বিবেকানন্দ ও একটি বিভ্রান্তির জবাবে
অভিষেক দে
Nov. 18, 2024 | | views :562 | like:0 | share: 0 | comments :0
বছরের পর বছর ধরে একটি মিথ্যেকে এমন ভাবে প্রচার করা হয়ে আসছে যেটাকে সত্য বলে ধরেই নিয়েছে আমজনতার একাংশ। মনোবিজ্ঞানে (Psychology) " Illusory Truth Effect " বলে একটা কথা আছে। এর মানে হচ্ছে একটি মিথ্যেকে ইচ্ছেকৃত ভাবে বারংবার বিকৃত করে জনগণের কাছে উপস্থাপন করলে জনগণ সেটাকেই সত্য বলে ধরে নেয়। এছাড়া অন্ধবিশ্বাসী, হুজুগ এবং গুজবপ্রিয় জনতা কোনওদিনই সত্যকে জানতে ভালো করে পড়াশোনা এবং পড়ে যাওয়া বিষয় নিয়ে আর দশজনের সাথে আলোচনা করে ঠিক ভুলটা বেছে নেন না।
গত ৭ই ফেব্রুয়ারি ২০২০ তে আনন্দবাজার পত্রিকার 'প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ এবং বিবেকানন্দ' শীর্ষক প্রবন্ধে উভয়ের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লেখক বিধান মুখোপাধ্যায় জাপানী কবি ওকাকুরার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ টেনে লিখেছেন, "ওকাকুরা রবীন্দ্রনাথের কাছে কিছু পরামর্শ চাইলে কবি রবীন্দ্রনাথ বলেন - ভারতকে যদি জানতে চান, বিবেকানন্দকে জানুন। " If you want to know India, study Vivekananda. There is in him everything positive, nothing negative'."১
তথ্যসূত্র হিসেবে বিধানবাবু স্বামী লোকেশ্বরানন্দ সম্পাদিত 'চিন্তানায়ক বিবেকানন্দ' গ্রন্থের উল্লেখ করেছিলেন। এইখানেই রহস্য।
“যদি ভারতবর্ষকে জানতে চাও তাহলে বিবেকানন্দকে...” দীর্ঘবছর যাবৎ এটি রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য বলে কোটেশনটির প্রচার চলেছে। যতদূর জানা যাচ্ছে, কবিগুরুর নামে এই বক্তব্যটি প্রথমবার প্রকাশ পায় উদ্বোধন পত্রিকার ৪৩তম বর্ষের ভাদ্র ১৩৪৮ সংখ্যায়, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ঠিক পরে। তাতে লেখা হয়েছিল, "রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ চরিতের জন্য রোমা রোলাঁ যখন উপাদান সংগ্রহ করিতেছিলেন, সেই সময় শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণ সংঘের এক সন্ন্যাসীকে তাঁর ওই উক্তির কথা জানিয়েছিলেন।" উদ্বোধন পত্রিকারই আশ্বিন ১৩৯৩ সংখ্যায় স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ তাঁর একটি প্রবন্ধের পাদটীকায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনাকালে লিখেছিলেন, "স্বামী অভয়ানন্দ বলেছেন, রোলাঁ নিজেই এই তথ্য একসময় স্বামী অশোকানন্দকে জানিয়েছিলেন।" স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ অবশ্য কোনও চিঠির উল্লেখ করেননি।
উদ্বোধন পত্রিকার আশ্বিন ১৩৯৫ সংখ্যায় 'রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে শ্রীরামকৃষ্ণ' শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। পত্রিকার ৫৮১ পৃষ্ঠার পাদটীকায় লেখক জানিয়েছেন, "শোনা যায় ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রোলাঁর যখন প্রথম দেখা হয়, কবি তখন ঐ ফরাসী মনীষীকে বলেছিলেন : 'If you want to know India, study Vivekananda. In him there is nothing negative', everything positive.' দুঃখের বিষয় রোলাঁর ডায়রিতে উক্ত সাক্ষাৎকারের যে বিবরণ আছে সেখানে রবীন্দ্রনাথের ঐ উক্তির কোনও উল্লেখ নেই। রোমা রোলাঁ অথবা রবীন্দ্রনাথ কারও কোনও প্রকাশিত রচনায় ঐ উক্তিটি পাওয়া যায় না। এর পর লেখক ভাদ্র ১৩৪৮ এবং আশ্বিন ১৩৯৩ সংখ্যার প্রবন্ধ দুটির উল্লেখ করেছেন এবং অত্যন্ত আপশোসের সঙ্গে জানিয়েছেন, "দেখা যাচ্ছে উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের নির্ভর করতে হয় শ্রুতি আর স্মৃতির উপর।"
ইতিমধ্যে প্রখ্যাত রবীন্দ্র গবেষক অমিতাভ চৌধুরী ১৯৬০ সালে প্রকাশিত তাঁর 'একত্রে রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থের অন্তর্গত 'কবি ও সন্ন্যাসী' প্রবন্ধের ৩২০ পৃষ্ঠায় আমাদের জানালেন, "জাপানী মনীষী ওকাকুরা এসেছিলেন ভারতবর্ষকে বুঝতে, ভারতবর্ষকে জানতে। তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করে তাঁর কাছে এই বিষয়ে পরামর্শ চাইলে রবীন্দ্রনাথ বলেন, 'ভারতবর্ষকে যদি জানতে চান, বিবেকানন্দকে জানুন' ; If you want to know India, study Vivekananda. There is in him everything positive, nothing negative." মজার বিষয়, এই উদ্ধৃতির কোনও তথ্যসূত্র কিন্ত অমিতাভ বাবু দেননি, এমনকি রোলাঁ যে কী করে পালটে ওকাকুরা হয়ে গেলেন, সে হদিসও তিনি আমাদের জানাননি। এটাই বড় রহস্যের।
আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত যে নিবন্ধটির উল্লেখ করেছিলাম, তাতে আমরা দেখেছি লেখক ওখানেও ওকাকুরার নাম দিয়েছেন। এবার মজার কথা হল, তথ্যসূত্র হিসেবে লেখক যে বইটির উল্লেখ করেছেন, অর্থাৎ স্বামী লোকেশ্বরানন্দ সম্পাদিত 'চিন্তানায়ক বিবেকানন্দ' বইয়ের বাংলা অনুবাদের ৯৭৪ পৃষ্ঠায় লেখা আছে "যদি তুমি ভারতকে জানতে চাও, বিবেকানন্দকে জানো। তাঁর মধ্যে সবকিছুই ইতিবাচক, নেতিবাচক কিছুই নেই।" এবং তথ্যসূত্র হিসেবে ৯৭৪-৯৭৫ পৃষ্ঠার ফুটনোটে উল্লিখিত আছে, "এই কথাগুলি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রোঁমা রোঁলাকে বলেছিলেন। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সন্ন্যাসী স্বামী অশোকানন্দকে লেখা একটি চিঠিতে রোঁমা রোঁলা এই তথ্যটি জানান। স্বামী অশোকানন্দের সূত্রে আমরা এই তথ্যটি জেনেছি।" জানিনা, আনন্দবাজার পত্রিকার উল্লিখিত প্রবন্ধের লেখক ওকাকুরার নাম কীভাবে পেলেন! মজার কথা হল, বিবেকানন্দ সম্পর্কে মিশনের সন্ন্যাসীরা এবং অসংখ্য বিবেকানন্দ বিশেষজ্ঞ রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্যটি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু স্বামী অশোকানন্দকে লেখা রোঁমা রোঁলার ওই বিশেষ চিঠিটি আজ পর্যন্ত কেউ ছেপেছেন বলে খবর পাওয়া যায়নি।
আরও একটি মজার কথা হল, ভারতের অভিজ্ঞতা নিয়ে রোঁমা রোঁলা একটি বই লিখেছিলেন। বইটির নাম 'ভারতবর্ষ দিনপঞ্জি : ১৯১৫-১৯৪৩'। অনুবাদক অবন্তীকুমার সান্যাল। প্রকাশকাল ১৯৬০। এরও ১৪ বছর আগে ১৯৪৬ সালে অমৃতবাজার পত্রিকায় সাংবাদিক থাকাকালীন সরোজ দত্ত অনুবাদ করেন রোমা রলাঁর পত্রপ্রবন্ধ 'I will not rest' এর। নাম দেন 'শিল্পীর নবজন্ম'। উভয় বইতেই কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ওই বহুচর্চিত বিশেষ মন্তব্যটি নেই। আমরা জানি, বিবেকানন্দের বেশ ভক্ত ছিলেন রোমা রোঁলা। ভারতবর্ষ দিনপঞ্জি বইটিতে রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দের প্রসঙ্গ বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। তাই অদ্ভুত লাগে রবীন্দ্রনাথের এত গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্তব্য তিনি লিখতে ভুলে গেলেন কেন? হাইলি সাসপিসাস।
দেখা যাচ্ছে, একই উক্তি রবীন্দ্রনাথের নামে চালানো হয়েছে অথচ পাত্র আলাদা। এমনটাও হতে পারে যে, রবীন্দ্রনাথ রোলাঁ ও ওকাকুরা দুজন বিদেশীকেই এই উপদেশ দিয়েছিলেন। ওকাকুরার ক্ষেত্রে পুরোটাই শ্রুতি হলেও রোলাঁর ক্ষেত্রে একটি তথাকথিত চিঠি বর্তমান। এখান থেকেই ভক্তির চশমাটা খুলে যদি আপনি যুক্তিসম্মত ইতিহাসচর্চা করতে বসেন তাহলে কি কয়েকটি প্রশ্ন উঠে আসা কি স্বাভাবিক নয়?
যেমন-
১- উদ্বোধন পত্রিকা ও চিন্তানায়ক বিবেকানন্দ বইতে রোলাঁর নাম অথচ কবি ও সন্ন্যাসী বইতে ওকাকুরার নাম কেন? অর্থাৎ দুই ঘরাণার লেখকরা সম্পূর্ণ বিপরীত তথ্য দিয়েছেন কেন?
২- রোলাঁ সত্যিই যদি অশোকানন্দকে কোনও চিঠি লিখে রাখেন তাহলে সেই গুরুত্বপূর্ণ চিঠিটি মিশন আজ অবধি প্রকাশ করেনি কেন?
৩- রবীন্দ্রনাথের জীবিতাবস্থায় মিশন কোনওদিন রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্যটি তাদের পত্রিকায় ছাপেনি কেন?
৪- রবীন্দ্রনাথ আসলে কাকে কথাটা বলেছিলেন অথবা আদৌ কী বলেছিলেন?
৫- এখানেই সন্দেহ জাগে যে, পুরোটাই কি অপপ্রচার মাত্র? বিবেকানন্দকে জাস্টিফাই করতে কি একজন রবীন্দ্রনাথের মতো বড়ো নামের প্রয়োজন পড়েছিল?
পরিশেষে জানাই, যে কোনও চরিত্র বিশ্লেষণের আগে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে - আমরা কেউই শ্রেণীবদ্ধতা ও কালবদ্ধতার উর্ধ্বে নই। সমস্ত দোষমুক্ত মানুষের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। প্রতিটি চরিত্রকে সামগ্রিক ভাবে বিচার করে দেখা প্রয়োজন তাঁদের দোষের পাল্লা ভারী, না গুণের। প্রিয় মুক্তমনা বন্ধুরা, রবীন্দ্রনাথের কোনও উক্তি ব্যবহার করার আগে সামান্য ভাববেন কিন্ত। যদিও এসব কারণে ওঁর মতন ব্যাক্তিত্বকে অসম্মান মোটেই জানানো উচিৎ নয়। কারণ আজ পর্যন্ত এমন প্রতিভাবান মানুষের কোনও সমকক্ষ কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
কবিগুরুই বলেছিলেন - "তাঁহারাই ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমান প্রকৃতির ধর্মসেতু নির্মাণ করিতেছিলেন। ভারতবর্ষ এখনই যে নিশ্চেষ্ট হইয়া আছে তাহা নহে— রামমোহন রায়, স্বামী দয়ানন্দ, কেশবচন্দ্র, রামকৃষ্ণ পরমহংস, বিবেকানন্দ, শিবনারায়ণ স্বামী ইঁহারাও অনৈক্যের মধ্যে এককে, ক্ষুদ্রতার মধ্যে ভূমাকে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য জীবনের সাধনাকে ভারতবর্ষের হস্তে সমর্পণ করিয়াছেন।" (এর সূত্র জানাবো না। আগ্রহী ব্যক্তিরা খুঁজে নেবেন)।
আবার দেখা যাচ্ছে, স্বামী বিবেকানন্দ ভগিনী নিবেদিতাকে বলেছিলেন - “মনে রেখো, ঐ পরিবারটি (ঠাকুর পরিবার) বাংলাকে যৌনতার বিষে প্লাবিত করেছে।“ সূত্র- ভগিনী নিবেদিতার পত্রাবলী, ১ম খন্ড, ১৯৬০:৮২ (ইং সংকলন)।
স্বামী বিবেকানন্দকে সত্যিই জানতে এবং বুঝতে চাইলে দশ খন্ডের বাণী ও রচনা, পত্রাবলি, স্বামীজিকে যেরুপ দেখিয়াছি, স্বামী শিষ্য সংবাদ, জ্ঞানযোগ, রাজযোগ, বিবেকানন্দ ও বাঙালির বিবেক,
সেকুলার বিবেকানন্দ, বিবেকানন্দ অন্য চোখে ইত্যাদি বইগুলো এবং কবিগুরুর ক্ষেত্রে বিশ্বভারতী হতে প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলী, স্বরবিতান, গীতবিতান, গীতাঞ্জলী ইত্যাদি বইগুলো বেশ ভালো ভাবে এবং পাতায় পাতায় নিজের যুক্তিবোধ দিয়ে পড়া খুবই প্রয়োজন যদি না আপনি অন্ধভক্তদের দলে পড়েন।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : শিবাশীস বসু, সুনীত দে, শমীন্দ্র ঘোষ, সপ্তর্ষি রায়।
সূত্র১- https://www.anandabazar.com/west-bengal/purulia-birbhum-bankura/friendship-between-rabindranath-tagore-and-swami-vivekananda-1.1105588