গল্পের ফাঁকফোঁকর : অসম প্রেমের পরিণাম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিয়োগান্তকই হয়েছে।

Guitar K Kanungo


Dec. 28, 2024 | | views :62 | like:3 | share: 2 | comments :0

হিন্দু পুরাণের সঙ্গে গ্রীক পুরাণের একটা অদ্ভুত মিল আছে। এই দুই পুরাণেই অমর দেবতাদের সঙ্গে মরণশীল মানুষের বেশ কিছু যৌন মিলনের ঘটনার কথা উল্লেখ আছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেবতারাই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে, মরণশীল মানব বা মানবীর তাদের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। ব্যাপারটা এমন নয় যে একজন মানব একজন মানবীতে সন্তুষ্ট হতে পারছে না। মহাভারতে নল-দময়ন্তীর কথা বলা হয়েছে; একইভাবে ইলিয়াডে বলা হয়েছে ওডিসিউস এবং পেনেলোপের কথাও।

রামায়ণ এবং মহাভারতে অজস্র উদাহরণ আছে। রামায়ণ দিয়েই শুরু করি। ঋষি বিশ্বামিত্র মেনকা নামের এক অপ্সরার সঙ্গে মিলিত হলেন। অপ্সরারা স্বর্গ-বেশ্যা; তাঁর সুন্দরী হওয়াটাই স্বাভাবিক, কিন্তু বিশ্বামিত্রের কাছে এই গোটা ব্যাপারটা ছিল একটি ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড। মিলনের পর তিনি তাঁর নিজের পথে চলে গেলেন, আর মেনকাও সন্তান জন্ম দিয়ে তাঁর নিজের পথে, অর্থাৎ স্বর্গে ফিরে গেলেন। এদের মিলনের ফলে যে সন্তানটির জন্ম হলো, তিনি ভুবনবিখ্যাত—তাঁর নাম শকুন্তলা। এই শকুন্তলা এবং দুষ্মন্তের সন্তান ভরতের নামেই আমাদের ভারতবর্ষের নামকরণ হয়েছে।

আবার এমন ঘটনাও ঘটেছে যেখানে অপ্সরারা মর্ত্যভূমিতে থেকে গেছেন এবং একেবারে ঘর-সংসার করেছেন কাঙ্ক্ষিত পুরুষের সাথে নির্দিষ্ট এক সময় পর্যন্ত। অপ্সরা উর্বশীর কথাই ধরা যাক। তিনি কুরুবংশের পূর্বপুরুষ রাজা পুরুরুবার প্রেমে পড়ে স্বর্গভূমি ছেড়ে এসেছিলেন। তবে এই ছেড়ে আসার একটি শর্ত ছিল, এবং সেই শর্তভঙ্গ হওয়ার কারণে তিনি আবার পুরুরুবাকে ছেড়ে স্বর্গে ফিরে গিয়েছিলেন। তাদের মিলনের ফলে আয়ু নামের এক সন্তানের জন্ম হয়, যিনি উপযুক্ত সময়ে পুরুরুবার স্থলাভিষিক্ত হন।

পিতামহ ভীষ্মের পিতা শান্তনুর ক্ষেত্রেও একইরকম ঘটনা ঘটেছিল। ভীষ্মের জননী গঙ্গা সাধারণ মানবী ছিলেন না; তবে তিনি অপ্সরাও ছিলেন না। দেবী গঙ্গা শর্তসাপেক্ষে মহারাজ শান্তনুর ঘরণী হতে সম্মত হয়েছিলেন। এক্ষেত্রেও একটি শর্ত ছিল—দেবী গঙ্গা তাঁর কোনো কাজের জন্য কাউকে, এমনকি মহারাজ শান্তনুকেও, জবাবদিহি করবেন না। এই শর্ত ভঙ্গ হলে তিনি শান্তনুকে ছেড়ে চলে যাবেন। দেবব্রতের জন্মের আগে গঙ্গার গর্ভে সাতটি সন্তানের জন্ম হয়েছিল, যাদের প্রত্যেককে তিনি নদীতে ডুবিয়ে হত্যা করেছিলেন। কেন তিনি এমন নিষ্ঠুর কাজ বারবার করে চলেছেন, এই প্রশ্ন তুলেই মহারাজ শান্তনু শর্ত ভঙ্গ করেছিলেন, যার ফলে দেবী গঙ্গা তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।

আমরা যাকে উষা বলি, গ্রীকরা সেই ঊষাকে এওস নামে ডাকে। দেবী এওস ট্রোজান রাজকুমার টিথোনাসের প্রেমে পড়ে যান। প্রেমে পড়ারই কথা, কারণ টিথোনাস ছিলেন যেমন স্বাস্থ্যবান, তেমন সুদর্শন। সৌন্দর্যের বিচারে দেবী এওসও কম যান না। অতএব, চার চক্ষুর মিলন হলো। কিন্তু একটা সমস্যা থেকেই গেল। এওস দেবী, কিন্তু টিথোনাস মরণশীল মানুষ। এই সমস্যার সমাধান করতে দেবী এওস দেবরাজ জিউসের কাছে হাজির হয়ে টিথোনাসকে অমর করে দেওয়ার আবেদন জানালেন। দেবরাজ জিউস নিজেও অনেক মানবীর প্রেমে পড়েছেন, অতএব তিনি এওসের অনুভূতিটা বুঝতে পারলেন। এওসের আবেদন মঞ্জুর হলো। কিন্তু এখানেই একটা বিপত্তি ঘটল। কী বিপত্তি ঘটল, সেটা একটু পরে বলছি। তার আগে আরেকটি ঘটনার কথা বলে নিই।

এলসিমেনে ছিলেন তিরিনসের রাজকুমার এমফিতরাইয়োর স্ত্রী। রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী। দেবরাজ জিউসের বেশ ভালো লেগে গেল এলসিমেনেকে। রূপবতী নারী দেখলেই জিউসের ভালো লাগে। রাজকুমার এমফিতরাইয়ো যখন অন্যত্র যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন, তখন জিউস এমফিতরাইয়োর রূপ ধারণ করে এলসিমেনের কাছে হাজির হলেন। এলসিমেনে ধরে নিয়েছিলেন স্বামী যুদ্ধ থেকে ফিরেছেন, এমফিতরাইয়োর কোনো আচরণ তাঁর মনে কোনো রকমের সন্দেহের উদ্রেক করেনি। যথাসময়ে তাঁরা মিলিত হলেন। এই ঘটনার সঙ্গে ইন্দ্র এবং অহল্যার মধ্যকার ঘটনার বেশ মিল আছে, একটি ব্যাপার ছাড়া। এলসিমেনে মানবগর্ভজাত হলেও অহল্যাকে অনেকটা প্যান্ডোরার সঙ্গে তুলনা করা চলে—যাঁকে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা মানবী করে সৃষ্টি করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন।

এলসিমেনের ক্ষেত্রে না ঘটলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, দুই পুরাণেই এই ধরনের অসম প্রেমের পরিণতি ভালো হয়নি, সেকথাই বলা হয়েছে। জিউস তাঁর যৌন লালসা চরিতার্থ করার জন্য মর্ত্যের নারীদের পেছনে ঘোরাঘুরি করলেও এবং এই সমস্ত মিলনের ফলে কখনো কখনো ভুবনখ্যাত সন্তানের জন্ম হলেও (এলসিমেনে যে সন্তানের জন্ম দেবেন, তার নাম হারকিউলিস, যিনি অনেক অসাধ্য সাধন করবেন এবং নিজের যোগ্যতায় দেবতার পদমর্যাদা লাভ করবেন), অনেক ক্ষেত্রে জিউসের লালসার শিকার সেই নারীদের জিউসের স্ত্রী হেরার আক্রোশের শিকার হতে হয়েছে।

দেবী এওস এবং টিথোনাসের কথা আগেই বলেছি। এওস টিথোনাসকে অমরত্ব দিলেও চিরযৌবনের অধিকারী করার আবেদন করতে ভুলে গিয়েছিলেন। ফলে এওস যৌবনবতী থেকে গেলেও টিথোনাস এক পর্যায়ে বুড়িয়ে যেতে শুরু করেন। শরীরের আবেদন ফুরিয়ে যেতেই প্রেমেরও সেখানে সমাপ্তি ঘটে।

হিন্দু পুরাণের ঘটনাগুলোও তেমন। ইন্দ্র এবং অহল্যার মিলনের ফলে হারকিউলিসের মতো কোনো সন্তানের জন্ম হয়নি, বরং দুজনেই অভিশাপ কুড়িয়েছেন। অহল্যা ইন্দ্র দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন, এমন দাবি করলেও তাঁর স্বামী গৌতম অহল্যার কথা বিশ্বাস করেননি। এদিকে, ইন্দ্র তো হাতেনাতেই ধরা পড়েছিলেন। অপকর্মের দায় থেকে মুক্তি না পেয়ে তাঁর কোনো উপায় ছিল না। ইন্দ্র যেহেতু দেবতা, দেবতাদের রাজা, সেহেতু গৌতমের অভিশাপ কাটিয়ে উঠতে পারলেও অহল্যাকে রূপ-যৌবন হারিয়ে পাথর হয়ে পড়ে থাকতে হয়েছিল হাজার বছর।

উর্বশী পুরুরুবাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, একই কাজ করেছিলেন গঙ্গাও। তিনি শুধু চলেই যাননি, তাঁর গর্ভজাত সব সন্তানকেও নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য দেবব্রতকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছিল বিশ্বামিত্র এবং মেনকার ক্ষেত্রে। শকুন্তলাকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন মেনকা। বিশ্বামিত্র জানতেনই না যে তাঁর একটি কন্যাসন্তান হয়েছে। কণ্ব মুনি সেই মেয়েকে কুড়িয়ে পেয়ে বড় করে তুললেও দুর্ভাগ্য শকুন্তলার পিছু ছাড়েনি। রাজরানী হওয়া সত্ত্বেও রাজপাঠে বসার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। উল্টো, সন্তানের পিতৃপরিচয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁকে অনেক লড়াই করতে হয়েছে।

দেবতা ও মানুষের এই ধরনের অসম প্রেমের পরিণতি প্রায় সবক্ষেত্রেই বিপর্যয়মূলক হলেও, এই প্রেম থামেনি। দুই পুরাণে যেসব ঘটনা এখানে আলোচনা করা হয়েছে, এর বাইরেও অনেক ঘটনার উল্লেখ আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেগুলোকেও ধর্ষণ বলা চলে। গ্রিক দেবতা পোসাইডন মেডুসার সঙ্গে যা করেছেন, সেটাকে ধর্ষণই  বলতে হবে। মুশকিলের ব্যাপার হলো, ধর্ষিতা হয়েও ধর্ষণের দায়টা ধর্ষিতাকেই নিতে হয়েছে। মেডুসা তার উদাহরণ। এথেনা মেডুসাকে অভিশাপ দিলেও পোসাইডনকে কোনো শাস্তি দেননি। হয়তো এথেনার ক্ষমতা ছিল না পোসাইডনকে শাস্তি দেওয়ার।

সুখের কথা, হিন্দু পুরাণে ধর্ষণের শাস্তি দুপক্ষকেই ভোগ করতে হয়েছে। অহল্যা এবং ইন্দ্রের ক্ষেত্রে, সহজভাবে চিন্তা করলে অহল্যা ধর্ষিত হয়েছেন, সেক্ষেত্রে ইন্দ্র একজন ধর্ষক। আবার একটু জটিলভাবে ভাবলে দেখা যায়, অহল্যা তাঁর যৌন জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। ফলত, তিনি ইন্দ্রকে কামনা করেছেন। তবুও ইন্দ্র অপরাধ করেছেন, কারণ তিনি নিজে বিবাহিত এবং যাঁর কামনা পূরণ করতে গেছেন, তিনিও বিবাহিত। অতএব, শাস্তি ইন্দ্রকেও পেতে হয়েছে।  পোসাইডনের মত ইন্দ্র পার পেয়ে যাননি ; শাস্তির মাত্রা কমাতে তাঁকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল।    




আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929