চোখ ঢেকে গান্ধারী দায়িত্ব এড়িয়েছেন মাত্র।
Guitar K Kanungo
April 2, 2025 | | views :170 | like:0 | share: 0 | comments :0
কুরুবংশ ধ্বংস হয়ে যাবার পেছনে সমস্ত দায় কৃষ্ণের— গান্ধারী এই মর্মে কৃষ্ণকে অভিশাপও দিয়েছেন, এবং কৃষ্ণ যে সেটা মাথা পেতে নিয়েছেন, সেটা কৃষ্ণের বদান্যতা। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে এই ধ্বংসের পেছনে এককভাবে কৃষ্ণ দায়ী— এরকম করে ভাবতে পারি না। কৌরবদের পতনের পেছনে দুর্যোধনের দায় তো ছিলই, দুর্যোধনের পিতা ধৃতরাষ্ট্র নিজেও অনেকটা দায়ী ছিলেন। সিংহাসন নিয়ে এই লড়াই অব্যাহতভাবে চলতে থাকার পেছনে পিতামহ ভীষ্মের অবদানও খুব একটা কম ছিল না। তিনি নিজে কখনো বিয়ে করবেন না— এরকম একটা উদ্ভট, অরাজক প্রতিজ্ঞা করে না বসলে, উত্তরকালে হস্তিনাপুরের সিংহাসন নিয়ে এই লড়াইয়ের সূচনাই হত না। এমনকি কাশী রাজকন্যা অম্বাকে নিয়ে তিনি যখন একটা ধর্মসংকটের মতো অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলেন, তখন পিতা শান্তনুকে দেওয়া প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে তিনি অম্বাকে বিয়ে করলে এই সংকটের সৃষ্টি হত না। একই রকম দায় গান্ধারীরও ছিল। আজকের আলোচনা সেই বিষয়ে।
অনেকেই মাতা গান্ধারীকে একজন সাধ্বী নারী হিসেবেই বর্ণনা করে থাকেন। স্বামী অন্ধ, দৃষ্টিহীন বলে তিনি স্বেচ্ছায় অন্ধত্বকে বরণ করে নিয়েছেন— এরকম একটা ধারণা মহাভারতের অনেক পাঠকের মধ্যেই আছে। অবশ্য অন্য একটা ধারণাও আছে। কেউ কেউ মনে করেন, গান্ধারী ঠিক স্বামীর অন্ধত্বের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্য নয়, বরং ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকেই সারাজীবন চোখের ওপর কালো পট্টি বেঁধে রেখেছিলেন। দ্বিতীয় ধারণাটাই অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে হয়, কারণ গান্ধারীকে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ধৃতরাষ্ট্রকে বিয়ের পক্ষে মত দিতে হয়েছিল। গান্ধারী বিদর্ভ রাজকন্যা রুক্মিণী নন; রুক্মিণী যেমন ভালোবেসে কৃষ্ণকে বিয়ে করেছিলেন, গান্ধারী সেটা করেননি। তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে আদৌ ভালোবাসতেন কিনা, এ নিয়ে সন্দেহ করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। বিশেষত হস্তিনাপুরের কারাগারে তাঁর পিতা-মাতার মৃত্যু যদি বিবেচনায় নেওয়া হয়, তাহলে এই সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়।
গান্ধারীর চোখে কালো পট্টি বাঁধার ব্যাপারটা যদি প্রতিবাদস্বরূপ হয়ে থাকে, তাহলে এর আরও একটা ব্যাখ্যা হতে পারে। এরকমও হতে পারে যে তিনি যেদিন হস্তিনাপুরে এসে পৌঁছেছিলেন, সেদিন থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলেন যে এই রাজ্যের ভালো-মন্দ কিছুতেই তিনি নিজেকে কোনোদিন জড়াবেন না। সেই প্রতিজ্ঞা তিনি রক্ষা করেছেন, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে— তিনি চোখ বন্ধ করে রেখেছিলেন বটে, কিন্তু কানে তো শুনতে পেতেন! চারিদিকে কী ঘটছে, সে খবর তাঁর কানে পৌঁছায়নি— এমন ভাবার তো কোনো কারণ নেই। যেদিন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ হলো, সেদিন রাজসভায় তিনি হয়তো ছিলেন না, কিন্তু এই ঘটনা যখন ঘটছে, তখন তো তিনি অন্তঃপুরে ছিলেন। ঘটনার খবর নিশ্চয়ই তাঁর কানে পৌঁছেছিল! কিন্তু তাঁকে তো এই ঘটনা বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা গেল না। অন্ধ হয়ে থাকলেই কি প্রলয় বন্ধ থাকে? না, এই ক্ষেত্রেও থাকেনি। অন্যদের মতো মাতা গান্ধারীও জানতেন— দ্রৌপদীর প্রতি দেখানো এই অসম্মান কুরুবংশ ধ্বংস হয়ে যাবার অন্যতম কারণ।
হতে পারে, পাণ্ডবদের পিতৃত্ব নিয়ে দুর্যোধনের সন্দেহ ছিল। সেই জন্যেই হস্তিনাপুরের সিংহাসনের ওপর পাণ্ডবদের দাবি সে কখনোই মেনে নিতে পারেনি। মুশকিল হচ্ছে, এইভাবে দেখলে তার পিতারও হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসার অধিকার নেই, কারণ তিনি মহারাজ শান্তনুর ঔরসজাত সন্তান ভীষ্মের বংশধারায় জন্মাননি। তিনি আসলে মহর্ষি ব্যাসদেবের পুত্র— হস্তিনাপুরের সঙ্গে যার সেই অর্থে কোনো সম্পর্কই নেই। তবুও দুর্যোধন পাণ্ডবদের দুচোখে দেখতে পারত না। এই নিয়ে প্রধানত দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমের সঙ্গে দুর্যোধনের একেবারে ছোটবেলা থেকেই প্রতিহিংসামূলক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। দুর্যোধন ছোটবেলাতেই ভীমকে একবার বিষ খাইয়ে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। শেষ পর্যন্ত ভীম বেঁচে যায়। ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া অত্যন্ত ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা— এবং রানী গান্ধারী নিশ্চয়ই এই ঘটনার কথা জানতে পেরেছিলেন। কিন্তু তিনি কি কখনো পুত্র দুর্যোধনকে ভৎসনা করেছিলেন? সেরকম কোনো খবর আমাদের মহর্ষির লেখায় পাওয়া যায় না। তাঁকে হত্যার এই চেষ্টার কথা ভীম ভুলে যায়নি এবং দুর্যোধনকে হত্যা করেই সে এই ঘটনার প্রতিশোধ নিয়েছিল।
ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ ছিলেন, পুত্র-স্নেহেও অন্ধ ছিলেন; তাঁর মধ্যে লোভও ছিল। শারীরিক বৈকল্যের কারণে তাঁর রাজা হওয়ার কথা ছিল না। ছোটভাই পান্ডুর হয়ে রাজ্য চালাচ্ছিলেন তিনি। বিধি অনুযায়ী পান্ডুর ছেলেদের তাদের পিতার রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তিনি সেটা করেননি। শুধু তাই নয়, তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর অবর্তমানে পুত্র দুর্যোধনই রাজা হোক। পান্ডুর পুত্রদের হস্তিনাপুর থেকে দূরে রাখার দুর্যোধনের সমস্ত চেষ্টাকে কখনো সরবে, কখনো নীরবে সমর্থন করেছেন। একই ছাদের নিচে থেকে তাঁর পুত্রদের সমস্ত অপকর্মের কথা ধৃতরাষ্ট্র যেমন জানতেন, তেমনি গান্ধারীও জানতেন। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ ছিলেন, কিন্তু গান্ধারী অন্ধ না হয়েও অন্ধের মতোই ছিলেন। ন্যায়ত যদি ধৃতরাষ্ট্র একজন দুষ্টু লোক হন, তবে একই অভিধা গান্ধারীরও পাওয়া উচিত। কিন্তু পাঠকেরা গান্ধারীকে একজন সাধ্বী নারী হিসেবেই দেখে এসেছে। মজার ব্যাপার হলো, গান্ধারীকে পুরোপুরি সাধ্বী বলা যায় না— সেই ইঙ্গিত কিছুটা বাসুদেব কৃষ্ণ দিয়েও রেখেছেন।
কীভাবে দিয়েছেন, সেই গল্পটা এখানে প্রাসঙ্গিক। গান্ধারী জানতেন, ভীম প্রতিজ্ঞা করেছিল উরু ভেঙেই দুর্যোধনকে হত্যা করবে, যেহেতু দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় দুর্যোধন দ্রৌপদীকে উরু দেখিয়ে অশ্লীল ইঙ্গিত করেছিল। দুর্যোধন যে অনুচিত কাজ করেছিল, তা জেনেও গান্ধারী ভীম যাতে এই কাজটা করতে না পারে, সেই জন্য সচেষ্ট হন। বলা হয়ে থাকে, তিনি যেহেতু স্বামীর সঙ্গে সহমর্মিতা দেখাতে গিয়ে পুরো বিবাহিত জীবন চোখে কালো পট্টি বেঁধে রেখেছিলেন, সেই জন্য তাঁর দৃষ্টিতে এক বিশেষ রকমের ক্ষমতা জন্মেছিল। তিনি দুর্যোধনকে সেই দৃষ্টি দিয়ে অবধ্য করে তুলতে চেয়েছিলেন। তাই একদিন দুর্যোধনকে পুরো নগ্ন হয়ে তাঁর কাছে আসতে বললেন। দুর্যোধন সেই মোতাবেক মায়ের সামনে হাজির হতে চলেছিলেন, কিন্তু পথে কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা। কৃষ্ণ বললেন, "মায়ের সামনে একেবারে দিগম্বর হয়ে যাওয়াটা কি তোমার জন্য শোভন? অন্তত শরীরের নিম্নাংশ ঢেকে রাখা উচিত।" দুর্যোধন তাই করলেন। গান্ধারীর দৃষ্টি দুর্যোধনের শরীরকে অবধ্য করতে পারল না, কারণ সে দুর্যোধনের শরীর পুরোপুরি অনাবৃত ছিল না। গান্ধারীর এই ব্যর্থতা নির্দেশ করে, তাঁর এই স্বেচ্ছা-অন্ধত্বকে সব সময় গৌরবজনক হিসেবে দেখার সুযোগ নেই।