ইতিহাসের ফাঁকফোঁকর: পলাশীর যুদ্ধের পূর্বাপর এবং কিছু প্রশ্ন ।
Guitar K Kanungo
Jan. 30, 2025 | | views :45 | like:1 | share: 0 | comments :0
পলাশীর যুদ্ধ নিয়ে বাঙালীদের একটা আবেগের জায়গা আছে। বাঙালি নিজেদের একটা স্বাধীন জাতি হিসেবে দেখতে চায়। অনেক বাঙালি মনে করে, পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের ফলে বাংলা এবং পরবর্তীতে এক সময় গোটা ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের অধীনে চলে গিয়েছিল। যদি পলাশীর যুদ্ধ না হত, যদি মীর জাফর বিশ্বাসঘাতকতা না করতেন, যদি নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত না হতেন, তাহলে কি আমরা স্বাধীন থেকে যেতাম? আমাদের ইতিহাসটা হয়ত ভিন্নভাবে লেখা হত, আমরা ব্রিটিশদের বদলে হয়ত ফরাসীদের উপনিবেশে পরিণত হতাম।
মীর জাফর যে বেঈমানী করবেন, সেটা একরকম জানাই ছিল। এমনকি সেটা আলীবর্দি খাঁর সময়েই জানা গিয়েছিল। আলীবর্দী খান যে একজন ভালো প্রশাসক ছিলেন, এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু মীর জাফরের ক্ষেত্রে তিনি মস্ত বড় ভুল করেছিলেন। বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্ত যাবার পেছনে আলীবর্দী খানের ভূমিকাকেও অগ্রাহ্য করার কোনো উপায় নেই। নইলে ইতিহাসকে যথাযথভাবে জানা হয় না। আবার, একথাও ঠিক যে বাংলা এক সুলতানী আমল ছাড়া অন্য কোনো সময়ে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ছিল না, সেটাও আমাদের মেনে নিতে হবে, যথাযথ ইতিহাসচর্চার খাতিরেই।
পলাশীর যুদ্ধটা যখন ঘটে, তখন আলীবর্দী খান মারা গিয়েছিলেন। সেইজন্য আলীবর্দী খাঁর দায়টা কোথায়, সেটা বুঝবার আগে একটি গল্প বলে নেয়া দরকার। একজন নারী কর্মচারী ক্যাশ থেকে অর্থ সরানোর অভিযোগে বরখাস্ত হলেন। সেই কর্মচারী সত্যিই একজন দুঃখী মানুষ ছিলেন। তাঁর স্বামী ছিল না; অসুস্থ সন্তান নিয়ে তাঁর সংসার চালানোর জন্য তিনি দুই জায়গায় কাজ করতেন। প্রতিষ্ঠানের মালিক সেটা জানতেন, তবুও তিনি কোনো রকমের দয়া দেখালেন না। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন—এবারই যে এই কাজটা সে প্রথম করেছে, এটা তিনি বিশ্বাস করেন না। সেইজন্য ওই নারী কর্মচারীকে তিনি দ্বিতীয় কোনো সুযোগ দিতে রাজী ছিলেন না।
আলীবর্দী খাঁ এই ভুলটাই করেছিলেন। তিনি তখন নবাব, আর তাঁর অধীনে বেশ কিছু সংখ্যক মসনদার ছিলেন, যারা যুদ্ধ-বিগ্রহে সৈন্য সরবরাহ করতেন। আসলে তখনকার দিনে আজকের মতো নিয়মিত সেনাবাহিনী ছিল না; সৈন্যরা ভাড়াটে হিসেবেই কাজ করতো। যারা এই সৈন্যদের যোগান দিতেন, তাদের মসনদার বলা হত। একবার আলীবর্দী খাঁকে জানানো হয়, সৈন্য সংখ্যা নিয়ে এক ধরনের দুর্নীতি চলছে। যত জন সৈন্য সরবরাহ করা হয়েছে বলে কাগজে-কলমে দেখানো হচ্ছে, আসলে ততজন সৈন্য সরবরাহ করা হয়নি, কিন্তু অর্থ ছাড় করা হয়েছে বেশি সংখ্যক সৈন্য দেখিয়েই। এবং এই কাজটা অনেকদিন ধরেই চলছিল। এই দুর্নীতির পেছনে যিনি ছিলেন, তিনি আর কেউ নন—স্বয়ং মীরজাফর। এই অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার পরেও, আলীবর্দী খাঁ মীরজাফরের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। শুধু তাই নয়, পরে যখন সিরাজউদ্দৌলা বাংলার নবাব হন, তখনও মীরজাফর তাঁর সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন।
এবার ইংরেজদের প্রসঙ্গে আসা যাক । ইতিহাসে ক্যালকাটা ব্ল্যাকহোল বলে একটা ঘটনার কথা আছে। ১৭৫৬ সালের ২০শে জুন এই ঘটনাটি ঘটেছিল। ইংরেজদের ভাষ্য অনুযায়ী ১৪৬ জন কারাবন্দির মধ্যে ১২৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল শ্বাসকষ্ঠ এবং ক্লান্তিতে ভুগে। এই সংখ্যাটির কথা বলেছেন এই ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কর্মচারী জন হলওয়েল। ইংরেজ ঐতিহাসিকরা এবং অনেক ক্ষেত্রে অনেক সাধারণ ইংরেজরাও এই ঘটনাকে অনেক বড় করে দেখানোর চেষ্টা করে। ভারতীয়রা যে কতটা বর্বর এবং কেন এই বর্বর জাতিটাকে সভ্য করে তোলার দায়িত্ব তাদের নিতে হয়েছিল, সেই কারণটা যৌক্তিক করে তোলার ক্ষেত্রে এই ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়।
আসলেই কি এতজন ইংরেজ সেদিন মারা গিয়েছিল? এই প্রশ্নটি উঠেছে, যেহেতু এই হিসাবটা পাওয়া গেছে ওই ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একজনের কাছ থেকে, সেহেতু এখানে অতিরঞ্জনের একটা সম্ভাবনা রয়ে গেছে। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক বীরেন কিশোর গুপ্ত "সিরাজুদ্দউলা এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি" নামের একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ লিখেছেন। সেই গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন, এই সংখ্যাটি কোন অবস্থাতেই দশ থেকে পনেরো জনের বেশি নয়। অর্থাৎ জন হলওয়েল যে সংখ্যাটির কথা বলেছেন, সেটি আসল সংখ্যার চাইতে অন্তত দশ থেকে বারো গুণ বেশি।
কি ঘটেছিল সেদিন সেটা একটু এই ফাঁকে দেখে নেয়া যাক। নবাবের বাহিনীর সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ চলছিল তিন-চার দিন ধরে। শেষ পর্যন্ত সেই যুদ্ধে ইংরেজরা হেরে যায় এবং পরাজিত ইংরেজদের ফোর্ট উইলিয়ামের মধ্যেই আটকে রাখা হয়। এদিকে, কিছু ইংরেজ সৈন্য মদ খেয়ে মাতলামো করতে গিয়ে নবাবের সৈন্যদের সঙ্গে গন্ডগোল পাকানোর চেষ্টা করলে, যারা ঝামেলা করছিল তাদেরকে আলাদা করে রাখার আদেশ দেয়া হয় নবাবের তরফ থেকে।
এখানে একটা কথা বলে নেয়া দরকার, নবাবের তরফ থেকে যখন এই আদেশ দেয়া হয়, তখন নবাব সিরাজুদ্দৌলা কিন্তু ফোর্ট উইলিয়ামে ছিলেন না। তিনি কলকাতাতেই ছিলেন, তবে অন্যত্র অবস্থান করছিলেন। এটা ঠিক যে, নবাবের সৈন্যরা বিশেষ কয়েকজন (যারা মাতলামি করছিল) ইংরেজ সৈন্যের উপর আগে থেকেই খেপে ছিলেন। সেই কারণে তারা কয়েকজন সৈন্যকে ঠেসে ঠুসে একটি কক্ষে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, যদিও নবাব সিরাজউদ্দৌলা সেরকম কোনো আদেশ একেবারেই দেননি। ওই ঘটনায় কিছু ইংরেজ সৈন্য অবশ্যই মারা গিয়েছিল, কিন্তু সেই সংখ্যাটি কখনোই জন হলওয়েল যা বলেছেন, তা নয়।