বেআইনি জ্যোতিষ সম্মেলন

সন্তোষ শর্মা


Nov. 16, 2024 | | views :843 | like:49 | share: 17 | comments :0

ভারতীয় আইনে জ্যোতিষ-শাস্ত্রের বা তন্ত্র-শাস্ত্রের কোনও স্বীকৃতি নেই। জ্যোতিষী বা তান্ত্রিক কোনও আইন স্বীকৃত পেশা নয়। এমনকি, জ্যোতিষ-শাস্ত্রের বা তন্ত্র-শাস্ত্রের চর্চা ও প্রচার ‘দ্য ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিস অ্যাক্ট, ১৯৫৪’- অনুযায়ী নিষিদ্ধ। অর্থাৎ অ্যাক্ট ১৯৫৪ অনুযায়ী, জ্যোতিষ বা তন্ত্রমন্ত্র চর্চা ও প্রচার করা বেআইনি। এছাড়া ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ট্যাক্স অন প্রফেশন,  ট্রেড, কলিং অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৭৯ অনুযায়ী জ্যোতিষ বা তান্ত্রিক পেশা স্মাগলার এবং খুন করা পেশার মতই বেআইনি, তাই সরকারী অডিটোরিয়াম বা প্রেক্ষাগৃহে বেআইনি এই পেশাদারদের সম্মেলন করতে দেওয়াটাও বেআইনি। দেশের যে কোনও স্থানে জ্যোতিষীদের বা তান্ত্রিকদের সম্মেলনের আয়োজন করাও বেআইনি। কিন্তু আজও  জ্যোতিষী- তান্ত্রিকের লোকঠকানো বে-আইনী ও বুজরুকির ব্যবসা আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চলছে। জ্যোতিষী- তান্ত্রিকের এই প্রতারক চক্র আবার সম্মেলনের আয়োজন করছে। এর পরেও ধান্ধাবাজ, প্রতারক এই জ্যোতিষী- তান্ত্রিকদের মনের মধ্যে একটি ভয় সব সময় লেগে থাকেই। সেই ভয়ের নাম ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’। কারণ, এই যুক্তিবাদী সমিতি’র জন্য প্রতারক জ্যোতিষীদের ও তান্ত্রিকদের রাতের ঘুম উড়ে গেছে। তাই এঁরা কোথাও সম্মেলন করার আগেও গ্রহ-রত্ন, তাবিচ, কবচ, মন্ত্রতন্ত্র ইত্যাদিতে বিশ্বাস হারিয়ে পুলিশের উপর ভরসা রাখেন। আজ এমনই একটি ঘটনা লিখছি।   

সোমবার ১৩ জানুয়ারী ২০২০ 

পুরুলিয়া জেলা থেকে প্রতি সোমবার ও  বৃস্পতিবার প্রকাশিত সংবাদপত্র ‘পুরুলিয়া দর্পণ’ –এ জ্যোতিষীদের সম্মেলনের একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। ১৩ জানুয়ারী প্রকাশিত ‘পুরুলিয়া দর্পণ’ থেকে আমরা জানতে পারি একটি জ্যোতিষ সংগঠনের ডাকে পুরুলিয়ার নিস্তারিণী মহিলা কলেজ -এ  জ্যোতিষ সম্মেলন হতে চলেছে। বিজ্ঞাপনটি এখানে তুলে ধরছি।

  অনুষ্ঠানের স্থান পরিবর্তন

 রবীন্দ্রকাডেমির অ্যানুয়াল ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অ্যান্ড কনভোকেসন-২০২০ অনুষ্ঠিত হতে চলেছে আগামী ১৮ই জানুয়ারী ( শনিবার) নিস্তারিণী কলেজের অডিটোরিয়ামে। 

দেশ বিদেশের খ্যাতনামা জ্যোতিষী, বাস্তুবিদ, তান্ত্রিক, সাধু ও মহাপুরুষগণের উপস্থিতিতে এক বিরল অনুষ্ঠানের সাক্ষী হতে চলেছে পুরুলিয়া। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য প্রবেশপত্র  সংগ্রহ করুন।

 যোগাযোগ

 সাউথ কোলকাতা অ্যাসট্রলজি অ্যান্ড বাস্তু সায়েন্স একাডেমি

 পুরুলিয়া শাখা

জ্যোতিষ সম্মেলনের এই বিজ্ঞাপন দেখার পরেই আমরা ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’ থেকে সিদ্ধান্ত নিই এই সম্মেলনের বিরুদ্ধে  পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার। কারণ, যে জ্যোতিষ বা তান্ত্রিক পেশার কোনও আইনি স্বীকৃতি নেই। সেই বেআইনি পেশার সঙ্গে জড়িত জ্যোতিষীদের বা তান্ত্রিকদের এবং তাঁদের সংগঠনের সম্মেলনও এক কথায় বেআইনি। তাই পুরুলিয়ার নিস্তারিণী মহিলা কলেজ-এ  জ্যোতিষ সম্মেলন বন্ধ করার জন্য পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে আমরা যুক্তিবাদীরা অবশ্যই দাবি জানাব। 

 বৃহস্পতিবার ১৬ জানুয়ারি ২০২০

১৩ জানুয়ারীর ‘পুরুলিয়া দর্পণ’–এ প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত জ্যোতিষ ও বাস্তুশাস্ত্রের সম্নেলন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ১৮ই জানুয়ারী নিস্তারিণী কলেজের অডিটোরিয়ামে। তাই যুক্তিবাদী সমিতি সিদ্ধান্ত নেয়, এই বেআইনি জ্যোতিষ সম্মেলনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়ার। কেন এই অভিযোগ ? এর উত্তরে শুক্রবার ২০ ডিসেম্বর, ২০০২-এ ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় প্রকাশিত একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর তুলে ধরছি।

   আনন্দবাজার পত্রিকা

 ২০ ডিসেম্বর, ২০০২

পেশাই নয় জ্যোতিষ, বৃত্তিকর দিতে গিয়ে জানলেন জ্যোতিষী

 অভিজিৎ ঘোষাল

 আইন মানা নাগরিক হিসাবে বৃত্তিকর দিতে গিয়ে তিনি জানলেন, জ্যোতিষচর্চা এই রাজ্যে পেশা হিসাবেই গণ্য নয়। হতবাক তিনি। কারণ, দেশের মানবসম্পদমন্ত্রী মাত্র কিছুদিন জ্যোতিশাস্ত্রকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের আওতায় এনেছেন। অথচ তাঁর কর দেওয়ার আবেদন নাচক করে বৃত্তিকর দফতর বলেছে, জ্যোতিষশাস্ত্রকে পেশা হিসেবে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এই চর্চা দেশের আইন পরিপন্থী। ওই  ‘অপরাধ’-এর জন্য জেল ও জরিমানা দুই-ই হতে পারে।

দেশে মনুবাদের ক্রমশ জোরালো হাওয়া উপেক্ষা করে বৃত্তিকর আধিকারিক অশোককুমার দাস-এর নজিরবিহীন নির্দেশে যা বলা হয়েছে, তা বস্তুত জ্যোতিষচর্চা নিয়ে বিতর্কে এক নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। অশোক বাবু লিখেছেন,  বৃত্তিকর দেওয়ার আবেদন অনুমোদনের সময় সেটা সংশ্লিষ্ট সমাজে স্বীকৃত আইনসিদ্ধ কিনা সেটা প্রথম ও প্রধান বিবেচ্য।

 তাঁর মতে এই পরীক্ষাতেই জ্যোতিষশাস্ত্র ডাহা ফেল।

 তাঁর নির্দেশে অশোকবাবু লিখেছেন, ভারতীয় আইনে জ্যোতিষশাস্ত্রের কোন স্বীকৃতি নেই। এমনকি, এর চর্চা ও প্রচার ১৯৫৪ সালের ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিস অ্যাক্ট অনুযায়ী নিষিদ্ধ। ফলে কনসালটেন্ট বা উপদেষ্টা হিসাবে আবেদন করলেও তাঁর পেশা আইনত গ্রাহ্য নয় - বলে ওই জ্যোতিষীকে ফিরিয়ে দিয়েছেন অশোক বাবু।

 যার বিরুদ্ধে এই রায়, বালিগঞ্জের সেই জ্যোতিষী মণিশংকর দাশগুপ্ত মুখ খুলে বিতর্কে ইন্ধন যোগাতে নারাজ। তাঁর সাফ কথা, কর দিতে ইচ্ছুক নাগরিকের কাছ থেকে দেউলিয়া সরকার যদি কর নিতে না -চায়, তাহলে তাঁর কিছু বলার নেই। তবে যে-বৃত্তি তাঁকে আয়কর দিতে বাধা দেয় না,  সেই বৃত্তিকে পেশার মর্যাদা দিতে রাজ্য সরকারের বাধা কোথায়? নির্দেশ হাতে পাওয়ার কয়েক সপ্তাহের পরেও সেটা তাঁর মাথায় ঢুকছে না। তবে তিনি স্বীকার করেছেন জ্যোতিষশাস্ত্রে প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত উত্তর কলকাতা অ্যাস্ট্রলজিক্যাল রিসার্চ প্রজেক্টের যে-সার্টিফিকেট তিনি বৃত্তিকর দফতরে পেশ করেছিলেন, তার আইনি স্বীকৃতি নেই বলে তাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন অশোকবাবু। মণিশংকরবাবুর বক্তব্য, তাঁদের পেশায় ‘লাইসেন্সসিয়েট সার্টিফিকেট’- এর প্রচলন নেই।

যে পেশার ওপর বহু শিক্ষিত মানুষের আস্থা আছে, সেই জ্যোতিষচর্চাকে কেন তিনি এভাবে নস্যাৎ করলেন ? গোটা বিষয়টি নিয়ে অশোকবাবু মুখে কুলুপ  আঁটলেও তাঁর নির্দেশেই পরিষ্কার তাঁর যুক্তি। ১৯৫৪ সালের ওই আইনে দেশের সর্বোচ্চ আইনসভার অর্থাৎ সংসদ এই পেশাকে এইভাবে বর্ণনা করেছে, পেশাটি অনৈতিক, অবাঞ্চিত, বেআইনি, মানুষের সুস্বাস্থ্যের ক্ষতিকারক ও মনুষ্য সভ্যতার পক্ষে হানিকারক।

 বছর পয়তাল্লিশের মণিশংকরবাবু ১০-১১ বছর ধরে মানুষের ভাগ্যগণনাকেই তাঁর জীবিকা করেছেন। মণিশংকরবাবু জানিয়েছেন, কোনও অলঙ্কার বা গ্রহরত্নের দোকানে বসে জ্যোতিষচর্চা করেন না তিনি। ফলে ভাগ্যগণনা ছাড়া অন্য কোনও স্বার্থ নেই তাঁর। কলকাতায় তো বটেই, দিল্লিতেও তাঁর বেশ ভাল পসার। বিদেশেও তাঁর কিছু গুণমুগ্ধ আছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। তবে দু’দিন টানা দেড় ঘণ্টা ধরে জ্যোতিষশাস্ত্র কী ও কেন, বৃত্তিকর আধিকারিকদের সেটা বোঝাতে যে ব্যর্থ হয়েছেন, তা স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি। 

 এই খবর থেকে দিনের আলোর মত এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, যে জ্যোতিষ পেশার কোনও আইনি স্বীকৃতি নেই। এই বেআইনি পেশায় বৃত্তিকর নেওয়া হয় না। বেআইনি পেশার সঙ্গে জড়িত জ্যোতিষীদের বা তাঁদের সংগঠনের সম্মেলনও এক কথায় বেআইনি। এমন অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কী করে একটি জ্যোতিষ সংগঠনকে নিস্তারিণী মহিলা কলেজের অডিটোরিয়ামকে জ্যোতিষ সম্মেলন করার জন্য ভাড়া দেওয়া হল ? বেআইনী এই জ্যোতিষ সম্মেলন বন্ধের দাবিতে যুক্তিবাদী সমিতি’র পুরুলিয়ার জেলা সম্পাদক মধুসূদন মাহাত, জেলা শাসক ও কলেজের প্রিন্সিপালকে চিঠি লেখেন। সেই চিঠি পাঠকের সামনে তুলে ধরছি।

 




প্রতিলিপি  

প্রিন্সিপাল                                                                                    নিস্তারিণী মহিলা কলেজ

বিষয়ঃ জ্যোতিষ বুজরুকদের সম্মেলন বন্ধ করার দাবি।

 

 মহাশয়া,

 আমরা অর্থাৎ ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র সদস্যরা সংবাদপত্র ‘পুরুলিয়া দর্পণ’  ( তারিখ - ১৩ জানুয়ারী, ২০২০ ) থেকে জানতে পারি যে, আপনার কলেজের অডিটোরিয়ামে জ্যোতিষীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১৮ জানুয়ারী, ২০২০, শনিবার।  তাই আপনার অবগতির জন্য জানাই যে, দ্য ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিস ( অবজেকসনেবল এডভারটাইজমেন্ট ) অ্যাক্ট, ১৯৫৪ আইন অনুযায়ী, জ্যোতিষ শাস্ত্রের চর্চা ও প্রচার করা বেআইনি। এছাড়া ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ট্যাক্স অন প্রফেশন,  ট্রেড, কলিং অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৭৯ অনুযায়ী ‘জ্যোতিষ’ পেশা হিসেবে গণ্য নয়, যেমন পেশাই নয় ‘খুন করা’ বা  ‘স্মাগলিং’। এছাড়া জ্যোতিষ শিক্ষার কোন বিধিবদ্ধ স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানও ভারতে নেই। জ্যোতিষ একটি অবিজ্ঞান বা বুজরুকি। তাই সরকারী অডিটোরিয়ামে বেআইনি পেশাদার বা বুজরুকদের সম্মেলন করতে দেওয়াটাও বেআইনি।

তাই আপনার প্রতি আমাদের তথা ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’ পুরুলিয়া জেলা শাখার সদস্যদের অনুরোধ দয়া করে জ্যোতিষের মত বেআইনি, নিষিদ্ধ, অবাঞ্ছিত, অনৈতিক এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক পেশাদার বা চর্চাকারীদের সম্মেলনের জন্য সরকারী অডিটোরিয়াম ভাড়া বাতিল করে বাধিত করবেন।

 

 

 

বিনীত

 মধুসূদন মাহাত,

 সম্পাদক

 পুরুলিয়া জেলা শাখা

 ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি 

 প্রতিলিপি –

 ১) জেলাশাসক, পুরুলিয়া

 মধুসূদন মাহাত এই চিঠিটি আমাকেও ওয়াটসঅ্যাপে পাঠানোর পর ফোন করে বললেন, “ সরকারী কলেজের অডিটরিয়ামে জ্যোতিষী নামক বুজরুকদের সম্মেলন বন্ধ করার দাবি জানিয়ে ঐ কলেজে আমরা গিয়েছিলাম। কিন্তু ঐদিন কলেজ বন্ধ থাকায় অভিযোগপত্র জমা দেওয়া যায়নি। কাল সকালে আবার যাবো। ” আমি বললাম, “ ঠিক আছে। নিস্তারিণী মহিলা কলেজের অডিটোরিয়ামে বেআইনি জ্যোতিষ সম্মেলন বন্ধের দাবি জানানোর পর প্রিন্সিপালের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলে আমাকে জানাও। আমি এই খবরটি মিডিয়াতে প্রকাশিত করার চেষ্টা করবো। ”

শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি ২০২০

 আজ আবার মধুসূদন মাহাত ও যুক্তিবাদী সমিতি’র উপদেষ্টা জয়ন্ত দাস ঐ সরকারী কলেজে যান। এদিন কলেজ খোলা থাকলেও প্রিন্সিপাল ডঃ ইন্দ্রানী দেবকে কলেজ পাওয়া যায়নি। এরপর কলেজ থেকেই ফোন নং নিয়ে প্রিন্সিপালকে ফোনে ধরেন জয়ন্তবাবু। জয়ন্তবাবু বলেন, “ আপনার একটি চিঠি রয়েছে। কিন্তু রিসিভ করার কেউই নেই। একটু ফোন করে বলে দিন যেন চিঠিটা রিসিভ করে নিক। ”  এরপর প্রিন্সিপাল বলে দেওয়াতে চিঠিটা একজন রিসিভ করেন। 

এরপর যুক্তিবাদী সমিতি’র তরফ থেকে মধুসূদন নিজে কলেজের প্রিন্সিপালকে ফোন করে প্রশ্ন করলেন, “ যেখানে জ্যোতিষ পেশা বেআইনি, সেখানে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত জ্যোতিষীদের সরকারি কলেজের কলেজের অডিটোরিয়াম কী করে ভাড়া দেওয়া হল?  যুক্তিবাদী সমিতি’র তরফ থেকে ওই অডিটোরিয়ামে বেআইনি জ্যোতিষ সম্মেলন বন্ধের দাবি জানানো হচ্ছে। চিঠিতে আমরা জানিয়েছি, যেহেতু দ্য ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিজ ( অবজেকসনেবল এডভারটাইজমেন্ট ) অ্যাক্ট, ১৯৫৪ অনুসারে জ্যোতিষ চর্চা ও প্রচার করা বেআইনি। এছাড়া ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রোফেসন এন্ড ট্যাক্স অনুযায়ী জ্যোতিষ পেশা স্মাগলার এবং খুন করা পেশার মতই বেআইনি, তাই সরকারী অডিটোরিয়াম বা প্রেক্ষাগৃহে বেআইনি পেশাদারদের সম্মেলন করতে দেওয়াটা বেআইনি। জ্যোতিষীদের সম্মেলন করতে দিলে আগামী দিনে হয়তো পতিতা, স্মাগলার, খুনিরাও সরকারী অডিটোরিয়াম ভাড়া নেবে। ”

 এই শুনে প্রিন্সিপাল জানালেন, “ জ্যোতিষ পেশা বেআইনি নয়। জ্যোতিষ পেশা বেআইনি হলে জ্যোতিষীরা চেম্বার খুলে বসে থাকতে পারতেন না। যদি জ্যোতিষ চর্চা বেআইনি হয়, তাহলে জ্যোতিষীদের পুলিশে ধরত। যদি জ্যোতিষ পেশা বেআইনি হয়, তবে জ্যোতিষীদের এত রমরমা হত না। ” এদিকে তিনি নিজেকে জ্যোতিষশাস্ত্রের বিরোধী ব্যক্তি ও নিজেকে একজন বিজ্ঞান মঞ্চের সক্রিয়কর্মী দাবি করেন।

 বাহ কেয়া বাত! 

 এদিকে নিস্তারিণী মহিলা কলেজের অডিটোরিয়ামে বেআইনি জ্যোতিষ সম্মেলন বন্ধের দাবি করে যুক্তিবাদী সমিতি কলেজের প্রিন্সিপাল ও জেলাশাসককে পাঠানো চিঠির উপর ভিত্তি করে দৈনিক ‘একদিন’ পত্রিকার সাংবাদিক কৃশানু দে’কে দিলাম। এদিকে যুক্তিবাদী সমিতি’র চিঠির প্রতিলিপি সোশাল মিডিয়া ও ফেসবুকে পোস্ট করে দেওয়ায়, তা কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাইরাল হয়ে যায়।

  শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২০

 সকালে স্মার্ট ফোনের ইন্টারনেট অন করে আজ প্রকাশিত ‘একদিন’-এর ই-পেপারে সরকারি কলেজের অডিটোরিয়ামে বেআইনি জ্যোতিষ সম্মেলন বন্ধের দাবি নিয়ে খবরটি পড়ছিলাম। খবরটি হল --

 

 একদিন

 ১৮ জানুয়ারি ২০২০

 জ্যোতিষচর্চায় কলেজে বিতর্ক 

 নিজস্ব প্রতিনিধি ঃ পুরুলিয়ার এক মহিলা কলেজের প্রেক্ষাগৃহে জ্যোতিষ চর্চার আয়োজন করা নিয়ে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। এই অভিযোগে শুক্রবার কলেজ কর্তিপক্ষকে লিখিত অভিযোগ জানাল ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র পুরুলিয়া জেলা শাখা। আজ অর্থাৎ ওই প্রেক্ষাগৃহে জ্যোতিষ চর্চার অনুষ্ঠান হওয়ার কথা রয়েছে। সমিতি প্রশ্ন তুলেছে, কলেজের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানে কিভাবে জ্যোতিষ চর্চার মতো বেআইনি অনুষ্ঠান  হতে পারে। সংগঠনের জেলা সম্পাদক মধুসূদন মাহাত-র তরফে লিখিত এই আবেদন কলেজ কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে, ‘ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিস অবজেকসনেবল অ্যাডভারটাইজমেন্ট আইন ১৯৫৪’ অনুয়ায়ী জ্যোতিষ শাস্ত্র চর্চা এবং প্রচার করা বেআইনি।  

একটু পরে পুরুলিয়া থেকে মধুসূদন ফোন করে বললেন, “ সরকারি কলেজের অডিটোরিয়ামে বেআইনি জ্যোতিষ সম্মেলন বন্ধের দাবি করে আমার লেখা চিঠির কথা জ্যোতিষীদের কানে পৌঁছে গেছে। সম্মেলন শুরু করার আগেই জ্যোতিষীরা আতঙ্কিত ও চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। তাঁদের চিন্তার কারণ, আমরা যুক্তিবাদীরা ওই জ্যোতিষ সম্মেলনে হাঙ্গামা করতে পারি। যুক্তিবাদী সমিতি’র নেতার চ্যালেঞ্জ জানিয়ে লণ্ডভণ্ড করে না দেয়। এই ভয়ে জ্যোতিষীদের সংগঠক সম্ভবত পুরুলিয়ার মফঃস্বল থানার ওসি সঞ্জয়কুমার চক্রবর্তীর স্মরণাপন্ন হয়েছেন। এরপরই পুরুলিয়ার মফঃস্বল থানার ওসি তাঁর সিভিক ভল্যান্টিয়ারের মাধ্যমে সকাল ১১ টার সময় জ্যোতিষ বিষয়ে আলোচনা এবং আমার সঙ্গে পরিচয় করার তাগিদে থানায় ডেকে পাঠিয়েছে। ”

 

 মধুসূদনের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। হেসে বললাম, “ জ্যোতিষীদের একি দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা। যে জ্যোতিষী তাঁর গ্রাহকের যে কোনও সমস্যার সমাধান করতে গ্রহ-রত্ন, পাথর, তাবিজ, কবজ, মাদুলি ইত্যাদি দিয়ে থাকে। আর যখন যুক্তিবাদী সমিতি’র সংকট ঘাড়ে চেপে ধরে তখন আবার এই জ্যোতিষীরাই গ্রহ-রত্ন,পাথর, তাবিজ, কবজ ইত্যাদির ওপর বিশ্বাস হারিয়ে পুলিশের সাহায্য চায়! যুক্তিবাদী সমিতি’কে আটকাতে শেষ পর্যন্ত পুলিশের সাহায্য! হায় রে প্রতারক জ্যোতিষীরা। এই জনই আমার যুক্তিবাদীরা বুক ঠুকে বলে থাকি, “ যে যত বড় জ্যোতিষী সে ততো বড় প্রতারক। ”

 

মধুসূদন বললেন, “জ্যোতিষীরা কেউ-ই জ্যোতিষ শাস্ত্রে তিল-মাত্র বিশ্বাস করে না। জ্যোতিষীরা তাঁদের জীবনের কোন সমস্যার সমাধানের জন্য গ্রহ-রত্ন ধারণ করে না। অসুখ হলে ডাক্তার দেখায়।  মামলা হলে উকিল রাখেন। এমনকি ভাগ্যের উপর নির্ভর না করে খদ্দের ধরতে পত্র- পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়। কিন্তু লোক ঠকানোর জন্য বুজরুকি রূপ ধারণ করে থাকা এই জ্যোতিষীরা হাতের আঙ্গুলগুলিতে, গলায় গ্রহ-রত্ন, তাবিচ, কবচ ইত্যাদি ধারণ করে থাকেন। কিন্তু এইসব হিজিবিজি জিনিসে এই জ্যোতিষীদের বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। ”

 আমি বললাম, “জ্যোতিষ সম্মেলন নিয়ে আলোচনা করার জন্য যখন থানার ওসি ডেকে পাঠিয়েছেন, তোমরা অবশই যাও। এটা আমাদের কাছে একটা সুবর্ণ সুযোগ। পুলিকেও এটা  বোঝানো যাবে, যে জ্যোতিষ পেশার কোনও আইনি স্বীকৃতি নেই। এই বেআইনি পেশায় বৃত্তিকর নেওয়া হয় না। বেআইনি পেশার সঙ্গে জড়িত জ্যোতিষীদের বা তাঁদের সংগঠনের সম্মেলনও এক কথায় বেআইনি। পুলিশের সঙ্গে দেখা করার পর আমাকে সবকিছু জানাবে। ”

 এদিকে আমার দুষ্টুবুদ্ধি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। ১৩ জানুয়ারী ‘পুরুলিয়া দর্পণ’-এ প্রকাশিত বিজ্ঞাপন থেকে জানতে পারি একটি জ্যোতিষ সংগঠনের ডাকে আজ পুরুলিয়ার নিস্তারিনী মহিলা কলেজে জ্যোতিষ সম্মেলন হতে চলেছে। তাই একটু খুঁচিয়ে দেখার জন্য ওই বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত মোবাইল নম্বরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সংগঠনের সভাপতি অভিজ্ঞান আচার্যকে ফোন করলাম। আমি প্রশ্ন করলাম, “ ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র তরফ থেকে আপনাদের বেআইনি সম্মেলন বন্ধ করার জন্য পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে দাবি জানানো হয়েছে। সমিতি’র জেলা সম্পাদক মধুসূদন মাহাত-র দাবি, ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিস (অবজেকসনেবল এডভারটাইজমেন্ট) অ্যাক্ট, ১৯৫৪ আইন অনুযায়ী জ্যোতিষ শাস্ত্রের চর্চা ও প্রচার করা বে-আইনি। এরপরেও জ্যোতিষ সম্মেলন কি করে আয়োজিত হচ্ছে ? ”

 আমার প্রশ্ন শেষ হবার আগেই আচার্যজী রেগে অগ্নিশর্মা।  “ জ্যোতিষ বেআইনি নয়। যদি ক্ষমতা থাকে তাহলে আমাদের সম্মেলন বন্ধ করে দেখাক ওঁরা ? ” এই বলে উনি ফোন কেটে দিলেন।

 

প্রায় দু’ঘণ্টা পরে মধুসূদন আবার আমাকে ফোন করে বললেন, “ আমি ও জয়ন্তদা থানায় গিয়েছিলাম। ওসি জ্যোতিষ নিয়ে আলোচনা করেন। ওসি কোনও সময়  জ্যোতিষের পক্ষে, কোনও সময় বিপক্ষে কথা বলেন। এরপর তিনি আমাদের কাছে জানতে চান ওই জ্যোতিষ সম্মলনে আমাদের যুক্তিবাদী সমিতি’র কোনও বিক্ষোভ কর্মসূচি রয়েছে কি না ? আমরা জানাই, আমাদের কোন বিক্ষোভ কর্মসূচি নেই, ব্যাপারটা আমরা প্রশাসনের মধ্য দিয়েই করতে চাই। এরপরেই দেখলাম ওসি জ্যোতিষ সম্মেলনের আয়োজকদের ফোন করে আশ্বস্ত করলেন, তাঁদের ভয়ের কিছু নেই, যুক্তিবাদীরা হাঙ্গামা করবে না। এর ফলে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল জ্যোতিষীরা যুক্তিবাদী সমিতি’কে ভয় করেছিল। তাই ভাগ্য, কুষ্ঠি, গ্রহ-রত্ন,আংটি, মাদুলির ইত্যাদির উপর বিশ্বাস হারিয়ে, শেষ পর্যন্ত পুলিশের উপর ভরসা রেখেছিল। জেলাশাসক ওসিকে তদন্ত করতে বলেছেন, এই দাবিটা ওসি  আসলে মিথ্যা বলেছিলেন। আসল সত্যিটা হল, জ্যোতিষীরা সম্ভবত টাকার বিনিময়ে ওসিকে বশে এনেছিলেন নিজেদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতেই।”

 আমি বললাম, “ ভাবতে অবাক লাগছে, বেআইনি পেশার সঙ্গে জড়িত জ্যোতিষীদের সরকারি সভাগারে সম্মেলন বন্ধ করার পরিবর্তে পুলিশ যুক্তিবাদীদের থানায় ডেকে পাঠাচ্ছে। একই সঙ্গে শুধু মাত্র টাকার বিনিময়ে এক প্রিন্সিপাল জ্যোতিষকে আইনি বলে দাবি করেছে। এঁরা কোন শিক্ষায় শিক্ষিত, তার জবাব সময় দেবে। কিন্তু জ্যোতিষীদের বেআইনি সম্মেলন বন্ধ করার জন্য আমরা যুক্তিবাদীরা যে বিশাল কাজ করেছি, তা নতুন প্রজন্মের কাছে একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে।”

সন্তোষ শর্মা

সংযুক্ত সম্পাদক

 ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি

 ‌ব্যারাকপুর, কলকাতা - ১২২

 মোবাইল : ৯৩৩০৪৫১৯৭৭

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929