মুঘল সম্রাটদের মধ্যে আকবর সবচাইতে বেশী সময়ের জন্য রাজত্ব করেছিলেন। প্রায় পঞ্চাশ বছর তিনি ভারতবর্ষ শাসন করেছিলেন। মোটা দাগে তিনি একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় শাসক ছিলেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে মাত্র দুজন শাসকের নামের আগে 'মহান' শব্দটি যোগ করা হয়। একজন সম্রাট অশোক, আরেকজন সম্রাট আকবর। এদের প্রথম জন বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারে কাজ করেছিলেন, দ্বিতীয় জন একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নির্মানের। একজন মুসলামন শাসক হওয়া সত্বেও আজ থেকে পাঁচশ বছরের কাছাকাছি সময়ের আগে একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করার কথা ভাবা সহজ ব্যাপার নয়, যেখানে আজকের দিনে এসেও অনেক মুসলমানের মধ্যে খেলাফত প্রতিষ্ঠার তীব্র আকুতি দেখতে পাওয়া যায়।
এখানে দুটো বিষয় আমাদের বোঝা দরকার। আকবর নিরক্ষর হলেও মোটেই অশিক্ষিত ছিলেন না। তিনি বরং অন্য মুঘল সম্রাটদের তুলনায় অনেক বেশী পরিমানে শিক্ষিত, আসলে বলা উচিত অনেক বেশী সুশিক্ষিত ছিলেন। তাঁর বিশাল সংগ্রহের ব্যাক্তিগত লাইব্রেরী ছিল। তিনি নিজে পড়তে পারতেন না বলে অন্যরা তাঁকে সেসমস্ত বই পড়ে শোনাতেন। আকবরকে নিয়ে আরেকটা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যেটা মূলত মুসলমান ঐতিহাসিকরা ছড়িয়েছে। বলা হয় তিনি দ্বীনে এলাহী নামের একটা ধর্মের প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। এই ব্যাপারটা সর্বৈব মিথ্যা। দ্বীনে এলাহী নামের একগুচ্ছ প্রবিধি (code of conduct) তিনি প্রচলন করেছিলেন কিন্ত যেগুলো কেবল যারা শাসনকার্যের সঙ্গে জড়িত তাদের জন্যেই প্রযোজ্য ছিল। তিনি আলাদা করে কোন বিশেষ ধর্ম প্রচার করেননি। তবে একথা ঠিক তিনি সব ধর্মের শাস্ত্রবিদদের ডেকে পাঠাতেন এবং তাঁদের কথা শুনতেন। ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসে তিনি ইসলাম ধর্মের প্রতিই অনুগত ছিলেন।
অনেক মুসলিম ঐতিহাসিক এবং অনেকে ভারতীয় মুসলামনও বলার চেষ্ঠা করেন মুঘলরা ভারতবর্ষে স্রেফ লুটপাট করার জন্য আসেনি, তারা এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য এসেছিলেন। এই কথাটা আকবরের আগেকার মুঘল সম্রাট বাবুর এবং হুমায়ূনের জন্যে সর্বাংশে সত্য ছিল না। তাঁদের মধ্যে পিছুটান ছিল। বিশেষত বাবুরের মধ্যে তো ছিলই, ভারতবর্ষের আবহাওয়া তাঁর কখনোই ভালো লাগেনি। মুঘল সম্রাটদের মধ্যে সম্রাট আকবরই সত্যিকার অর্থে প্রথম বারের মত কোন রকমের পিছুটান ছাড়াই একজন ভারতীয় হয়ে ওঠার চেষ্ঠা করেছিলেন। কাবুল কিংবা সমরখন্দ নিয়ে তাঁর কোন পিছুটান ছিল না।
এবার আনারকলির গল্পটা বলি। গল্পটা প্রেমের হলেও, এই গল্পের পরিণতি অত্যন্ত মর্মান্তিক। আনারকলি পরিণতি সম্পর্কে যে ধরণটা প্রচলিত আছে সেটি হলো সম্রাট আকবর তাঁকে জীবন্ত হত্যা করার আদেশ দিয়েছিলেন। সেই হত্যাটা কিভাবে করা হয়েছিল সেটা নিয়ে নানান মতমত থাকলেও সবচাইতে প্রচলিত ধারণটা ছিল আকবর আনারকলিকে চার দেয়ালের মধ্যে পুরে দিয়ে তাকে জীবন্ত অবস্থায় হত্যার নির্দেশ দেন। তবে, কিছু ইতিহাসবিদ এটাও মনে করেন আকবর মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে আনারকলিকে কোনো এক দুর্গে বন্দী করে রেখেছিলেন সেখানে আনারকলি জীবনের বাকিটা সময় অতিবাহিত করেছিলেন। শেষেরটা হবার সম্ভাবনাই বেশী।
আনারকলির অপরাধটা কী? আনারকলির অপরাধ তিনি প্রেমে পড়েছিলেন এবং তিনি প্রেমে পড়েছিলেন আকবরের পুত্র শাহজাদা সেলিমের। এটাই কী তার অপরাধ ? ইতিহাস থেকে জানা যায় আকবর এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি, শুধু যে মেনে নিতে পারেননি তা নয়, তিনি আনারকলিকে সেলিমের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার সব চেষ্টাই করেছেন। কিভাবে করেছেন সেকথা একটু আগেই বলেছি। প্রশ্ন হচ্ছে কেন? এমন তো কোন কথা ছিল না শাহজাদার প্রেম করার কোন অধিকার ছিল না। পুরোদমেই ছিল। তাহলে?
আনারকলি হিন্দু ছিলেন নাকি মুসলমান এই ব্যাপারটা নিয়ে পরিষ্কারভাবে কিছু জানা যায় না। হিন্দু বলে আকবর সেই সম্পর্ক মেনে নেননি, এরকম ভাবার খুব একটা সুযোগ নেই কারণ আকবর নিজেই হিন্দু রমনী বিয়ে করেছেন। শাহজাদা সেলিমের জননী যোধাবাঈ নিজেও ছিলেন একজন রাজপূত নারী - তথা হিন্দু ধর্মের অনুসারী । সেক্ষেত্রে আনারকলি হিন্দু হলেও আকবরের তরফে কোন রকমের আপত্তি থাকার কথা ছিল না। সমস্যাটা ছিল আসলে অন্য জায়গায় এবং সেটা গুরতর - যে জায়গাটা নিয়ে ইতিহাস অনেকটাই নীরব - বিশেষ কিছু বলে না।
আকবরের সেলিমের বাইরে আরো দুজন সন্তান ছিল। তাদের একজনের নাম দানিয়েল। আগেই বলেছি সালিমের মা ছিলেন যোধাবাঈ যদিও সেই মায়ের সঙ্গে সালিমের সম্পর্ক কখনোই খুব একটা ভালো ছিল। সেলিম বৈরাম খানের বিধবা স্ত্রী যাঁকে আকবর পরবতীতে বিয়ে করেছিলেন সেই রমণীকে নিজের মা বলে মনে করতেন এবং তাঁর সঙ্গেই বেশী ঘনিষ্ঠ ছিলেন। যাই হোক, দানিয়েলের মা ছিলেন হারেমেরই আরেক নারী। আকবরের রাণীদের কেউ নন। তিনি ছিলেন আকবরের হারেমের রক্ষিতাদের একজন। ঐতিহাসিক আব্রাহাম ইয়ার্লির মতে আনারকলিই ছিলেন দানিয়েলের মা।
সম্পর্কের এই বিশেষ জটিলতার কারণেই শাহজাদা সেলিম, যিনি কিনা সাম্রাজ্যের পরবর্তী উত্তরাধিকারী, আনারকলির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক বজায় রাখুক আকবর সেটা চাননি।