বার্ডেন অব প্রুফ

আমিনুল ইসলাম ইমন


Nov. 21, 2024 | | views :577 | like:0 | share: 0 | comments :0

Burden of Proof নামের একটা বিশেষ কনসেপ্ট আছে যেটার সাথে আমাদের দেশের সংস্কৃতিতে অশিক্ষিত মানুষ তো নয়ই খুব কম শিক্ষিত মানুষ পরিচিত। অথচ এই কনসেপ্ট ক্লিয়ার না থাকলে মানুষ কখনো যৌক্তিক বা বিজ্ঞানমনষ্ক হবে না।

এই কনেসেপ্ট এর মূল কথা হল,

 

“যে ব্যাক্তি কোন বিষয়ে কোন পজিটিভ ক্লেইম করবে তার স্বপক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করার দায় শুধুই তার”

 যেমন, কেউ যদি দাবি করে তার বাসায় একটা হরিণ আছে, এটা অন্যকে বিশ্বাস করাতে চাইলে তাকেই প্রমাণ করে দিতে হবে যে হরিণটা আসলেই তার বাসায় আছে। অনেক ভাবেই প্রমাণ করা সম্ভব। তার মধ্যে কোন না ভাবে সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ তাকে করতেই হবে। না হলে তার কথাটা বিশ্বাস না করার দায় অন্যকে দিতে পারবে না। এক্ষেত্রে ব্যাপারটা সহজ, সে মানুষ জনকে বাসায় নিয়ে হরিণটা দেখাইলেই হবে। আবার অন্যান্ন বৈজ্ঞানিক উপায়ে স্বশরীরে  না নিয়ে গিয়েও প্রমাণ  করতে পারে।

সমস্যা আরেকটু জটিল হবে যখন কেউ দাবি করবে যে তার বাসায় একটা হরিণ আছে যেটা শুধু রাতের বেলা হেঁটে হেঁটে বাসায় হাজির হয়। সে নিজে দেখে কিন্তু অন্য কাউকে দেখাতে গেলে পালিয়ে যায়, কোনভাবেই সে হরিণটাকে প্রমাণ করতে পারছে না। কিন্তু সে সত্যি সত্যিই প্রতিদিন তাকে দেখে। তখন তার কথা অন্যদের বিশ্বাস করা উচিত, নাকি উচিত না?  হয়ত লোকটা বাকি সব বিষয়ে সত্যবাদী, সুতরাং এই একটা বিষয়ে মিথ্যা বলেব কেন? আবার এমন ও হতে পারে এইই লোকটা সত্যবাদী হলেও সে এইএকটা বিষয়ে কোন কারণে মিথ্যা বলছে। তাই ভেবে  তাকে মিথ্যাবাদী ভেবে নেওয়াই বা কেমন হয়ে যাচ্ছে। আমাদের কাছে তো আর এমন কোন প্রমাণ তো নেই যে,  মধ্য রাতে তার বাসায় হরিণটা সত্যিই আসে না। আসতেও তো পারে। বিশেষ করে তার বাসা বন জঙ্গলের কাছে হলে তো হরিণ আসা অসম্ভব কিছু না।

তাহলে আমাদের করনীয় কী? একজন যুক্তিবাদী মানুষ এক্ষেত্রে কি করবে? একজন বিজ্ঞানী কি করবে? একজন সুশিক্ষিত মানুষ এখানে কি করবে? উত্তর হচ্ছে, তাকে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনটাই করবে না। তারা তাদের সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখবে।

এ আবার কেমন কথা!  আমরা কি তাইলে এরকম হাজারো দাবীর বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবো? উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ। এরকম সিদ্ধান্তহীনতায় থাকা, বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝে থাকাটাই হচ্ছে আসল শিক্ষা।

আমরা আমাদের জগত সম্পর্কে খুব অল্প কিছু কিছুই জানি, বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর জানি না।

কেউ যদি জিজ্ঞ্যেস করে, আসলে কি এলিয়েন আছে, ভূত আছে, মারমাইড আছে, সান্টা ক্লজ আছে, ড্রাকুলা আছে, আমাদের উত্তর হবে জানা নাই। কিন্তু কেউ যদি দাবি করে এর কোন একটা  আছে, তখন তাকেই চেপে ধরতে হবে, মামা এই বার তো Burden of proof তোমার ঘাড়ে এসে পড়ল। প্রমান করে দেখাও দেখি? আমরাও ব্যাপারটা বুঝে নেই। তার পাল্টা উত্তর এটা দিলে চলবে না যে, তুমি বা  তোমাদের বিজ্ঞান কি প্রমাণ করে দিয়েছে যে  ভূত নেই, মারমেইড, সান্টাক্লোজ বা ড্রাকুলা নেই? তার এ কথাই প্রমাণ করে যে সে প্রমাণ করা করার প্রসেসটাই বোঝে না। অর্থাৎ Burden of proof কনসেপ্টটা বোঝে না। সে আমাদের দেশের বেশাইরভাগ মানুষের মতই  সাধারণ একজন। অথচ এরকম অসংখ্য দাবি নিয়েই আমাদের মানব জীবনে বসবাস।

এই যেমন ঔষধ জগতে, কেউ বলে খেজুর খেলে রোগ ঠিক হয়, কেউ বলে গোমূত্র। কেউ বলে তুলসী, কেউ বলে জলপাই, কেউ বলে কুয়ার পানি, কেউ বলে নদীর জল। কেউ বলে ঝাড় ফুক, কেউ বলে তন্ত্র মন্ত্র। কেউ হোমিও কেউ এলো। কত ছাল বাকল, কত শিকড় বাকড়, কত পাতা, কত বিচি, লক্ষ কোটি গাছ পালা, পোকা মাকড়,  কে জানে কার মধ্যে কী উপকার বা অপকার আছে, তাই না? এই সব ক্ষেত্রে উত্তর হবে, আমরা জানি না। যে দাবি করবে তাকেই চেপে ধরতে হবে, বলতে হবে ব্রাদার proof টা দেখাও না please.

আমরা যতক্ষণ এই লেখাটি পড়ছি ঠিক তখন বিশেষ ধরনের কিছু মানুষ (লাখ লাখ তো হবেই) ঠিক এই মুহুর্তে  নিবিষ্ট মনে খুঁজে বেড়াচ্ছে এসবের মধ্যে আসলেই কোনটা কতটা উপকারী বা কোনটা ক্ষতিকর। কেউ খুঁজে পেলেই মহা উতসাহে অন্যদের জানাচ্ছে, তার মধ্যে বেশির ভাগ প্রাপ্তিই  অন্যরা পরীক্ষা করে দেখতে গিয়ে কোন না কোন ত্রুটি খুঁজে পাচ্ছে। তারা সবাই মিলে পরেরদিন থেকে আরও সতর্ক হয়ে খুঁজছে। মোটামুটি ভাল কিছু পাওয়া মাত্র সেটা নানা পেপার বা জার্নালে লিখে ফেলে কোটি মানুষের সামনে সেটার বিচারের ভার তুলে দিচ্ছে। তাদের প্রতিদিন এর প্রাপ্তির যোগফলকেই  আমরা বিজ্ঞান বলি, এঁর ওই বিশেষ  মানুষগুলোকে আমরা বিজ্ঞানী বলি।

এই বিজ্ঞানীরা আবার অন্য সাধারণ মানুষদের মত, গোষ্ঠীকেন্দ্রিক না।  তারা নিজেদের গোত্রের একে অন্যকে তেল মেরে বা মুখ রক্ষা করে চলে না। তাদের কোন নেতা নাই, তারা কারো ভক্ত না।  বরং তারা  সারাক্ষণ একে অপরের ভুল ধরার চেষ্টায় থাকে, ভুল ধরে, ভুল শুধরে ঐষধটার নতুন আপডেট বা রিপ্লেসমেন্ট বের করে। তাদের সম্মিলিত এই সব কর্মকান্ডে  বিজ্ঞান প্রতিদিন আগের দিনের চেয়ে একটু বদলে যায়, আরেকটু উন্নত হয়। ঠিক যেভাবে আমাদের হ্যাতের মোবাইল গুলো আপডেট হয়।

এই যে পজিটিভ ক্লেইম এর নিজ Burden বুঝে দ্বায়িত্বে নিজ কাঁধে তুলে নেওয়ার ইচ্ছা, প্রমাণ খুঁজে বের করার চেষ্টা, অন্যদের প্রমাণে সন্দেহ করা, ভুল খেজে বেরার করার চেষ্টা এবং দিন শেষে খানিকটা আপডেট হওয়া, "জ্বী এটাই সায়েন্স"। 

এটা সত্যি কথা যে এই প্রক্রিয়া খুব স্লো। এর চেয়ে কোন একটা কিছু বিশ্বাস করে নেওয়া অনেক স্বস্তির। এত চিন্তা করলে জীবন অতীষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া এই বিজ্ঞান প্রক্রিয়ায় আমাদের জীবদ্দশায় আমাদের মনে মধ্যে লুকিয়ে থাকা লক্ষ কোটি প্রশ্নের মধ্যে খুব কম প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে। হয়ত কিছু প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান কোনদিনই দিতে পারবে না। কিন্তু সত্য কথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে। আমোদের বলতে হবে ‘আমাদের জানা নাই’।  

আমাদের জানা নাই বলার মধ্যে কোন মূর্খতা বা অজ্ঞতা নাই, কোন চতুরতা বা মিথ্যা নাই। কোন ভ্রান্তি বিলাস বা মানসিক প্রশান্তি নাই। তবে সততা আছে। নির্ভেজাল সততা আছে। 

আমাদের জানা নাই বলাটা আমাদের ইশকুল, মাদ্রাসা, ও  নানা বইয়ের পাতায় পাতায় লিখে লিখে পরবর্তী প্রজন্মের  মগজে ঢোকাতে হবে। তাইলে তারা আরও জানতে চাইতে, শিখতে চাইবে। মুখস্ত বাদ দিয়ে খুঁজে বের করতে চাইবে।  প্রতিটা পজিটিভ ক্লেইমকে চ্যালেঞ্জ করে Burden of proof কনসেপ্ট টা দেশের ঘরে ঘরে  ছড়িয়ে দেবে। তখন,  পীর, ফকির, তান্ত্রিক, ওঝা, কবিরাজ, হোমিও যে যাই বলুক তাকে বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের লটারিতে না ফেলে, নিজেরা সারা জীবন দোটানায় না থেকে Burden of proof এর নিয়ম মেনে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

"what may be asserted without evidence, may be dismissed without evidence." Carl Sagan

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929