বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর

পার্থ সারথি চন্দ্র


Nov. 25, 2024 | | views :293 | like:0 | share: 0 | comments :0

“আমি সমস্ত জীবন ধরে বিশ্বাস করেছি একমাত্র বিজ্ঞান আর শান্তির চেতনাই পারে সমস্ত অজ্ঞানতা আর যুদ্ধের বিভীষিকাকে দূর করতে। .. বিশ্বাস রাখুন এক দিন সমস্ত দেশই সম্মিলিত হবে যুদ্ধের বিরুদ্ধে, শান্তি সহযোগিতার পক্ষে আর সেই ভবিষ্যৎ হবে বর্বরদের নয়, শান্তিপ্রিয় মানবজাতির।”



কথাগুলো প্রখ্যাত বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের (Louis Pasteur)। তোমরা কি বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের নাম শুনেছ? তিনি একজন ফরাসি জীববিজ্ঞানী, রসায়নবিদ তথা অণুজীববিজ্ঞানী ও রসায়নবিদ যিনি পাস্তুরায়ন প্রক্রিয়ার আবিষ্কারক, জীবাণুতত্ত্বের প্রবক্তা ও আ্যনথ্রাক্স ও জলাতঙ্ক রোগের টিকা আবিষ্কারক হিসেবে ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন। তার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলো মানবজাতির ইতিহাসে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে এবং আজও রাখছে।

লুই পাস্তুর ১৮২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর ফ্রান্সের জুরা প্রদেশের দোল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বেড়ে ওঠেন আরবোয়া শহরে। তাঁর দরিদ্র পিতা বাবা জাঁ জোসেফ পাস্তুর সেখানকার একটি ট্যানারিতে কাজ করতেন। পাস্তুরের মায়ের নাম জা‍ঁ এটিয়েনেট রোকুই। পাস্তুর বাবা মায়ের তৃতীয় সন্তান ছিলেন।


শৈশবে গ্রামে বেড়ে ওঠা পাস্তুরকে যখন তাঁর পিতা প্যারিসের একটি স্কুলে লেখাপড়া করার জন্য ভর্তি করলেন, তখন কিছুতেই শহরের পরিবেশে তিনি স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। ১৮৩১ সালে পাস্তুরের প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়। ছাত্র হিসেবে অত্যন্ত সাধারণ মানের ছিলেন তিনি। পড়াশোনার থেকে আঁকা এবং মাছ ধরাতেই বেশি আগ্রহ ছিল তাঁর। স্কুল শিক্ষা শেষ করে পাস্তুর ১৮৩৯ সালে কলেজে খুব অল্প সময়েই নিজেকে মানিয়ে নিলেন। তাঁর মেধা অধ্যবসায় পরিশ্রম শিক্ষদের দৃষ্টি এড়াল না। স্কুল শিক্ষা শেষ করে পাস্তুর ১৮৩৯ সালে কলেজ রয়্যাল অব বিসানকোন (Collège Royal at Besançon)-এ দর্শন পড়তে ভর্তি হন এবং ১৮৪০ সালে সেখান থেকে স্নাতক হন।  মাত্র ১৮ বছর বয়সে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে নিজের কলেজেই শিক্ষকতায় যুক্ত হলেন, পাশাপাশি বিজ্ঞানে ডিগ্রি নেওয়ার জন্য পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকলেন। বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর মধ্যে পাস্তুরের প্রিয় বিষয় রসায়ন। চাকরির পাশাপাশি পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন নিয়ে গবেষণাও চালিয়ে যান। ১৮৪৭ সালে তিনি পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের দুটি থিসিস জমা দেন এবং একই বছর দুটি বিষয়েই ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। রসায়নের উচ্চতর শিক্ষায় মনপ্রাণ ঢেলে দিলেন। এরই মধ্যে পাস্তুরের বিজ্ঞানচর্চায় খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। স্ট্রাসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে রসায়নের অধ্যাপক পদ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানালে তিনি সানন্দে তা গ্রহণ করেন। সেখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টরের কন্যা মেরি লরেন্তের সঙ্গে পরিচয়। ২৯ মে ১৮৪৯ সালে তারা বিয়ে করেন। তাঁদের পাঁচ সন্তানের তিনজনই প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে টাইফয়েডে মারা যায়। এ ঘটনায় মুষড়ে না পড়ে, এর প্রতিকারে মনোনিবেশ করেন পাস্তুর।

স্ত্রী মেরি ছিলেন তাঁর যোগ্য সহচরী, সহমর্মী, সহকর্মী এবং সহধর্মীও বটে। ১৮৫৪ সালে লুই পাস্তুর 'লিলে বিশ্ববিদ্যালয়ে'র বিজ্ঞান বিভাগে ডিন এবং প্রধান অধ্যাপক নিযুক্ত হন। লিলে অঞ্চলে ছিল মদ তৈরির অসংখ্য কারখানা। দীর্ঘদিন উৎপাদিত মদ ভালো রাখতে না পারায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল মালিক এবং সরকার। পাস্তুর গবেষণা করে বের করলেন কী কারণে মদ নষ্ট হয়ে যায়। ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসের জন্য তিনি আবার গবেষণা করতে থাকেন। গবেষণায় সফল হলেন। 


আকৃতি 3 পাস্তুর ও মেরি

তিনি তাঁর গবেষণার মাধম্যে প্রমাণ করে দেখান অ্যালকোহল উৎপাদন ইস্টের পরিমানের উপর নির্ভর করে। তিনি এও প্রমাণ করেন মদের অম্লতার জন্য ব্যাক্টেরিয়াই দায়ী। তৎকালীন সময়ে ফ্রান্সের মদ ব্যবসা মদের অম্লতার কারনে প্রভূত আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হত। পাস্তুর মদের স্বাদ অপরিবর্তিত রেখে ব্যাক্টেরিয়া মুক্ত করার জন্য গবেষণা শুরু করে লক্ষ্য করেন উষ্ণ মদে ব্যাক্টেরিয়া টিকতে পারেনা অথচ মদের স্বাদ অপরিবর্তিত থাকে। পাস্তুর একই পদ্ধতি দুধের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করেন এবং সাফল্য পান। পাস্তুরের আবিষ্কৃত এই এই পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী এখন ব্যবহৃত হয় যা 'পাস্তুরায়ন' নামে বিখ্যাত।

পাস্তুর মদে ব্যক্টেরিয়ার উৎস নিয়ে গবেষণা শুরু করেন যখন তখন অনেকের ধারণা ছিল ব্যাক্টেরিয়া নির্জীব বস্তু থেকে নিজে থেকেই জন্ম নেয় যদিও এই মতের বিপক্ষেও অনেকে বিজ্ঞানী ছিলেন। পাস্তুর প্রথম পরীক্ষার মাধ্যমে দেখান, নির্জীব বস্তু থেকে ব্যাক্টেরিয়া বা কোন প্রাণ জন্ম নিতে পারে না। পাস্তুর তাঁর বিখ্যাত তত্ত্বের সাহায্যে প্রমাণ করেছিলেন জীবাণুমুক্ত নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে প্রাণ কখনোই নিজে থেকে সৃষ্টি হয়না।


পাস্তুরের পরীক্ষা স্বতঃজননবাদকে (Theory of spontaneous generation) ভুল প্রমাণ করেছে। স্বতঃজননতত্ত্বের দাবীদারদের সবাই বিশ্বাস করতেন জটিল জীব তার পূর্ণ অবয়বে নিজে নিজেই ‘সৃষ্টি’ হয়। যেমন, এরিস্টটল বিশ্বাস করতেন কিছু মাছ এবং পতংগের মত ছোট প্রানী স্বতঃস্ফুর্তভাবে উদ্ভূত হয় । ব্রিটিশ গবেষক আলেকজান্দার নীডহ্যাম (১১৫৭-১২১৭) বিশ্বাস করতেন ফার গাছ সমুদ্রের লবণাক্ত জলেতে ফেলে রাখলে তা থেকে রাজহাঁস জন্ম নেয়। জ্যান ব্যাপটিস্ট হেলমন্ট (১৫৮০-১৬৪৪) ভাবতেন ঘর্মাক্ত নোংরা অন্তর্বাস ঘরের কোনায় ফেলে রাখলে তা থেকে ইঁদুর আপনা আপনিই জন্ম নেয়। বিজ্ঞানী পুশে (১৮০০-১৮৭২) বিশ্বাস করতেন খড়ের নির্যাস থেকে ব্যাকটেরিয়া বা অণুজীব স্বতঃস্ফুর্তভাবেই জন্ম নেয়। পাস্তুরের গবেষণা মূলতঃ এই ধরনের ‘সৃষ্টিবাদী’ ধারণাকেই বাতিল করে দেয়। কিন্তু পাস্তুরের পরীক্ষা কিংবা জৈবজনির কোন সূত্রই বলে না যে, প্রাথমিক জীবন জড় পদার্থ থেকে তৈরি হতে পারবে না


ফ্রান্সে এক মহামারীতে রেশম পোকার উৎপাদন হ্রাস পেলে ফরাসি সরকার পাস্তুরকে রেশম শিল্পের এই সমস্যা সমাধানে আহ্বান জানায়। পাস্তুর লক্ষ্য করেন রেশম পোকার এই সমস্যা বংশগত এবং মায়ের থেকে পরবর্তী প্রজন্মে সংক্রামিত হয়। তিনি প্রস্তাব করেন কেবলমাত্র রোগ মুক্ত গুটি বাছাই করার মাধ্যমে একমাত্র রেশম শিল্পকে বাঁচানো সম্ভব।

পাস্তুর তাঁর বিখ্যাত জীবাণু তত্ত্বে (Germ Theory) প্রমাণ করে দেখান কিছু রোগের জন্য অণুজীব দায়ী, যারা জল ও বাতাসের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। তিনি তাঁর জীবাণু তত্ত্বে দেখান অণুজীব বৃহদাকার জীবকেও আক্রমণ করে রোগ সৃষ্টি করতে পারে।

পাস্তুরই প্রথম অ্যানথ্রাক্সের টিকা আবিষ্কার করেন। তিনি লক্ষ্য করেন একমাত্র গৃহপালিত পশুর দেহেই অ্যানথ্রাক্স ব্যাসিলি (Bacillus anthrasis)-র আক্রমণে অ্যানথ্রাক্স রোগ সৃষ্টি হয়।

অ্যানথ্রাক্সের টিকা আবিষ্কারের পর পাস্তুর অন্যান্য রোগের প্রতিরোধের জন্য গবেষণা শুরু করেন। তিনি জলাতঙ্ক রোগের ওপর গবেষণা করে দেখেন এই রোগের জীবাণু আক্রান্তের স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে এবং আক্রান্ত পশুর মেরুদণ্ডের নির্যাসের মাধ্যমে অন্য প্রাণীদেহে জলাতঙ্ক সৃষ্টি করা যায়। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে পাস্তুর রোগ প্রতিরোধে অক্ষম জলাতঙ্ক ভাইরাস সৃষ্টি করেন, যা জলাতঙ্কের টিকা হিসেবে ব্যবহার হয়। ১৮৮৫ সালে পাস্তুর প্রথম এক শিশু বালকের ওপর এই টিকা প্রয়োগ করেন। লুই পাস্তুর কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় দ্বারা আবিষ্কার করেন জলাতঙ্ক রোগের প্রতিষেধক। এই আবিষ্কার তাঁকে বিখ্যাত করে তোলে। ফরাসি অ্যাকাডেমির সভাপতি নির্বাচিত হলেন তিনি।


লুই পাস্তুর একজন রসায়নের অধ্যাপক হলেও আমৃত্যু কাজ করেছেন অণুজীব নিয়ে। কেমন করে এর উৎপত্তি, কীভাবে এর দ্বারা সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় সেসব নিয়ে। মানবদরদী মহান এই বিজ্ঞানীর কাজ আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার এক উজ্জ্বল নিদর্শন।

১৮৯২ সালের ২৭ ডিসেম্বর তাঁকে অভিনন্দন জানাতে প্যারিসে সমবেত হলেন দেশবিদেশের বিজ্ঞানীগণ। সম্মান, উপাধি, পুরস্কার, মানপত্র তাঁর চরিত্র বদলে দেয়নি। তিনি আগের মতোই নিরহঙ্কার, নিরলস, সাদামাটা রয়ে গেলেন। শেষ জীবনে বাইবেল পাঠ আর উপাসনার মধ্যে নিজেকে সমর্পণ করেন। এই বিখ্যাত বিজ্ঞান-সাধক, ১৮৯৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর চিরনিদ্রায় শায়িত হন। মৃত্যুর পর তাঁর দেহ প্যারিসের 'পাস্তুর ইনস্টিটিউটে' স্থানান্তরিত করা হয়। তাঁর মৃত্যুদিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতিবছর ২৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ব জুড়ে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস পালন করা হয়। 

এই মহান বিজ্ঞানীর জন্মদিবসে (২৭ ডিসেম্বর) আমার শ্রদ্ধার্ঘ‍্য।


তথ‍্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার :- পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীবনীশতক, বিশ্বের সেরা ১০১ বিজ্ঞানীর জীবনী, রোর মিডিয়া, কালের কণ্ঠ, সব বাংলায়, ইন্ডিয়া টুডে ডট ইন, ফ্রন্টিয়ারসীন ডট ওআরজিও, ব্রিটানিকা ডট কম ও উইকিপিডিয়া।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929