এখনও গ্রাম বাংলার মানুষ থেকে শুরু করে শহরাঞ্চলে অনেক মানুষই আছেন, যারা ম্যাজিসিয়ানের জাদু দেখানোটাকে তন্ত্র, মন্ত্র ঈশ্বরের শক্তি এবং ভুতের অস্তিত্বের সঙ্গে বিশ্বাস করেন। অনেকেই মনে করেন ম্যাজিসিয়ানের হাতে থাকা কালো ছোটো লাঠি বা দন্ডটাই তার জাদুবিদ্যার উৎস। আসলে ম্যাজিক কোন তন্ত্র - মন্ত্র, ঈশ্বর বা ভূত-প্রেতের কারিগরি শিক্ষা বা কৌশল নয়; ম্যাজিক হল বিজ্ঞানের কলাকৌশল। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ম্যাজিশিয়ানদের মধ্যে একজন পিসি সরকারের (জুনিয়র) সামান্য একটু তথ্য তুলে ধরলাম বোঝানোর সুবিধার্থে। পি. সি. সরকার জাদুবিদ্যায় কল্পনা, উদ্ভাবনীর ক্ষমতা, প্রদর্শনভঙ্গি, পরিবেশনের মুর্ছনা, জাঁক-জমকপূর্ণ পোশাক, থিয়েটারের কায়দায় দৃশ্যপট, স্বদেশি কায়দায় বাজনা-সহ অভিনয়ে দক্ষ সুন্দর-সুন্দরী সহকারী-সহকারিনীর সঙ্গে আল্ট্রাভায়োলেট আলোর ব্যবহার করতেন। তিনিই প্রথম এসবের প্রবর্তক।
পি.সি.সরকাররের সেরা ম্যাজিক, বড় আকারের বস্তুগুলি অদৃশ্য করা। তাজমহল এবং ইন্দোর-অমৃতসর এক্সপ্রেস অদৃশ্য করেন। ৪ নভেম্বর ২০০০ সাল, তিনি আগ্রার কাখপুরাতে দুই মিনিটের জন্য তাজমহল "অদৃশ্য" করেন। তিনি কলকাতার ৩০০তম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালটি অদৃশ্য করেন। এবং ১৯৯২ সালে ভারতে বর্ধমান জংশনে এক বিশাল জনসাধারণের সামনে যাত্রীদের পূর্ণ ট্রেন অদৃশ্য করেছেন। তিনি লন্ডনের ট্রফ্লাগার স্কয়ার থেকে, চোখ বেঁধে উচ্চ গতিতে সাইকেল চালান এবং একটি রেকর্ড তৈরি করেন।
পিসি সরকার যতবার ইন্টারভিউ দিতে সামনে এসেছেন ততবারই উনি বলেছেন যে জাদু কোন অলৌকিক ক্ষমতা নয়, শুধুমাত্র বিজ্ঞানকে এমন ভাবে প্রয়োগ করা যাতে তা মানুষের চোখে আশ্চর্য লাগে। এককথায় মানুষের Attention Divert করার কৌশলের অপর নামই জাদু। উনি সবসময়ই বলেন জাদুবিদ্যায় কোনও অলৌকিকত্ব নেই। সবটাই বিজ্ঞান আর কঠোর অনুশীলন। যা ঘটছে সবই দর্শকদের চোখের সামনে, কিন্তু আমরা সেটা বুঝতে পারছি না। এছাড়া মঞ্চ, আলো, জাদুকরের মুখে অনর্গল কথা, বাজনা... সবকিছুই দর্শকের সামনে এক camouflage তৈরি করে যেটা জাদুকরকে দর্শকের মন divert করতে সাহায্য করে।
বর্তমানে "ট্রিক বিহাইন্ড ম্যাজিক", “ফাইনালি ম্যাজিক'স সিক্রেট রিভিউ” বলে দুটি অনুষ্ঠান হয় যেখানে কিভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে, কারসাজি এবং কৌশলের মাধ্যমে ম্যাজিক প্রদর্শন করে সেগুলো তুলে ধরা হয়। এছাড়াও ফেসবুক এবং ইউটিউব এ প্রচুর ভিডিও পাবেন যেখানে ম্যাজিশিয়ান কিভাবে ম্যাজিক দেখান তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়।
অবশেষে এটাই বলতে পারি যে যত ভালোভাবে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং কলাকৌশল কে কাজে লাগাতে পারে সে তত বড় ম্যাজিশিয়ান। ম্যাজিক বা জাদু কোন দৈবিক বিদ্যা, মন্ত্র, ভূতাত্মা, কোন মানুষের হাড় বা বিড়ালের হাড় (ম্যাজিশিয়ান এর হাতে থাকা ঐ কালো লাঠিটি যা অনেকে ভাবে) প্রভৃতির মাধ্যমে মোটেই হয় না। এগুলো একটা সম্প্রদায়ের নিজেদের ব্যবসা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কল্পনার মাধ্যমে মানুষের মগজের ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। আর তার সঙ্গে বিশ্বাস শব্দটা যুক্ত করে দেয়া হয়েছে। এই সমস্ত ভন্ড এবং ভন্ডামির থেকে দূরে থাকবেন।
জেনে রাখুন ম্যাজিক এবং ম্যাজিশিয়ান দুটোই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া; কোনটাই অস্বাভাবিক বা অলৌকিক নয়।
দুই:
আজ অফিস যাওয়ার পথে একটা বিচারকের গাড়ির দিকে চোখ যায়। আমি বরাবরই উৎসুক থাকি নেতা মন্ত্রী, অফিসার, বিচারক, ডাক্তার এদের মুখটা, এদের চেহারাটা দেখার। স্বাভাবিকভাবে ভালো করে লক্ষ্য করার চেষ্টা করছিলাম ভদ্রলোককে কেমন দেখতে, কেমন তার চেহারা, কেমন গঠন। বিচারক বলে কথা! কিন্তু যে জায়গায় গিয়ে আমার চোখ আটকে গেল সেটা হল- আমি দেখলাম ভদ্রলোকের ডান হাতের তর্জনী, মধ্যমা এবং অনামিকা তিনটিতেই পাথর বিশিষ্ট আংটি। দুটি পাথর বেশ বুঝতে পারছিলাম একটি মুক্তা এবং অপরটি নিলা কিন্তু তৃতীয় পাথরটির রং ভালোভাবে বুঝতে পারিনি।
যাইহোক এখানেই আমার প্রশ্ন দেশের বিচারক যদি কুসংস্কারচ্ছন্ন হয়, তিনি কীভাবে অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করবেন? যদি কোন অপরাধি বলেন, "আমার মাথায় শনি ভর করেছিল তাই আমি খুন/ ধর্ষন করে ফেলেছি।" তাহলে কি বিচারক তাকে নীলা পরার পরামর্শ দেবেন? যদি কোন অপরাধি বলে তার মাথা এমনিতেই গরম তাই উল্টোপাল্টা কাজ করেছেন। তাহলে কি তাকে মুক্ত পরার উপদেশ দেবেন?
আজ যে শুধু বিচারককে দেখেছি বলেই বিষয়টা আমার মাথায় লেগেছে তা নয়, এর আগেও আমি বহু শিক্ষককে দেখেছি, আমাদের অফিসের অফিসার কেও দেখেছি এবং অনেক উচ্চশিক্ষিত, পদমর্যাদার লোককেও দেখেছি এই ধরনের কুসংস্কার কে মান্যতা দিতে।
যে দেশের বিচারক, আইন রক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষক, ডাক্তার এদের মত সমাজের আদর্শবান মানুষেরাই কুসংস্কার মানেন, ভুত-প্রেত, জিন, দেব-দেবীতে (আকার এবং নিরাকার) বিশ্বাস রাখেন, তন্ত্র মন্ত্রে আস্থা রাখেন, হাতে - গলায় মাদুলি ঝোলানো থেকে শুরু করে তাবিজ বা আংটি পরা, মানত করা, রোজা, নামাজ, যাগ-যজ্ঞ করা, বলি দেওয়া প্রভৃতি কুসংস্কার মেনে থাকেন। সেই দেশের জনগণ সুবিচার পাবে কিসের আশায় বলতে পারেন? যে মানুষটা বিশেষ একটা ধর্মীয় রীতিনীতিকে মান্যতা দেয়, সেই মানুষটার থেকে আপনি নিরপেক্ষ বিচার পাবেন, এটা কি সম্ভব?
যে দেশের উচ্চ শিক্ষিত মানুষেররা, যারা জাতির মেরুদন্ড, যারা ছাত্র-ছাত্রীদের আদর্শ, যাদেরকে আমরা ছোটবেলা থেকে জীবনের লক্ষ্য বলে মনে করি তারাই যদি এমন আচরণ করে থাকেন। সেই দেশের গ্রাম্য, খেটে খাওয়া, অর্ধ শিক্ষিত, অশিক্ষিত মানুষদের আপনি কিভাবে কুসংস্কারমুক্ত করবেন বলতে পারেন?