মৃত মানুষের নাভিকুন্ড কি অদাহ্য?
কৃষ্ণ ঘোষ
Nov. 18, 2024 | | views :930 | like:0 | share: 0 | comments :0
মানবদেহ অবিনশ্বর নয়। মারা যাওয়ার পর আমাদের দেহের সমগ্র অংশ মাটিতে বিলীন হয়ে যায়। বিলীন হয়ে যাওয়াটা ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে হয়। কোনও দেহ পুড়ে ছাই হয়ে মাটিতে মিশে যায়। আবার কোনও দেহ মাটিতে পচে গলে মিশে যায়। এসব তথ্য আমরা সবাই জানি। এসব জানার মাঝেও আমরা দু একটা তথ্য ভুল জানি। যেমন, মৃত মানুষের নাভিকুন্ড নাকি কখনওই পোড়ে না। এই নিয়ে বেশ কিছু মানুষের সাথে আলোচনা করে দেখেছি,কেউ কেউ মানলেও অনেকেই মানতে চান না মানুষের নাভিকুন্ড পোড়ে বলে। দিন কয়েক আগে ফেসবুকেও একজন এই বিষয়ে প্রশ্ন রেখেছিলেন। সেখানেও দেখলাম,অনেকেই নিজের নিজের অভিজ্ঞতা পরিবেশন করে জানিয়েছেন, নাভিকুন্ড পোড়ে না। এমন কি ইলেকট্রিক চুল্লিতেও নাকি মৃত মানুষের নাভিকুন্ড পোড়ে না। কথা প্রসঙ্গে আমাদের এক বন্ধু তো তার সারা জীবনে তিনি কত মরা পুড়িয়েছেন,সেই হিসেব দেখিয়ে প্রমাণ করতে চাইলেন মৃত মানুষের নাভিকুন্ড কখনওই পোড়ে না। কেউ যদি তার নিজের অবস্থানে অনড় অটল থাকে,তবে তাকে কিছুতেই বোঝানো যায় না। বেশি কিছু বলতে গেলে অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়।
শ্মশানে মৃতদেহ পোড়ানো দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের প্রায় সকলেরই কমবেশি থাকলেও মানুষের নাভিকুন্ড পোড়ে কি পোড়ে না,এই নিয়ে আমরা কেউই তেমন একটা ভেবে দেখিনি। মরা পোড়ানো হয়ে যাওয়ার পরে শ্মশানের ডোম 'অস্তি' হিসাবে গনগনে চিতা থেকে কিছু একটা পোড়া অংশ সদ্য প্রয়াত মানুষের নিকটজনের হাতে তুলে দেন। ওটাই নাকি মৃত মানুষটির নাভিকুন্ড। এমনটাই আবহমান কাল ধরে চলে আসছে। এর মধ্যে বড় শহরগুলিসহ জেলায় জেলায় ইলেকট্রিক চুল্লির প্রচলন হলেও 'নাভিকুন্ড' পোড়ে না,এমন একটা ভ্রান্ত ধারণার খুব একটা বদল ঘটেনি। কিন্তু কেন এমন ভ্রান্ত ধারণা আজকের দিনেও বিরাজমান মানুষের মনে ? এই নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
যেখানে আগুনের তাপে লোহা জলের মতো তরল হয়ে যায়,সেখানে নাকি মানুষ নামক প্রাণীর নাভিকুন্ডলি পোড়ে না ! এই রকম ধারণা পোষণ করার মধ্যে আছে আমাদের আজন্ম লালিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানসিকতা। সুদূর অতীতে অল্প কিছু করেকম্মে খাওয়া স্বঘোষিত ব্রাহ্মণ তকমাধারী মানুষদের তৈরী করা সংস্কারকে অনুসরণ করে পোড়া কাঠ কয়লা মাখানো অর্ধদগ্ধ একটা টুকরোকে শ্মশানের ডোমেরা মৃতের পরিবারের হাতে তুলে দেয়। ওটা আদৌ নাভিকুন্ড, নাকি অন্য কোনও আধা পোড়া দেহাংশ,এ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার মতো মানসিকতা মৃতের পরিবারের তো থাকেই না,অন্য কোনও মানুষের ইচ্ছে থাকলেও করতে পারেন না অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। তাই আবহমান কাল ধরে চলে আসছে এমন ভ্রান্ত ধারণা। মানুষের নাভিকুন্ড কখনওই পোড়ে না,এমন জল্পনা শ্মশানের চৌহুদ্দির মধ্যেই হয়। বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরিতে বোধহয় কখনও এমন গবেষণা হয়নি।
কিছু অতি সাধারণ বিষয় আছে,যা বুঝতে ও বোঝাতে কোনও বিরাট কিছু বিদ্যা শিক্ষা জ্ঞান কিম্বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজন হয় না। এসব ক্ষেত্রে একেবারে সাধারণ কান্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। মানুষের নাভিকুন্ড পোড়ে কি পোড়ে না,এটা সেই রকমই একটা সাধারণ বিষয়।
ধরা যাক, কোনও একজন মানুষকে যদি প্রশ্ন করা হয়,একটা লোহার টুকরো এবং এক টুকরো মাংস কোনও গনগনে জ্বলন্ত ফার্নেসের মধ্যে একসঙ্গে ছুঁড়ে দিলে কোনটা আগে পুড়ে যাবে ? এমন প্রশ্ন শুনে উত্তরদাতা প্রশ্নকর্তার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকাবে,এমন একটা উদ্ভট প্রশ্ন করার জন্য।
কিন্তু যদি 'এক টুকরো মাংসের' পরিবর্তে 'এক টুকরো মানুষের নাভিকুন্ড' কথাটা বসিয়ে প্রশ্ন করা হয় তবে তিনিও একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়বেন। কারণ,তিনি যত বড় শিক্ষিত হোন না কেন, তিনি তার বংশ পরম্পরায় জেনে এসেছেন,দেখে এসেছেন মানুষের নাভিকুন্ড পোড়ে না। কেন পোড়ে না,এটা নিয়ে তেমন কেউই ভেবে দেখেনি বা দেখতে চান না। কারণ,এই নাভিকুন্ড নিয়ে অস্তি বিসর্জনের মতো একটা পারলৌকিক আচার ও সংস্কার আছে। তাই সংস্কারটির পিছনে আমাদের আজন্ম লালিত ভ্রান্ত ধারণাও কাজ করে।
উপযুক্ত তাপমাত্রায় এবং পর্যাপ্ত সময়ে যেখানে সবচেয়ে কঠিন ধাতু হীরের টুকরোও পুড়ে যায়,সেখানে সামান্য নাভিকুন্ড তো কোনও ব্যাপারই নয়। আমাদের শরীরের অন্যান্য অংশের তুলনায় নাভিকুন্ডে চর্বি জাতীয় পদার্থ অনেক বেশি পরিমাণে থাকে। তাই পুড়তে কিছুটা সময় নেয়। কিন্তু পোড়ে। নাভিকুন্ড পোড়ে না,এমন ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। কাঠের চিতায় একটা মৃতদেহ পোড়াতে প্রায় আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লেগে যায়। এই সময়ের মধ্যে সারা দেহের অন্যান্য অংশ পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও দেহের চর্বি জাতীয় অংশ ঠিক মতো পোড়ে না। এছাড়া অস্তি নেওয়ার মতো একটা সংস্কার কাজ করে। ফলে,খুব সহজেই নাভিকুন্ড 'অদাহ্য পদার্থ' হিসেবে মর্যাদা পেয়ে যায়।
একটা খুব সহজ সরল উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক বিষয়টি। কিছুটা বদ্ধ জায়গায় একটা A4 সাইজের কাগজ হাতে নিয়ে কাগজটির যে কোনও একটা কোণায় আগুন লাগিয়ে মাটিতে রেখে দিন। কিছু ক্ষণের মধ্যেই দেখবেন,কাগজটার অধিকাংশ অংশ পুড়ে গেলেও মাটিতে লেগে থাকা কিছুটা অংশ পোড়েনি। এই ভাবে আপনি দশ বারোটা কাগজ একটা একটা করে পোড়াতে গিয়ে লক্ষ্য করে দেখবেন, একেবারে সম্পূর্ণ কোনও কাগজই ঠিক মতো পুড়ছে না। কোনও না কোনও অংশ বাকি থেকে যাচ্ছে। অথচ ওই একই সাইজের কাগজ আপনি হাতে ধরে রেখে যদি পোড়াতে যান অথবা কোনও জ্বলন্ত উনুনে ছুঁড়ে দেন,তাহলে দেখবেন মুহূর্তের মধ্যে কাগজটা পুড়ে যাচ্ছে। এইবার ধরুন, কোনও ধর্মগুরু যদি আগুনের এই স্বাভাবিক নিয়মটিকে কাজে লাগিয়ে ঘোষণা করে যে,আমার মন্ত্রপূত কোনও কাগজই আগুনে সম্পূর্ণ পুড়বে না। দেখা যাবে বহু মানুষই ওই ধর্মগুরুর কথাকেই মেনে নেবেন,প্রকৃতির কার্যকারণের বিষয় ভেবে দেখবেন না। মানুষের নাভিকুন্ড না পোড়ার ব্যাপারটাও অনেকটা এই রকমের।
নাভিকুন্ডের মধ্যে একটা অতি অলৌকিক কিছু একটা ব্যাপার আছে,এই ধারণাটা যদি নষ্ট হয়ে যায়, তবে এটাকে ঘিরে যে লৌকিক আচার কিম্বা সংস্কার আছে, সেগুলোও একেবারে নির্মূল হয়ে যাবে। তাই এই ধরনের ভ্রান্ত ধারণাকে নষ্ট করে দেওয়ার প্রচেষ্টা আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় থাকে না। রাষ্ট্র ও সরকারও এসব ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। কারণ, তাহলে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। আর আমরা সাধারণ মানুষেরাও এই নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতেও রাজী হই না। তাই এই রকম বহু ভ্রান্ত ধারণা আমাদের মনের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে। থাকবেও বহু কাল।