আমার জন্ম যশোর জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম শিমুলিয়ায়। আমার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে এই গ্রামে। আমি যখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি তখন আমার প্রাইমারি স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক আতিয়ার রহমান যাকে আমার সেকেন্ড স্যার ডাকতাম তিনি একদিন ক্লাসে বললেন, "রবি ঠাকুরের বদলে নজরুলের নোবেল পাওয়ার কথা ছিল।"
এজন্য রবী ঠাকুর নজরুলকে বোবা(বাকশক্তিহীন) করতে বিষ খাইয়ে দেই, ফলে নোবেল জিতে রবী ঠাকুর। হিন্দুরা হল লাল পিপড়া যেটা কামড়ালে মুসলমানরা কষ্ট পাই আর মুসলিমরা হল কালো পিপড়া যেটা কামড়ালেও কেউ কষ্ট পাই না, রবী ঠাকুর হল লাল পিপড়া এজন্য নজরুলের এভাবে ক্ষতি করেছে।
এই ঘটনার আগে আমি হিন্দু-মুসলিম যে আলাদা এমন কিছু জানতাম না। আমাদের গ্রামে হিন্দু-মুসলিম সবাই ছিল, আমার সব বাড়িতেই যাতায়াত ছিল কিন্তু আমি এসব বিভেদ জানতাম না। এই ঘটনা আমাকে বেশ ধাক্কা দেই, আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন আমার পিতাই। আমি আব্বুকে বললাম, আব্বু সেকেন্ড স্যার তো আজ এই ঘটনা বললো। তখন প্রগতিশীল রাজনীতিতে জড়িত আমার আব্বু বললো স্যার ভুল কথা বলেছেন, হিন্দু-মুসলিম উভয়ের ভিতরে যেমন ভাল মানুষ আছে তেমনি উভয়ের ভিতরেই খারাপ মানুষ আছেন। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পেয়েছেন কবি নজরুল তখনও কবিতা লিখতে শুরু করেননি। আমার মাথায় তারপর থেকেই ঘুরতে লাগলো কেন স্যার আমাকে মিথ্যা তথ্য দিলেন।
ছোটবেলার আরেকটি স্মৃতি আমাকে দারুণভাবে রোমাঞ্চিত করে। ঈদে আর দূূূর্গাপূজায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে সোনাই নদীতে নৌকা বাইচ হতো। নৌকা বাইচে দেখতে আব্বুর সাথে মোটরসাইকেলে যেতাম সোনাই নদীতে, বাংলাদেশের এপারের জায়গাটির নাম সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া থানার ভাদলি আর সীমান্তের ওপারে ভারতের হাকিমপুর বাজার। নৌকা বাইচের সময় সীমান্ত খুলে দিতো কয়েক ঘন্টার জন্যে, আমরা ওপাওে যেতাম, ওখানে যাত্রাপালাও দেখেছি কয়েকবার। শুনেছি এখন আর নৌকা বাইচ’ই হয় না।
ধীরে ধীরে চিন্তাজগতে এসব প্রভাব ফেলতে শুরু করলো দুইপারের ভাষা এক, তারপরও কেন আমরা ওখানে সবসময় যেতে পারি না, হিন্দু-মুসলিমের ভাষা একই, আচার-ব্যবহার একই তারপরও এসব বিদ্বেষ কেন! একে একে পড়তে শুরু করলাম ট্রেন টু পাকিস্তান, জয়া চ্যাটার্জিও ‘ভারত কেন ভাগ হল’, বুঝতে শুরু করলাম এই আচারণের মনস্তত্ত¡। বঙ্গভঙ্গ, ভারত ভাগ, ব্রাহ্মণ্যবাদী মনোভাব, নোয়াখালী গণহত্যা, কলকাতা দাঙ্গা সম্পর্কে যখন পড়তে শুরু করলাম তখন অনেককিছুই বুঝতে সুবিধা হল।
বর্তমানে আমাদের বাংলাদেশে ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে রামু, নাসিরনগর, ভোলা, মালোপাড়ায় হিন্দু-বৌদ্ধদের উপরে যে হামলা করেছে সংঘবদ্ধ মৌলবাদী চক্র সেটার পিছনে আছে ভারত ভাগের সময় তৈরি হওয়া সাম্প্রদায়িক মনস্তত্ত¡। তারা চাই এদেশ থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সব চলে যাক, এই দেশ কেবল মুসলমানের দেশ। এই মৌলবাদীদের জন্যে প্রধান বাধা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যেখানে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই দেশ পাকিস্তানী শত্রু মুক্ত করেছিল।
সাম্প্রদায়িক এই আচারণ দেখে মনে হয়, দেশভাগই হচ্ছে এই উপমহাদেশে চলা চলমান বিদ্বেষের মূল কারণ। কাঁটাতারের দেওয়াল তুলে কখনো বিদ্বেষ দূর করে কোন দেশ শান্তিতে থাকতে পারে না। ভারতে গরু খাওয়া নিয়ে মুসলিম পিটিয়ে মারা আর বাংলাদেশে ইসলাম অবমাননার ভুয়া অভিযোগ তুলে হিন্দু-বৌদ্ধদের উপর হামলার উপর হামলা চলছে অথচ সাতচল্লিশে ভাবা হয়েছিল যে, দেশ বিভক্ত করলেই বোধহয় সকল সমস্যার সমাধান হবে, সেই ধারণা যে কতবড় ভুল সেটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে বর্তমান সময়ে ঘটা এই ঘটনাবলীসমূহ। আর এই সাম্প্রদায়িক বিভেদের দেওয়াল তোলার কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ জাতিও বাঙালী জাতি, তারপরও আমাদের বোধদয় এখনও হয়নি যে সাম্প্রদায়িক কার্ড খেলে কখনো শান্তি আনা যায় না সমাজে। বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক সীমান্ত হত্যা, তিস্তা চুক্তি নিয়ে সংকট নিয়ে কিছু দ্বিপাক্ষিক সমস্যা হয়েছে। অথচ এইসব সুনির্দিষ্ট সমস্যার সমাধান কিংবা প্রতিবাদ জারী না রেখে বাংলাদেশে চলে হিন্দু বিদ্বেষী প্রচারণা। সাম্প্রদায়িকতার কারণে পানি ঘোলা হয় কেবল কিন্তু সমাধান আসেনা। দেশের কোন উপকার না হলেও হিন্দুদের উপর নিপীড়ন জায়েজ করা হয় এটার মাধ্যমে। সাম্প্রদায়িকতা কেবল আমাদেও সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, কোন সমাধানের পথ তৈরি করতে সক্ষম নয়।