বেমানান

সুমন কর্মকার


Nov. 21, 2024 | | views :286 | like:0 | share: 0 | comments :0

প্রতি শনিবার সন্ধ্যেয় সৌরকে দেখতে পাওয়া যায় স্টেইন্ড গ্লাস পাবের বাঁদিকের একদম কোনার টেবিলে। ও কখনোই ডান্সফ্লোরে আসে না। কার্লসবার্গের দুটো ক্যান আর চারটে ক্লাসিক ওর কোটা। কখনোই এর কম-বেশি হয়না। নিজের চেয়ারে বসে নৃত্যরত মানুষগুলোকে দেখা, ওদের দিক থেকে ভেসে আসা টুকরো টুকরো কথা, হাসির শব্দ শুনতে ওর বেশ লাগে। আস্তে আস্তে মাথার মধ্যে একটা ঝিমুনি অনুভূত হয়। তারপর কোটা পূরণ হয়ে গেলেই বিল মিটিয়ে বেরিয়ে পড়ে নিজের একলা ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে। এভাবেই এক শনিবারের সন্ধ্যেয় সৌর দেখতে পেল একদল প্রাণোচ্ছল যুবক-যুবতীকে। দলে আছে তিনটে ছেলে আর দুটো মেয়ে। দেখেই বোঝা আছে দুটো কাপল গ্রুপ আর তাদেরই এক বন্ধু। হাই সাউন্ডের মাঝে একে অন্যের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে চিৎকার করে কিছু কথা বলছে আর মাঝেমাঝে হেসে উঠছে। ওরা পাঁচটে চেয়ারের একটা টেবিলে বসে বিয়ার অর্ডার করল। এই অবধি দেখে সৌর টেবিল ছেড়ে উঠে ওয়াশরুম গেল। ফিরে এসে দেখল এর মধ্যেই গ্রুপটা ডান্সফ্লোরে চলে গিয়েছে এবং গোল হয়ে ঘিরে চলছে নাচ। রোজকার চিত্র। নতুন কিছু নয়। সৌর নিজের কোটা পূরণে মনোনিবেশ করল। কোটা যখন প্রায় শেষের মুখে হঠাৎ একটা গোলমালের আওয়াজ সৌরর দৃষ্টি আকর্ষন করল। একটা জটলা তৈরি হয়েছে। ডিজে গান থামিয়ে দিয়েছে। বাউন্সাররা নিজেদের কর্তব্যপালনে নেমে পড়েছে। সৌর উঠে পড়ল। জায়গাটায় যেয়ে যা বুঝল, ওই পাঁচজনের গ্রুপের একটি মেয়েকে নাচতে নাচতে অন্য একটি যুবক নিজের দিকে টেনে নিয়েছিল, সাথে সাথেই মেয়েটি যুবকটিকে একটি সপাটে চড় মেরেছে। তাতেই তৈরি হয়েছে এই বিপত্তি। যুবকটি এই গ্রুপের কারোরই পরিচিত নয়। 

লম্বায় প্রায় ছফুট, ফর্সা গালটাতে আঙুলের দাগগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, চুলগুলো অবিন্যস্ত হয়ে পড়েছে, এলকোহলের প্রভাবে চোখদুটো খানিক রক্তাভ।

পাশে আস্তিন গুটিয়ে রাগী-রাগী মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটি খুব সম্ভবত যুবতীটির বয়ফ্রেন্ড। গ্রুপের বাকিদের মুখ দেখেও বোঝা যাচ্ছে তারাও অসভ্য ছেলেটাকে একহাত বুঝে নিতে চায় কিন্তু বাউন্সারদের জন্য সেই সুযোগ পাচ্ছে না। একটু পরেই একজন বাউন্সার ছেলেটাকে বাইরে বেরিয়ে যেতে বলার সাথে সাথেই ছেলেটা মাথা নীচু করে বেরিয়ে গেল। ওর থমথমে মুখটা দেখে সৌরর বেশ ভালোই লাগলো। ঠিক হয়েছে। নেশাগ্রস্ত মেয়ের সুযোগ নিতে যাওয়ার যোগ্য জবাব পেয়েছে। ভাবলো মেয়েটাকে একটু সাবাসি দিয়ে আসবে। কিন্তু পেছন ফিরে দেখলো ওদের দলটাও ধীরে ধীরে বেরিয়ে পড়ছে। এইধরণের উটকো ঝামেলার পর নাচের আগ্রহ হারানোটা স্বাভাবিক। সৌরও নিজের টেবিলে ফিরে এলো। অর্ধেকটা বিয়ার এখনো পড়ে আছে। গরম হয়ে গিয়েছে। সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিয়ে সৌর বিল কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল। 

এরপরের শনিবার পাবে ঢুকতে সৌরর খানিক দেরিই হয়ে গেল। অফিস থেকে বেরিয়েই বৃষ্টি। ছাতা নিয়ে বেরোয়নি। ক্যাব অবধি আসতে আসতেই অল্প ভিজে গেল। এই সামান্য বৃষ্টিতেই শহরের জায়গায় জায়গায় জল জমে গেছে। স্টেইন্ড গ্লাস ওর অফিস থেকে ক্যাবে পঞ্চাশ মিনিটের রাস্তা। আজ জ্যামের জন্য সেই রাস্তাই পেরোতে সময় লাগলো এক ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট। পাবে ঢুকেই ও ওর কোনার টেবিলে চলে এলো। রেগুলার কাস্টমার। তাই আলাদা করে অর্ডার দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনা। ওয়েটার ক্যানগুলো আনতে আনতে সৌর একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলো। ডিজে হাল্কা সাউন্ডে একটা রোমান্টিক গান বাজাচ্ছে। কাপলরা বেশ ঘনিষ্ঠভাবে একে অপরকে জড়িয়ে নাচ করছে। সিঙ্গেলরা কেও কেও নিজেদের টেবিলে বসে লালায়িত দৃষ্টিতে দৃশ্যটা উপভোগ করছে, আবার কেও কেও বিরক্তি প্রকাশ করছে ডিজের ওপর। হঠাৎ একটা কাপলের ওপর সৌরর চোখ আটকে গেল। আরে! এ তো সেই সাহসী মেয়েটাই। আগের দিন অসভ্যতা করার জন্য যে চড় মেরেছিল। আশেপাশে ওদের গ্রুপের আর কেও চোখে পড়ল না যদিও। সাথে নিশ্চয়ই বয়ফ্রেন্ড। ছেলেটার খালি পেছন দিকটাই দেখা যাচ্ছে। বেশ লম্বা। ব্ল্যাক গ্লসি শার্টের সাথে ডেনিম জিন্স। এই তো ওরা ঘুরছে। ধীরে ধীরে ছেলেটার মুখটা সৌরর দৃষ্টিগোচর হলো। আর সাথে সাথেই ও চমকে উঠলো। এটা তো সেই চড় খাওয়া ছেলেটাই। ছেলেটার একটা গালে মেয়েটার হাত। ধীরে ধীরে নিজের দিকে টেনে নিচ্ছে। বেশ আবেগঘন মুহুর্ত। বোধহয় ওরা কিস করতে চলেছে। একসপ্তাহ আগেও ছেলেটার গালে মেয়েটার হাত পড়েছিল। তবে আজকের সাথে তার তুলনা চলেনা। সৌর মুখ ঘুরিয়ে নিল। বিয়ারটা কি আজ একটু বেশিই তেতো লাগছে? মুখটা বিস্বাদ ঠেকছে কেন?  কয়েকদিন আগে কি একটা প্রসঙ্গে অফিসের বৃদ্ধ সিকিউরিটি গার্ড গৌরদা বলছিলেন, "বুঝলে সৌর, যুগ পাল্টাচ্ছে। সময়টা ভীষণ তাড়াতাড়ি বদলে যাচ্ছে। পুরনো সবকিছু বেমানান হয়ে পড়ছে। একটা গোটা জেনারেশন নিজেদের শেষ করার জন্য কেমন উঠে পড়ে লেগেছে দেখছ তো?" সৌরর মনে পড়ে গেলো। ও উঠে পড়ল। আজ আর বিয়ার খাওয়া হবে না। পাব থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে সৌরর চোখে পড়ল বিল কাউন্টারের এক পাশে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছেলেটাকে। একেই আগের দিন মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড বলে মনে হয়েছিল। সৌর আর দাঁড়ালো না। পাবের দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসতে আসতে শুনতে পেলো ডিজে নতুন গান চালিয়েছে, 'ফলক তক চল সাথ মেরে, ফলক তক চল সাথ চল....'। নিজেকে হঠাৎই বড্ড বেমানান মনে হল সৌরর।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929