আমাদের দেশ বা তার আশেপাশের দেশ যেরম বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল ইত্যাদি দেশে বিয়ের রীতিনীতি গুলো প্রায় একই। অর্থাৎ, বিয়ের পর মেয়েকে তার বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যেতে হয়। খেয়াল করলে দেখবেন এই বাপেরবাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি শব্দদুটোর মধ্যেও কেমন পুরুষদের সম্পত্তি-অধিকারের ব্যাপারটা ফুঁটে ওঠে। অর্থাৎ, নারীদের নিজের বাড়ির সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। বিয়ের আগে বাপের, বিয়ের পর স্বামীর বা শ্বশুরের। আমরা যদি পদবীর দিকটাও দেখি সেক্ষেত্রেও দেখবো বাবার সূত্রে পাওয়া পদবী বিয়ের পর পাল্টে স্বামীর সূত্রে পাওয়া পদবী হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, ব্যক্তিত্ত্ব বা আইডেন্টিটি বলে মেয়েদের আসলেই কিছু নেই। সমাজ এখন আগের চেয়ে অনেকটাই প্রগতিশীল। তবে সেটা মূলত বড়ো বড়ো শহর ও শহর সংলগ্ন অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ।
অনেকেই বলতে পারেন যে ছেলেরাও তো ঘরজামাই থাকে। অবশ্যই থাকে। তবে সেটা গোটা পুরুষসমাজের ঠিক কত অংশ বা যেই পুরুষরা মোটা অংকের অর্থ উপার্জন করেন তারা কি আদৌ ঘর জামাই থাকেন? তারা কি এই ঘরজামাই থাকাকে অপমান হিসেবে দেখেন না? আশা করি আপনিও উত্তরটা জানেন।
ছোটবেলা থেকে যে বাবা মায়ের আদরে মেয়ে বড়ো হলো, যে পরিবেশে সে অভ্যস্ত, কম্ফোর্টেবল, যে বাড়ির প্রতি তার একটা মায়া রয়েছে, সেই সবকিছু ছেড়ে তাকে সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা একটা পরিবেশে গিয়ে মানিয়ে নিতে হয়। নতুন বাড়ি, নতুন সংসার। প্রধানত ছেলেদের এই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়না। বিয়ের পর মেয়েরা যখন তার স্বামীকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যায় অর্থাৎ, জামাই যখন তার শ্বশুরবাড়ি যায়, জামাই সেখানে যে আদরটা পায়, তাকে আপ্যায়ন করার যে ইলাহী আয়োজন করা হয় সেটা কি মেয়েরা বিয়ের পর তার শ্বশুরবাড়িতে পায়? ভেবে দেখুন তো। ছেলেরা বা মেয়েরা বাড়িতে যেই পরিবেশে বেড়ে ওঠে, বিয়ের পর ছেলেদের সেই জীবনের খুব একটা হেরফের নাহলেও মেয়েদের জীবন অনেকটা পরিবর্তন হয়ে যায়।
যদি একটি ছেলে আর মেয়ে আত্মনির্ভর হয়ে বিয়ে করে, তবে বিয়ের পর সেই ছেলেটা সংসারে যতটা না কন্ট্রিবিউট করে থাকে, তার চেয়ে অনেক বেশি কন্ট্রিবিউট করে থাকে মেয়েরা। তাকে বাইরের সাথে বাড়ির প্রায় সবকিছুই সামলাতে হয়। সমাজের এই পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা গুলো আজও সমানভাবে বয়ে চলেছে আমাদের মানসিকতার মধ্যে দিয়ে। গ্রাজুয়েট, পোস্ট গ্রাজুয়েট এমনকি পিএচডি হোল্ডার ছেলেরাও এই পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা থেকে বেরোতে পারেনি। আজও প্রায় সব মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে ছেলেদের অন্যভাবে ও মেয়েদের অন্যভাবে মানুষ করা হয়। বাড়িতে ছেলেদের মূলত শেখানো হয় তাদের কাজ একটাই। অর্থ উপার্জন। বাড়িতে মেয়েদের এটা শিখিয়ে দেওয়া হয় তাদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু কাজ বরাদ্দ করেছে এই সমাজ। যেমন ঘরমোছা, জামাকাপড় কাচা, জামাকাপড় ইস্ত্রি করা, ঘরবাড়ি পরিষ্কার ও ফিটফাট রাখা, রান্নাবান্না করা, বাসন মাজা এবং বিয়ের পর স্বামীর হুকুমের তামিল করা। বাড়ির বউ এইসবকিছু ঠিকঠাক ভাবে করলেই সে একজন ভালো বৌমা, ভালো স্ত্রী হতে পারবে। শ্বশুর শাশুড়ির বা স্বামীর প্রশংসা পেতে তাকে সব কাজেই নিপুণ হতে হবে। মফস্বলে বা পল্লীর দিকে গেলে এখনও এটাই মুখে মুখে ফেরে মানুষের। সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। এইখানে এই গুণের কথাই বলা হয়েছে। মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজে অর্থ উপার্জন করাটা গুণ নয়। তাইতো হিন্দুরীতিতে বিয়ের পর পাত্রকে বলতে হয় “আমি আমার স্ত্রীর ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিলাম।”কথাটা কতটা পুরুষতান্ত্রিক আর নারীসমাজকে অপমান করছে এটা কজন ভেবে দেখেছেন? কিভাবে নারীসমাজকে শোষণ করা যায়, তাদের সাথে দাসীর মতো আচরণ করা যায় তার পুরো বন্দোবস্ত করে গেছে একটা বড়ো অংশের ব্রাহ্মণবাদী মানুষ। সমাজের মধ্যে এখনও একটা অংশের মানুষ নিজের ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজতে গিয়ে পড়াশুনা জানা, শিক্ষিতা কিন্তু ইন্ডিপেন্ডেন্ট নয় এরম পাত্রী খোঁজেন। কারণ এরম পাত্রীদের শোষণ করা সহজ। তাকে দিয়ে বাড়ির প্রায় সব কাজ করানো যায়। সেই ছেলের বাড়ি এটাই চায় স্বামী, শ্বশুরশাশুড়ির সেবা করা বা বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করাই সেই মেয়েটার জীবনের মূল লক্ষ্য হবে।
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও এই চিন্তভাবনা থেকে আজ আমরা পুরোপুরিভাবে সবাই বেরিয়ে আসতে পারিনি। শহরঅঞ্চলে এখনও এই প্র্যাকটিস হয়ে চলেছে। আগামী ৫০-১০০ বছরেও সম্পূর্ণভাবে এই প্রাকটিস বন্ধ হবে কিনা, জানিনা। যেই পরিবারে একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে আছে অথবা, যেই পরিবারে ছেলে আর তার বিবাহিত বউ আছে, সেই বাড়িতে কোনো না কোনোভাবে মেয়েরা শোষিত হচ্ছে। ছেলে আর মেয়ের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। আর সেটা এখনও হচ্ছে। একটি মেয়ে যদি শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে নিজের বাড়ির মতোই আদর যত্ন পাওয়ার আশা করে, স্বপ্ন দেখে সেখানে ভুল কোথায়? একটি ছেলে তার শাশুড়িমার কাছ থেকে যে আদরটা পায়, সেই একই আদরযত্ন কি মেয়েটা তার শাশুড়িমার কাছ থেকে প্রত্যাশা করতে পারেনা?