বাস্তবে যুক্তিবাদী হতে পারা ও তার প্রয়োগ নিয়ে কিছু কথা

বিশ্বনাথ মুরমু


Dec. 3, 2024 | | views :285 | like:0 | share: 0 | comments :0

আমরা অনেক সময়ই খুব সাধারণ একটা কথা, খুব সাধারণভাবেই ব্যাবহার করে থাকি, charity begins at home. অর্থাৎ কিনা, বাড়ি থেকেই আসল বিদ্যাশিক্ষার শুরু করতে হয় (এখানে যুক্তিবোধ বা যুক্তিবিদ্যা শিক্ষা)। আক্ষরিক অর্থে, এক্ষেত্রে শুধু নিজের বাড়ি বা বাড়ির লোকই ধরা হয় না, ধরা হয় প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় পরিজন, সহপাঠী, সহকর্মী, ইত্যাদি। কিন্তু, ভেবে দেখলে ধরা পড়বে যে যারা নিজেদের যুক্তিবাদী বলে বা যাদের যুক্তিবাদী বলে লোকে জানে এবং যারা যুক্তিবাদী নয়, অনেক ব্যাবহারিক ক্ষেত্রেই তাদের সবার আচরণ এক হয়ে দাঁড়ায়, যা হল অযৌক্তিক অনেক কিছুই, না দেখার ভান করে থাকা বা অনেক সময় বাধ্য হয়েই চেপে যাওয়া। যারা যুক্তিবাদী নয় তারা তো গড্ডলিকা প্রবাহের লোক, কাজেই কিছু বলারই নেই। কিন্তু যারা জীবন যাপনে আদর্শবাদী, সত্যবাদী, অন্তত নিজেদের সেইভাবে তুলে ধরতে চায়, তাদের যদি গলায় তুলসি মালা, কপালে তিলক দেখা যায়, এটা কি আদর্শবাদী বা সত্যবাদীর আচরণ বলে মেনে নেওয়া যায়? 

এটা হয়ে যায় আর এক প্রবাদের বহিঃপ্রকাশ, তামাকও খাব, আবার ডুডুও খাব। যুক্তিবাদ ছাড়া না আদর্শবাদ মানা যায়, না সত্যবাদের অনুসরন করা যায়। যুক্তিবাদ হল বাস্তবতা, বাস্তবতাই সত্য (এই সত্যই ধর্ম/ন্যায়), এর কোন দরাদরি হয় না। কাজেই, অবাস্তবতার আদর্শবাদ যেমন হতে পারে না, তেমনই অবাস্তবতার সত্যবাদও হতে পারে না।

চাই সচেতনতার পাঠ, প্রসার যা কিনা বিজ্ঞান মঞ্চগুলিই পালন করতে পারে। অবশ্য, এটা সত্যি, সব ক্ষেত্রে এবং সব সময়ে এককভাবে প্রতিবাদ করা যায় না বা যুক্তিটুকুও প্রকাশ করা যায় না। প্রচলিত ধারনার মূলে কুঠারাঘাত করা চাই পাল্টা যুক্তির অর্থাৎ বাস্তবতার ধারনা প্রচার করে। এরজন্য, সব জায়গায় সব সময়ে বিলি করা যায় এমন হ্যান্ডবিল ছাপা থাকলে, বিলি করলে হয়, যা কোন সংগঠনের মাধ্যমে করা হয়ে থাকলেই ভালো হয়, জোরদার হয়। বড় বড় বই কিনে পড়ে লোকে যুক্তিবাদী হবে, কুসংস্কারের ব্যাবসায়ী ধান্দাবাজরা পিছু হঠবে, এটা আশা করাই হাস্যকর। এবং যে কোন একক প্রতিবাদীই হয় হাসির পাত্র।

যখনই কেউ নতুন বাড়ি বানায়, কর্তা গিন্নি দুজনেরই কল্পনায় থাকে ছোট্ট একটা ঠাকুরঘর। যারা পারে না বা যাদের নেই, তারা একটা কোনে বসিয়ে নেয় ঠাকুরের আসন। কেউ, ঠাকুরের জন্য কাঠের আসন বা সিংহাসন, ফার্নিচারের দোকান থেকে কিনে এনে দেওয়ালে টাঙিয়ে দেন এই আসন। এই মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। চাই যুক্তিবাদী ফার্নিচারের দোকান, যে তার বিঞ্জাপনে লিখে রাখবে, এখানে কোন ঠাকুরের আসন বিক্রি হয় না বা বানানো হয় না। বাড়ি বানানোর সিভিল ইঞ্জিনীয়ার লিখে রাখবে, আমি মানুষের ঘরের প্ল্যান বানাই, ঠাকুরঘরের প্ল্যান বানাই না।

বাড়ির বাচ্চা কোলে করে কাজের মাসি কি আপন মাসি, তাকে ক্যালেন্ডারে ঠাকুর চেনাচ্ছে আর বলছে, নমো কর, নমো কর। কোন ক্যালেন্ডার ওয়ালার কি হিম্মৎ হবে, শুধুই রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সূর্য সেন, ক্ষুদিরামের ক্যালেন্ডার বানানোর? সে কি লিখে রাখার হিম্মত দেখাতে পারবে, যে সে ঠাকুরের ক্যালেন্ডার ছাপায় না? একশ' টাকার বিজনেসে তার হয়ত আঠানব্বই টাকাই আসে নানাবিধ ঠাকুরের ছবির (হনুমানেরও হতে পারে) ক্যালেন্ডার বেচে।  আমাদের একমাত্র ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ বলে আমরা সস্তায় ফেসবুকে আলোড়ন তুলতে ব্যাস্ত, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের র' জানতে চিনতে অনীহা। কেননা তাতে প্রভূত পরিশ্রম আছে।

বাড়িতে পূজোর আয়োজন হয়েছে। ছোটখোকা ঘোর নাস্তিক। সে তার নিজের ঘর থেকে বেরোবে না। বাড়ি ভর্তি পাড়ার লোক, আত্মীয় স্বজন। বড়খোকার উপর ভার দেওয়া হল, তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে একঘন্টার জন্য যেন নিয়ে আসে পূজোর ঘরে।

নিজের বাড়ি হোক কি পরের বাড়ি, কাউকে যখন বেরোতে দেখা যায় বাড়ির কোন সদস্য বা সদস্যা হয়ত বলে ওঠেন দুর্গা, দুর্গা। এটা হয় এবং হয়ে থাকে আজন্ম সংস্কার বা শিকড়হীন এক বিশ্বাস থেকে। যেন, রাস্তাঘাটে অদৃশ্য মা দুর্গা তাকে রক্ষা করবেন। যে যাচ্ছে, তার যাত্রার শুভ কামনা করাই উদ্দেশ্য। সেখানে বাস্তবতা মেনে, যাত্রা শুভ হোক বললেই তো হতে পারে। সবচেয়ে বলা ভালো, চোখ কান খোলা রেখে যেও। সত্যিই যা দিনকাল পড়েছে!

বাড়ির লোকজনের মধ্যে কোন একটা বিষয়ে হয়ত আলোচনা চলছে। এমন সময়ে বেয়াদপ টিকটিকি ডেকে উঠল, আর কেউ একজন হাতের আঙুলে তিন তুড়ি মেরে বলল, 'ঠিক, ঠিক, ঠিক'। চোখে ভেসে ওঠে হীরক রাজার দরবার, রাজা তিনজন পারিষদকে পরপর প্রশ্ন করেন 'ঠিক কিনা?' উত্তর আসে, 'ঠিক,' 'ঠিক,' 'ঠিক'।


ছেলেমেয়েরা মা বাবাকে প্রণাম করে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে, মা হয়ত বলে উঠলেন, মা সরস্বতীকে স্মরণ করো, তিনি সব ঠিক করে দেবেন। সত্যিই কি তাই? পড়াশুনা না করে থাকলে, কোন দেব বা দেবীই কলমের নিবের ডগায় বসে গড়গড়িয়ে প্রশ্নের উত্তর লিখিয়ে দেবে না। সরস্বতীর যুক্তিতে, রেজাল্ট খারাপ করা কোন ছাত্রছাত্রীকেই দোষারোপ করা মোটেই ঠিক না।

বন্ধুরা মিলে হুইস্কির আসর বসিয়েছে। জল, সোডা, চিপস্, বাদাম, পেঁয়াজ, আদাকুচি, কোন ত্রুটি নেই আয়োজনে। এক বন্ধু তুখোড় ব্যাবস্থাপনায়। ছিপি খুলে প্রথমেই মাটিতে তিন ফোঁটা ফেলে ভূমি পূজণ সেরে পেগ সাজিয়ে ফেলল। এই ভূমি পূজনটা কেমন বেমানান (সুপারস্টিশন) হয়ে গেল না? নাকি মদ খাওয়ার আনন্দে 'এই একটুখানি' বলে নিজের বিবেককে ফাঁকি দেওয়া যায়?

নার্সিং হোমে রুগী ভর্তি আছে। কয়েক মাসের চেষ্টায় অনেক পরিশ্রমে বেশকিছু অর্থের বিনিময়ে ভর্তির পর আজ অপারেশনের ডেট পাওয়া গেছে। অপারেশন থিয়েটারে ঢুকবার সময়ে ডাক্তার বলে গেলেন, এখন যা করবার উপর-ওয়ালাই করবেন, তাঁর উপর ভরসা রাখুন। বিজ্ঞান শিক্ষিত ডাক্তার, বিজ্ঞানের অবদান চিকিৎসা বিদ্যাকে হেয় করে উপর-ওয়ালার দোহাই দিলেন। বাড়ির মেয়েরা নার্সিং হোমের নিচতলায় কোন এক দেব বা দেবীর ছোট করে বানিয়ে রাখা মন্দিরে প্রার্থনায় বসে গেলেন। চতুর চূড়ামনি নার্সিং হোম কর্তৃপক্ষ এটাকে কি কায়দা করে বানিয়ে রাখে নি, যাতে করে, রুগীর মৃত্যুতে গাফিলতির অভিযোগ তুলে রুগীর আত্মীয়স্বজন নার্সিং হোম, ডাক্তার নার্সের উপর চড়াও না হতে পারে?


এরকমই, প্রায় সব নার্সিং হোমে, প্রাইভেট হাসপাতালে, পুলিশ ব্যারাকে, থানা চত্বরে, বড় বড় আবাসনে, বাজারে বড় ছোট মন্দির, মসজিদ, গুরুদ্বারা, যারা যেখানে যেমন জমাতে পেরেছে, বানিয়ে রেখেছে। খুব ভালো ভাবে ভেবে দেখলে বোঝা যাবে, এতে করে কেমন ভাবে শাসক এবং শোষক শ্রেনীর স্বার্থই পুষ্টিলাভ করে। তামাম দেশবাসীকে বাসস্থান, অন্ন, বস্ত্রে স্বনির্ভর করা অসাধ্য নয়। অসাধ্য নয় ভালো শিক্ষা, স্বাস্থ্যের ব্যাবস্থা করা। কিন্তু, তাতে করে ভোট পাওয়ার আশা নাও থাকতে পারে। এবং নিজেরা একচ্ছত্রভাবে সুখের সিংহাসনে বসে ছড়ি ঘোরাতেও পারবে না। তাই, শাসকশ্রেনীর লক্ষ্য থাকে আপামর জনসাধারণকে ভাগ্যবাদী করে তোলা।


ব্যাস্ত জাতীয় সড়কের পাশেই আছে বিপত্তারিনী মন্দির। যাওয়া আসার সময়ে সব বাসের গতি ধীর হয়ে যায়, যাতে গদ্গদ ভক্তবৃন্দ একটাকা দু টাকা দেবীকে উদ্দেশ্য করে মন্দিরের দিকে ছুঁড়ে দিতে পারে। কন্ডাক্টার নিজেও ছুঁড়ে দেয় কয়েন। ওখানে অনেক দু চাকা চারচাকা, নতুন গাড়ি কিনলেই মালিকরা আসেন পূজো দিতে। দেবী নাকি দু চাকা, চারচাকা গাড়ি ও গাড়ির চালক বা আরোহীকে রক্ষা করেন। অথচ এমনও নজির আছে, পূজো দিয়ে ফেরার সময়েই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে নতুন গাড়ি ভেঙেছে, আরোহীদের মৃত্যু হয়েছে।

বাজারের মোড়েই ডানদিকে টিনের চেয়ারে লালশালু ঢেকে বসিয়ে রাখা আছে শনির ফটো, পাশে কাঁসার থালায় কটা জবাফুল, জ্বলন্ত ধূপকাঠি, কিছু কয়েন, দশ বিশ টাকার নোট। তাঁর কোপে না পড়তে হয়, বাজার ফিরতি দশটাকার নোট ফেলে দিলাম অকাতরে। দোকান বন্ধের সময়ে এসে নজর করলে দেখতে পেতাম, শনি ঠাকুরের ব্যাপারী ফটো, শালু, থালা, খুচরো সমেত চল্লিশ পঞ্চাশ টাকা মূলধন, বাজারের থলেতে ভরে, গুনগুন

গাইতে গাইতে লাভের টাকাগুলো পকেটে ভরে নিচ্ছে। তার না আছে শনির কোপের ভয়, না আছে রবি সোমের পরোয়া।

প্রবল মেঘ গর্জন, মূহুর্মূহু বিদ্যূত চমক তৎসহ ঝোড়ো হাওয়ার দাপট। নিতান্তই প্রাকৃতিক ঘটনা। বাড়ির কর্তাগিন্নি একযোগে শুরু করলেন হরি মাধবের স্তব।

বাড়ির গাছে এই বছরের প্রথম ফল, নারকেল কি আম কি কুল বা অন্য যা কিছুই হোক, দেবতাকে নৈবেদ্য না দিয়ে খাওয়া যাবে না, কাউকে দেওয়া যাবে না।

কোন গাছ কাটার দরকার পড়েছে। বৃক্ষদেবতার কাছে করজোড়ে মাপ চেয়ে নিয়ে কেটে ফেললেই হল। যুক্তি তক্কে যাই না যে, আগে একটা বিকল্প বৃক্ষরোপন করি, তারপরেই না হয় গাছ কাটবো।

এক পানগুমটি দোকানদারের অকুন্ঠ স্বীকারোক্তি, সারাদিন তো লোকজনকে পান, দোক্তা, জর্দা, বিড়ি-সিগারেট খাওয়াচ্ছি, কোনটাও ভালো জিনিস নয়, তাই সকাল সন্ধ্যা ধূপ জ্বালিয়ে ঠাকুরের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিই, যাতে পাপ না দেন (ঠাকুর ঠাকুরানীরা ঘুষখোর কিনা পাঠকই বলবেন)।

রেলের কোন শিলান্যাস কি, জলজাহাজ উড়োজাহাজের কোন কিছুর উদ্বোধন হোক, ধূপ জ্বালিয়ে, কাঁসর বাজিয়ে, নারকেল ফাটিয়ে মঙ্গল কামনা করছেন বিজ্ঞান শিক্ষিত চিফ ইঞ্জিনিয়ারের দল।

তারকেশ্বরই হোক কি বৈদ্যনাথধামই হোক, ভোলে বাবা কি জয় চিৎকারকারীর সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। তরুন প্রজন্ম একে অ্যাডভেঞ্চারের চোখেই দেখছে নাকি ভক্তির চোখে দেখছে, বলা অসম্ভব। অন্যদিকে রেল এবং রাজ্য সরকার গ্রাফ এঁকে চলেছেন, এই বছরে কত তীর্থযাত্রীর সংখ্যাবৃদ্ধি হল। গঙ্গাসাগর নিয়েও একই কথা বলতে হয়। এরকম বহু উদাহরণ চেষ্টা করলেই খুঁজে পেতে অসুবিধা হবে না।

সেই বোকা গৃহস্থ আর চালাক চোরের কথা মনে পড়ে নাকি? যে গৃহস্থ, বাড়িতে চোরের ঢোকা থেকে, তার নিজের বালিশের তলা থেকে চাবি নেওয়া থেকে, আলমারি খোলা পর্যন্তও, শুধু দেখে গেল এবং তখনও ভেবেই যাচ্ছে যে 'দেখি না, এরপর কি করে?' ফল যা হবার তাই হল, চোর বাবাজী ধীরে সুস্থে গৃহস্থের লুঙ্গি খুলে পোঁটলা বেঁধে, দরজা হাট করে খোলা রেখে, বামাল বেরিয়ে গেল।

চোর নিরাপদ দূরত্বে গেলে (আসলে  গৃহস্থ নিজেকে নিরাপদ মনে করলে তবেই), তারস্বরে আর্তনাদ শুরু করল চোর, চোর বলে।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929