজকের ভারতে ভয়ংকর অভাব, এটা ঠিকই, সহ অস্তিত্বের কথা, সহিষ্ণুতার কথা বুদ্ধ মহাবীর প্রথম বললেও বা “রুচীনাম্ বৈচিত্র্যাত্ ঋজু কুটিলনানাপথ” -এর কথা বহ আগে উল্লেখ করা হলেও, কোন পথটা ঠিক, কোনটা বেঠিক এর চেয়ে বড় কথা “সংবাদ”, পরস্পর আলাপ আলোচনা এভাবেই সামাজিক সম্প্রীতি বজায় থাকে, কারণ সমাজের সব মানুষ যুক্তিবাদী হয়ে যাবেন এটা যেমন অসম্ভব তেমনি বিভিন্ন ধর্মের, সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব থাকলেও তা অযৌক্তিক মনে হলেও অন্যের ভিন্ন মতকে মেনে নেওয়াটাও প্রয়োজন, এই বার্তাটা রামকৃষ্ণের “যত মত তত পথ”-এর মধ্যে নিহিত রয়েছে, যেটা গান্ধীও গুরুত্ব দিয়েছেন, আজ যখন দেখি পাকিস্তানে শিয়া ও আহমেদিয়া-দের মসজিদে বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছে।
নবরাত্রিতে ও জৈন পর্বে মাছ মাংস বন্ধের দাবী তোলা হচ্ছে তখন এই ভিন্ন ভাবনাকে মর্যাদা দেওয়াটাও “যত মত তত পথ” থেকেই সম্ভব। অতীতেও ‘মছলিখোর বাঙালি’র বিরোধীতা উত্তর ভারতে হত, বর্তমানে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা নিরামিষ খাওয়াটাই আদর্শ হিন্দু আহার বলে জনমানসে প্রচার করতে পেরেছে।
এপ্রসঙ্গে গোহত্যা নিবারণী সংস্থার জনৈক ভক্তের সঙ্গে বিবেকানন্দের কথোপকথন স্মরণীয়।
বিবেকানন্দ দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের জন্য কিছু করতে বলছেন, সেখানে জনৈক গোভক্ত মানুষের চেয়ে গোরুকে রক্ষা করাটাই ধর্মরক্ষা ভাবছেন।
বিবেকানন্দ খ্রিষ্টান মিশনারীদের অনুসরণ করে হিন্দু সমাজেও সেবার ধারণাকে জনপ্রিয় করেন, অথচ হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা দলিত হিন্দুদের ক্ষমতায়নের বদলে মন্দির মূর্তি প্রতিষ্ঠা করাটা ও ইতিহাসের বিকৃতি করাই হিন্দুরক্ষার উপায় বলে গণ্য করেছে।
বিবেকানন্দর গীতার কর্মযোগের ব্যাখ্যা সেই সময়কার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অনেককে প্রেরণা জুগিয়েছিল অর্থাৎ দেশসেবার মাধ্যমেই ঈশ্বরসেবাও সম্ভব সেটাও একজন বাঙালিরই ভাবনা ছিল।
বিবেকানন্দ, যিনি ইউরোপ আমেরিকায় হিন্দু ধর্মপ্রচারের পথিকৃৎ তাঁর পথেই অন্য বাঙালিরা - পরমহংস যোগানন্দ থেকে ইসকনের অভয়াচরণরা ছাড়াও অন্যান্য ভারতীয় সাধুরা রজনীশ মহেশ যোগী প্রভৃতি যাঁরা যোগ ও আধ্যাত্মিকতাকে বিপণন করেই বিশাল আর্থিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন।
এভাবে দেখা যায় বাঙালিরা বিজ্ঞান শিল্প সাহিত্য ছাড়া ধর্মক্ষেত্রেও সমগ্র ভারতের পথপ্রদর্শক। কিন্তু জাতীয় আন্দোলনের সময় থেকেই হিন্দু মহাসভা তারপর সংঘপরিবার বাংলায় তাদের অনুপ্রবেশ বাড়াতেই রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার শুরু করে,
এই দুই হিন্দু সংগঠনের ভাবনা বাংলার ঐতিহ্যের পরিপন্থি, এদের মাধ্যমেই উত্তর ভারতের জাতপাতসর্বস্ব উগ্র পুরুষতান্ত্রিক ধর্মভাবনা বাঙালির মনকে আজ আচ্ছন্ন করেছে।
এই সংগঠনগুলোকে প্রথম থেকেই আর্থিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে বাংলার অবাঙালী গুজরাটি ও মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরাই, তাই বর্তমানে সিনেমা থেকে টিভি সিরিয়াল সর্বত্রই বাংলার সনাতন দেবদেবী, আচার-অনুষ্ঠানের বদলে উত্তর ভারতীয় ধর্মাচরণকে প্রচার ও প্রসার করা হচ্ছে পরিকল্পিতভাবেই।
আজ পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামেও রাম ও হনুমান মন্দির গড়ে উঠেছে।
অন্যদিকে বাংলার ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ছিল ভারত ও পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলনের উদাহরণ -
যেখানে মজনু শাহ্, ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরাণী, রামানন্দ গোঁসাই, নুরুল উদ্দিনরা একসঙ্গে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, অথচ ফরাজী ও ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে সাম্প্রদায়িক ভাবনার প্রচার করা হয় এর ফলেই তিতুমীরের আন্দোলন থেকে মোপলা বিদ্রোহ এমনকি সিপাহী বিদ্রোহেও জেহাদি ভাবনার প্রভাব দেখা যায়।
পরবর্তীকালে মুসলিম লীগের মাধ্যমে বাংলার শিক্ষা থেকে সাংস্কৃতিক জগতে পৌত্তলিকতার বিরোধীতা করতে গিয়ে উগ্র নারী বিরোধী সামন্ততান্ত্রিক আরবি সংস্কৃতির প্রচার প্রসার শুরু হয়।
1937 সালে মোহাম্মদ আক্রম খাঁর নেতৃত্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীক “শ্রী” ও
“পদ্ম”-এর বিরোধীতা শুরু করে, এভাবেই তারা ধুতি শাড়ির বিরোধীতা শুরু করে।
এমনকি 1937 সাল নাগাদ মুরারিচাঁদ কলেজের পত্রিকার প্রচ্ছদে একটি রাজহাঁসের ছবি ছিল, এবং কলেজ - সঙ্গীতেও ছিল “সুর্মা তীরের আমরা মরাল, কলেজ মোদের রঙমহল”। এই “মরাল” শব্দের বিরোধীতা শুরু হয়, এমনকি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা গিরিশচন্দ্র রায়ের, প্রতিকৃতিতে মাল্যদান যেহেতু ইসলাম বিরোধী তাই তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়,
বন্দে মাতরম্ এর অঙ্গচ্ছেদের পর প্রথম স্তবক গ্রহণ করতেও বিরোধীতা করেন মুসলিম সাম্প্রদায়িকরা! বর্তমানে বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখের শোভাযাত্রারও বিরোধীতা করা হচ্ছে। এভাবেই বাংলার আবহমান ধর্মসংস্কৃতির সাম্প্রদায়িকীকরণের ফল বঙ্গভঙ্গের কারণ হয়েছিল তবে এবার তা বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্কট বলেই মনে হচ্ছে।
দ্বিতীয় পর্ব:
পৃথিবীর কোনও সভ্যতাই ধর্মকে বাদ দিয়ে বিবর্তিত হয়নি, কারণ মানুষের বৌদ্ধিক বিবর্তনটা প্রাথমিকভাবে ধর্মকে ভিত্তি করেই হয়েছে।
ভবানীপ্রসাদ সাহু তাঁর “ধর্মের উৎস সন্ধানে”-র “ধর্মচিন্তার স্তরভাগ “ প্রসঙ্গে লিখেছেন - “মানুষ যেভাবে ধর্মচিন্তার বিকাশ ঘটিয়েছে তার স্তরভাগ করলে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট ধাপ দেখা যায়, যেমন - আদিম (primitive), প্রাচীন(archaic), ঐতিহাসিক (historic), প্রাক্ -আধুনিক (early modern) ও আধুনিক (modern)। আধুনিক ধর্ম এখনও পরিপূর্ণভাবে সৃষ্টি হয়নি, কিন্তু সৃষ্টি হওয়ার পথে, যেটি বিজ্ঞানের তথ্য ও যুক্তিবোধের সঙ্গে উপযোগী হয়ে, মানবিকতার সমস্ত সৎ মূল্যবোধ নিয়ে গড়ে উঠতে পারে, কিন্তু এটা এখনও সম্ভাবনা মাত্র, কবে কীভাবে হবে তা সুনিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। এবং এই “ধর্ম”
আদিম চিন্তার ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি হওয়া ঈশ্বর ও অতিপ্রাকৃত শক্তির কল্পনা থেকে বিযুক্ত হয়েই সৃষ্টি হবে, অন্তত ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি তাই। এখনকার প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস থেকে তা হবে গুণগতভাবে পৃথক। অন্ধবিশ্বাস, অনড় অচল আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি তথা ধর্ম সম্পর্কিত প্রচলিত সমস্ত ধারণা থেকেই তা মুক্ত হবে। বাঙালির ধর্মসংস্কৃতির বিবর্তনকে ও তার স্বরূপকে বর্ণনা করাই এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য।
বাঙালি তার সমৃদ্ধ ধর্মসংস্কৃতির ঐতিহ্যকে ভুলে আজ নির্বিচারে পরানুকরণ করতে গিয়েই বাঙালি জাতি অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগছে। আজ এই প্রশ্নটা বড় হয়ে উঠছে - বাঙালি আগে হিন্দু/মুসলমান নাকি বাঙালি, নাকি ভারতীয়/বাংলাদেশী/আমেরিকান?
আসলে আমাদের আত্মপরিচয়টা বহুমাত্রিক, তাই একাধারে আমি বাঙালি ভারতীয় হিন্দু/ মুসলমান/নাস্তিক সবই হতে পারি।
প্রাক্-ঔপনিবেশিক ভারতে হিন্দু-মুসলমান এই জাতীয় আত্মপরিচয় ছিল না, বরং
আমার জাত -উপাসনার সম্প্রদায় -ভাষা-অঞ্চলত্তিক পরিচয়টাই তখন ছিল, ঔপনিবেশিক আমলেই পরবর্তীকালে Pan-Islamic, Pan-Hindu প্রভৃতি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ধারণা জনপ্রিয় হয়, এটার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে ঐক্যস্থাপন করা কিন্তু এর ফল হলো মারাত্মক।
এইধরণের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে হিন্দু ও ইসলামের বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে একটা কাল্পনিক আদর্শবাদী ধারণার মধ্যে বেঁধে দেওয়া হল, এভাবেই ধর্মীয় মৌলবাদের জন্ম হয়,
মনে রাখতে হবে ধর্মীয় মৌলবাদ মূলত ঔপনিবেশিকতার ফল।
এর ফলে সাম্প্রদায়িক হিংসার বিশ্বায়ন হল, খিলাফতকে কেন্দ্র করে ভারতীয় মুসলমানরা একসঙ্গে আন্দোলন শুরু করল, অথচ তুরস্কের খিলাফত বিরোধী আন্দোলন ছিল এক প্রগতিশীল আধুনিক তুরস্ক গঠনের আন্দোলন। তিতুমীর থেকে মোপলা বিদ্রোহেও স্থানীয় শোষকদের বিরোধীতার সঙ্গে যুক্ত হলো হিন্দু বনাম মুসলমান এই দ্বান্দ্বিক ন্যারেটিভের।
ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙার ফলে বাংলাদেশের ঢাকার হিন্দু মন্দির ভাঙা হল,
ISIS এর জন্য ইউরোপ আমেরিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক মুসলমানরা জেহাদ করতে গিয়েছিল। প্যালেষ্টাইন ও কাশ্মীরের প্রতি অনেক মুসলমানদের একাত্ম অনুভব করাটাও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদই। কারণ জাতীয় হিংসা তো প্রতিটি মহাদেশেই ঘটে চলেছে, সেসবের ক্ষেত্রে তো সর্বাত্মক প্রতিবাদ দেখা যায় না।
অপরদিকে তুরস্কের হায়া সোফিয়া গীর্জাকে মসজিদ বানানো হলে ভারতীয় মুসলমানদের অনেকেই খুশি হয়েছিলেন। কাতারের বিশ্বকাপের সাফল্যে অনেকেই মুসলিম দেশের সাফল্য ভেবে গর্বিত হয়েছিলেন।
বাংলাদেশের দুর্গাপূজায় মূর্তি ভাঙা ও পরবর্তী আক্রমণের পরিবর্তে আসাম ত্রিপুরার মুসলমানদের ওপর অত্যাচার করা হয়।
আফগানিস্তানের তালিবানদের বামিয়ান বুদ্ধমূর্তি ভাঙার ফলে মায়ানমারের রোহিঙ্গা বাঙালি মুসলিমদের নিজের ভূমি থেকে উচ্ছেদ হতে বাধ্য হতে হয়।
প্রতিটি ঘটনার কারণ ছিল, কাকতালীয়ভাবে তাঁরা সকলেই বিশেষ ধর্মগোষ্ঠীর সদস্য হওয়াটাই।
এই কারণেই গ্রীস ও তুরস্কের আলাদা হওয়া বা ভারতের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদেরও ফসল হচ্ছে দেশভাগ।
ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ফলেই “ইসলামের স্বর্ণযুগ”, “হিন্দুদের স্বর্ণযুগ” নামক কাল্পনিক ইতিহাসের সৃষ্টি।
যেখানে হজরত মহম্মদের পূর্ব যুগকে অন্ধকারের যুগ বলে বর্ণনা করা হয়, অথচ সেই যুগই ছিল মহিলাদের স্বাধীনতার যুগ।
এখনও অনেক মুসলমানই ভাবেন তুর্কি ও মুঘল শাসন আসলে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের অবদান অথচ তাঁরাই মুসলমানদের হারিয়ে ব্রিটিশদের শাসকে খ্রিষ্টানদের শ্রেষ্ঠত্ব হিসেবে দেখেন না।
প্রাচীন বৈদিক যুগকে হিন্দুত্ববাদীরা ব্যবিলনীয় ও মিশরীয়দের চেয়ে উন্নত ভাবেন।
ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ বা ধর্মীয় আত্মপরিচয়ের রাজনীতি আজ বর্তমানে বিশ্বশান্তির ও “আধুনিকতা”র প্রধান অন্তরায়।
কারণ আধুনিকতার সাথে যৌক্তিক মানসিকতার সম্পর্ক রয়েছে,
অন্যদিকে আধুনিকীকরণ হচ্ছে পরিকাঠামোগত উন্নয়ন যা কাতার ইরাণ সৌদি আরব বা হিন্দুত্ববাদী ভারত, ইসলামিক বাংলাদেশ পাকিস্তান সবজায়গাতেই হচ্ছে।
আমরা অনেকেই এই আধুনিক বনাম আধুনিকীকরণের তফাৎটা ভুলে যাই।
প্রশ্ন উঠতে পারে, ধর্ম ও জাতিসত্তা তো মানুষের ভিন্ন ভিন্ন আত্মপরিচয়ের জায়গা, এই আইডেন্টিটিগুলো ছাড়াও তো মানুষের অস্তিত্ব সম্ভব।
হ্যাঁ, তা সম্ভব হলেও, বাঙালির সাংস্কৃতিক সম্পদ শুধুই বাঙালির নয় বরং তা সমগ্র মানবতার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, কারণ প্রতিটি জনগোষ্ঠীর অবদান রয়েছে মানুষের বৈশ্বিক সংস্কৃতিতে। এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রতিটি জাতির পরিচয়ের অংশ।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আমাদের অতীত ও বর্তমানের সমাজবিকাশের সূত্র দেয়।
সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদে বিশ্বাস করলে, আমাদের প্রত্যেকের দায় আছে
নিজের সংস্কৃতি রক্ষা করার, অপর সংস্কৃতির সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে তা সমৃদ্ধ করা, তবে তা নির্বিচারে গ্রহণ বা বর্জন নয় বরং যা কিছু যুক্তিহীন অপসংস্কৃতি রয়েছে তার বর্জনের সঙ্গে অন্যের সুসংস্কৃতির কোনও উপাদানকে গ্রহণের মাধ্যমেই সাংস্কৃতিক বিকাশ সম্ভব হয়।
এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হচ্ছে বাঙালির রন্ধনসংস্কৃতি, যা তুর্কি মুঘল থেকে ইউরোপীয়, সকলের অবদানে সমৃদ্ধ বাঙালির রন্ধনসংস্কৃতি।
পুঁজিবাদ বনাম সমাজতান্ত্রিক দ্বন্দ্বের যুগে “বিশ্বায়ন” ও “আন্তর্জাতিকতাবাদ এই দুটি শব্দের উদ্ভব হয়।
পুঁজিবাদের প্রাধান্যের কারণেই “বিশ্বায়ন” শব্দটি খুব জনপ্রিয় হয়ে যায়, কিন্তু এর সমস্যা হচ্ছে মানুষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আত্মপরিচয়কে উপেক্ষা করা।
তাই আমার পছন্দ আন্তর্জাতিকতাবাদ, যা গভীর তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ।
এতে আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে অস্বীকার করা হয়নি অথচ মানবসভ্যতার বিকাশের স্বার্থে প্রতিটি জাতির পরস্পরের সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানকেও গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়েছে।
তাই আমি বিশ্বায়নের পরিবর্তে আন্তর্জাতিকতাবাদকেই বেশি গ্রহণযোগ্য ভাবনা বলে মনে করি।
প্রতিটি জাতির বিকাশ হলেই আন্তর্জাতিকতাবাদেরও বিকাশ সম্ভব, তাই সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য, ভাষাগত স্বাতন্ত্র্যকে অস্বীকার করে কখনওই সুস্থ সুন্দর সম্প্রীতিময় মানবজাতির ভবিষ্যত সম্ভব হবে না।
তৃতীয় পর্ব:
প্রাচীন বাংলার ধূসর ইতিহাসের কালপর্বে রাজনৈতিক শক্তির অভাবেই সম্ভবত “ বৃহৎ বঙ্গদেশ”-এর আত্মপ্রকাশ সম্ভব হয়নি। কিন্তু বিভিন্ন কারণেই সাংস্কৃতিক ঐক্য ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে। “বঙ্গ” শব্দটি প্রাথমিক পর্যায়ে কোনও দেশবাচক শব্দ ছিল না, ছিল জনবাচক (tribe)।
আজকের এই “বৃহত্তর বাংলার” ভৌগলিক পরিসরে বিভিন্ন জনপদের নাম পাওয়া যায়। বঙ্গ -পুন্ড্র-রাঢ়-গৌড় এসবই ছিল একসময় কোম বা জনপদ-রাষ্ট্র। পরবর্তীকালে রাঢ়-বঙ্গ-গৌড়-বরেন্দ্র-পুন্ড্র-বঙ্গ-সমতট-হরিকেল প্রভৃতি খন্ড-খন্ড জনপদ নিয়ে বাঙালির ভৌগলিক পরিচয় গড়ে ওঠে। যা মুঘল আমলে “সুবে বঙ্গাল” থেকে ঔপনিবেশিক আমলে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি তে পরিণত হয়।
তবে বিশেষ ভূপ্রকৃতিগত সীমার মধ্যেই জাতি ও ভাষাগত ঐক্য গড়ে উঠলেও দেশ গঠন হয় তার রাজনৈতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী। তাই বর্তমানে বাঙালি অধ্যুষিত ভূমি বলতে পশ্চিমবঙ্গ,বাংলাদেশ, ত্রিপুরা ছাড়াও বিহার ঝাড়খন্ড আসামের কিছু অংশও রয়েছে।
বাঙালির অখন্ড জাতি-চেতনার উদ্ভব উনিশ শতকে হলেও তা অনেকটাই কৃত্রিম ও বায়বীয় ছিল। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক কারণেই হিন্দু-মুসলিম ও দলিত বাঙালির আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরফলস্বরূপ দেশভাগটাই ভবিতব্য হয়ে ওঠে।
আজ বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই অখন্ড বাঙালি জাতি-চেতনার বিকাশ প্রয়োজন, এবং এই কারণেই বাঙালির, বাঙালি -জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের ইতিহাসটা জানা দরকার।
এই প্রবন্ধের প্রধান উদ্দেশ্য যেহেতু ধর্মসাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে অনুসন্ধান করাই, তাই বাঙালির নৃতাত্ত্বিক সামাজিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনটা নিয়ে অতি সংক্ষেপে আলোচনা করে নেব।
জৈবিক নৃবিজ্ঞান ও আধুনিক জিনতত্ত্ববিদদের মতে অতীতে বাংলায় মোট পাঁচটি পরিযান হয়েছিল - যা সারা পৃথিবীতেই এক বিরলতম ঘটনা। অর্থাৎ নৃতাত্ত্বিকভাবেও এই পাঁচটি জাতির মিলনে বাঙালির উদ্ভব। আজকাল যদিও শারীরিক বৈশিষ্ট্যকে ভিত্তি করে জাতিগত পরিচয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তাই সাংস্কৃতিকভাবেও যে বাঙালি একটি সংকর জাতি তা নিয়ে বিশেষ আলোচনা করব।
সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানকে তিন ভাগে ভাগ করা হয় – প্রত্নতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব এবং জাতিতত্ত্ব (ethnology)।
অন্যদিকে সংস্কৃতির প্রধান দুটি উপাদান হচ্ছে - ভাষা ও ধর্ম।
বাংলাভাষার উদ্ভবের ক্ষেত্রেও পাঁচটি পূর্বোক্ত পরিযানকারী জাতির প্রভাব থাকবে।
তবে আলোচনার সুবিধার জন্য বাংলা ভাষার উদ্ভবের ক্ষেত্রে প্রধান দুটি ধারাকেই উল্লেখ করব - প্রথমটি অনার্য ধারা, যার মধ্যে দ্রাবিড় ও অষ্ট্রিক ভাষাগোষ্ঠীগুলি রয়েছে
এবং দ্বিতীয়টি ও প্রধান ধারাটি হচ্ছে -
আর্যভাষার ধারা যা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষানদীর একটি ধারা থেকেই মাগধী প্রাকৃত হয়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব।
সংস্কৃতির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি হলো -ধর্ম।
যা এই প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয়।
প্রচলিত ধর্মমতগুলির তিনটি দিক রয়েছে, বিশ্বাস (belief) অনুষ্ঠানাদি (worship) ও সংগঠন (organization), এই বিশ্বাসের ধারাটি সৃষ্টি ও সংঘবদ্ধ হয়েছে পুরা-প্রস্তরযুগেই, অর্থাৎ বাঙালির ধর্মভাবনার উৎসও সেই প্রস্তরযুগেই।
তবে বাঙালির ধর্মসংস্কৃতির বিবর্তনটা জানতে হলে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবটাও আগে আলোচনা করে নেওয়া দরকার।
ষোড়শ মহাজনপদের একটিও বাংলায় না থাকায় এবং বৈদিক সাহিত্যে তেমন বিশেষভাবে উল্লেখ না থাকায় অনেকেই বাংলাকে অনার্য অধ্যুষিত ভূমি হিসেবেই বর্ণনা করেছেন।
কিন্তু উয়ারী-বটেশ্বর থেকে মহাস্থানগড় এবং Northern black polished ware pottery -র নিদর্শন থেকেই বোঝা যায়, বাংলায় আর্যদের আগমন আড়াই হাজার বছর আগেই হয়েছিল।
মহাভারতের সভাপর্বের “দিগ্বিজয়পর্বে” উল্লেখ রয়েছে - পঞ্চপান্ডবরা বিভিন্ন দেশ যুদ্ধে জয়লাভ করেন, সেখানে ভীম তাম্রলিপ্ত ও বঙ্গদেশ জয় করেন, আমরা জানি তাম্রলিপ্ত একটি প্রাচীন রাজ্য এবং লক্ষ্যণীয় যেটা তা হলো আজও মেদিনীপুরে ভীমের পূজা বিশেষভাবে হয়। গগনেডাঙায় কথিত আছে এখানে ভীম-বকাসুরের নাকি যুদ্ধ হয়েছিল।
তবে বাঙালি জাতির আর্যায়ন মৌর্য যুগ থেকেই শুরু হয়ে যায় এবং এর ধারাবাহিকতা গুপ্ত যুগ পর্যন্ত চলে।
আর্য ধর্মসংস্কৃতির দুটি ধারা রয়েছে, একটি বৈদিক অপরটি অবৈদিক।
বৈদিক আর্যসংস্কৃতি ছিল মূর্তিপূজাহীন যাগযজ্ঞময়, এই বৈদিক সংস্কৃতির ধারাটি হয়ত
বাংলায় জনসমর্থন পায়নি, এবং কালক্রমে এই বৈদিক ধর্ম থেকেই classical hinduism এর উদ্ভব হয়।
যা বাংলায় শুঙ্গ থেকেই গুপ্তযুগের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এবং সেনযুগে রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা পায়।
অন্যদিকে অবৈদিক ধর্মগুলোর মধ্যে প্রথমের দিকে জৈন ও আজীবিকরা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, তাই জৈন ও আজীবিকদের বাংলার আদিধর্ম বলে বর্ণনা করা যায়। পরবর্তীকালে আজীবিকরা স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে জৈনদের মধ্যেই মিশে যায়। বর্দ্ধমান জেলার নাম তীর্থংকর বর্ধমান মহাবীরের নামেই হয়েছে,
বাঁকুড়া ও পুরুলিয়াতেও জৈনদের প্রভাব বিশেষভাবে ছিল।
বৌদ্ধ ধর্মও একই সময়ে বাংলায় এলেও ঐ দুই ধর্মের কারণেই অনেক পরে বাংলায় বৌদ্ধদের প্রভাব দেখা যায়। বৌদ্ধধর্মে বঙ্গদেশ প্লাবিত হলেও জৈনরাই কিন্তু বঙ্গভূমির সন্ধান জানতেন বেশি।
জৈনভগবতী সূত্রে - অঙ্গ বঙ্গ এবং রাঢ়ের উল্লেখ রয়েছে।
জৈন ও বৌদ্ধ প্রচারকদের মাধ্যমেই আর্যভাষা ও আর্যসংস্কৃতির সঙ্গে বাংলার তৎকালীন অধিবাসীদের পরিচয় হয়।
এভাবেই গুপ্তযুগে বাঙালি জাতির উদ্ভব হয়।
তবে রাজনৈতিকভাবে বাঙালির উত্থান হয় রাজা শশাঙ্কের মাধ্যমেই, যেহেতু হর্ষবর্ধনের পরম শত্রু ছিলেন শশাঙ্ক, তাই শশাঙ্ককে বৌদ্ধবিরোধী বলে অপপ্রচার করা হয়েছিল, এবং হিউয়েন সাং তাঁকে বৌদ্ধবিরোধী বলে উল্লেখ করলেও শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণে যে দশটি বৌদ্ধবিহার ও দুহাজার হীনযান বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ছিলেন, রক্তমৃত্তিকা নামক বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহার ও দেবমন্দিরও ছিল তার উল্লেখও করেন।
তাই শশাঙ্ককে একজন পরমতসহিষ্ণু ও প্রজাপালক রাজা হিসেবেই বলা উচিৎ।
এবং শশাঙ্কের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন তাঁর রাজ্য দখল করলেও, শশাঙ্কের সময় থেকে পালযুগ পর্যন্ত সর্বধর্মসমন্বয়ের রাষ্ট্র নীতিই রাজারা অনুসরণ করতেন।
এই সময় থেকেই বাংলা বাণিজ্যসূত্রে বহির্ভারতের সাথে যুক্ত হয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্যের কারণেই তাম্রলিপ্ত সেই সময় আন্তর্জাতিক বন্দর হয়ে ওঠে। বাঙালি স্থপতি শিল্পী ও কারিগরদের সুনাম ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে,
তবে বাংলা ভাষার গুরুত্ব পালযুগের পরই বৃদ্ধি পায়,কারণ পাল আমলের সব রচনাই ছিল, সংস্কৃত।
অথচ এই সময়ই চোল শাসকরা শ্রীলঙ্কায় বঙ্গলিপিতে মুদ্রা জারি করেন।
সেন শাসনামলেই বঙ্গলিপি প্রথম স্বীকৃতি পায় এবং ইলিয়াস শাহী আমল থেকে বাংলা ভাষা রাজদরবারে স্বীকৃতি পেতে শুরু করে।
যদিও অনেকেই সেন আমলকে ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনরুত্থান হিসেবেই বর্ণনা করেছেন, আমার ধারণা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। এটাও প্রণিধানযোগ্য, যে “বাংলার মনু” রঘুনন্দন কিন্তু ১৫শ - ১৬শ শতকের লোক ছিলেন।
জয়দেবও সেনযুগের কবি যাঁর সময়ই বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার বলে গ্রহণ করা হয়।