CIE ঈশ্বরচন্দ্র ‘বিদ্যাসাগর’ ঔপনিবেশিক শিক্ষার আদর্শ
স্বপন জানা
May 19, 2025 | | views :3 | like:0 | share: 0 | comments :0
(প্রথম পর্ব)
জনৈক চিকিৎসক বন্ধু বলছিলেন, আমার ডাক্তার হওয়ার পেছনে মূল কারণ যন্ত্রণাময় ও আভিজাত্যহীন কৃষক জীবন থেকে পালিয়ে আসা। ১৯৭০-৭২ সালে কৃষক জীবনের অনাহার, অভাব, অনটন, বঞ্চনা, অনিশ্চয়তা ইত্যাদি ছিল গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে আসার চালিকা শক্তি। যে ভাবে হোক চাকরি চাই! আরামের জীবন চাই! মা, বাবা, দাদু, আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী সবার আকাঙ্খা পূরণ করার তাড়না আমাকে পেয়ে বসেছিল। হঠাৎ ডাক্তারী তে সুযোগ পেয়ে গেলাম! আজও লেখাপড়া জানা যুবক-যুবতীরা চাকরির সন্ধানে শহরমুখী!
বন্ধুটি আরও বললেন, “লেখাপড়া শেখে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে” -বিদ্যাসাগরের লেখা পড়ে আমার আকাঙ্খার জন্ম হয়নি। সেদিনের সমাজিক ব্যবস্থাপনা থেকে এ শিক্ষা (কৃষক জীবন থেকে পলায়ন) আমার মস্তিষ্কে অন্তঃসলিলার মতো ঢুকে গিয়েছিল। পড়াশুনা আমাকে করতেই হবে।
কোন বিষয়ে নম্বর কম পেলে বাবা বলতেন “শালা পড়াশুনা করবে না, সারাজীবন লাঙ্গল ঠেলবে”। বাবার এই সাবধান বাণীতে সন্তানের প্রতি ভালোবাসা ছিল ঠিকই, সাথে ছিল কৃষক জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা, অশ্রদ্ধা ও এক প্রচ্ছন্ন ঘৃণা। এখান থেকেও আমি কৃষক জীবন থেকে পালিয়ে আসার রসদ নিয়েছি।
ডাক্তার হয়ে ওঠার প্রাক্কালে সবাই আমার নামের শেষে ‘বাবু’ শব্দ যোগ করে ডাকতেন। সুদিন বাবু! সেদিন এক ধরনের আনন্দ পেয়েছিলাম। আর আজ, লজ্জায় মাথা নত আসে। ‘ডাক্তারী বুদ্ধির’ খাবারটা আমাকে বাবু বলে ডাকা মানুষদেরই যোগানো। চিকিৎসক হিসেবে আমাদের কাছে ওই অন্নদাতা কৃষকরা ব্রাত্যই রয়ে গেলেন। আজও দেশে এমন ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হয়নি যেখানে অন্নদাতা কৃষকের চিকিৎসা ভালোভাবে দেওয়া যায়। সবার আগে দেওয়া যায়। আজও এই অন্নদাতা-বিরোধী সংস্কৃতির ধারা প্রবহমান!
‘সিআইই’ ‘বিদ্যাসাগর’ তাহলে কি করলেন?
ভারতবর্ষ কৃষক ও কারিগরের দেশ। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের যুগ তো বটেই, আজও তাই। বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণ পরিচয়’ বই খুঁজেও কৃষক, কামার, কুমোর ও তাঁতী, ঘরামী শব্দ গুলো আপনি পাবেন না।
(দ্বিতীয় পর্ব)
স্বাস্থ্য শিক্ষা উন্নয়ন (জন উদ্যোগের সমাহার গণ আন্দোলনের কন্ঠস্বর)। নবম বর্ষ। নববর্ষ সংখ্যা। বৈশাখ ১৪২৬। এপ্রিল ২০১৯ সংখ্যার, বিশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি তে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) সম্পর্কে লিখেছেন, “কেউ তাঁকে দেবতার উপরে স্থান দিয়েছেন,কেউ তাঁর মূর্তি ভেঙেছেন। কিন্তু নিরুত্তাপ একরোখা এই আটপৌর বাঙালি পন্ডিত সমগ্র জাতির উপর ছাতা মেলে দীর্ঘ আলপথ ধরে এগিয়ে চলেছেন।”
এতো ইন্দ্র মিত্র এর কথার প্রতিধ্বনি – “বিদ্যাসাগরের এই মানব বিদ্বেষ, মনে হয়, তাঁর অসামান্য মানব প্রেমেরই ফল।”
দুশো বছর পরে আজও আধা ঔপনিবেশিক ও আধা সামন্ততান্ত্রিক ভারতবর্ষে বিদ্যাসাগরের আদর্শ খণ্ডহর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে!
কি দাঁড়ালো তাহলে?
‘মূর্তিভাঙ্গার কাজ’ আর ‘দেবতা বানানোর কাজ’ এই দুয়ের মধ্যে কোনটা সমাজকে দিয়েছে গতি বা চালিকা শক্তি? মনে রাখতে হবে মূর্তি গড়ার কাজ আগে হয়েছে। পরে অন্যেরা মূর্তি ভেঙেছে। দুটোই কি সমাজের কাছে প্রগতিশীল? না। সমাজ বিজ্ঞানে তা অসম্ভব। সমাজকে কোনটা সামনের দিকে আর কোনটা পেছনের দিকে চালিত করেছে?
বিদ্যাসাগরের বসানো মূর্তি সমাজকে দিয়েছে বঞ্চনা, অপমান, অনাহার, মৃত্যু, বিনা চিকিৎসা, নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি। ভাঙার কাজ সমাজকে দিয়েছে গতি আর মুক্তির নিশানা।
যে শক্তিতে সমাজের উৎপাদন, নিরাপত্তা, সংস্কৃতি, মানবিকতা ইত্যাদির উন্নতি ঘটেছে, সেই শক্তি প্রগতিশীল। চলমান সমাজ যে চলমান প্রকৃতির মতোই গতিময়। তাকে থামানো মুশকিল! এটাই সমাজে চলমান শ্রেণী সংগ্রামের নিয়ম।
চলমান সমাজে রয়েছে দুই মনোভাব,দুই চেতনা, দুই চিন্তার, দুই কর্মের লড়াই। দেবতা বানিয়ে মূর্তি গড়ার কাজ যাঁরা করেছেন তাঁরা একটা পক্ষ আর সে মূর্তি ভেঙে ফেলার লড়াই যাঁরা করেছেন তাঁরা অন্য পক্ষ। সমাজে সত্যি-মিথ্যে,ন্যায় -অন্যায়, ঠিক-বেঠিক, জনদরদী- জনবিরোধী, শ্রদ্ধা-অশ্রদ্ধা, দেবতা-শয়তান, দেশপ্রেমিক-দেশদ্রোহী, প্রশ্নে বিদ্যাসাগর তাঁর সময়কালে জড়িয়ে ছিলেন। লড়াইয়ে অংশ নিয়ে ছিলেন।
একই সাথে বস্তু বা মানুষের দুটো গুণই থাকে। কিন্তু প্রধান গুণ দিয়ে মানুষটির চরিত্র নির্ধারিত বা বিচার হয়। বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম নেই। কোন দিকে থাকাটা জনগণের প্রয়োজন পূরণ করবে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ।
বিদ্যাসাগরের জন্ম ও কর্ম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে। ফলে যে কোন মানুষের ব্রিটিশ বিরোধী হওয়া হচ্ছে ন্যায় সঙ্গত কাজ। দেশমাতৃকার পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তি সেদিনের দেশপ্রেমের প্রধান কর্তব্য ও দাবী। অথচ ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা উন্নয়ন’ লিখছে,”---ব্রিটিশ রাজপুরুষদের কাছে তাঁর ভারতীয় হিসাবে আত্মসম্মান বোধ ও দৃঢ়তা প্রমাণিত”। আর রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “......তিনি (বিদ্যাসাগর-লেখক) যে সকল ইংরেজ প্রধান কর্মচারীদের সংস্রবে আসিয়াছিলেন, সকলেরই পরম শ্রদ্ধা ও প্রীতি-ভাজন হইয়াছিলেন”। ব্রিটিশ রাজশক্তির গুণগ্রাহী, নিজে আশীর্বাদ পুষ্ট আর দেশের মানুষের প্রতি ঘৃণার গরল ভান্ডার নিয়ে দুশো বছর পরেও অনেক বুদ্ধিজীবীর প্রাণের অনবদ্য রসদ!
ব্রিটিশ প্রেমের আর কি বাকি রইল? এরপর ব্রিটিশ বিরোধিতার জন্য ঈশ্বরচন্দ্রের ‘চটিকাহিনী’ খাপ খায় না। ইংরেজ শাসকের আশীর্বাদ লাভ না হলে ঈশ্বরচন্দ্র a Companion of the Indian Empire (CIE) in 1877। CIE উপাধি পান না।
(তৃতীয় পর্ব)
ভারতবর্ষ কৃষিপ্রধান দেশ। দুনিয়ার কৃষকরাই হচ্ছেন মানব সমাজের অন্নদাতা। ভারতের ব্যাপক কৃষকরা হচ্ছেন শিক্ষা বঞ্চিত। লেখাপড়া না জেনেই দেশের কোটি কোটি মানুষের খাবারের যোগানদার তাঁরা। তাঁরা আমাদের মহান অন্নদাতা।
কৃষকরাই (নারী ও পুরুষ) হচ্ছেন আদি অন্নস্রষ্টা, আদি বিজ্ঞানী, আদি চিকিৎসক, আদি শিল্পী ও কারিগর এবং আদি যোদ্ধা। মানব সমাজ কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চালক শক্তি।
ঈশ্বরচন্দ্রের কোন ভাবনা ও কাজ দেশের খাদ্য উৎপাদনের সাথে যুক্ত? কোন কাজ কৃষক তথা অন্নদাতাদের উৎসাহিত করে? ঈশ্বরচন্দ্রের কোন পদক্ষেপ মানুষের বস্ত্র ও বাসস্থান তৈরিতে সাহায্য করেছে?
খাদ্য উৎপাদনের দক্ষতার উপর নির্ভর করে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব। মানব জাতির ক্ষেত্রে তা গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের কৃষকরা কেবল দেশের অন্নদাতার কাজই করেন শুধু তাই নয়, শ্রেষ্ঠ কৃষি বিজ্ঞানী হিসেবে মানব সমাজে শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার।
এই কৃষকদের সম্পর্কে ঈশ্বরচন্দ্রের মূল্যায়ণ দেখুন! “বাল্যবিবাহের দোষ” নিরূপণে ঈশ্বরচন্দ্র লিখেছেন, ‘অন্যান্য জাতি অপেক্ষা অস্মদেশীয় লোকেরা যে শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্যে নিতান্ত দরিদ্র হইয়াছে, কারণ অন্বেষণ করিলে পরিশেষে বাল্য বিবাহই ইহার মুখ্য কারণ নির্ধারিত হইবেক সন্দেহ নাই’ (বিদ্যাসাগর রচনাবলী। দ্বিতীয় খণ্ড। পৃষ্ঠা: ০৩)। রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরকে সম্মান জানাতে গিয়ে তাঁর মনের কথা লিখেছেন, “এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল। কারণ তিনি সর্ব বিষয়ে ইহাদের বিপরীত ছিলেন” (রবীন্দ্রনাথ)। ঈশ্বরচন্দ্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তব্যের উদ্দেশ্য যাই হোক দেশের মানুষ সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের মনোভাবের এই রূপরেখা বা চিত্রায়ণ ভুল ছিল না।
কি দাঁড়ালো এর অর্থ? এত দেশের আপামর জনসাধারণকে অসম্মানিত করে ঈশ্বরচন্দ্রের গুণকীর্তন। যা দেশের অন্নদাতা কৃষক ও কারিগর সম্পর্কে ঈশ্বরচন্দ্রের হীন, অসম্মানকর মনোভাবের এ এক বিচিত্র বর্ণমালা!
যে দেশের তাঁত শিল্পীরা “সান্ধ্য শিশির” নামের মসলিন বুনতেন, তা কি তাঁদের যুগ যুগ ধরে আশ্চর্য্য দক্ষতা ও অপরিসীম মানসিক সামর্থ্যের ফসল নয়? যে কারিগরদের অপরিসীম মানসিক শ্রম ও যুগ যুগ ধরে অনুশীলনের চিহ্ন বয়ে নিয়ে চলেছে দক্ষিণের মন্দির থেকে উত্তরের তাজমহল! তাঁদের শ্রম, দক্ষতা ও শিল্পী মানসকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করানো কে দেশপ্রেম বলে না!
ঈশ্বরচন্দ্রের বর্ণপরিচয় বইতে চাষী, কৃষক,তাঁতী,কামার, কারিগর, কোদাল, কাস্তে, লাঙ্গল,মই, ইত্যাদি শব্দ গুলো নেই। “বোধদয়” এর শিক্ষামালা তো “ঔপনিবেশিক শিক্ষা আদর্শ” এর চর্চা ও প্রয়োগ। যা ব্রিটিশ রাজের স্থায়িত্বকাল বাড়িয়ে ছিল। দেশের মানুষের ব্রিটিশ বিরোধী যুদ্ধে ঈশ্বরচন্দ্র ব্রিটিশের পক্ষ নিয়ে ছিলেন
সৌজন্য: সোসাইটি ফর সোসাল ফার্মাকোলজি, পশ্চিমবঙ্গ।
৩০ জুলাই ২০১৯। কলকাতা।