ব্রাহ্মণদের শাস্ত্রভিত্তিক চৌর্যবৃত্তি কবে বন্ধ হবে?
শম্ভুনাথ চার্বাক
Nov. 25, 2024 | | views :902 | like:2 | share: 2 | comments :0
বিখ্যাত সাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তীর মস্কো থেকে পন্ডিচেরির ব্রাহ্মণদের সম্পর্কে লেখা দিয়েই শুরু করি -
আমাদের সনাতন ব্রাহ্মণেরা ব্রহ্মচিন্তার সঙ্গে অর্থচিন্তার কী অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন --- একাধারে যেমন বেদ উপনিষদ, গীতা যা মান্যতা দেয় শূদ্র ও নারীদের দাবিয়ে রাখার জটিল তত্ত্ব আর অন্যধারে অন্যদিকে সমাজের বৃহত্তর শূদ্র শ্রেণীর মানুষকে দাবিয়ে রাখার প্রত্যক্ষ ধর্মের গ্রন্থ মনুসংহিতা। এই দাবিয়ে রাখতে গিয়েই বিভিন্ন জটিল ধর্মীয় আচার ও সংস্কৃতির মাধ্যমেই ব্রাহ্মণদের আয়ের ব্যবস্থা বা এক কথায় বলা যায় শাস্ত্রানুসারী চৌর্য্যবৃত্তি। ব্যক্তি নির্বিশেষে জন্মের আগেই সাধ থেকে শুরু করে ছয় ষষ্টী, অন্নপ্রাশন, বিয়ে, বেচারার শ্রাদ্ধ পর্যন্ত ট্যাক্সো আদায়, এমন কি, বহুকাল আগে খতম হয়ে গেলেও তার পুত্রপৌত্রাদিক্রমে নেড়া মাথার ওপর বংশানুক্রমে বাৎসরিকের মাধ্যমেই জিজিয়া এবং এছাড়াও বারো মাসে তেরো পার্বন গৃহ প্রবেশ দোকান শুরুর পুজোতো আছেই। দুর্গ্রহক্রমে এই ভূগ্রহে জন্মাবার ও মরবার পাপের শাস্ত্রমত প্রায়শ্চিত্ত আমাদের ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের মূলধন বিহীন চিরকেলে ব্যবসা, একদম বিনা পুঁজির ফলাও কারবার। অর্থনীতিতে সেই সময়ে নোবেল পুরস্কার থাকলে আমাদের দেশের ব্রাহ্মণদের অনেকেই এই পুরস্কার পেতেন। ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট মিল; অ্যাডাম স্মিথ বা লর্ড কেইনসও ভাবতে পারেননি এই রকম হরেক ট্যাক্সের কথা
কয়েক দিন আগে এক ছাত্রের মায়ের শ্রাদ্ধে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। শ্রাদ্ধবাড়িতে যাই না এবং যাওয়া ভীষণভাবে অপছন্দ করি। নিজের মা – বাবার মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করিনি, সাদা কাপড় পরিধান করিনি, চুল কাটিনি, এক এক কথায় কিছুই করিনি, এই জন্য পাড়ায় আমার বেশ বদনাম আছে নাস্তিক হিসেবে। যে মানুষের মৃত্যুর আগে তাকে বিন্দুমাত্র সাহায্য করতে পারিনি তার শ্রাদ্ধে কবজি ডুবিয়ে খেয়ে এসে সেটা সম্পর্কে গল্প করতে খারাপ লাগে তাই ছাত্রদের বলে দিয়েছিলাম যেতে পারি কিন্তু কিছু মুখে দেবো না। কিছু কিছু জায়গায় যেতেই হয় তাদের মান এবং মন রক্ষার্থে। যে বাড়িতে গিয়েছিলাম তারা তিন ভাইই আমার পূর্বতন ছাত্র এবং প্রায়ই বাড়ির দোরগোড়ায় থাকে ফলে যেতে একপ্রকার বাধ্যই হয়েছিলাম। তাদের বাবা নেই, মা দীর্ঘদিন ধরে বিছানায় ছিলেন। ভাইয়েরা মিলে রান্না করে মায়ের শুশ্রূষা করেছে বছর তিনেক ধরে। কাজকর্মও সেভাবে কিছু করে না, বড়জন সম্পূর্ণ বেকার, মেজোর একটা অটো আছে লিজে দেওয়া, শুধুমাত্র ছোটটি একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করে। মাঝে মধ্যে দু একবার দেখতে যাওয়া ও মা কেমন আছে জিজ্ঞাসা করা ও আহা উহু করা ছাড়া আর কিছু সাহায্য তাদের করিনি। অথচ শ্রাদ্ধের নিয়মভঙ্গের দিন সবাইকে নেমন্তন্ন করেছে। আমার বাড়ির লোক শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যাওয়া পছন্দ করে না । তারা কেউ যাবে না অগত্যা আমাকেই শ্রাদ্ধের দিন ফুল মালা ধূপকাঠি হাতে দেখা করতে যেতে হল। শ্রাদ্ধের দিন পুরোহিত মহাশয় দুজন দিয়ে শ্রাদ্ধ করানো হয়েছে। সেদিনও দুশো লোক খেয়েছে এবং নিয়মভঙ্গের দিন প্রায় পাঁচশো লোক নিমন্ত্রিত। তাকে শ্রাদ্ধের আগে ঠারেঠুরে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি শ্রাদ্ধ ব্যাপারটির কোনো যৌক্তিকতা নেই, মরার পর মানুষের স্মৃতি আর কাজ ছাড়া কিছুই থাকে না। তোরা মায়ের জন্য যা যা করেছিস এই কবছরে তার থেকে বেশী পুণ্য আর কিছু নেই, এই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের অপরের মাথায় টাক দিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা। কে কবে দেখেছে মৃত ব্যক্তি খেতে আসে? আদিম অজ্ঞ মানুষের ভয় ও বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে পুরোহিতেরা নিজেদের আয়ের ব্যবস্থা করেছে। এগুলি ধর্ম নয় এগুলি অধর্ম, ব্রাহ্মণদের প্রবর্তিত হিন্দুদের কু-আচার। পুনর্জন্ম বা পরলোক বলে কিছু নেই, মানুষ প্রকৃতি পরিবেশের সৃষ্টি ও মৃত্যুর পর সব প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে যায়। পুরোহিত শ্রেণি মানুষকে ভয় দেখিয়ে মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ব্যবসা করে, যেমন -
১) জন্মের আগে সাধ ও ছয়দিনে ছয় ষষ্ঠী
২) অন্নপ্রাশন
৩) বিবাহ
৪) মৃত্যু
৫) মরার পরও ছাড় নেই, তার পুত্র প্রপৌত্রদের থেকে বাৎসরিকের নামে চাঁদা আদায় করে।
কিন্তু আমার ছাত্ররা এতো কুসংস্কারগ্রস্থ পরিবারে মানুষ হয়েছে যে তাদের যুক্তি দিয়ে বোঝানো খুব কঠিন। যাইহোক আমাকে তারা পাড়ার লজে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে দেখি রুই মাছ এবং বিশাল বিশাল পাবদা মাছ পটল চিংড়ির ব্যবস্থা ছাড়াও মিষ্টি আইসক্রিমের ব্যবস্থা আছে। আমাকে প্রায় জোর করেই খেতে বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হল। আমি পরিষ্কার জানালাম পেট পুরে খেয়ে এসেছি কোনোমতেই খেতে পারবো না। তখন ওরা বসতে বলল এবং কিছুক্ষণ থাকতে অনুরোধ করল। সেখানে বসে কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্রের সাথে আলোচনা করছিলাম রামায়ণের দশরথের পুরোহিত জাবালির কথা। সেই যুগের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান এর বিরুদ্ধে জাবালি প্রতিবাদ করেছিল। বুঝলাম আমাদের সমাজের শিক্ষার পদ্ধতির পরিবর্তন না হলে এই ব্যবস্থা চলতে থাকবে। এই মৃত্যুভোজ কবে বন্ধ হবে জানিনা?
এইসব অনুষ্ঠানগুলি কবে যে মানুষ বাদ দেবে জানি না। ঐ ছেলে তিনটির তেমন আয় নেই। বাবার জমানো যা পুঁজি ছিল তা বোধ হয় মায়ের শ্রাদ্ধে শেষ করেছে। এরপর কি হবে? এইসব ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের পেট ভরার অনুষ্ঠান মানুষকে ধনেপ্রাণে শেষ করে। বর্তমান দিনের অল্প কিছু আধুনিক সৎ ব্রাহ্মণ পদবিধারীদের এই অনুষ্ঠানকে ঘৃণা করে দেখেছি। নিজেরা এই অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকে।
আমরা যারা নিজেদের শিক্ষিত যুক্তিবাদী মনে করি তারাতো এই অনুষ্ঠানগুলি বর্জন করতে পারি নিজেদের জীবন থেকে! সমস্ত পারিবারিক অনুষ্ঠান থেকে ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের বিসর্জন দিতে পারি। জন্ম মানুষের জীবনে এক দুর্ঘটনার মতো, ৩০ - ৩৫ কোটি শুক্রানু লড়াই করে একটা বাঁচে, সেটাই মানুষ হয়, কিন্তু মৃত্যু অনিবার্য। জন্ম যেমন প্রকৃতি উদ্ভুত তেমন মরার পর সে পোড়াও বা কবরে দাও সবই প্রকৃতিতে ফিরে যায়। তখন স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই থাকেনা, যাকে অনেকে আত্মা বলে। আর শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান না করে শ্রদ্ধানুষ্ঠান স্মরণসভা করতে পারি! এতে মৃতের প্রতি সঠিক শ্রদ্ধা জানানো হয় আবার ব্রাহ্মণদের শাস্ত্রানুযায়ী চৌর্যবৃত্তিকে প্রতিরোধ করাও যায়।