বয়স তাঁর ৭৫, কবিতার আসরে একটি কবিতা শোনালেন। মুক্তমনের কবিতা। বক্তব্য, পৃথিবীতে অনেক অনেক দেশ আছে, যেখানে লক্ষ্মীপুজো করা হয় না কিন্তু ব্যবসায়ে তারাই অনেক এগিয়ে অনেকানেক দেশ আছে যে দেশের অনেকে সরস্বতীর নামই শোনেনি, কিন্তু তারাই শিক্ষায় জ্ঞানে বুদ্ধিতে বিজ্ঞানের আবিষ্কারে পথ দেখাচ্ছেন সারা বিশ্বকে। পুজোর নীটফল আসলে শুন্য। প্রার্থনার ভরসায় না থেকে, সেই সময়টাতে কায়িক বা মানসিক উৎপাদনাত্মক কাজ করার সুপরামর্শ বিষয়ে কবিতা। বৌদ্ধিক বিকাশে পুজো-আচ্চার সার-শুন্যতাই তাঁর কবিতার উপজীব্য-কেন্দ্র। পাঠশেষে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, বেশ একটা অন্য রকম চিন্তা ভাবনা। তাই নয় কি?
বুঝলাম, জীবনের ৭৪-টি শরৎ-আঁধার পার করার পর তাঁর মাঝে এই সু-বোধ এসেছে। মুক্তচিন্তনের জানালা খুলে মুক্তির বাতাসের বার্তায় কান রাখার সন্ধিক্ষণ এসেছে তাঁর জীবনে। তিনি নতুনের পেয়েছেন সন্ধান, সত্যের আলোয় দিশা পেয়েছেন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে। এগুলি খুবই ভাল কথা, আশার কথা। এই আশার কথা নিয়েই আজ দুটো কথা লিখি। মুক্ত চিন্তনের পরিসর করে দেওয়া আমাদের দায়। তাঁর কাছে যাওয়ার কথা ছিল আমার, দেবরাজের আর অনির্বাণের। উনিই একদিন চলে এলেন আমার বাড়িতে। অনেক কথা হলো। ভাল লেগে গেল ৭৫ বছরের এই যুবকটিকে। তাঁর মাঝে যুক্তিবাদের এই উন্মেষকে প্রত্যক্ষ করেই এবারের চেতনায় লেখার বিষয় পেয়ে গেলাম। বুঝলাম, দ্বীপে শুধু আমরা কয়েকজনই নেই, আমাদের সমমনস্কের প্রসারতার মহাবিশ্বে অনেকেই আমাদের আজো অজানা, আজো অজ্ঞাত। আজ তাই আমাদের আশার কথা নিয়েই এক কলম লেখার প্রয়াস।
দ্বিতীয় জনকে যেমন দেখেছি:
ইনি একজন রাজমিস্ত্রী। কাজ করছিলেন আমাদের বাড়িতে। লেখাপড়া ঐ ক্লাস নাইন কি টেন পর্যন্ত। কিন্তু তার সম্বন্ধে একটা কথার উল্লেখ না করলেই নয়। নিয়মিত লাইব্রেরী যান। রাত্রে বই পড়েন; শরৎ থেকে শরদিন্দু সব। আগাথা ক্রিস্টি, হ্যাডলি চেজ, ডিকেন্স, রবীন্দ্রনাথও তার পছন্দের লেখিকা-লেখক। জীবনানন্দও পড়ে ভাল লাগে। জিজ্ঞেস করলাম, প্রবীর ঘোষ বা ভবানিপ্রসাদ সাহুর বই পড়েছেন? বললেন, এই দুইজনই তাঁর অত্যন্ত পছন্দের লেখক। হাল আমলের তসলিমাও তাঁর আগ্রহের ভিতরেই। একবার আমাদের ধনিয়াখালী সুরভি পাঠাগারের সম্পাদকও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। বয়স ঐ রকমই অর্থাৎ মধ্য সত্তর। তিনি ব্রাহ্মণ, কায়স্থ্য, ডোম, হাড়ি, শুঁড়ি এসব জাতপাত মানেন না। বেদ পুরাণ হ'ল ব্রাহ্মণদের বানানো গ্রন্থ। ধর্মের কঙ্কাল তাঁর অন্তর্দৃষ্টিতে বেশ ধরা পড়ে। নিরীশ্বরবাদী না হলেও, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র ও মোল্লাতন্ত্রের কাঠামোটির অনেকটাই চিনে নিয়েছেন।
চায়ের দোকানে চা খাচ্ছিলেন কয়েকজন শ্রমজীবি। গান বাজছিল, "শত জনমের, কত সাধনায়, পেয়েছি মানব প্রাণ।" শুনে একজন অকপটে দ্বিধাহীন উচ্চৈস্বরে বলেন, গানটাতে ভুল বলছে, একেবারেই ভুল বলছে। জীবন একটাই। জন্ম একটাই। আগের জন্ম, পরের জন্ম, ওসব একেবারেই ধাপ্পাবাজি।
আমি সেখানেই ছিলাম। বেশ অবাক হয়েছিলাম। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কিভাবে বুঝলেন জন্মান্তর নেই? উনি উত্তর দিয়েছিলেন, আপনি দাবী করছেন জন্মান্তর বলে কিছু আছে? তাহলে আপনিই আপনার কথাটার প্রমাণ দিন। সত্যি অবাক হয়েছিলাম তাঁর এই যুক্তিশীল মানসিকতায়।
এক খ্যাতনামা জ্যোতিষীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বললেন, দেখো, আগে তো নিজের জীবিকা। জ্যোতিষ প্র্যাক্টিস করে উপার্জন আমাদের দেশে সম্মানের পেশা। তবে তুমি যেটি বলতে চাইছ, তাতে আমিও পূর্ণ সহমত। আমি তো বিজ্ঞান নিয়ে কিছুটা পড়েছি। তাতেই বুঝলাম, জ্যোতিষে বিজ্ঞানের কোনোকিছুই নেই। লোককে বিজ্ঞানের নামে ধাপ্পা না দিলে কিছু শিক্ষিত লোককে আমাদের আঙিনায় আনা যায় না।
এক ওঝা। আঁকিবুঁকি এঁকে, গুনে, মন্ত্রতন্ত্র, ঝাড়ফুঁক, তেলপড়া, জলপড়া দিয়ে ভূত তাড়ান। বাড়ির দোষ কাটান। একান্তে স্বীকার করেছিলেন, ভূত, প্রেত, বলে কিছুই নেই। তাঁর অভিজ্ঞতায় এগুলো খেটে খাওয়া, কোথাও এতটুকু আলো-না-পাওয়া সমাজের অন্ধবিশ্বাস। সেই অন্ধবিশ্বাসকে পুঁজি করেই আমাদের এই উপার্জন। মন সায় দেয় না। কিন্তু এ কাজে নাম হয়ে গেছে। পুরাতন পেশা। ছাড়ার কথাই চিন্তা করি না। কোনো প্রশ্নই আসে না। বরং আমার ছেলে যখন লেখাপড়া শিখে বেকার জীবন কাটাচ্ছিল। তাকে চাকুরির ব্যবস্থা ধ্বংস করে, কোটি টাকার পাহাড় জমাচ্ছিল নেতা-মন্ত্রীরা, দুটো টাকার জন্য হতাশায় ভুগছিল, সুইসাইড করতে যাচ্ছিল। তখন সেই অবস্থায় তাকে এই পথে আসার জন্য উৎসাহিত করি। এখন সে মাসে মাসে সম্মানজনক আয় করে থাকে। আর দেখবে, পয়সা না থাকলে তার কোনো জায়গাও নেই এই পৃথিবীতে।
সাথী, আজ আমি এইসবের মধ্য দিয়ে দুটি বিষয় বুঝলাম।
এক, যুক্তিবাদ সকলের মধ্যেই আছে, সামাজিক আচার সেই যুক্তিমনস্কতাকে চাপা দিয়ে রেখেছে। কখনো আপন সত্তায় তা কোথাও কোথাও প্রস্ফুটিত হয়েও চলেছে। তবে সমর্থনের অভাবে, অভিঘাতের প্রভাবে, সম্পূর্ণভাবে তার প্রস্ফুটন ঘটতে পারছে না। উপরের যাঁদের কাছে আমি সরাসরি জানতে চেয়েছি, ঈশ্বর আছে কি না, তার উত্তর পেয়েছি, "কেউ একটা, কিছু একটা আছে।"
এবং
দুই, পেশার কারণে অবৈজ্ঞানিক বুঝলেও সেই পেশাকে গ্রহন করে জীবিকানির্বাহ করতে হচ্ছে। অনেক হোমিও ডাক্তার আছেন, যিনি নিজের চিকিৎসা করান মর্ডার্ণ ট্রীটমেন্ট ব্যবস্থায়। অবৈজ্ঞানিক বুঝলেও সেই পেশা নিতে বাধ্য হন। রাষ্ট্রযন্ত্রের কাঠামো অনেককে বাধ্য করে অবৈজ্ঞানিক জীবিকা বেছে নিতে। আমার দেখা এই জ্যোতিষিটি একান্তে স্বীকার করেন, এটা একটা ব্যাবসায়। জাতকের জীবনশৈলী দেখেই ভূত-ভবিষ্যত বলতে হয়। মামলা-মোকদ্দমা, প্রেম, সন্দেহ, বেকারত্ব, প্রতিবেশীর সঙ্গে শত্রুতা, সন্তানের লেখাপড়াজনিত হতাশার সমাধানের আশায় ছুটে আসেন তাঁরা। তাঁদের এই হতাশা, দুর্বলতাই জ্যোতিষীর মূলধন।
মানুষ তো আসলে এক র্যাশানাল এ্যানিমাল, তার মাঝে যেমন এ্যানিম্যালিটি আছে, তেমনই তার মাঝে র্যাশানালিটিও আছে। কিন্তু ঐ যে স্বার্থান্বেষী সমাজে ধর্মধ্বজীদের বানানো এক জগদ্দল পাথর মানুষের এই যুক্তিবাদী মননকে চাপা দিয়ে দমিয়ে রেখে এসেছে, আসছে। তবু শাশ্বত প্রকৃতিকে দমিয়ে রাখার ক্ষমতা কৃত্রিমের থাকতে পারেনা৷ তাই নিকষ আঁধারের দুর্ভেদ স্থুল-বেধ প্রাচীরকেও ভেদ করতে পারে যুক্তিবাদের আলো। তার প্রকাশই আমরা পাই জীবনের আবশ্যিক ডাইমেনশন বা মাত্রাগুলিতে।
স্বার্থান্বেষীদের ভারী ভয়, যুক্তিবাদের মশাল যাঁরা বহন করে চলেছেন, তাঁদেরকে ভীষণ ভয়। তাই তারা মুক্তমনাদের খুন করে কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টা জারি রেখে চলেছে। পারছে কি?