বিদ্যাসাগর পরবর্তী যুক্তিবাদী আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ল কেনো?

শম্ভুনাথ চার্বাক


Nov. 20, 2024 | | views :489 | like:2 | share: 2 | comments :0

বাংলাদেশে ধর্মের বিবর্তন বারবার ঘটেছে। প্রথমে আর্য আগ্রাসন এবং পরবর্তীতে বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার।  শশাঙ্কের নির্মম  হাত ধরে আবার হিন্দু ধর্মের উত্থান, শৈব  শশাঙ্ক অধিকাংশ  বৌদ্ধ মঠ গুঁড়িয়ে দিয়েছিল।পাল রাজাদের সময়ে আবার বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার, কিন্তু সেন রাজাদের হাতে পুনরায় হিন্দু ধর্মের উত্থান বাংলা দেখেছে। হিন্দু বৌদ্ধ বৈষ্ণব ইসলাম  খ্রিস্টান ধর্মের জাতাকলে বাংলায় রক্ষণশীল ধর্ম মতের জয়জয়কার ঘটেছে।      

পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই বিভিন্ন আন্দোলনের প্রাথমিকভাবে নেতৃত্বে থাকে মধ্যবিত্তেরা। ইংরেজ আগমনের পরে  উনবিংশ শতকে বাংলার সামন্তযুগের ভাঙন ও নতুন ধনতান্ত্রিক শিল্প বাণিজ্যের অভ্যুদয়কালে কাঁচামালের উৎপাদকের সাথে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে  শ্রমবিভাগের ফলে বিচ্ছেদ ঘটে এবং নগরে শহরে শিল্পবাণিজ্য কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। তার ফলে সমাজে এক সুসংবদ্ধ মধ্যবিত্ত জনস্তরের বিকাশ হয়। এই মধ্যবর্তী জনস্তরে ধীরে ধীরে যখন নাগরিকতার বিকাশ হয়, তখন সামাজিক ও রাষ্ট্রিক অধিকারের চেতনাও তাদের মধ্যে জাগ্রত হয়। এই মধ্যবর্তী শ্রেণি থেকেই রামমোহন ডিরোজিও বিদ্যাসাগরেরা নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলার নবজাগরণের। রামমোহনের সতীপ্রথা রদ ও ইংরাজীর মাধ্যমে  পাশ্চাত্য শিক্ষার জন্য প্রচেষ্টা সেই সময় বাংলায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। এবং পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে  বিধবা বিবাহ আন্দোলন প্রথম সর্বভারতীয় আন্দোলনের  রূপ নেয় এবং পরবর্তীকালে বাল্য বিবাহ রদ, বহুবিবাহ বন্ধ, নারী শিক্ষা বিস্তার সহ সামগ্রিক শিক্ষার বিস্তার, কলেজ প্রতিষ্ঠা, পাঠ্যপুস্তক রচনা, বাংলা ভাষা ও গদ্যে প্রাণ সঞ্চার, বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা,  পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের মিলনের শিক্ষা বিস্তার  করা সহ সমস্ত কাজ সমাজে এক বিপ্লব এনে দিয়েছিল। রামমোহন দেবেন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত  ব্রাহ্ম্যদের একেশ্বরবাদের আন্দোলন ও পাশ্চাত্য ভাবধারার বিস্তারও সমাজে প্রভাব বিস্তার করেছিল। কিন্তু রামমোহনের পরবর্তীকালে ব্রাহ্মরা সমাজের উচ্চবিত্তদের মধ্যেই এই ধর্মকে রেখে দিলেন, সাধারণ বঙ্গ সমাজে এর বিস্তার ঘটালেন না। নারী শিক্ষার ব্যাপারেও তারা ছিলেন সংকীর্ণমনা, নিজেদের বাড়ীর মহিলাদের শিক্ষার জন্য অন্তঃপুরের  অবরোধের বাইরে বার করেননি। বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধেও এরা গেলেননা । এই ব্রাহ্মরা যেন ফিসফাস করে সংস্কারের কাজ করতে উৎসাহী, সেভাবে কেউ এগিয়ে এলেননা। ফলে এই ব্রাহ্মধর্ম সাধারণের মধ্যে প্রসার পেলোনা। 

    হেনরী লুই ভিভিয়ান  ডিরোজিও ছিলেন  ঝড়ের পাখির মতো, স্বল্প কালের জন্য এই পৃথিবীতে এসেছিলেন এবং বাংলার সমাজ জীবনে ঝড়ের পাখির মতো উত্থান হয়েছিল তাঁর আবার ঝড়ের পাখির মতো মিলিয়ে গেলেন এই পৃথিবী ছেড়ে। এই স্বল্প কালে  ইয়ং বেঙ্গলের মাধ্যমে শিক্ষা ও সমাজ সম্পর্কে নতুন ভাবনা বঙ্গের যুবকদের  মাথায় গুঁজে দিয়েছিলেন।এর ফসল ইয়ং বেঙ্গল এবং তাদের মাধ্যমে সংস্কার।

  নবযুগের বাংলায় সমাজ জীবনের স্রোত দুটি স্বতন্ত্রমুখী খাতে প্রবাহিত হয়।একটি সম্মুখগামী উদারপন্থী  উন্নতিশীল ধারা, আর একটি পশ্চাদগামী হিন্দুভাবধারী রক্ষণশীল ধারা। এবং আশ্চর্যের বিষয় জীবন  এই স্রোতের দুটি ধারার মধ্যে ব্রিটিশের চাটুকার  শোভাবাজার রাজবাড়ীর নেতৃত্বে চরম রক্ষণশীল পশ্চাদগামী ধারা সব সময়ই বাংলাদেশে অতীব শক্তিশালী ছিল। এই বাড়ি থেকেই সমস্ত অন্ধবিশ্বাস কুসংস্কার সীলমোহর পেত। ১৮৭০ সালের পর থেকে জাতীয়তাবোধের প্রথম উদ্বোধনকালে তারা অত্যন্ত উগ্রভাবে ঐতিহ্যবাদী হয়ে ওঠেন। এইসব কারণেই এই সময় প্রাচীন আদর্শ ও ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার – আন্দোলন প্রবল হয়ে ওঠে, এবং স্বভাবতই তা মধ্যে মধ্যে বাঁধ ভাঙার উপক্রম করে। বৈদেশিক পরাধীনতার জন্য বাংলাদেশে ধনতন্ত্রের যুগসম্মত স্বাভাবিক বিকাশ সম্ভব হয়নি বটে, কিন্তু ধনতন্ত্রের  এই অসমবিকাশের মধ্যে অর্থনৈতিক  বাস্তব ভিত্তি  রচিত না হওয়ার ফলে চিত্তবিকার ও বিভ্রমই বৃহত্তর সত্য হয়ে উঠেছে এবং নবযুগের নবজাগরণ রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের উত্থানে প্রহসনে পরিণত হয়েছে। ইউরোপে স্টুয়ার্ট মিল, ডারউইন, কার্ল মার্ক্স ও অন্যান্য মনীষীদের উত্থানে ইউরোপীয় চিন্তাধারাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে তোলে। সে সময় প্রথম পর্বে বিদ্যাসাগরের নেতৃত্ব সমাজকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছিলেন এবং পরবর্তী পর্বে ১৮৬০-৬১ থেকে ১৮৭০-৭২ পর্যন্ত নেতৃত্বে ছিলেন কেশবচন্দ্র সেন।  

           কেশব চন্দ্র সেন বিধবা বিবাহ আন্দোলনের সময় চিৎপুরের গোপাল মল্লিকের বাড়িতে নিজের প্রযোজনায় বিধবা বিবাহ নাটক মঞ্চস্থ করেন  এবং বিদ্যাসাগর তা দেখতেও যান। যে সময় বাংলার গৃহবধূরা অবরোধে কড়া প্রহরায় অন্তরীণ থাকতো সেসময় কেশবচন্দ্র সেন কোলকাতার রাস্তায় সস্ত্রীক এসে দাঁড়ালেন এবং দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্ম ধর্মের  আচার্য পদে অভিষেক দেখতে জোড়াসাঁকো গেলেন। এটাকে তৎকালীন ভারতীয় সমাজে এক বিপ্লব বলেই চিহ্নিত করা হয়। এটা বন্ধ করার জন্য কেশব সেনের আত্মীয় ও সমাজের রক্ষণশীল নেতারা তাঁর বাড়িতে গুণ্ডা পর্যন্ত পাঠায়, কেশব সেন সেগুলিকে উপেক্ষা করেই স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে জোড়াসাঁকো যান। এই ঘটনার পরে ব্রাহ্ম্যরা তাদের স্ত্রীর সাথে বেরোতে শুরু করেন এবং পরে তা হিন্দু  সমাজেও তা প্রচলিত হয়। কেশবচন্দ্রের উত্থানকে বাংলার ব্রাহ্ম্য সমাজের নবোত্থানের যুগ বলে উল্লেখ করা হয়। কেশবচন্দ্র ব্রহ্ম্যবিদ্যালয়, সঙ্গতসভা, কলিকাতা কলেজ  প্রতিষ্ঠা করে বাংলার শিক্ষিত তরুণ সমাজকে ব্রাহ্ম্য ধর্মের দিকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। এই সময় তিনি সুবক্তা,পুস্তিকা লেখক, সংস্কারকর্মী, ধর্ম প্রচারক ও মানবহিতৈষী বলে সমাজে খ্যাতি লাভ করেন। ১৮৬০  --১৮৭২ সাল পর্যন্ত কেশব সেনের জন্য বাংলার সমাজ জীবন প্রব; আলোড়িত হয়। কেশব সেন বিদ্যাসাগরের একান্ত অনুগামী। তাঁর জন্যই ব্রাহ্ম্যধর্মের আচার্যদের ব্রাহ্মণ্যত্বের সনাতন প্রতীক উপবীত বা পৈতা  ত্যাগের কথা বললেন। দেবেন্দ্রনাথ অনিচ্ছা সত্বেও তরুণদের এই প্রস্তাবে রাজী হলেন। ব্রাহ্ম্যধর্মে অসবর্ণ বিবাহ শুরু হলো ১৮৬২ সালে। দেবেন্দ্রনাথ কিন্তু অসবর্ণ বিবাহ মনে মনে স্বীকার করতেননা। ব্রহ্মোপাসনার সময় পুরুষদের সাথে মেয়েদেরও যোগ দেওয়ার অধিকার থাকবে। এইসব সংস্কার প্রাচীনপন্থী দেবেন্দ্রনাথ সহ্য করতে পারেননি, ফলে ব্রাহ্ম্য সমাজ দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। ১৮৭০ এর ফেব্রুয়ারীতে কেশবচন্দ্র ইংল্যান্ড যাত্রা করেন র প্রতিভায় ও বাগ্মিতায় ইংরেজ সমাজ মুগ্ধ হয়ে গেল। সেখানে জনসাধারণের আত্মোন্নতির ও আত্মপ্রতিষ্ঠার অদম্য আগ্রহ এবং শ্রমিক শ্রেণির সচেতন আন্দোলন তাঁর উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল।১৮৭০ এর শেষে কলকাতায় ফিরে এসে ভারত সংস্কার সভা, স্থাপন করেন। এদের কর্মসূচী ছিল সুলভ সাহিত্য প্রকাশ,সুরাপান নিবারণ, শ্রমজীবী বিদ্যালয় স্থাপন, স্ত্রী-শিক্ষা প্রসার, দান-দাতব্য সভা।

              কিন্তু ক্রমে ক্রমে কেশবচন্দ্রের চিন্তাধারা ও কাজকর্মে নানারকমের অসঙ্গতি দেখা যায়। তিনি গণতান্ত্রিক ভাবধারার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই তিনিই এর বিরোধীতা শুরু করলেন।অল্পদিনের মধ্যেই ঈশ্বরপ্রেরিত মনুষ্যাবতার সম্বন্ধে তাঁর গভীর বিশ্বাস জন্মালো, সে বিষয়েও তিনি আবেগময়ী বক্তব্য রাখা শুরু করলেন এবং নিজেকে অবতার বলে ভাবতে শুরু করলেন। কেবল অবতারবাদ নয়, বৈষ্ণব ভক্তিবাদও তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। বৈষ্ণব পরিবারের সন্তান শেষ পর্যন্ত খোল-করতাল সহ নগরকীর্তনে বেরোতে শুরু করলেন। নিজেকে অবতার বলে ভাবতে শুরু করলেন। ১৮৭৬ সালে রামকৃষ্ণর সাথে দেখা হতে তিনি মাতৃভাবে উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়লেন এবং ব্রাহ্ম্যধর্ম হিন্দু ধর্মের মধ্যে লুপ্ত হয়ে গেল। ১৮৭২ সালে তিনি নিজের নাবালিকা কন্যা সুনীতিদেবীর কুচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনাথের সাথে হিন্দুমতে বিবাহ দিলেন। যত তাড়াতাড়ি প্রদীপ শিখা প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল তত দ্রুত প্রদীপ নিভে গিয়েছিল। কেশবচন্দ্র ও অনেকটাই দায়ী বাংলার যুক্তিবাদী আন্দোলন বিস্তার না হওয়ার। কেশবচন্দ্র ও তাঁর অনুগামীরা সব দক্ষিণেশ্বরে দৌড়তে শুরু করলো এবং ব্রাহ্ম্য ধর্মকে হিন্দু ধর্মের সাথে মিলিয়ে দিল। এই সময় তরুণ ব্রাহ্ম্যরা সমাজ থেকে বেরিয়ে  সমদর্শী নামে একটি দল গঠন করেন। শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু,দুর্গামোহন দাস, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন। শিবনাথ শাস্ত্রী ছিলেন এদের নেতা, তিনি পুনরায় ব্রাহ্ম্যসমাজকে যুক্তিবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ ও গণতন্ত্রের ওপর প্রতিষ্ঠা করেন এবং সাধারণ ব্রাহ্ম্যসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। 

সূত্রঃ বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ - বিনয় ঘোষ

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929