বিষধর সাপে কাটা রুগী ওঝার বাড়ি থেকে সুস্থ হয়ে ফেরে কীভাবে?
অদিতি প্রকৃতি কন্যা
May 20, 2025 | | views :3 | like:0 | share: 0 | comments :0
(প্রথমে বলি আমি ঠিক করে গুছিয়ে লিখতে পারি না তাই সহজ সরল ভাবে বলছি সবার বোঝার সুবিধার্থে! ভুল ত্রুটি হলে একদম ক্ষমা করবেন না! বলবেন আমি ঠিক করে নেবো যদি সঠিক প্রমান ও যুক্তি থাকে।)
আগে আমরা জেনে নিই মারণ মাত্রা বা লিথাল ডোজ কী? বিষের তীব্রতা মাপার মাপকাঠি হল median lethal dose বা LD50। এক্ষেত্রে যে সংখ্যক প্রাণীর উপর বিষ পরীক্ষা করা হচ্ছে, তাদের পপুলেশনের 50% প্রাণী মরতে কতটা বিষ প্রয়োজন তা হলো LD50! এই LD50 যে সাপের যত কম,তার বিষের তীব্রতাও তত বেশি!
প্রত্যেক সাপের লিথাল ডোজ বা বিষের মারণ মাত্রা আলাদা আলাদা হয়!।
এই LD50 মাপা হয় চাররকম প্রদ্ধতিতে:
1. Subcutaneous (SC): বিষ চামড়ার নিচের চর্বি যুক্ত অংশে প্রবেশ করিয়ে।
2. Intravenous (IV): বিষ সরাসরি শিরায় প্রবেশ করিয়ে।
3. Intramuscular (IM): বিষ কোন মাংস পেশী তে প্রবেশ করিয়ে।
4. Intraperitoneal (IP): বিষ পেটে (abdominal cavity) প্রবেশ করিয়ে।
এর মধ্যে সর্বাধিক পরীক্ষিত প্রদ্ধতি হলো Intravenous ও subcutaneous।
subcuteneous পদ্ধতিটি সব থেকে বেশি নির্ভরযোগ্য এবং এই পদ্ধতিতে মেপেই বিষের তীব্রতা সম্পর্কে সব থেকে বেশি তথ্য পাওয়া গেছে।
আমাদের চেনা 6-টি সাপের (subcuteneous বা SC পদ্ধতিতে) লিথাল ডোজ বা মারণবিষ হলো -
(1) কালাচ (common krait - 0.325mg/kg (SC)
(2) গোখরো (spectacled cobra) - 0.29mg/kg (SC)
(3) কেউটে (monocled cobra) - 0.47mg/kg (SC)
(4) চন্দ্রবোড়া (russell’s viper) - 0.75mg/kg (SC)
(5) শঙ্খচুড় (king cobra) - 1.5mg/kg (SC)
(6) শাঁখামুটি (banded krait)-3.6mg/kg (SC)
এবার জেনে নিই এক কামড়ে একটা সাপ গড়ে কতটা বিষ মানুষের শরীরে ঢালতে সক্ষম।
1. শঙ্খচুড় (King Cobra) = 350-500 mg
2. কেউটে(Monocled Cobra) = 263 mg
3. গোখরো (Spectacled cobra) = 170-250 mg
4. চন্দ্রবোড়া(Russell’s Viper) = 130-250 mg
5. শাঁখামুটি (Banded krait) =144 mg
6.কালাচ(Common krait) = 8-20 mg
অর্থাৎ এক কামড়েই অনেকটা বিষ শরীরে ঢুকিয়ে দিতে পারে যা একজনের বেশি বা কয়েকজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষকে মারার জন্য যথেষ্ট! তবে বিষধর সাপে কামড়ে ড্রাই বাইটের সম্ভাবনা প্রায় 50%।
কালাচ সাপের ড্রাই বাইটের সম্ভবনা খুবই কম তবে অধিকাংশ সাপ প্রায়ই dry bite বা শুকনো কামড় দেয়। সাপ অনেক সময়ই মারণ মাত্রার বিষ শরীরে ঢোকাতে ব্যর্থ হয় এবং অনেক সময় শুকনো কামড় দেয়। অর্থাৎ সাপ কামড় দেয় কিন্তু বিষ ঢালে না বা খুবই কম পরিমানে বিষ ঢালতে পারে যাতে অল্প যন্ত্রনা ও অল্প ফোলা ও অস্বস্তি ছাড়া কিছুই হয় না! এখানে একটা প্রশ্ন আপনার মাথায় ঘুরছে যে - সাপেরা ড্রাই বাইট করে কেন?
ওরা এটা করে কারণ ওদের বিষ শিকার করতে কাজে লাগে এবং খুব রেগে না গেলে অযথা বিষ খরচ করতে চায় না। এছাড়াও মানুষের রিফ্লেকশনের জন্য অনেক সময় ঠিক করে কামড়াতেই পারে না। যেমন পায়ে পেরেক বা কাঁটা ফুটে গেলেই সঙ্গে পা মাটি থেকে উঠে যায় ঠিক তেমনি সাপের কামড়ের ক্ষেত্রেও এমন হয়। এই ড্রাই বাইট বা শুকনো কামড় খাওয়া রুগী 24 ঘন্টা থেকে 3দিনের মধ্যেই বিনা চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে যায়! আর এখানেই ওঝা গুনীনরা কেরামতি দেখায়! মারণ মাত্রার বিষ শরীরের ঢুকলে বিনা চিকিৎসায় মানুষ মারা যাবে কিন্তু সাপের মারণমাত্রার বিষ মানুষের শরীরে না ঢুকলে মানুষ সাময়িক অসুস্থ হবে কিন্তু মরবে না।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওঝা গুনীনরা নির্বিষ ঘরচিতি, দাঁড়াস, হেলে সাপের কামড়ের রোগীকে গোখরো, কেউটে বা কালাচ কামড়েছে বলে দাবি করেন কারণ সাধারণ মানুষ সাপ চেনেই না। এই জন্যই গ্রামের দিকে এই ২০২২ সালে দাঁড়িয়েও ওঝাদের বিনাপুঁজির ব্যবসা রমরমিয়ে বাড়ছেই। নির্বিষ দাঁড়াস সাপের কামড় খাওয়া রোগী ওঝার কাছে গিয়ে জানলো যে তাকে কেউটে কামড়েছে এবং ওঝা তার প্রাণ বাঁচিয়েছে! ব্যাস সুস্থ হয়ে আরও হাজার মানুষের কাছে ওঝার গুণগান করতে থাকে। অথচ নির্বিষ সাপের কামড়ে কিছুই হয় না তা আমরা সবাই জানি।
বিষধর সাপে কামড়ে রোগীকে অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার মাধ্যমে কষ্ট দেওয়া হয় যতক্ষন না রোগী মারা যাচ্ছেন। আর নির্বিষ সাপে কামড়ের রোগী ও শুকনো কামড় বা ড্রাই বাইট এর রোগীকে বাঁচিয়ে ওঝা নাম কামায়। মানুষ ওঝাকে রক্ষাকর্তা ভাবতে শুরু করে।
ওঝারা সাপের কামড়ের রুগীকে বাঁচাতে বিভিন্ন কার্যকলাপ করে থাকেন সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি বলছি।
বিষ পাথর: আক্রান্ত স্থান কিছুটা চিরে বা টিপে কিছুটা রক্ত বের করে সেখানে বিষপাথর দিয়ে চেপে ধরে রাখেন। বিষ শুষে নেওয়া হয়ে গেলে পাথর আপনা আপনি পড়ে যাবে শরীর থেকে। সাধারণ মানুষের ধারণা বিষপাথর হল এমন এক পাথর যা সাপের বিষ শুষে নিতে পারে যা মূলত সাপুড়ে ও ওঝারাই সাধারণ মানুষের মাথায় ঢুকিয়েছে। এটি একটি উৎকৃষ্ট মানের ঢপের চপ। পৃথিবীতে কোনও পাথর নেই যা রক্ত থেকে বিষ শুষে নিতে পারে।
কড়ি চালান: বাংলা নাগনাগিনীর অনেক সিনেমায় দেখেছেন সাপে কাটা নায়ককে বাঁচাতে ওঝা কড়ি চালান দেয়। তারপর সেই চালান দেওয়া কড়ি সাপকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এসে আক্রান্ত স্থানে মুখ লাগিয়ে চুষে সব বিষ বার করে দেয় ও নায়ক বেঁচে যায়। শুধু সিনেমায় নয় সাপের ওঝারা এটা হামেশায় করে। নিয়মটা হলো- বাজার থেকে তিনটি কড়ি কিনে আনতে হবে তারপর মন্ত্র পাঠ করে ঐ কড়ি তিনটিকে একটি সিঁদুররের কৌটোয় রেখে ঢাকনা বন্ধ করে দিতে হবে। এবার ঐ কড়ি-সহ সিঁদুর কৌটো কোন জলাশয়ে নিক্ষেপ করতে হবে। এই রূপ করলে কিছুক্ষনেরর মধ্যেই সাপ এসে পড়বে এবং সাপের শরীরে তিন জায়গায় কড়ি আটকে থাকবে। সাপ এসে রোগীকে যেখানে দংশন করেছিলো সেখানে পুনরায় দংশন করবে এবং সমস্ত বিষ তুলে নেবে এবং সাপের শরীরে আটকে থাকা কড়ি আপনা আপনি খুলে যাবে।
আরেকভাবেও এই কড়ি চালান দেয় সেটা হচ্ছে একটি কাঁসার বাটি উল্টে তার তিনদিকে তিনটি কড়ি রেখে দেয়। তারপর ওঝা বিন বাজাতে শুরু করে সেই বিনের শব্দে কড়ি গুলি উড়ে গিয়ে সাপকে টানতে টানতে নিয়ে আসে তারপর ক্ষত স্থানে মুখ লাগিয়ে বিষ তুলে নেবে।
আদতে - দুটো পদ্ধতির কোনওটাতেই সাপ আসে না! জলাশয়ে নিক্ষেপ করা কড়ি কখনও সাপ নিয়ে আসতে পারে না ওঝাসহ আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবার অপেক্ষা করতে থাকে এই বুঝি সাপ এসে বিষ তুলে নেবে আর পরিবারের মানুষটা আগের মতো তরতাজা হয়ে উঠবে। কিন্তু হায়! তা কখনওই হয় না অপেক্ষা করতে করতে এক সময় রোগী মারা যায়। তখন ওঝা দুঃখী দুঃখী মুখ নিয়ে বলে সাপটিকে কেউ মেরে দিয়েছে তাই কড়ি সাপটাকে আনতে পারছে না। সাপটি যদি কেউ না মারতো তাহলে নিশ্চয়ই আসতো। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে বিন বাজানো সত্ত্বেও যখন কড়ি বাতাসে উড়তে পারে না বা সাপকে আনতে যেতে পারে না তখনও ওঝা বলে সাপটিকে কেউ নিশ্চয়ই মেরে দিয়েছে।
হাত চালান: হাতে একটি শিকড় নিয়ে রোগীর আক্রান্ত স্থান থেকে মাথা পর্যন্ত বোলাতে থাকে ও মনে মনে মন্ত্র পড়তে থাকে যতক্ষণ না রোগী মারা যাচ্ছে! রোগি মারা গেলে পরিষ্কার বলে দেন একে কাল সাপে সাপে কামড়েছে বা আর 5 মিনিট আগে আনলে বেঁচে যেতো বিষ মাথায় উঠে গেছিল তাই আর পারলাম না।
ঝাড়ফুঁক: নিমপাতা নিশিন্দা পাতা দিয়ে আঁটি করে রোগীকে ঝপাং ঝপাং করে ঝাড়ায় ও মাঝে মাঝে ফুঁ দেয় ও মন্ত্র বলতে থাকে। এই সময় রোগীকে জোর করে দুধ খাওয়ায় ওঝারা কিন্তু এতে রোগীর কষ্ট আরও বেড়ে যায়। রোগী মারা গেলে সেই এক ডায়লগ দেয়, কাল সাপে কেটেছিল, সাপ মেরে দিয়েছে! আরেকটু তাড়াতাড়ি এলে বাঁচাতে পারতাম আরও বিভিন্ন কথা বলে।
চর থাপ্পড় দিয়ে বিষ নামানো: ওঝারা এটা প্রায়ই করে থাকে। যে ব্যক্তি ওঝাকে প্ৰথম খবর দেয় যে অমুক লোককে সাপে কামড়েছে বা বিছে কামড়েছে, তখন ওঝা মন্ত্র তিনবার পাঠ করে পাঁচবার ফুঁ দিয়ে রোগী অথবা ওই খবর আনার ব্যক্তির কাঁধে বা গালে দুম দুম, ঠাস ঠাস করে তিন বার মারে তাতে কাজ না হলে আরও অনেক প্রদ্ধতি অবলম্বন করা হয় যতক্ষন না রোগী মারা যাচ্ছেন। রোগী মারা গেলে সেই এক ডায়লগ দিয়ে ল্যাঠা চুকিয়ে দেবে!
এখানে সমস্যা হলো অনেক ওঝা এই ধাপ্পাবাজি বা কেরামতি দেখিয়ে বহু টাকা আয় করে। এবং কিছু ওঝা আছে তারা আসলে এই ধাপ্পাবাজিটা জানে না। মানে হলো তারা এটাই জানে যে মন্ত্রে কাজ হয়। গুরুর কাজ থেকে শিখেছে বিনা পয়সায় রোগী বাঁচাতে চান কিন্তু তিনি অনিচ্ছাকৃত ভাবে মানুষের প্রাণ নিয়ে যেভাবে খেলছেন তিনি বুঝতেই পারেন না! অনেকটা আপনার মতো মানে, কার্বলিক অ্যাসিডে সাপ তাড়ানো যায় না এটা পরীক্ষিত কিন্তু আপনি শুনেছেন বা ছোটো বেলার কোনও বইতে হয়তো পড়েছেন যে কার্বলিক অ্যাসিড বাড়িতে রাখলে সাপ আসে না। এইবার আপনি এখনও বিশ্বাস করেন যে কার্বলিক অ্যাসিডে সাপ তাড়ানো যায় তাই বাড়িতে একটি ছোট শিশিতে কার্বলিক অ্যাসিড রেখে দিয়েছেন। কার্বলিক অ্যাসিডে সাপ তাড়ানো যায় এই বিশ্বাসে সাপের কিছু আসে যায় না। খাবারের খোঁজে আপনার বাড়িতে সাপ ঢুকবেই তাতে আপনি কার্বলিক অ্যাসিড দিন আর না দিন। ঠিক তেমনই কোনও ওঝা যদি বিশ্বাস করেন বা দাবি করেন তার গুরুর দেওয়া শিক্ষা বা মন্ত্র কোনও সাপে কামড়ের রুগীকে বাঁচাতে পারেন তাহলে বিষের কিছু আসে যায় না। মারণবিষ শরীরে ঢুকলেই মানুষ মরবেই আর শুকনো কামড় হলে ওঝার কাছে যান আর না যান রোগী আপনা আপনি ঠিক হয়ে যাবে!
এই বার প্রশ্ন করবেন কী করে বুঝবেন যে ড্রাই বাইট হয়েছে? ড্রাই বাইট হয়েছে কিনা বুঝতে অনেকটা সময় লাগে মানে ড্রাই বাইট হয়েছে শিওর হতে এতো সময় লাগে তাতে ভেনমাস বাইটের চিকিৎসা শুরু করা দেরি হয়ে যাবে সাপের কামড়ে সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাই ড্রাই বাইট না ভেনোমাস বাইট সেটা বোঝার জন্য সময় নষ্ট করা একদম যাবে না। তাহলেই বিপদ! যতদ্রুত পারেন হাসপাতালে নিয়ে যান। গ্রামের দিকে এম্বুলেন্স পরিষেবা ঠিকঠাক পাওয়া যায় না। তাই বাইকের মাঝখানে রোগীকে বসিয়ে পিছন থেকে একজন রোগীকে ধরে বসবেন ও একজন বাইক চালাবেন। রোগীর সাথে কথা বলে তাকে আস্বস্ত করবেন। যেতে যেতে রোগীকে অবজার্ভ করবেন কী কী বলছে বা কী কষ্ট হচ্ছে সেটা ডাক্তার বাবুকে জানবেন। টাইট করে কিছু দিয়ে বাঁধবেন না। যদি হাতে কামড়ায় তাহলে বালা, আংটি তাগা, চুড়ি খুলে রাখবেন। ঘরোয়া টোটকা করবেন না, মুখ দিয়ে বিষ চুষে বার করতে যাবেন না,আক্রান্ত স্থান হাত দিয়ে ডোলবেন না, আক্রান্ত স্থান কাটবেন না বা আগুনের ছ্যাঁকা দেবেন না। মনে রাখবেন সাপের কামড়ে সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ! কাছাকাছি যেকোনও সরকারি হাসপাতালে বা সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র (যেখানে রাত্রে রোগী থাকে) পৌঁছান। কামড়ানোর 100 মিনিটের মধ্যে চিকিৎসা শুরু হলে রোগীকে সুস্থ হয়ে যায়। সবাইকে জানাতে ছড়িয়ে দিন অন্তত মুখে মুখে মানুষকে কুসংস্কার মুক্ত করুন। সাপের কামড়ে মৃত্যু মিছিল থামান। কোথাও ওঝার কেরামতি দেখলে থানায় খবর দিন। রোগীকে ওঝার থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান।
পুনশ্চ: পাঠকদের ধন্যবাদ জানাই
তথ্যসূত্র: LD50 - https://en.m.wikipedia.org/wiki/List_of_dangerous_snakes
ধন্যবাদ- পিন্টু হালদার
ছবি - ইন্টারনেট
ভিডিও- News18 ও বাংলাদেশ রেসকিউ টিম