গল্পের ফাঁকফোঁকর : সদা সত্য কথা বলা ভালো নয়।

Guitar K Kanungo


Jan. 3, 2025 | | views :91 | like:2 | share: 2 | comments :0

এক পথিক দস্যুদের ভয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য এক ঋষির কুঠিরে আশ্রয় নেয়।  কিছুক্ষণ পরেই দস্যুরা সেই আশ্রমে এসে উপিস্থত হয়। তার ঋষিকে একটা লোক কিছুক্ষন আগে তাঁর কুঠিরে আশ্রয় নিয়েছে কিনা। ঋষি ভেবে দেখলেন সত্য কথা বললে লোকটার প্রাণ যাবে। আবার মিথ্যে কথা বললে তার পাপ হবে। তিনি নিরুত্তর থাকাটায় শ্রেয় বিবেচনা করলেন। দস্যুরা হৃষীকে নিরুত্তর দেখে নিজেরাই কুঠিরের ভেতর লুকিয়ে থাকা পথিককে খুঁজে বের করল। তারপর তার সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়ে তাকে হত্যা করে তার মৃতদেহ সেখানে ফেলে রেখে চলে গেল।

প্রকৃতির নিয়ম মেনে একদিন সেই ঋষির মৃত্যু হল। কিন্তু যমরাজ তাকে নরকভোগের জন্য পাঠিয়ে দিলেন সেদিনের তার স্বার্থপর আচরণের জন্যে, তিনি নিজের পাপকে একজন মানুষের জীবনের চাইতেও বড় করে দেখেছেন। এই গল্পটা ছোটবেলায় অনেকেই শুনেছেন। এই গল্পের মর্মার্থটা তাই খোলাসা করে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। পুরাণে আরেকটা গল্প আছে যেটা হয়ত অনেকেরই জানা নেই। সেই গল্পটা বলি।  

দেবতাদের গুরু মহর্ষি বৃহস্পতি। তাঁর স্ত্রীর নাম তারা যিনি কিনা পঞ্চকন্যাদের একজন। তিনি সুন্দরী ছিলেন, স্বাস্থ্যবতী ছিলেন। এদিকে চন্দ্রদেব দেবতাদের মধ্যে অন্যতম  আকর্ষনীয় দেবতা ছিলেন। গুরুপত্নী তারা এই চন্দ্রদেবের প্রেমে পড়ে গেলেন। খুবই গর্হিত কাজ! কিন্তু প্রেম কবে কোথায় নিয়ম মেনে চলেছে? সম্পর্ক যেহেতু অবৈধ তারা চন্দ্রকে নিয়ে পালিয়ে গেলেন।

আগেই বলেছি বৃহস্পতি দেবতাদের গুরু। চন্দ্রদেবের এই অনৈতিক আচরণে দেবরাজ ইন্দ্র বিশেষ ক্ষিপ্ত হলেন। তিনি চন্দ্রদেবেকে অবিলম্বে তারাকে ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। চন্দ্রদেব ইন্দ্রের আদেশ থোড়াই কেয়ার করলেন। তিনি তখন তারার সঙ্গে মধুচন্দ্রিমায় ব্যস্ত। ফলত ইন্দ্রকে চন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হল।  অনেকটা হেলেনকে উদ্ধার করার জন্য মেনেলাউসকে ট্রোজান রাজকুমার প্যারিসের বিরুদ্ধে যেরকম যুদ্ধ ঘোষণা করতে হয়েছিল সেরকম। সেই যুদ্ধে চন্দ্র পরাজিত হলেন এবং তারাকে বৃহস্পতির কাছে ফিরিয়ে দেয়া হল।

বৃহস্পতি অবশ্য কোন রকম প্রশ্ন ছাড়াই তারাকে গ্রহণ করলেন।  রামায়ণে আমরা দেখেছি রামচন্দ্র সীতাকে অনায়াসে গ্রহণ করেননি। সীতাকে অগ্নিপরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল এবং রাম এরকম কথাও বলেছিলেন তিনি সীতাকে উদ্ধার করার জন্যে লংকায় এসে রাবনকে বধ করেননি। বৃহস্পতি অনেকটা ইলিয়াড মহাকাব্যের মেনেলাউসের মতোই আচরণ করবেন। হেলেন নিজ থেকে প্যারিসের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং এই পালিয়ে যাবার কারণে মেনেলাউস ব্যাক্তিগতভাবে যথেষ্ট পরিমানে অসম্মানিত হয়েছিলেন। পুরুষ হিসাবে তার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সেইজন্যে হেলেনের প্রতি তার এক রাশ ঘৃণা এবং আক্রোশ পুঞ্জীভূত হয়ে ছিল, কিন্তু ট্রয় নগরী ধ্বংস হবার পর মেনেলাউস হেলেনকে দেখে সব ঘৃণা সব আক্রোশ এক নিমিষে ভুলে গিয়েছিলেন। দেবগুরু বৃহস্পতির ক্ষেত্রে এরকমই একটা কিছু হয়েছিল। তিনি কোন প্রশ্ন ছাড়াই স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিলেন।


স্ত্রী বিশ্বাসঘাতকতা করলেও স্বামী তাকে ফিরিয়ে নিয়েছেন। খুবই ভালো কথা। কিন্তু সমস্যা একটা থেকেই গিয়েছিল শেষ পর্যন্ত। তারা যতদিনে বৃহস্পতির কাছে ফিরে এসেছেন ততদিনে তিনি গর্ভবতী। অনাগত এই সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠল। বৃহস্পতি বললেন আমার সন্তান। চন্দ্র বললেন আমার সন্তান। এদিকে তারা কিন্তু কিছুই বললেন না অথচ সন্তানের আসল পিতা কে, সেটা একমাত্র তারারই জানার কথা।

এরকম একটা অদ্ভুতুড়ে অবস্থায় তারার গর্ভস্থ সন্তানই বলে উঠল - আমি স্বামীর নই, প্রেমিকের সন্তান। সেই সন্তানের নাম দেয়া হবে বুধ।  বুধের সততা এবং এই বিশেষ ক্ষমতায় দেবতার বেশ চমৎকৃত হলেন। দেবতারা চমৎকৃত হলেও বৃহস্পতি নিজের ক্রোধ দমন করতে পারলেন না। তিনি অভিশাপ দিলেন - তারার গর্ভস্থ এই সন্তান লিঙ্গহীন হয়েই জন্মাবে- অর্থাৎ সে নারী ও হবে না, আবার পুরুষও হবে না। তাই হয়েছিল। এইজন্যে বুধকে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে যেরকম আমাদের সমাজে অনেক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের পোহাতে হয়। নিজের পিতৃপরিচয় দিতে গিয়ে সত্য কথা বলেই বুধ নিজের জন্যে এই বিপদটা ডেকে এনেছিল। সে চুপচাপ থাকলেই পারত। চাপের মুখে তারাই একসময় ক্র্যাক করত।  

এখানে আরেকটা গুরুতর বিষয় আছে। হেলেন এবং তারা কিছুটা তুলনীয় হলেও, বৃহস্পতি এবং মেনেলাউস একে অপরের সঙ্গে তুলনীয় নন। মেনেলাউস একজন রাজা ছিলেন—তাঁর চরিত্রে কিছু সহজাত ত্রুটি থাকতেই পারে, কিন্তু বৃহস্পতি একজন ঋষি। তিনি অন্য কোনো নারীর প্রতি আসক্ত ছিলেন, এমন কোনো খবর আমরা পুরাণে খুঁজে পাই না। আবার তিনি স্ত্রী তারাকে অনাদর করেছেন, সেরকম কোনো খবরও পুরাণ আমাদের দেয় না। তাহলে তারা চন্দ্রদেবের প্রতি আকৃষ্ট হলেন কেন?

গোটা ব্যাপারটা কি কেবলই যৌনতা? যদি তাই হবে, তাহলে বৃহস্পতি অনুসূয়া নন। অনুসূয়া স্বামীর প্রতি তাঁর অচলা ভক্তি এবং ভালোবাসার জন্য একজন সতী নারী হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা যদি অনুসূয়া না হন, তাহলে তাঁকে পঞ্চকন্যাদের একজন হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হলো কেন? কেন একজন সাধারণ হিন্দু নারীকে এমন একজন নারীর কথা স্মরণ করতে হবে, যিনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছিলেন?

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929