প্রার্থনা বা যাগযজ্ঞে কি ফললাভ হয়?

চিত্রদীপ সোম


Nov. 21, 2024 | | views :612 | like:2 | share: 2 | comments :0

প্রার্থনা বা যাগযজ্ঞ জাতীয় জিনিসগুলি বিশ্বজুড়ে প্রচলিত সমস্ত উপাসনা ধর্মগুলিরই একটি অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য। বলা যেতে পারে উপাসনা ধর্মগুলি টিকেই আছে যে সমস্ত বিষয়ের উপর ভিত্তি করে তার মধ্যে অন্যতম হলো এইসব প্রার্থনা। বিভিন্ন ধর্মের প্রার্থনা পদ্ধতি বিভিন্ন। অমিলও প্রচুর। তবে একটা বিষয়ে সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাসী মানুষই একমত, ঠিকমত প্রার্থনা করলে ফললাভ অবশ্যম্ভাবী। হাতে গোনা কয়েকটি ধর্ম বাদ দিলে প্রায় সমস্ত ধর্মেই ঈশ্বরের কথা বলা হয়েছে যাকে প্রার্থনায় তুষ্ট করতে পারলে তিনি মানুষের কামনা পূরণ করেন। যাগযজ্ঞ, মানত করা, ইত্যাদি এরই রকমফের।

কিন্তু ধর্মীয় প্রার্থনায় কি আদৌ ফললাভ হয়? বিশ্বাসীরা বলবেন অবশ্যই হয়। অবিশ্বাসীরা বলবেন ‘সব ঝুট’। এইসব তর্কের মীমাংসা হওয়া দুঃসাধ্য৷ তাই তর্কে না গিয়ে খোলামনে একটু দেখে নেওয়া যাক প্রার্থনায় আদৌ ফললাভ হয় কিনা।

সুরেশবাবু ব্যাংকের কর্মী৷ প্রথম সন্তান মেয়ে হবার বছর দুই পরে আবার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী মিনতিদেবী। সুরেশবাবুর একান্ত ইচ্ছা এবার একটি ছেলের মুখ দেখার। পাড়ার এক বয়স্কা মহিলার পরামর্শ মতো এক 'জাগ্রত' কালীর থানে মানত করলেন সুরেশবাবু পুত্রসন্তানের জন্য। এর কয়েকমাস পরেই স্ত্রীর প্রসববেদনা উঠলো। মিনতিদেবীর কোল আলো করে এলো এক ফুটফুটে পুত্রসন্তান। মায়ের কৃপায় বিগলিত সুরেশবাবু সেই সপ্তাহেই ছুটলেন মানত পূর্ণ করতে।

মাঝবয়সী বিজনবাবু ইদানীং খুব গ্যাস অম্বলে ভুগছেন। ওষুধ খেয়েও বিশেষ কিছু কাজ হচ্ছে না৷ অফিসের দত্তদার পরামর্শ অনুযায়ী হুগলীর এক বিখ্যাত ঠাকুরের চরণামৃত পরপর তিনদিন সকালে খালিপেটে খেলেন বিজনবাবু। আর তারপরেই ম্যাজিক। গ্যাস অম্বল যেন মন্ত্রবলে অনেকটাই কমে গেলো!  ঠাকুরের এহেন কৃপায় বিজনবাবু একটি ছবি বাঁধিয়ে রেখেছেন ঠাকুরঘরে।নিত্য এখন সেই ছবিতে ফুলমালা দেন তিনি।

প্রদীপ বছর ছাব্বিশের এক বেকার যুবক। অনেক চাকরির পরীক্ষায় বসেছে। কিন্তু বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি। বাড়ির লোক অনেকবার বলেছে ভালো দেখে একটা পুজো দিতে ঠাকুরের কাছে। কিন্তু যুবক প্রদীপ রক্তের জোরে সে সবকে এতদিন উপহাসই করে এসেছে। অবশেষে একদিন বাড়ির পীড়াপীড়িতে ঠাকুরের কাছে পুজো দিয়ে বুক পকেটে প্রসাদি ফুল বেলপাতানিয়ে চাকরির পরীক্ষায় বসলো প্রদীপ। আর এবারেই বাজিমাত! লিষ্ট বেরোতে দেখা গেলো জ্বলজ্বল করছে প্রদীপের নাম।

উপরের ঘটনাগুলির মতো ঘটনা অহরহ হয়ে চলেছে আমাদের চারপাশে। আর এগুলোকে হাতিয়ার করেই দৈব বিশ্বাসীরা প্রশ্ন তুলে দেন যুক্তিবাদীদের দিকে। প্রার্থনায় যদি ফললাভ নাই হবে তাহলে উপরের ঘটনাগুলির ব্যাখ্যা কি? আছে এসবের কোনো উত্তর অবিশ্বাসী নাস্তিকদের কাছে?

বিষয়টিকে ভালোভাবে বুঝতে উপরের ঘটনাগুলির কাটাছেঁড়ায় আসা যাক এবার। কিভাবে পূরণ হয়েছিলো উপরের প্রার্থনাগুলি? আসলে প্রার্থনায় সেইসব চাহিদাই পূরণ হয় যেগুলো এমনিতেও পূরণ হওয়া সম্ভবপর ছিলো। মাঝখান থেকে নাম হয় প্রার্থনার। 


আপনি যদি উপরের দিকে একটা কয়েন ছুঁড়ে প্রার্থনা করেন হেড পড়ার তাহলে প্রার্থনায় ফল লাভের সম্ভাবনা ৫০%। প্রার্থনা না করলেও হেড পড়ার চান্স ছিলো ওই ৫০%-ই

কিন্তু প্রার্থনা করায় নাম হয়েছে প্রার্থনার। কিন্তু আপনি যদি কয়েন ছুঁড়ে প্রার্থনা করেন হেড ও টেল উভয়ই একইসাথে পড়ার তাহলে আপনার প্রার্থনা পূরণ হবার সম্ভাবনা ০%, সে আপনি যতই ভক্তিভরে আপনার ঈশ্বরকে ডাকুন না কেন৷ কারণ বাস্তবত হেড ও টেল একইসাথে পড়া সম্ভব নয়৷ একইভাবে আপনি যদি ভারত পাকিস্তান খেলার সময় আপনার ভগবানকে ডাকেন আপনার দেশকে জেতানোর জন্য, যাগযজ্ঞ করেন এই উদ্দেশ্যে, তাহলেও আপনার প্রার্থনা পূরণ হবার সম্ভাবনা ৫০%। কিন্তু আপনি যদি প্রার্থনা করেন দুটো দেশই জেতার তাহলে আপনার প্রার্থনা পূরণ হবার সম্ভাবনা ০%।  কারণ দুটো দেশের একসাথে জেতা বাস্তবে সম্ভব নয়।

উপরের উদাহরণগুলিতেও তাই হয়েছে। সুরেশবাবু মানত না করলেও তার পুত্রসন্তান হতে পারত। মানত করায় নাম হয়েছে মানতের৷ বিজনবাবু একইসাথে চরণামৃতও খেয়েছেন আবার ওষুধও খেয়েছেন। রোগ সারায় নাম হয়েছে চরণামৃতের। শুধু বিজনবাবু নন, অধিকাংশ রোগীই এটা করেন। আধুনিক চিকিৎসা ও দৈব পদ্ধতি উভয়েরই সাহায্য গ্রহন করেন। রোগ সারলে নাম হয় দেবতার। আর না সারলে 'ডাক্তারের ব্যর্থতা'।  

আজ অবধি কোনো ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষকেই দেখিনি ঈশ্বরের ক্ষমতার উপর ভরসা করে চিকিৎসা না করিয়ে কেবল প্রার্থনা বা চরণামৃত বা মাদুলি তাবিজের ভরসায় পড়ে থাকতে। এটাই এদের ভন্ডামি।

অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওষুধ না খেয়ে কেবল চরণামৃত খেয়েও রোগ সারতে পারে। বিজ্ঞানসম্মত কারণও আছে তার। যে কোনো চিকিৎসক মাত্রেই জানেন আমাদের দেহের অনেক রোগই সারানো যায় কোনো ওষুধ ছাড়াই কেবল মনের বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে। যাকে placebo effect বলেন চিকিৎসকরা। আজকের আলোচনায় এনিয়ে বিস্তারিত কথা বলার অবকাশ নেই, পরে কোনোদিন সুযোগ হলে বলব। আপাতত শুধু এটুকু জেনে রাখুন কেবলমাত্র মনের বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়েই গ্যাস, অম্বল, হাঁপানি, নানা স্থানে ব্যাথা ইত্যাদি নানাপ্রকার রোগেরনিরাময় বা প্রশমণ সম্ভব৷ বহুক্ষেত্রে সাইকো-সোম্যাটিক রোগ(মন জনিত দেহের রোগ) সারাতে প্ল্যাসিবো এফেক্টের ব্যবহারও করেন ডাক্তারবাবুরা। আসলে চরণামৃতের ঔষধিগুন নয়, এক্ষেত্রে চরণামৃতের প্রতি রোগীর বিশ্বাসই তাকে সুস্থ হতে সাহায্য করেছে। প্রদীপের ঘটনাটির ব্যাখ্যাও একই। ফুল বেলপাতা ছাড়াও প্রদীপের সফল হবার সম্ভাবনা ছিলোই। কিন্তু সফল হওয়ায় নাম হয়েছে ঠাকুরের কৃপার।

তাহলে কিভাবে 'মিথ্যা' প্রমান করা যাবে প্রার্থনার শক্তিকে? খুব সোজা। এমন কিছু প্রার্থনা করুন যেগুলো এমনিতেই সফল হবার সম্ভাবনা 'শূন্য'। তাহলেই দেখবেন ঈশ্বর আর সাড়া দিচ্ছেন না প্রার্থনায়। তা সে যত 'জাগ্রত' দেবতাই হোক। যেমন আপনি আপনার মনোমত যে কোনো দেবতার কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করুন ভারত যেন আগামী অলিম্পিকে সবচেয়ে বেশী পদক লাভ করে। দেখবেন প্রার্থনায় আর কোনো ফল হচ্ছে না৷ ভারত পদকতালিকায় পড়ে থাকছে সবার শেষেই। কিম্বা প্রার্থনা করুন ভারত যেন আগামী দশ বছরের মধ্যে ফুটবলে বিশ্বকাপ জেতে। দেখবেন কালী বা আল্লা বা গড কোনো ঈশ্বরই আর প্রার্থনা পূরণ করছেন না৷ কিম্বা প্রার্থনা করুন আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে যেন ভারত থেকে সমস্ত দারিদ্র, অনাহার ও বেকারীত্ব দূর হয়ে যায়। এবারও দেখবেন কোনো ঈশ্বরই আর সাড়া দিচ্ছেন না আপনার প্রার্থনায়। কারণ এই দাবীগুলো বাস্তবে মেটা সম্ভব নয়। ওই হেড আর টেল একসাথে পড়ার মতই। আর তাই এখানে প্রার্থনার শক্তিও 'ফেল' করে যায়। এটাই বাস্তব।

অর্থাৎ এই আলোচনা থেকে প্রমাণিত প্রার্থনায় ফলে কেবল সেইসব দাবীগুলোই যেগুলো এমনিতেও ফলার সম্ভাবনা ছিলো। প্রার্থনার ভূমিকা তাই বাস্তবে শুন্য।

এরপরও যদি কেউ প্রার্থনার শক্তিনিয়ে কুতর্ক করতে আসেন তাহলে তার কাছে উদাত্ত আহ্বান থাকবে প্রার্থনার সাহায্যে আগামী দশ বছরের মধ্যে ভারতকে ফুটবলে বিশ্বকাপ জেতানোর বা প্রার্থনার সাহায্যে পাঁচ বছরের মধ্যে দেশ থেকে সমস্ত দারিদ্র, অনাহার, বেকারত্ব দূর করতে পারার। যদি পারেন, তাহলে যে কোনো কট্টর নাস্তিকও মেনে নেবে ধর্মীয় প্রার্থনায় সত্যিই ফললাভ হয়। আর যদি না পারেন তাহলে মেনে নিন প্রার্থনা কেবল মনের শান্তি বিশেষ। বাস্তব কোনো ফলপ্রদান সম্ভব নয়। কোনো ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ চাইলেই এই চ্যালেঞ্জ নিয়ে নাস্তিকদের মুখে ঝামা ঘষে দিতে পারেন। খোলা আহ্বান রইলো সমস্ত ঈশ্বরবিশ্বাসী, প্রার্থনার শক্তিতে বিশ্বাসী মানুষদের কাছে।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929