আবহমান কাল ধরে মানুষ কি জানতে চায়?
Mahbubur Rahman
Feb. 23, 2025 | | views :275 | like:2 | share: 0 | comments :0
আদিম
যুগে মানুষ খুব বেশি মাত্রায় প্রকৃতির উপর নির্ভর ছিল। প্রকৃতি যেমন তাদের
সুফল বয়ে আনত তেমনি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও কম ছিল না। প্রকৃতির এই পরিবর্তিত
চরিত্রের বস্তুগত ব্যাখ্যা তারা খুঁজে পেত না। তাই এই শুভ ও অশুভ রুপের
কারণ হিসেবে তারা অদৃশ্য কোন শক্তির হাত রয়েছে বলে কল্পনা করে নেয়।
প্রবৃত্তিগত ভয়ের অনুভুতি থেকে উৎসারিত শুভ ও অশুভ অদৃশ্য শক্তির ধারণা
তাদের মস্তিষ্কের স্মৃতিকোষে এমনভাবে গেঁথে যায় যে এগুলো সত্য বলে বদ্ধমূল
ধারণায় পরিনত হয়। অব্যাখ্যায়িত অসংখ্য বিষয়ের কাল্পনিক ব্যাখ্যার জগত নিয়ে
তাদের ভাবগত জ্ঞানের পরিধি বাড়তে থাকে।
জন্ম
ও মৃত্যু মানুষের অনুভূতির জগতকে সব সময় আলোরিত করে। আদিম সমাজের মানুষ
জন্ম ও মৃত্যুকে নিয়ে বিভিন্ন ব্যখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছে, তৈরি করেছে বহু
কল্প কাহিনী মিথ। তাদের পূর্ব পুরুষেরা কোথা থেকে আসল, এই টেরিটরি তাদের কে
দিয়েছে, মৃত্যুর পর প্রবীণেরা কোথায় চলে যায়, প্রবীণেরা কি সব সময় অদৃশ্যে
থেকে তাদের রক্ষা করে চলছে ইত্যাদি প্রশ্নের জবাব তারা তাদের ভাষার তথ্য
ভাণ্ডারে সংগ্রহ করে রেখেছে। পৃথিবীর অসংখ্য ট্রাইবাল সমাজে অসংখ্য মিথ ও
বিশ্বাস রয়েছে। এইসব মিথের একটি হোল বিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে ব্যাখ্যা।
আফ্রিকান অনেক উপজাতি বিশ্বাস করে বিশ্বের জন্ম হয়েছে একটি ডিম থেকে। ডগন
উপজাতিরা বিশ্বাস করে সৃষ্টিকর্তার জোড় আত্মা নুম্মু একটি স্বর্গীয় ডিম
থেকে জন্ম লাভ করে। অনেক উপজাতিরা বিশ্বাস করে পৃথিবী গঠিত হয়েছে একটি
বিড়াটকায় সাপের শরীর থেকে। বেনিনের ফণ লোকেরা মনে করে মাউ (চাঁদ) ও লিসা
(সূর্য) এই দুই সৃষ্টি দেবতার বড়ছেলে গু পৃথিবীতে আসে লোহার এক তলোয়ারের
রুপে এবং পরবর্তিতে কামার হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। তার কাজ ছিল মানুষের
বসবাসের জন্য পৃথিবীকে প্রস্তুত করা। সে মানুষকে বিভিন্ন হাতিয়ার বানাতে
শেখায় এবং সেগুলো ব্যবহার করে শেখায় কিভাবে ফসল চাষ করা যায় ও কিভাবে ঘর
বাড়ী বানানো যায়। দক্ষিণ আফ্রিকার সান লোকেরা (বুশমেন) মনে করে সৃষ্টি কর্ম
করেন ডক্সোই নামে এক আত্মা। যিনি একই সাথে মানুষ বা ফুল বা পাখী বা কোন
সরীসৃপ। আমেরিকান আদিবাসীরা মনে করে একজন পরম আত্মা বিশ্ব জগত সৃষ্টি
করেছেন। কিন্তু সৃষ্টির শুরুটা ঘটিয়েই তিনি তার দ্বায়িত্ব শেষ করে স্বর্গে
গিয়ে বসবাস শুরু করেন। সৃষ্টির পরবর্তি খুটিনাটি বিষয় এবং প্রতিদিনের
কার্য্যক্রম পরিচালনা করেন অন্যান্য দেবতারা। তাদের মতে আকাশ পিতা ও
ধরিত্রী মাতা সৃষ্টি জগতের গুরুত্বপূর্ণ দুটি শক্তি। পরম আত্মা আকাশ,
পৃথিবী, শুকতারা, সন্ধ্যাতারা এবং অন্যান্য গ্রহ দেবতাদের মধ্যে বিভিন্ন
কাজ ভাগ করে দিয়েছেন। লাকোটার লোকেরা মনে করে আকাশ, সূর্য্য, বাতাস, পৃথিবী
এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বহু উপাদান, মানুষ, আধ্যাত্মিক জগত সবকিছুই একজন
চরম স্বত্বার বহু গুণ। দক্ষিণ পশ্চিম আমেরিকান আদিবাসীদের সৃষ্টি তত্বের
পৌরাণিক কাহিনী আবার ভিন্ন ধরণের। তাদের কাহিনীতে রয়েছে সৃষ্টির শুরুতে
পৃথিবী সাগরের নিচে নিমজ্জিত ছিল। একটি হাস বা কচ্ছপ সাগরের নীচ থেকে কিছু
মাটি পিঠে করে উপরে নিয়ে আসে। সেই মাটি দিয়েই পৃথিবীর সৃষ্টি। এই মিথ উত্তর
ইউরোপ ও এশিয়াতেও রয়েছে। ইরোকুইস বাসীরা এই মিথের সাথে আরো কিছু যোগ করেন।
সেই মতে আকাশ দেবী আতাহেন্সিক স্বর্গের মেঝে ফুটো করে দিলে সেখান দিয়ে
একজন নারী নিচে সাগরে পড়ে যান। তাকে দাঁড়াবার ও বিচরণের স্থান দেবার জন্যই
সাগরের গভীর তলদেশ থেকে হাঁস কাঁদা তুলে আনে এবং কচ্ছপের পিঠে তা বৃস্তিত
করে পৃথিবী তৈরি করা হয়।
মৃত্যু
সম্পর্কেও মানুষের বিভিন্ন মিথ রয়েছে। আফ্রিকা জুড়ে এই বিশ্বাস প্রচলিত
আছে যে সর্বোচ্চ দেবতা মানুষকে অমর করে সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন কিন্তু কোন
ভুলের জন্য সেটা হয়নি। সিরা লিয়ন অঞ্চলের লোকেরা মনে করে মানুষের অমরত্বের
সংবাদ নিয়ে একটি কুকুরকে পাঠানো হলে সে পথিমধ্যে খাবারের সন্ধান করতে করতে
দেরী করে ফেলে। ইতিমধ্যে একটি ব্যাঙ মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে আগেই পৌঁছে যায়।
ফলে মৃত্যু মানুষের একমাত্র পরিণতি হিসেবে থেকে যায়।
এভাবে
জন্ম, মৃত্যু, মানুষ ও জগতের উৎপত্তি সম্পর্কে আদীম সমাজ থেকে শুরু করে
বর্তমান যুগের অসংখ্য ট্রাইবাল সমাজ এমন কি আধুনিক সমাজের মানুষের মনো জগতে
বিভিন্ন মিথ জোরালো ভাবে বিরাজ করছে। এই সমস্ত মিথের উপর নির্ভর করেই
মানুষ্য সমাজে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক আচার আচরণ, জীবনাচরণের রীতি নীতি
নৈতিকতা, সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন ভাষার তথ্য ভাণ্ডার এই সমস্ত জ্ঞান
সংরক্ষিত করে রেখে পরবর্তি প্রজন্মে সঞ্চারিত করছে। এই সমস্ত সামাজিক জ্ঞান
একদিকে যেমন সামাজিক একাত্বতা ধরে রাখে, অপর দিকে বিভিন্ন সমাজের
স্বাতন্ত্রতাও বজায় রাখে।
এক সময় বস্তুগত জ্ঞানের প্রভাব থেকেও ভাবগত
জ্ঞানের প্রভাব অনেক বেশি জোড়ালো হয়ে উঠে। ক্রমশ ভাবগত জ্ঞানের সামাজিকিকরণ
হওয়ার ফলে মানুষ একসময় এই জ্ঞানের ভিত্তিতেই বস্তুগত জ্ঞানএর সত্যতা যাচাই
করতে শুরু করে দেয়। ফলে বস্তুগত জ্ঞানের গ্রহণ যোগ্যতা নির্ভর করে ভাবগত
জ্ঞানের দ্বারা অনুমোদনের উপর।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আবহমান কাল ধরেই মানুষের মনে একই জিজ্ঞাসা এই বিশ্ব
জগতের সৃষ্টির রহস্য কি? এই জগত সৃষ্টির পেছনে কি কোন উদ্দেশ্য কাজ করছে?
জন্ম মৃত্যুর রহস্যটাই বা কি? বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বিভিন্ন ভাবে এর জবাবও
রয়েছে। পাশাপাশি বিজ্ঞানের জবাবটাও আমাদের জানা প্রয়োজন।