আজাদি-কা অমৃত্ মহোৎসব! এবং আম্বেদকার
কিনোক্ষ্যাপা
Nov. 24, 2024 | | views :284 | like:0 | share: 0 | comments :0
প্রথম দৃশ্য – স্বাধীনতার ৭৫ বছর উপলক্ষে দেশব্যাপী সাজো সাজো রব, পালিত হচ্ছে ‘আজাদি-কা অমৃত্ মহোৎসব’, বড় বড় ব্যানার, যেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবি যদিও ঢেকে গিয়েছে ৫৬-ইঞ্চি ছাতির আড়ালে। দ্বিতীয় দৃশ্য – নয় বছরের ছেলে ইন্দ্র-র শেষকৃত্য করছে তার বাবা; ইন্দ্র-র স্কুলের শিক্ষক তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে; ইন্দ্র-র অপরাধ ছিল সে জাতিতে নিচু হয়েও উঁচু জাতির শিক্ষকের জন্য রাখা জলের পাত্র ছুঁয়ে ফেলেছিল। ২০২২ সালের আগস্ট মাসের মন্তাজ্টা কিছুটা এইরকম। যখন জাতি-বৈষম্যের নির্মম শিকার হতে হয় সুরেখা ভোতমাঙ্গেদের, সাগর শেজওয়ালদের, কিংবা ইন্দ্রদের তখন একবিংশ শতক নিজের সমস্ত অত্যাধুনিকতাকে পাশে বসিয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। এই অভাগা দেশে ‘গরু’ হয়ে জন্মালেও হয়তো তাঁদের প্রাণরক্ষা হতো। কিন্তু এই মানুষগুলোর অপরাধ হলো তাঁদের জন্ম নিচু জাতের পরিবারে, যে পরিবার বংশপরম্পরায় এই জাতিগত নিপীড়ন বহন করে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে। তাঁদের অপরাধ হলো তাঁরা ‘অবর্ণ’, তাঁদের স্পর্শ করতে নেই; এমনকি তাঁদের ছায়াও মাড়াতে নেই; দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতে তাঁদের অপেক্ষা করতে হয় রাতের অন্ধকারের, যাতে তাঁরা নিজেদের ছায়া সমেত অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে পারেন এবং উঁচুজাতির মানুষরাও নিজেদের শুচিতা রক্ষা করতে পারেন। ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, এবং শূদ্র – এই চার বর্ণের মধ্যে ঠাঁই পাওয়ার সৌভাগ্য তাঁদের হয়নি। আর সৌভাগ্য হলেও তাঁদের সামাজিক অবস্থা নির্ভর করতো তাঁদের বর্ণের উপর। ব্রক্ষ্মার ‘পা’ থেকে উৎপন্ন হলে তার আবার কিসের অধিকার! তার একটাই কাজ ব্রক্ষ্মার ‘মুখ’, ‘বাহু’ ও ‘উরু’ থেকে উৎপন্ন হওয়া ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয় ও শূদ্রদের সেবা করা। আর এই স্তরবিন্যাস এতটাই ছোঁয়াচে যে এক শূদ্র আরেক শূদ্রের উপরেও নামিয়ে আনতে পারেন জাতিগত নিপীড়ন, যদি তিনি অপেক্ষাকৃত উঁচুজাতির শূদ্র হন। সময়ের সাথে এই সামাজিক ব্যাধি কমা তো দূরের কথা, বরং দেখা যাচ্ছে রাজনীতির ছত্রছায়ায় এই ব্যাধি যেন প্রতিদিন আরও বেড়েই চলেছে। আসুন, কিছু সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড্স ব্যুরো-র বার্ষিক প্রতিবেদন (২৯-এ অগাস্ট, ২০২২) অনুযায়ী এসসি ও এসটি-দের বিরুদ্ধে জাতিগত অপরাধ ২০২১ সালে যথাক্রমে ১.২% ও ৬.৪% বৃদ্ধি পেয়েছে। এসসি-দের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ঘটনার ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানে আছে উত্তর প্রদেশ (২৫.৮২%), রাজস্থান (১৪.৭%), এবং মধ্য প্রদেশে (১৪.১%)। এসটি-দের ক্ষেত্রে শীর্ষে আছে মধ্য প্রদেশ (২৯.৮%), রাজস্থান (২৪%), এবং ওড়িশা (৭.৬%)। নথিভুক্ত মোট অপরাধের মধ্যে মহিলাদের উপর নির্যাতনের সংখ্যাও যথেষ্ট উদ্বেগজনক; শুধুমাত্র ধর্ষণের শতকরা ভাগই হলো এসসি মহিলাদের ক্ষেত্রে ৭.৬৪% এবং এসটি মহিলাদের ১৫%। প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে ২০২১ সালের শেষ পর্যন্ত এসসি ও এসটি-দের বিরুদ্ধে যথাক্রমে নৃশংসতার মোট ৭০,৮১৮ ও ১২,১৫৯-গুলো মামলা তখনও তদন্তের অপেক্ষায়, যার মধ্যে আগের বছরের মামলাও ছিল। সেই বছর এসসি ও এসটি-দের বিরুদ্ধে যথাক্রমে নৃশংসতার মোট ২,৬৩,৫১২ ও ৪২,৫১২-টা মামলা আদালতে বিচারের জন্য এসেছিল, যার মধ্যে ৯৬.০% ও ৯৫.৪% মামলা বছরের শেষ পর্যন্ত বিচারাধীন অবস্থাতেই ছিল। ভারতীয় দণ্ডবিধি-র (আইপিসি) সাথে ‘এসসি ও এসটি (পিওএ) আইন’-এর অধীনে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার শতাংশ এসসি ও এসটি-দের জন্য যথাক্রমে ৩৬% ও ২৮.১%। বিগত বছরগুলোর প্রতিবেদনের দিকে তাকালেও খুব একটা আলাদা কিছু চোখে পড়বে না। সেই একই রাজ্যের নাম, ধর্ষণ-সহ অন্যান্য নৃশংস অপরাধের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা, তদন্তের অনীহা, ন্যায়বিচারের অভাব, শাস্তি প্রদানের বদলে অভিযুক্তদের বেকসুর খালাস বা জামিনে মুক্তি – এই প্যাটার্নটাই খুঁজে পাওয়া যাবে। আর এই পরিসংখ্যানের সবটাই নথিভুক্ত তথ্যের ভিত্তিতে। গণতন্ত্র বা গণমাধ্যম কোনোটাই তাদের নির্দিষ্ট শ্রেণী-গন্ডি ভেঙ্গে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে পৌঁছাতে পারেনি, এখনও। তাই এত বড় দেশের কোন অংশে কোন অঘটন যে জাতপাতের নামে ঘটে চলেছে তার হদিশ মেলা দুষ্কর। গড় হিসাবে প্রতিদিন প্রায় ৪ জন করে দলিত মহিলা ধর্ষিতা হয়ে চলেছেন। যে ‘নির্ভয়া’ কান্ড নিয়ে সারা দেশ তোলপার হয়েছিল, সেই বছরই সারা দেশে নথিভুক্ত তথ্য অনুযায়ী ১৫৭৪ জন দলিত মহিলা ধর্ষিতা ও ৬৫১ জন খুন হয়েছিলেন।
তবে শুধু পরিসংখ্যান দিয়ে পরিস্থিতির গভীরতা নির্ণয় সম্ভব নয়। অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে এসসি-এসটি-দের বিরুদ্ধে নৃশংসতার ঘটনা সচরাচর সংবাদমাধ্যমগুলোতে সম্প্রচারও করা হয় না, কারণ স্থানীয় স্তর থেকে শুরু করে জাতীয় স্তর পর্যন্ত প্রশাসন, সংবাদমাধ্যম সবকিছুই মূলত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দ্বারাই পরিচালিত। সুতরাং, সেখানে দলিতদের উপর সামাজিক নিপীড়ন, দলিতদের বঞ্চনার কাহিনী সর্বসমক্ষে প্রচারিত হবে এমনটা ভাবাও বোধহয় অন্যায়। তাও ২০০৬ সালে মহারাষ্ট্রের খৈরলানজী গ্রামে সুরেখা ভোতমাঙ্গে-র গোটা পরিবারের নৃশংস হত্যার ঘটনা সবাইকে নাড়িয়ে দেয়; সংবাদমাধ্যমও কিছুটা নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়।
সুরেখা ভোতমাঙ্গে ছিলেন একজন গরীব, দলিত মহিলা, জাতিতে ‘মাহার’, মহারাষ্ট্রের খৈরলানজি গ্রামে যেখানে পরিবারসমেত তিনি থাকতেন সেখানকার অন্যান্য জাতির নিরীখে যার স্থান অনেক নিচে। তাই বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা থেকে চাষের জল সবক্ষেত্রেই পঞ্চায়েত থেকে জুটত বঞ্চনা, নিপীড়ন; যেগুলোর মাত্রা চরমে উঠলে তিনি পুলিশের দ্বারস্থ হন সাহায্য চাইতে। কিন্তু নিচু জাত হয়ে সাহায্যের আবেদন! এতো সাহস হয় কিভাবে? তাই খেসারত দিতে হয় আত্মীয় পরিবারের এক সদস্যকে। আবার পুলিশ। এবার কিছু গ্রেপ্তারী। অভিযুক্তেরা অবশ্য সাথেসাথেই জামিন পেয়ে মুক্ত। এইবার আর কোনো সময় নষ্ট নয়। শিক্ষা দেওয়ার পালা; যেমন রামচন্দ্র দিয়েছিলেন শম্বুককে! উন্মত্ত অভিযুক্তেরা দলবল সমেত (সকলেই উচ্চবর্ণের গ্রামবাসী) ঝাঁপিয়ে পড়ে সুরেখা-র পরিবারের ওপর। সুরেখা, সুরেখা-র সতেরো বছরের মেয়ে প্রিয়াঙ্কা, আর সুরেখা-র ছেলেদুটোকে টানতে টানতে উঠোনে বের করা হয়। ছেলেদের বলা হয় মা আর বোনকে সবার সামনে ধর্ষণ করতে। না শোনায় তাদের যৌনাঙ্গ থেঁতলে দিয়ে তাদের মেরে ফেলা হয়। সুরেখা ও প্রিয়াঙ্কাকে গণধর্ষণ করা হয়, এবং পিটিয়ে হত্যা করা হয়। শোনা যায় তাঁদের প্রাণহীন মৃতদেহের উপরও ধর্ষণ চলেছিল অনেকক্ষণ। দিনটা ২৯শে সেপ্টেম্বর, সাল ২০০৬। তার নয় বছর পরেই বা পরিস্থিতি কিরকম? ২০১৫ সালের ১৬ই মে – বাবাসাহেব আম্বেদকারকে নিয়ে বাঁধা একটি গানের রিংটোন তার মোবাইলে বেজে ওঠে বলে ২৩ বছর বয়সী দলিত যুবক সাগর শেজওয়াল-কে মারধর ও পরে তার শরীরের উপর দিয়ে বাইক চালিয়ে দিয়ে নৃশংসভাবে খুন করা হলো তাকে। আরও সাত বছর পর তথাকথিত স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির কয়েকদিন আগে উঁচু জাতির শিক্ষকের জলের পাত্র ছুঁয়ে ফেলার ‘অপরাধ’-এ শিক্ষক পিটিয়ে খুন করে ফেললেন ৯ বছর বয়সী দলিত কিশোর ইন্দ্র-কে। ইন্দ্র-র লাশের উপর দিয়ে উদ্যাপিত হলো ‘আজাদি-কা অমৃত্ মহোৎসব’। আদৌ কোনো মাধ্যম দিয়েই কি এই হাজার হাজার বছরের সামাজিক পচনের গভীরতা নির্ণয় করা সম্ভব?
পুকুর, পাতকূয়ো, পানীয় জল, জমি, বিদ্যুৎ ইত্যাদির অধিকার থেকে আজও প্রত্যন্ত এলাকার দলিতরা বঞ্চিত। হরিয়ানার মত জায়গায়, যেখানে একদিকে বিশ্বায়নের রমরমা, সেরমই আরেকদিকে সে রাজ্যের প্রত্যন্ত গ্রামে দলিত বরকে সমস্যায় পড়তে হয় যদি তিনি ঘোড়ার পিঠে চড়ে বিয়ে করতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বছর কয়েক আগে হিসার জেলার দৌলতপুর গ্রামে এক ব্যক্তির হাত কেটে নেওয়া হয়। তাঁর অপরাধ ছিল তিনি উঁচুজাতের কোনো এক জমিদারের জলাধার থেকে জল খাওয়ার ‘সাহস’ দেখিয়েছিলেন। উঁচুজাতের কোনো পরিবারের মেয়ের সাথে নিচুজাতের কোনো ছেলের ভাব-ভালোবাসা অচিরেই ছেলেটির ‘খুন’ ডেকে আনে, এবং এই সত্যটা এতটাই প্রতিষ্ঠিত যে অন্যান্য কোনো কারণে দলিত খুন হলেও সেটা আড়াল করতে একটা প্রেম-ভাব-ভালোবাসার মিথ্যা দৃষ্টিকোণ জড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, যাতে সেই খুনটা সমাজে ‘স্বাভাবিক’ বা ‘বৈধ’ বলে গণ্য হয়; যাকে বলে – Honor killing। আর এই সমস্ত কিছুই ঘটে পুলিশ-প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতে। পুলিশের কাছে সাহায্য পাওয়া যাবে কিনা সেটাও নির্ধারণ করে দেবে সাহায্যপ্রার্থীর ‘জাত’। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এরকম কোনো অত্যাচারের ঘটনা নথিভুক্ত করতে গেলে বিরোধীপক্ষও একটা মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করে থাকে, এবং প্রায় প্রতিক্ষেত্রেই আক্রান্ত ব্যক্তি বা পরিবারের উপর চাপ সৃষ্টি করে তাঁদের বাধ্য করা হয় অভিযোগ প্রত্যাহার করতে। তাই “Scheduled Caste and Scheduled Tribe (Prevention of Atrocities) Act, 1989” আইনটাও বড়ই হাস্যকর হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষতঃ যেখানে আইন-রক্ষক ও ন্যায়দাতাদের মধ্যে থেকেই এই স্বৈরাচারী বর্ণচেতনা এতদিনেও দূর করা যায়নি। উল্টে তাঁরা নিচুজাতিকে পদদলিত করে রাখতে নিজেদের প্রশাসনিক ক্ষমতা অবলীলায় ব্যবহার করে থাকেন। অথচ, যে সামাজিক পার্থক্যকে ঘিরে এতকিছু, সেই সামাজিক পার্থক্য ও জাতপাতের শুচিতার প্রশ্ন কর্পূরের মত উবে যায় যখন উঁচুজাতির গ্রামবাসীরা নিচুজাতির ‘অস্পৃশ্য’ সুরেখা বা প্রিয়াঙ্কাদের অবলীলায় গণধর্ষণ করে খুন করতে পারে, সাগর বা ইন্দ্রদের পিটিয়ে হত্যা করতে পারে। এই জঘন্য জাতি-ব্যবস্থা সম্পর্কে বাবাসাহেব আম্বেদকার-এর করা মন্তব্যটা তাই আজকের দিনেও সমান, হয়তো বা আরও বেশী গুরুত্বপূর্ণ – “There cannot be a more degrading system of social organization than the caste system. It is the system that deadens paralyses and cripples the people from helpful activities.”
ভারতবর্ষের মূলধারার ইতিহাস-চর্চায় ভীমরাও বাবাসাহেব আম্বেদকর-কে কোনোদিনই সেইভাবে যথাযথ স্থান দেওয়া হয়নি। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আম্বেদকরকে একটি গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার এক অদৃশ্য অশুভ প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। তাই আম্বেদকর শুধু দলিতদের নেতা হয়ে রয়ে যান। আর প্রিভিলেজ্ড মানুষজনের কাছে তিনি ভারতের সংবিধানের রচয়িতা। জাতি-ব্যবস্থা, ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর যে সংগ্রাম, তাঁর যে সংস্কার-মুক্ত আধুনিক চিন্তাভাবনা ইত্যাদি স্বাভাবিকভাবেই ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী ক্ষমতাসীনদের রচনা করা ইতিহাসের নিচে পিষ্ট হয়ে এসেছে, ‘আম্বেদকর’ আর ‘সংবিধান’ শব্দদুটো একে অপরের সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এও যেন এক দুরভিসন্ধির পরিণাম। জীবনের অন্তিম পর্যায়ে কৌশলে তাঁকে সংবিধানের জনক বানিয়ে দেওয়া হলো, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম সংবিধানের ফাঁকফোকড়-কে ঘিরে ওনার একটা ঋণাত্মক মূল্যায়ন করতে পারে। এই পরিকল্পনার স্রষ্টা যাঁরা, তাঁদের দূরদৃষ্টির প্রশংসা না করে পারা যায় না। কারণ আম্বেদকরকে ঠিক যতটা কোণঠাসা করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, ঠিক ততটাই কোণঠাসা তিনি হয়েছেন, জীবদ্দশাতেও, এবং মৃত্যুর পরেও। আম্বেদকর নিজে যে এই সংবিধানে একেবারেই খুশী ছিলেন না সেটা ২-রা সেপ্টেম্বর, ১৯৫৩-তে, রাজ্যসভায় প্রদত্ত একটা ভাষণে স্পষ্টই বোঝা যায়। তিনি বলেন – “Now, Sir, we have inherited a tradition. People always keep saying to me: ‘Oh, you are the maker of the Constitution.’ My answer is I was a hack. What I was asked to do, I did much against my will.”। তাই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও যেখানে এই দেশ জাতপাতের ব্যাধিতে আক্রান্ত, সেখানে প্রয়োজন আছে সংবিধানের সংকীর্ণ বৃত্ত থেকে বেড়িয়ে এসে আম্বেদকরের এক পরিপূর্ণ মূল্যায়নের। কারণ, আম্বেদকর এমন একজন শিক্ষক, যিনি আমাদের প্রশ্ন করতে শেখান, যাবতীয় প্রাচীন (কু)সংস্কারের বিরুদ্ধে, সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ টিকে থাকা নিম্নবর্ণের মানুষের উপর উচ্চবর্ণের মানুষের একচেটিয়া শোষণের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে।
এই সামাজিক বৈষম্য ও তাকে ঘিরে এই অত্যাচারের কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে অবশ্যই গিয়ে পড়তে হবে হিন্দুশাস্ত্রের ফাঁকফোকরে। এই বৈষম্য কোনো একদিনে তৈরি হয়নি। হাজার হাজার বছর ধরে এই বৈষম্যকে লালন-পালন করা হয়েছে, আরও হৃষ্টপুষ্ট বানানো হয়েছে। তাই মাত্র কয়েক দশক পুরানো সংরক্ষণ নীতি, যে নীতির প্রয়োজনীয়তা ও প্রয়োগ নিয়ে আজও বিস্তর বিতর্ক হয়ে চলে, সেই নীতিও স্বাভাবিকভাবেই অপারগ এই বিরাট ফাঁক কে দূর করতে। হিন্দুশাস্ত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল ‘মনুস্মৃতি’ অনুযায়ী তাই কোনো শূদ্র যদি ভুল করেও ‘পবিত্র’ বেদমন্ত্র উচ্চারণ করে কিংবা শুনে ফেলে তাহলে তার জিভ ছিঁড়ে নেওয়া হবে, অথবা তার কান গলিত গরম সীসা ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া হবে। সুতরাং, পবিত্র বেদমন্ত্রকে যদি জ্ঞানলাভের প্রাচীনতম আধার হিসাবেই দেখি তাহলে এটা খুবই স্পষ্ট যে শুরু থেকেই সেই আধার সকলের জন্য নয়। শুরু থেকেই সেই আধার একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর জন্য তৈরি, যাতে শিক্ষা এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে আরেক শ্রেণীর উপর যুগের পর যুগ ধরে শোষণ চালানো যায় বিনা বাধায়। তাই চতুর্বর্ণের শুরুতেই যখন উদ্দেশ্য অসৎ, শুরুতেই যখন উদ্দেশ্য মৌলিক অধিকারগুলোর ক্ষেত্রে একটা বাধ্যতামূলক নির্ভরতার সম্পর্ক তৈরি করা এবং সেটাকে সময়ের সাথে বিভিন্ন রূপে লালন করা, ক্ষমতাশীল উচ্চবর্ণের কাছে ক্ষমতাহীন নিম্নবর্ণের বাধ্যতামূলক বশ্যতা স্বীকার করার এক ব্যবস্থা তৈরি করা – তখন এই অত্যাধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে অবশ্যই প্রয়োজন আছে সেই আম্বেদকারকে জানার, যিনি নব্বই বছরেরও বেশি সময় আগে ‘মনুস্মৃতি’ পুড়িয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে তৎকালীন ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
রক্ষণশীল সমাজের কাছে, ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের কাছে আম্বেদকার আজও এক বিরাট বড় চ্যালেঞ্জ। তাঁর “অ্যানিহিলেশন অফ কাস্ট” আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক। এই লেখাটি বক্তৃতার আকারে তিনি তৈরি করেছিলেন ১৯৩৬ সালে। “জাত-পাত তোড়ক মণ্ডল” নামক এক গোষ্ঠীর হয়ে তাঁর সেই বক্তব্য রাখার কথা ছিল, সমাজে বর্ণবৈষম্যের কু-প্রভাব গুলো তুলে ধরার জন্য। কিন্তু সেই বক্তব্যের ধার এতটাই ছিল যে সেটার খসড়া পড়ার পর র্যাডিক্যাল হিন্দুদের নিয়ে তৈরি সংস্কারপন্থী সেই গোষ্ঠীও শেষ পর্যন্ত এই বক্তব্য বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও সেই বক্তব্য একেবারে অব্যক্ত থাকেনি। আম্বেদকর নিজ উদ্যোগে সেটা ছাপিয়েছিলেন “অ্যানিহিলেশন অফ কাস্ট” নামে, এবং বিতরণ করেছিলেন। শাস্ত্রের লেখা কারও কাছে অন্য বার্তা বহন করলে সেটা শাস্ত্রের লেখার দোষ নয়, কারণ শাস্ত্র ও শাস্ত্রের লেখা চিরন্তন সত্য, অবিনশ্বর – এই বস্তাপচা যুক্তি দিয়ে বারেবারেই হিন্দুশাস্ত্র ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছে। তার উত্তরে আম্বেদকর “অ্যানিহিলেশন অফ কাস্ট”-এ লিখেছেন – “It is no use telling people that the shastras do not say what they are believed to say, if they are grammatically read or logically interpreted. What matters is how the shastras have been understood by people.” আরেকধরণের ভাঁওতাবাজী, যেটা প্রায়শই একটু কম রক্ষণশীলরা বর্ণাশ্রম প্রথার ভিত্তি রক্ষার জন্য বলে থাকেন, সেটা হল – বেদ অনুযায়ী এই প্রথা কর্মের ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করে, তাই মানুষের জন্ম তার বর্ণ নির্ধারণ করতে পারেনা। আপাতদৃষ্টিতে খুব প্রশংসনীয় দৃষ্টিভঙ্গি মনে হলেও, এর বাস্তব গ্রহণযোগ্যতাকে অকাট্য যুক্তিতে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন আম্বেদকর। তিনি জানতে চেয়েছিলেন – “How are you going to compel people who have acquired a higher status based on birth, without reference to their worth, to vacate that status? How are you going to compel people to recognize the status due to a man, in accordance to his worth, who is occupying a lower status based on his birth?”
এই প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি। তার একটা বড় কারণ – সদিচ্ছার অভাব। তাই সংরক্ষণ নীতি থাকা সত্ত্বেও, বহুক্ষেত্রে এই নীতির বাস্তব প্রয়োগ ও সেই প্রয়োগ থেকে প্রাপ্ত সুবিধার পরিমাণ শূন্য। সংরক্ষণ নীতির জন্য যোগ্য হতে গেলে একজন দলিতকে হাইস্কুলের গণ্ডি পেরোতে হবে। সেই হিসাবে এই সংরক্ষণ নীতির সুবিধা প্রতি চারজন দলিতের মধ্যে মাত্র একজনই পেতে পারে। বাকি তিনজনকে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক কারণে হাইস্কুল পেরোনার আগেই পেটের চিন্তা করতে হয়। তাই সংরক্ষণ নীতি আদপে ততটা কার্যকর হয়ে ওঠে না, যতটা তার ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা দাবি করেছিল। তবে যেটা চলে, সেটা হলো এই নীতি কে নিয়ে দর-কষাকষির রাজনীতি। পরিণাম – “যারে তুমি নীচে ফেল, সে তোমারে টানিবে যে নীচে / পশ্চাতে রেখেছো যারে, সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে”। একদা আম্বেদকরও বলেছিলেন – “If the fundamental rights are opposed by the community, no Law, no Parliament, no Judiciary can guarantee them in the real sense of the word.”। এই কথাটা আজও সমান গুরুত্বপূর্ণ, যতটা সেদিন ছিল।