বাস্তব কথা হলো, এ জগৎ এক বস্তু জগৎ। তবু মানুষ কল্পনা করতে ভালবাসে, কল্পনার এক জগত গড়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করে।
এই মানসিকতাকেই পুঁজি করে পূঁজিবাদীরা তৈরি করেছে এক হাতিয়ার। সেটি হলো ভাববাদ। ভাববাদে ঈশ্বর, সৃষ্টিকর্তা, আত্মা, প্রেতাত্মা প্রভৃতি কাল্পনিক জিনিসের অবতারণা করা হয়। ক্যাপিটালিজমের বহুল প্রচারে সমাজমানসে এইসব আত্মা, ভূত, ভগবান, সৃষ্টিকর্তা ইত্যাদি হাবিজাবি কাল্পনিক অস্তিত্বহীন জিনিস বিভিন্ন অস্ত্রের বারংবার ব্যবহারে, বিভিন্নভাবে ব্যবহারে, মানব মনে বিশ্বাসের মুখোশ তৈরি করতে সক্ষম হয়, সফল হয়। মানুষ এসবে বিশ্বস্ত হয়ে ওঠে। তার এই বিশ্বাস দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে আত্মিকরণ করতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ জগৎ যে শুধুই বস্তুজগৎ, এছাড়া অন্য কিছুই নয়, তা বলীষ্ঠভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন প্রবীর ঘোষ। গত শতকের আটের দশকে লক্ষ বাধাকে যুক্তিবাদের ধারে স্বমহিমায় অতিক্রম করতে পেরেছেন প্রবীর ঘোষ।
উৎপাদন প্রক্রিয়া সচল রাখতে মানুষকে মানবেতর প্রাণী করে রাখাটা খুব দরকার পড়ে। এজন্য এইসব কাল্পনিক জিনিস তাদের মনে প্রোথিত করার খুব প্রয়োজন। কিছু কিছু প্রফেট, ধর্ম প্রচারক, ধর্ম প্রণেতা তাদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বস্তুবাদের বিরোধীবাদ প্রচার করে থাকেন যা আসলে ক্যাপিটালিজম দিয়ে শোষণকেই সমর্থন করে চলে।
মুনাফার লোভ চালায় শোষণ। শ্রমিক মানসে যখন জন্ম নেয় সংগ্রামের ইচ্ছার পাখি। অধ্যাত্মবাদ, অদৃষ্টবাদ, স্বর্গ-নরক-কল্পনা সেই সংগ্রামী পাখীকে থামিয়ে দেয়, উড়তে না দিয়ে বন্দি করে ধর্মের খাঁচায়। শ্রেণিবিহীন সমাজ গড়তে বিপ্লবের ইচ্ছাকে দমিয়ে দেয় এইসব অধ্যাত্মবাদ। মানুষকে অন্ধ করে দেয়। এক ধরণের জম্বি (zombie) তৈরি করে দেয়। মানুষের শ্রেণিচেতনাবোধ গড়ার সঙ্গে সঙ্গে এইসব বিরোধীবাদগুলি সেই চেতনাকে মেরে ফেলে চারদিক দিয়ে আক্রমণে। গড়ে উঠতেই দেয় না।
দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ অনুধাবন করার প্রাথমিক কথাই হলো, এ জগৎ বস্তু জগৎ। এখানে অলৌকিকতার কোনও ঠাঁই নাই।
কিন্তু পুঁজিবাদের মূল পুঁজিই তো হলো অলৌকিকতা। প্রবীর ঘোষ সেই অলৌকিকতাকে চ্যালেঞ্জ করলেন একেবারে মাঠে ময়দানে নেমে। গুরু, গুরুবাবা, জ্যোতিষী, আত্মাবিশেষজ্ঞ, ভূতবিদ, পরাবিজ্ঞানবাদী সকলের সামনে ধেয়ে এলেন সুনামি হয়ে। এক ধাক্কায় ধুয়ে গেল এইসব অলৌকিকতাবাদের ধারকের, বাহকেরা।
প্রমাদ গুণলো এই সব মিথ্যাশ্রয়বাদীরা। বিপন্ন হল তাদের অস্তিত্ব। তাই সকলে একযোগে আক্রমণ করতে থাকল তারা। তাদের তাসের ঘর রক্ষা করতে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করল। নিয়োগ করল নানান এজেন্সি। আজও সক্রিয় সেই সব এজেন্সি। নইলে যে তাদের মিথ্যের দুনিয়া প্রকাশ হয়ে পড়বে। ভেঙে পড়বে তাদের অলৌকিকতার সাম্রাজ্য।
প্রবীর ঘোষ হলো সেই ব্যক্তির নাম, যে নাম যুক্তিবাদের সমার্থক অন্য নাম। সমাজে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল নবজাগরণের ঢেউ। যুক্তিবাদ-নদের ঢেউ। সেই নদীতেও বাঁধ দিতে লাগল স্বার্থান্বেষী এক চক্র। আজও তারা সক্রিয়। পি.জি যেদিন মারা গেলেন, গর্তের অন্ধকার থেকে হিলহিল করে বেরিয়ে আসতে লাগল, কাদা ছুঁড়তে লাগল, সেইসব অন্ধকারের জীবগুলি। প্রবীর ঘোষ মারা গেছেন, কিন্তু আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল তাঁর ঘোষিত চ্যালেঞ্জ। এইসব অন্ধকারের জীবেরা তো পাঁক ঘাঁটা জীব,
চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে মৃত প্রবীরকেও মারতে পারে না।
তাই প্রবীর ঘোষের সামনে অলৌকিকতার দাবিদারের সংখ্যা শুণ্য।
এতেই এইসব অলৌকিকতাবাদীদের লজ্জা পাওয়া উচিত। কিন্তু ঐ যে বলে না, লজ্জা ঘেন্না ভয়, তিন থাকতে নয়। এরাও মিথ্যার পশরা সাজিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে আছে, রূপ পালটে, ছল পালটে, ঢঙ পালটে।
যতদিন এই যুদ্ধ চলবে, প্রবীর ঘোষ ততদিন বেঁচে থাকবেন যুক্তিবাদীদের আদর্শ হয়ে। ততদিন তাঁর চ্যালেঞ্জ, তাঁর বইগুলি যুদ্ধের মারণাস্ত্র হয়ে তাদের রাত্রের নিদ্রায় ত্রাসের অস্ত্র হয়ে ভয় দেখিয়ে যাবে। ভীতের চিৎকার শোনা যাবে। আজ যেমন শোনা যাচ্ছে।
যুক্তিবাদের পথ চলতেই থাকবে চলতেই থাকবে। কারণ এ পথ কাল্পনিক কোনও গোঁজামিল দিয়ে তৈরি নয়। সত্য ও সত্যার্থ দিয়ে তৈরি।