ভাষা সাম্রাজ্যবাদ: বিজেপি ও বিবেকানন্দ
তন্ময়
Dec. 3, 2024 | | views :588 | like:0 | share: 0 | comments :0
"নানা ভাষা,নানা মত,নানা পরিধান
বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান।"
মাননীয় অতুল প্রসাদ সেন মহাশয়ের কালজয়ী গানের এই দুটি লাইনের বারতা আজ প্রশ্নের মুখোমুখি।
নানারকমের ভাষার সমন্বয় ও গুরুত্বের ধারণাকে নস্যাৎ করে সমগ্র বিশ্বের দরবারে দেশ ও জাতির পরিচয় তুলে ধরতে এক ভাষা নীতি প্রনয়ণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে আরএসএস, বিজেপি।
যেহেতু ১৯৫০ সালে দেবনগরী মুদ্রণে হিন্দিকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় তাই ২০১০ সালে গুজরাট হাইকোর্টে দায়ের হওয়া জনস্বার্থ মামলায় হিন্দিকে জাতীয় ভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার আবেদন সংবিধান অনুসারে বাতিল করে আদালত। আদালতের রায় অনুযায়ী হিন্দিকে সরকারি ভাষা বলা গেলেও জাতীয় ভাষা কোন ভাবেই বলা যায় না।
তবে আবার নতুন উদ্যমে শুরু হয়েছে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত।
“Hardline Hindu nationalist groups like the Vishwa Hindu Parishad and the Rashtriya Swayamsevak Sangha make no secret of their support for a homecoming campaign designed to return non Hindus to the fold. More than 80% Indians are Hindu,but Prabian Togadiya of the VHP says his organisation's goal is a country that is hundred percent Hindu.”
হিন্দুত্ববাদীরা মনে করেন ভারতকে একশো শতাংশ হিন্দুদের দেশ করতে হবে এবং তার সাথে একটি ভাষা গ্রহণ করতে হবে যা সারা ভারতে প্রতিটি মানুষের মধ্যে যোগসুত্র তৈরি করবে।
স্বামীজি বলিয়াছেন “এমন একটি মহান পবিত্র ভাষা গ্রহণ করিতে হইবে,অন্য সমুদয় ভাষা যাহার সন্ততি স্বরূপ। সংস্কৃতই সেই ভাষা। ইহাই ভাষা সমস্যার একমাত্র সমাধান।”
সংস্কৃত-এর পরিবর্তে হিন্দুত্ববাদীদের লক্ষ্য হিন্দি। কারণ হিন্দি হল গো বলয়ের জনগোষ্ঠীর মিশ্রিত মাতৃভাষা। সংস্কৃত ভারতে প্রচলিত হিন্দি সহ অনেক ভাষার মাতৃস্বরূপ। হিন্দির সাথে সংস্কৃত ভাষার উচ্চারণের বহু মিল বিদ্যমান। তাই বিবেকানন্দের চাহিদার সংস্কৃতের সাথে আরএসএস এর চাপানো হিন্দির খুব একটা পার্থক্য নেই। লক্ষ্য তো একই। এক জাতির এক ভাষা। তাছাড়া রাজনৈতিক জগত এবং সাংস্কৃতিক জগতে হিন্দির বিপুল প্রভাব।তাই ভাষা সমস্যার সমাধানে বিস্তর আলোচনার শেষে
সরকারি ভাষা কমিটির চেয়ারপার্সন অমিত শাহ দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন এখন সময় এসেছে গোটা দেশে একটি রাষ্ট্র ভাষা প্রচলন করা। সেই মহান পবিত্র ভাষা হল হিন্দি। তিনি মনে করেন সমগ্র দেশকে একসূত্রে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষমতা আছে হিন্দির মধ্যে। বহুদিন আগে থেকেই বিজেপি হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। ভাষা কমিটির চেয়ার পার্সন অমিত শাহ সেই দাবি মেনেই এক দেশ, এক জাতি এবং এক ভাষার পক্ষে সওয়াল করেন।
বিবেকানন্দ আক্ষেপ করে বলেছিলেন - “তোমরা সংস্কৃত ভাষায় পন্ডিত হও না কেন? তোমরা ভারতের সকল বর্ণের মধ্যে সংস্কৃত শিক্ষা বিস্তারের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করো না কেন? আমি তোমাদিগকে ইহাই জিজ্ঞাসা করতেছি। যখন এইগুলি করিবে তখনই তোমরা ব্রাহ্মণের তুল্য হইবে। ভারতে শক্তি লাভের ইহাই রহস্য।”
হিন্দির জনপ্রিয়তা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে এই ব্রাহ্মন্য শক্তি লাভের উদ্দেশ্যেই সম্প্রতি সরকারি ভাষা সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট সরকারি বিজ্ঞাপনের বাজেটের অর্ধেকের বেশি হিন্দি বিজ্ঞাপনে খরচ করার প্রস্তাব দিয়েছে। হিন্দি বিজ্ঞাপন বড় করে প্রথম পাতায় এবং ইংরেজি বিজ্ঞাপন ছোট করে ভেতরের বা শেষের পাতায় দেওয়ার কথাও বলা রয়েছে।
ভারতে সকল বর্ণের জন্য নবম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের হিন্দি ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক করতে চান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। জাতীয় শিক্ষানীতির প্রস্তাবিত খসড়ায় সেটারই উল্লেখ রয়েছে। সরকারি কাজকর্ম যাতে পুরোপুরিভাবে হিন্দি ভাষায় করা যায় তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের তোড়জোড় শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
ভারতবাসীর উদ্দেশ্যে স্বামীজী উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করেছেন – “ভারতে সংস্কৃত ভাষা ও মর্যাদা সমার্থক। সংস্কৃত ভাষায় জ্ঞান লাভ হইলে কেউই তোমার বিরুদ্ধে কিছু বলিতে সাহসী হইবে না। কারণ সংস্কৃত শিক্ষায়, সংস্কৃত শব্দগুলির উচ্চারণ মাত্রই জাতির মধ্যে একটা গৌরব, একটা শক্তির ভাব জাগিবে।”
সরকারি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে মোদিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে এখন সেই সময় এসেছে যখন আনুষ্ঠানিক ভাষাকে ভারতের ঐক্যের জন্য গুরুত্ব দিতে হবে। ভারতের নাগরিকরা নিজেদের মধ্যে শুধু হিন্দিতে কথা বলবে।
হিন্দি ভাষা হবে হিন্দু জাতির গৌরব, হিন্দি ভাষায় জ্ঞান লাভ হইলে মানুষ মধ্যে শক্তির ভাব জাগ্রত হবে। যে শক্তিকে মোকাবিলা করার সাহস পাবে না কেউই।
তাই আইন আসতে চলেছে হিন্দু রাষ্ট্রে হিন্দি ভাষা না শিখলে বঞ্চিত হতে হবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের যেকোনো চাকরিতে। এমনকি যে সকল অফিসার এবং কর্মী হিন্দিতে কাজ করতে অস্বীকার করবেন বা এড়িয়ে যাবেন তাদের পারফরম্যান্স রিপোর্টে লেগে যাবে কালো দাগ।
মন্ত্রকের এই রিপোর্ট গত সেপ্টেম্বর মাসেই পৌঁছে গেছে রাষ্ট্রপতির কাছে। ভারতীয়দের রাষ্ট্র ভাষা হিন্দি হবে। আপনি বাধ্য হবেন হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের কাছে মাথা নত করতে। নচেৎ লোটা-কম্বল গুটিয়ে চলে যেতে হতে হবে নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে। এরকমই ইঙ্গিত দিলেন উত্তরপ্রদেশের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির জোট সঙ্গী ভারতীয় শোষিত হামারা আম দলের প্রধান মৎস্য মন্ত্রী সঞ্জয় নিশাদ। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, “ভারতের সংবিধান বলে ভারত হল হিন্দুস্তান যার অর্থ হিন্দি ভাষাভাষীদের জায়গা। যার হিন্দি বলতে পারে না তাদের জন্য হিন্দুস্তানে জায়গা নেই তাদের উচিত এই দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়া।”
এক দেশ, এক জাতি, এক ভাষার মধ্যে নিহিত ফ্যাসিস্ট সংস্কৃতি। আমরা এই সংস্কৃতির বিরুদ্ধে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে সংগ্রাম জারি রাখব।