সেদিনটা ছিল ২১ শে ফেব্রুয়ারী ২০২৩। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। হোয়াটস এপ্প - এ বার্তা পাঠালাম আজকের যুক্তিবাদী সমিতির এক অন্যতম কর্মকর্তা সন্তোষ শর্মাকে। “প্রবীরদা কেমন আছেন এখন? ওনার সঙ্গে দেখা করা যেতে পারে?” বিকেল ৩ তে বেজে ৪৫ মিনিটে বার্তাটা দেখেই ফোন করলো সন্তোষ। আমাকে জানালো প্রবীরদার শরীরের অবস্থা ভালো নয়,তবু আমি যদি ওনাকে মতিঝিলের ফ্ল্যাটে দেখতে যাই,কোনও অসুবিধা হবে না। না,আমার আর যাওয়া হয়নি। এই আফসোস আমার সারা জীবন থেকে যাবে। প্রবীরদার ৭২/৮ দেবীনিবাস রোডের ফ্ল্যাটে শেষবারের মতন গেছি; সস্ত্রীক,২০০৫ সালে। প্রবীরদার সঙ্গে পরিচয় ১৯৮৭ সালে। আমার কলেজের এক দাদা (বিশিষ্ট ম্যাজিসিয়ান তন্ময় অধিকারী) আমাকে প্রথম প্রবীরদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। প্রথম দর্শনেই ওনার ‘দর্শন’ আমার ভালো লেগে গিয়েছিল। যুক্তিবাদী দর্শন, শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার দর্শন। সেই স্বপ্ন বুকে নিয়ে আমিও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম যুক্তিবাদী আন্দোলনে। দেবীনিবাস রোড, শশিভূষণ দে স্ট্রিট, ক্রিক রো প্রভৃতি স্থানের বিভিন্ন সময়ের আড্ডায় নিয়মিত অংশ নিতাম আমি। যুক্তিবাদীদের আড্ডা,আমার কাছে এক অত্যন্ত আকর্ষণীয় বিষয় ছিল। প্রবীরদার কাছ থেকেই সংবাদপত্রে চিঠিপত্র লেখার হাতেখড়ি আমার। একসময় যুক্তিবাদী আন্দোলন, যুক্তিবাদী সমিতির কর্মপদ্ধতি নিয়ে বহু চিঠি, প্রবন্ধ লিখেছি আমি বাংলা সংবাদপত্রের পাতায়। প্রবীরদা প্রত্যেকটি লেখা মন দিয়ে পড়তেন এবং উৎসাহ যোগাতেন। আশির দশকের শেষাশেষি এবং নব্বইয়ের দশকে যুক্তিবাদী আন্দোলন এক বিশেষ মাত্রা পেয়েছিল। যুক্তির ঢেউ আছড়ে পড়েছিল বাংলার শহর থেকে গ্রামে,ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে।
সেই সময় বাংলার বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের এক বড়ো অংশ যুক্তিবাদী সমিতির ডাকে সাড়া দিয়ে, প্রবীর ঘোষের হাত শক্ত করতে এগিয়ে এসেছিলেন। ড:আবিরলাল মুখোপাধ্যায়, ড: বিষ্ণু মুখোপাধ্যায়, ড: শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় (অভিনেতা), ড: পবিত্র সরকার, ড: বিরল মল্লিক, বিক্রমণ নায়ার (সাংবাদিক), আজিজুল হক (রাজনীতিক), নারায়ণ সান্যাল (লেখক), পাঁচু রায় (বিজ্ঞানী), কৃষ্ণা বসু (কবি) প্রমুখ। গুণীজনদের এই নামের তালিকা লিখে শেষ করা যাবে না। প্রবীরদা একজন বড়ো নেতা, একজন দক্ষ সংগঠক এবং অসম সাহসী মানুষ। এই তিনটি গুণ-ই ওনাকে সমাজচালকের আসনে বসিয়েছিল। সম্মুখে দাঁড়িয়ে কিভাবে একটি দলকে নেতৃত্ব দিতে হয়, তা তিনি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। সমাজপরিবর্তনের যে কোনও আন্দোলনই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, যেকোনও মুহূর্তেই অঘটন ঘটে যেতে পারে। যুক্তিবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও হয়েছিল তাই। সমিতির মধ্যে থেকে সমিতিকে পিছন থেকে ছুরি মারার উদ্যোগ চলছিল। যুক্তিবাদী সমিতির জনপ্রিয়তা যতই বাড়ছিল, সেই সঙ্গে গুণোত্তর প্রগতিতে বাড়ছিল শত্রুর সংখ্যা। জ্যোতিষী, ভন্ড গুরুবাবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করাটা যত না শক্ত, তার থেকে বেশি কঠিন মেকি যুক্তিবাদীদের সঙ্গে লড়াই করা। ষড়যন্ত্র করে যুক্তিবাদী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদককে-ই সমিতি থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল। সমিতির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলতাম, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি এই বিরাট ষড়যন্ত্রের কথা। পরের দিন সকালের সংবাদপত্র দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছিলাম প্রবীরদার বাড়ির ল্যান্ড লাইন- এ। ফোন ধরেছিলেন সীমা বৌদি। আজ-ও স্পষ্ট মনে আছে, বৌদি ফোন ধরে হতাশামিশ্রিত ক্ষোভের সঙ্গে বলে উঠেছিলেন, কী হলো কিছুই বুঝতে পারছিনা। বুঝতে আমিও পারিনি তখন, যে, এটা একটা ষড়যন্ত্র। কারণ যাঁরা তখন সমিতির সম্পাদকমণ্ডলী, তথা পরিচালকমণ্ডলীতে ছিলেন, তাঁরা সকলেই আমার খুব ঘনিষ্ঠ। যাইহোক, বিতর্ক থেকে দূরে থাকতে কিছুদিনের জন্য সমিতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলাম।
জানতাম, প্রবীরদা একদিন সসম্মানে ফিরে আসবেন। প্রবীরদা কিভাবে স্বমহিমায় ফিরে এসেছিলেন, এ’তো সকলেরই জানা। ষড়যন্ত্রকারীদের অপযুক্তি ধোপে টিকলো না, নিজেদের পায়ে কুড়ুল মেরে আজ তাঁরা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। মনে পড়ে একদিনের কথা, রবিবারের সকাল, প্রবীরদার সঙ্গে গেলাম বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক ড: পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সল্টলেকের বাড়িতে। প্রবীরদা ওনার লেখা ‘বিশ্ব ক্যুইজ’ -এর একটি কপি সম্মানস্বরূপ দিলেন পার্থবাবুকে। প্রবীরদার সঙ্গে অনেক জ্যোতিষীর ভান্ডাফোঁড় করতে অনেক জায়গাতেই গিয়েছি, যে অভিজ্ঞতা জীবনে ভোলার নয়। বালক ব্রহ্মচারীর ‘নির্বিকল্প সমাধি’ নামক বুজরুকির ভান্ডাফোর করতে, যুক্তিবাদী সমিতির প্রতিনিধি করে সুখচর আশ্রমে আমাকে পাঠিয়েছিলেন প্রবীরদা। এটা সমিতির তৎকালীন নেতৃবৃন্দের কারো কারো পছন্দ হয়নি। কিন্তু আমার উপর উনি ভরসা করেছিলেন।
সুখচর সম্মিলনী ক্লাবের সামনে প্রবীরদার নেতৃত্বে এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছিল ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি। এই প্রতিবাদসভার তীব্রতা জনমানসে বিশাল প্রভাব ফেলেছিল। কিছুদিনের মধ্যেই তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে বালক কিস্সার পরিসমাপ্তি ঘটে। যুক্তিবাদীদের এক বড়ো জয় হয়েছিল সেদিন। আমার অভিজ্ঞতার কথা প্রকাশিত হয়েছিল ‘যুক্তিবাদী’ পত্রিকায়, পরে প্রবীরদার উদ্যোগে আমার লেখাটি একটি প্রবন্ধ সংকলনেও স্থান পায় (দে’জ পাবলিশিং)। আজ এই মুহূর্তে প্রবীরদা সম্পর্কে বহু কথাই মনে পড়ছে। ভাবছি কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি। কলকাতা বইমেলায় তাঁর জীবনমুখী ভূমিকা দেখেছি। সাধারণ মানুষকে লিটল ম্যাগাজিনের ছোট্ট একটা স্টলে কিভাবে আকর্ষণ করে নিয়ে আসতে হয়, তা প্রবীরদার থেকে আর কেউ ভালো জানেন বলে মনে হয় না। বইমেলায় যুক্তিবাদী সমিতি ছিল অনেকের কাছেই এক পরম আকর্ষণের বস্তু। আর যুক্তিবাদী সমিতির কাছে প্রবীরদা ছিলেন এক অভিভাবক, যাঁকে কেন্দ্র করে সারা দেশে যুক্তিবাদী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল। আমি ব্যাক্তিগতভাবেও ওনার কাছে অনেকভাবে উপকৃত হয়েছি। অনেক ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধান অক্লেশে করে দিয়েছেন উনি। আজ ভারাক্রান্ত মনে সেই দিনগুলোর কথা বার বার মনে পড়ছে। প্রবীর ঘোষরা নেতৃত্ব দিতেই জন্মান, আবার যাবার সময় নেতৃত্ব তৈরী করে দিতেও জানেন। এক প্রবীর চলে গেছেন;আক্ষরিক অর্থেই। কিন্তু অনেক প্রবীর তৈরী করে দিয়ে গেছেন তিনি। তাঁর যুক্তিপূর্ণ চোখ দিয়ে এই সমাজ আলো দেখবে, তাঁর দান করা অমূল্য দেহটা দিয়ে অনেক ভাবি চিকিৎসক গবেষণা করবেন, একজন মানুষের সাফল্যের পরাকাষ্ঠা তো এটাই। প্রবীর ঘোষ নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান, সেই প্রতিষ্ঠানের মশাল তিনি সঠিক এবং যোগ্য তরুণ প্রজন্মের হাতে দিয়ে গিয়েছেন, এটাই বড়ো আশার কথা।
যাবার বেলায়, বিদায় বলতে নেই,
আমি আছি তোমাদের সঙ্গেই ------।
আমার দেহ টা রইলো এই সবুজ গ্রহেই,
আমার চোখ দিয়ে দেখো গোটা দুনিয়াটা--।
প্রানভরে দেখো, আর অনুভব করো,---
ওই উঠেছে স্লোগান,
সমাজের নিচতলা থেকে।
যুক্তির শানিত বাণে খান খান করে দাও অজ্ঞতার বেড়াজাল --------।
বেড়াজালের ওপারেই আছে মুক্তি,অজ্ঞানতা থেকে মুক্তি।
প্রাণহীন অবয়বে কোরোনাকো ভক্তি, কারণ;
যুক্তিতেই আছে মুক্তি, কুসংস্কার থেকে মুক্তি।
মনোরা পিক, নৈনিতাল (উত্তরাখন্ড)