যে গল্প আমাদের কখনো বলা হয় না।

Guitar K Kanungo


Jan. 1, 2025 | | views :43 | like:3 | share: 2 | comments :0

মামা-ভাগ্নে একসঙ্গে হলেই যে সবকিছু ঠিকঠাক চলবে, এমন ভাবার কিছু নেই। নর্সদের প্রধান দেবতা ওডিনও কারো ভাগ্নে ছিলেন, অর্থাৎ তারও একজন মাতুল ছিল। সেই মাতুলের নাম মিমির। এই মিমির আবার সম্পর্কে ওডিনের মাতুল হলেও তিনি দেবতাদের শত্রুপক্ষই ছিলেন। মিমিরের একটা কুয়ো ছিল, টলটলে, শীতল জলে পুরিপুর্ণ, বিশেষ রকমের এক কুয়ো। এই কুয়ো থেকে কেউ এক ছিলিম জল পান করলে সে অসীম জ্ঞানের অধিকারী হয়ে যেত। অনেকটা অমৃতের মত, যেটা পান করে হিন্দুদের দেবতাকূল অমর হয়েছিল। কিন্তু তাতে কী? মিমির কাউকেই এই কুয়ো থেকে বিন্দু জল তুলতে দিত না।

ওডিন সেটা জানত। ওডিন এটাও জানত, তিনি দেবতাদের মধ্যে প্রধান হলেও তিনি অপরিসীম জ্ঞানের অধিকারী নন; তাঁর জ্ঞানও সীমাবদ্ধ। সেইজন্যেই তাঁর একদিন ইচ্ছে হল তিনি মিমিরের কুয়ো থেকে খানিকটা জল পান করে দেখবেন। সেই মোতাবেক মিমির যে এলাকায় বসবাস করতেন, সেই এলাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলেন। সেখানে যাওয়াটা খুব একটা সহজ ছিল না, এমনকি ওডিনের জন্যেও, তবুও ওডিন হাল ছাড়লেন না। তিনি সেখানে হাজির হলেন।

ওডিন ছদ্ববেশেই এসেছিলেন। কিন্তু বোনের এই মহাপ্রতাশালী ছেলেটিকে মিমিরের চিনতে মোটেই অসুবিধা হল না। ভাগ্নেকে দেখে একটু হাসলেন, কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। ওডিন জানতেন, মিমির কথা বলার চাইতে কথা না বলতেই বেশী পছন্দ করে।

"মামা! আপনার কুয়ো থেকে এক চুমুক জল খেতে চাই," ওডিন কোন ভনিতা না করেই বললেন।

মিমির দুপাশে মাথা নাড়লেন।

"কিন্তু আমি তো আপনার ভাগ্নে, তাই না? এটুকু আবদার আমি তো আপনার কাছে করতে পারি?"

"এই কুয়ো থেকে জল একমাত্র আমিই খেতে পারি, আর কেউ নয়," মিমির দৃঢ়কণ্ঠে বললেন।

ওডিন চাইলে জোর খাটাতে পারতেন। হাজার হোক তিনি দেবতাদের রাজা। তাঁর সেই ক্ষমতা ছিল। কিন্তু পরমুহূর্তে সেই চিন্তা ওডিন বাতিল করে দিলেন। জ্ঞান গায়ের জোরে অর্জন করাবার জিনিস নয়। সত্যিকারের জ্ঞান বিনম্রতা এবং আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই অর্জন করতে হয়।

হিন্দু পুরাণের একটা ঘটনা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। অস্বথমা, আচার্য দ্রোণের পুত্র, এবং তিনি জানতেন তাঁর এই পুত্র অস্বথমা ব্রহ্মাস্ত্র ধরণের, অর্থাৎ এই অস্ত্রের জ্ঞান লাভের যোগ্য নন। সেইজন্যেই পুত্র হলেও তিনি এই জ্ঞান অস্বথমা কে দিতে চাইছিলেন না, কিন্তু অস্বথমা দ্রোণের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেন, তিনি পুত্রের চাইতে তাঁর একজন শিষ্যকে বেশি পছন্দ করেন। সেইজন্যে ব্রহ্মাস্ত্রের জ্ঞান তাকে না দিয়ে, সেই শিষ্যকে দিয়েছেন। স্নেহবৎসল পিতা শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মাস্ত্রের জ্ঞান দিলেন পুত্র অস্বথমাকে। যোগ্যতার জোরে অর্জিত হয়নি যে জ্ঞান, অবধারিতভাবে সেই জ্ঞানের অপপ্রয়োগ হয়েছে, এবং অস্বথমা সেই কারণে ভয়ঙ্কর অভিশাপ কুড়িয়েছেন।

মহাভারতে ব্যাস কী বলেছেন ওডিনের সেট জানা থাকবার কথা নয়। কিন্তু জোর জবরদস্তি করতে চাইলেন না। মিমিরকে উদ্দেশ্যে করে বললেন, "দেখুন মামা! আমি এতটা পথ আপনার কুয়ো থেকে এক চুমুক জল খেতে এসেছি। এর জন্য আমাকে যদি কোন মূল্য পরিশোধ করতে হয়, আমি সেই মূল্য দিতে রাজী।"

"তোমার একটা চোখ আমাকে দিয়ে দিতে হবে। যদি তুমি তাতে রাজী থাক, আমিও তোমাকে এই কুয়ো থেকে এক চুমুক জল খেতে দিতে রাজি আছি," মিমির নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললেন।

মিমির সত্যিই তাঁর চোখ চাইছে না, ভাগ্নে বলে তাঁর সঙ্গে ঠাট্টা করছে -  এই ভাবনাটাও ওডিন মাথায় আসতে দিলেন না। মিমিরের পৃথিবীতে আসতে গিয়েই ওডিন জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন। জায়ান্টদের সঙ্গে দেবতাদের অনেক পুরোনো দিনের শত্রুতা। ভয়ঙ্কর শত্রুতা, বিশেষ করে ওডিন যাদের নেতৃত্ব দেন। সেই তুলনায় একটা চোখ তো কিছুই না। কুয়োর পারে একটা শামুকের খোল পড়ে ছিল। ওডিন সেই খোল দিয়ে তাঁর ডান চোখটা খুবলে বের করে মিমিরের হাতে তুলে দিলেন।

মিমির ওডিনের সেই চোখকে কুয়োর জলে ভাসিয়ে দিলেন। তারপর বিশেষ এক শিঙ্গায় ভরে, ওডিনকে কুয়োর জল খেতে দিলেন। কুয়োর জল ঠান্ডা। ওডিন এক চুমুকে পুরো জলটা পান করলেন। তাঁর শরীরে জ্ঞান আর প্রজ্ঞায় প্লাবিত হয়ে গেল। তাঁর মনে হল তিনি আগে এক চোখে যা দেখতে পেতেন তার চাইতে অনেক বেশী দেখতে পাচ্ছেন। ওডিন শারীরিকভাবে একটি চোখ হারালেও তিনি আরো বেশী চক্ষুষ্মান বা অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন  হয়ে উঠলেন।

মহাভারত অনুসারে হস্তিনাপুরের রাজা ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হলেও তাঁকে চক্ষুষ্মান বলা হত কারণ তার অন্তর্দৃষ্টি বা মানসিক জ্ঞান দৃষ্টিমানদের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। তিনি অন্ধ ছিলেন জন্মগতভাবে। দৃষ্টিহীনতার কারণে তিনি শারীরিকভাবে কিছু দেখতে না পারলেও তার মনের দৃষ্টি ছিল অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। তিনি এমন কিছু দেখতে পেতেন যা অন্যরা দেখতে পেত না।

নর্স পুরাণ অনুসারে মিমিরের কুয়োর জল পান করার মাধ্যমে ওডিন বিশ্বসংসারের গভীর সত্য রহস্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছিলেন। দেবতাদের রাজা এবং মানুষের স্রষ্টা হিসাবে সফল হবার জন্যে তাঁর এই বাড়তি জ্ঞানের প্রয়োজন ছিল। ফলে, দৃষ্টির বাইরের যে জ্ঞান, যেমন ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জ্ঞান, প্রকৃতির গভীর তাৎপর্য ইত্যাদিএসবের প্রতি তার উপলব্ধি বৃদ্ধি পায়। ওডিনের এই ত্যাগকে জ্ঞানের জন্য আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়, যেখানে শারীরিক ক্ষতি সত্ত্বেও তার মানসিক আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929