রেনেসাঁসের অন্যতম প্রমিথিউস বিদ্যাসাগর

শম্ভুনাথ চার্বাক


Nov. 21, 2024 | | views :891 | like:2 | share: 2 | comments :0

বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের কাজ ছেড়ে দিলেন সম্পাদক রসময় দত্তের সাথে বনিবনা না হওয়ার জন্য। রসময় দত্ত আড়ালে বলতে লাগলেন, বিদ্যাসাগর যে চাকুরিটা ছেড়ে দিলে, খাবে কি? 

এই কথা বিদ্যাসাগরের কানে পৌঁছুলে তিনি বললেন, রসময়বাবুকে বলো তিনি আলু পটল বেচে খাবেন। জীবিকার জন্য যেকোন স্বাধীন বৃত্তি তিনি নিতে পারতেন। স্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিস্বাধীনতা ছিল তাঁর আত্মমর্যাদা বিচারের অন্যতম মানদণ্ড। সমস্ত শাস্ত্র অধ্যয়ন করা বিদ্যাসাগরের আলু পটল বেচতেও কোনো অসুবিধা হতো না। 

তখন তাঁর বাসায় আশ্রিতের সংখ্যা অনেক। অসহায় দরিদ্র আত্মীয়স্বজনের প্রায় কুড়িটি ছেলের খাওয়া পড়ার দায়িত্ব তাঁর কাঁধে; এছাড়াও অনেক দায়িত্ব তিনি মাথায় নিয়ে চলতেন। কিন্তু স্বাধীনভাবে অর্থোপার্জোনের পথ কোথায়? আলু পটলের ব্যবসা করার মতোও তাঁর নিজস্ব কোনো মূলধন ছিল না। বিদ্যাসাগরের মূলধন ছিল বিদ্যা, বিদ্যাই তাঁর স্বোপার্জিত মূলধন এবং তিনি ছিলেন বিদ্যার ব্যাপারী। কিন্তু বিত্তের সাথে বিদ্যার সাদৃশ্য কোথায়? বিশেষ করে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে? বিত্ত দান করলে কমে, কিন্তু বিদ্যা দান করলে বাড়ে। স্বাধীন বাণিজ্যবৃত্তির দৃষ্টান্ত তাঁর পূর্বে রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক তারানাথ তর্কবাচস্পতি ও কয়েকজন শাস্ত্রজ্ঞ বাঙালি পণ্ডিতদের মধ্যেও এটা দেখা গিয়েছিল। অনেক ইয়ং বেঙ্গল সদস্যরা এই স্বাধীন ব্যবসার পথে দেখিয়ে গেছেন। এটা রেনেসাঁসের একটা অন্যতম লক্ষণ। বিদ্যাসাগরও নিজের বিদ্যাকে মূলধন করে তারই যুগোপযোগী বাণিজ্যের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন, সেদিক থেকে তিনিই বাংলাদেশে ও ভারতে এই ব্যবসায়ের অন্যতম পথপ্রদর্শক। 

এতদিন পর্যন্ত হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি ছিল পাতালের অন্ধকারে শৃঙ্খলিত প্রমিথিউসের মতো। মুদ্রণযন্ত্র তাকে মুক্তি দিল যেদিন এবং সেদিন জ্ঞানের আলোক চারিদিকে পরিব্যপ্ত হল এবং অজ্ঞানের অন্ধকার ধীরে ধীরে কাটতে লাগল। পুরোহিত যাজক ইমামমদের পুঁথিগত জ্ঞান হাতেলেখা পাণ্ডুলিপির কারাজীবন থেকে মুক্ত হয়ে সকল মামুষের আয়ত্তের মধ্যে এল ছাপার অক্ষরে। কুসংস্কার ও কূপম্পন্ডুকতার কারাগার থেকে মানুষের মুক্তির জন্য যে স্বপ্ন বিদ্যাসাগর দেখেছিলেন, তা হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির সাহায্যে সম্ভব নয়। মূদ্রিত বইয়ের ভূমিকা অন্য কিছুই পুরণ করতে পারেনা সেই সময়ে। মুদ্রনযন্ত্র তাই নবযুগের জ্ঞান বিদ্যার প্রমিথিউস। গুরুগৃহের জীর্ণ-সংকীর্ণ দেয়াল ভেঙে জনসমাজের মুক্তাঙ্গনে জ্ঞানবিদ্যার আলোকবর্তিকা বহন করে নিয়ে আসার প্রচন্ড শক্তি যে মূদ্রণযন্ত্র ধারণ করে, সে এযুগের প্রমিথিউস বৈ কি? নবযুগের জ্ঞান তথাকথিত কল্পিত স্বর্গের অপহৃত প্রমিথিউসের অগ্নির মতো। 

এই মুদ্রিত বই ছিল বিদ্যাসাগরের জীবনের মুক্তির প্রতীক। সংস্কৃত কলেজ ছাড়ার আগেই তিনি সংস্কৃত প্রেস ও ডিপোজিটারি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 


মদনমোহন তর্কালঙ্কার ও বিদ্যাসাগরের সমান অংশীদ্বারিত্বে এই প্রেস স্থাপিত হয়েছিল। এই দুই বন্ধু ছিলেন একই বৃন্তে দুটি ফুলের মত। শিক্ষা প্রসার ও সামাজিক কুসংস্কার নিবারণের জন্য ওনারা দুই বন্ধু লেখা শুরু করেছিলেন।

 এনাদের বন্ধু বাবু নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের থেকে ৬০০ টাকা ধার করে দুজনে এই পুরানো প্রেস ক্রয় করেন। বিদ্যাসাগর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ইংরেজ সিভিলিয়ন ছাত্রদের বাংলা শিক্ষার জন্য অন্নদামঙ্গল কাব্য কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ি থেকে এনে ছাপিয়ে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে ৬০০ টাকা পেয়েছিলেন। সেই অর্থে নীলমাধব বাবুর ধার পরিশোধ হয়। এই অন্নদামঙ্গল কাব্যই প্রথম বই যা ওনাদের প্রেস থেকে বেরোয়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের জন্য আরো অনেক বই ছাপান। এর পর যে সমস্ত পুঁথি মুদ্রিত ছিলনা সেগুলি ছাপাতে শুরু করেন। সংস্কৃত কলেজে ও অন্যান্য লোকেদের কাছে সেগুলি বিক্রি করে লাভের মুখ দেখেন। বিদ্যার দুর্ভেদ্য গর্ভগৃহ থেকে পুথিবন্দি সাহিত্য দর্শন ইত্যাদির জ্ঞানভাণ্ডার মুদ্রিত গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। 

বাণিজ্যক্ষেত্রে সে যুগে মুদ্রক প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতার স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা হয়নি। মুদ্রিত বইয়ের জন্য প্রকাশকদের তখনও পৃথক দোকান খুলে বিক্রির প্রয়োজন দেখা দেয়নি। কিন্তু এদেশে ছাপা বইয়ের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছিল পাঠকমহলে। তখন কলকাতার চীনা বাজারই ছিল সব থেকে বড় বইয়ের ব্যবসার কেন্দ্র। অন্যেরা ক্যানভাসারদের দিয়ে বই বিক্রি করতেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর কলেজষ্ট্রীটে সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটারি নাম দিয়ে প্রথম বইয়ের দোকান করলেন এবং নিজের লেখা ও ছাপাখানায় মুদ্রিত প্রকাশিত বই ছাড়াও অন্য লেখকদের বইও বিক্রি করতে শুরু করলেন। বিদ্যাসাগরই সম্ভবত এই অঞ্চলের প্রথম গ্রন্থ ব্যবসায়ী এবং যা আজ মহীরুহে পরিণত হয়েছে। মুদ্রণের টেকনিক্যাল ব্যাপারেও উনি কতটা আগ্রহী ছিলেন তা ওনার অক্ষর বিন্যাস দেখেই বোঝা যায়। এরপর গিরিশচন্দ্র নিজের নামে একটি মুদ্রণযন্ত্র স্থাপন করে ব্যবসা শুরু করেন। 

বাংলাদেশের জমিদার ও পণ্ডিতদের একটি বড় অংশ মুদ্রণের প্রসার কামনা করতেন না। পণ্ডিত পুরোহিতদের কুক্ষিগত শাস্ত্রবিদ্যা গ্রন্থাকারে জনসাধারণের মধ্যে প্রচারিত হুলে তাদের বংশগত শাস্ত্রবিদ্যার ব্যবসা নষ্ট হয়ে যাবে, এই ছিল তাদের ভয়। 

মুদ্রণের ঐতিহাসিক তাৎপর্য বুঝেই বিদ্যাসাগর অন্য কোনো স্বাধীন বাণিজ্যের প্রতি আকৃষ্ট হননি। কারণ আর্থিক আত্মনির্ভরতাই তাঁর একমাত্র কাম্য ছিল না। তাঁর লক্ষ্য ছিল, জীবনের স্বাধীন বৃত্তিকে জীবনের ব্রতের অবিচ্ছেদ্দ অঙ্গ করে তোলা। শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার যার জীবনের ব্রত, স্বাধীন মুদ্রক প্রকাশক ও গ্রন্থাকারের বৃত্তিই তার শ্রেষ্ট উপযোগী বৃত্তি। বাংলা তথা ভারতে জ্ঞানকে কারাগারের অন্ধকার মুক্ত করে আলোতে নিয়ে আসার প্রমিথিউস বিদ্যাসাগর ছাড়া আর কে? 

বিদ্যাসাগরের জন্ম মাসে ওঁকে আমার শতকোটি প্রণাম ও শ্রদ্ধাঞ্জলি।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929