রাজা রামমোহন রায়ের কবিতা এবং এক মহান যোগসূত্র
মলয় দাস
Nov. 20, 2024 | | views :485 | like:0 | share: 0 | comments :0
রাজা রামমোহন রায় এক যুগপুরুষl তাঁর কর্মজীবন এবং জীবনবোধের গভীরতা অবাক করেl কুসংস্কারের ঘন কুয়াশায় আবৃত সনাতন ভারতীয় চিন্তা নতুন প্রাণস্পর্শে জেগে ওঠে তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমেl পন্ডিতপ্রবর কেশবচন্দ্র সেন মহাশয় রামমোহন সম্পর্কে বলছেন,
উপনিষৎ পুরাণ হইতে চারি সহস্র বৎসর পূর্বে যে ব্রহ্মমন্ত্র উচ্চারিত হইয়াছিল, সেই ওঁকার পুনঃসংস্থাপন করিলেনl আমাদিগের দেশীয় শাস্ত্রে যে বড় বড় কথা মহারণ্যের মধ্যে পড়িয়া ছিল, তৎসমুদয় উদ্ধার করিলেনl সমুদয় বিরুদ্ধবাদীগণকে নিরস্ত্র করিয়া সত্য উদ্ধার করিলেন, দেশীয় ভ্রাতাদিগকে সৎপথ দেখাইলেনl (পশ্চিমবঙ্গ, রামমোহন সংখ্যা, পৃ : ৬)
রামমোহনের আধ্যাত্মিক ভাবনা যেমন প্রকাশ পেয়েছে তাঁর বেদবেদান্তের বিবিধ রচনায়, তেমনই বাসা বেঁধেছে তাঁর কবিতায়। তিনি লিখছেন,
একদিন যদি হবে অবশ্য মরণ।
এত আশা বৃদ্ধি কেন এত দ্বন্দ্ব কি কারণ।
এই যে মার্জিত দেহ,
যাতে এত কর স্নেহ,
ধূলি সার হবে তার মস্তক চরণ।
যত্নে তৃণ কাষ্ঠখান,
রহে যুগ পরিমাণ,
কিন্তু যত্নে দেহ নাশ না হয় বারণ।
অতএব আদি অন্ত,
আপনার সদা চিন্ত,
দয়া কর জীবে লও সত্যের শরণ।(ঐ, পৃ : ৪৩)
প্রশ্ন হল, কি সেই সত্য, কোন সত্যকে আঁকড়ে ধরতে বলছেন রাজা রামমোহন, কোন সত্যের জন্য সবকিছু মানুষ তৃণজ্ঞান করতে পারে? উত্তর অন্বেষণে চলতে চলতে, এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াই। একজন বলছেন,
অনেকে মনে করেন যে, suffering ( দুঃখ) এর মধ্যে বুঝি শুধু কষ্টই আছে, কিন্তু একথা সত্য নয়। suffering এর মধ্যে কষ্ট যেমন আছে - তেমনি একটা অপার আনন্দও আছে। এই আনন্দবোধ যার হয়নি তার কাছে কষ্ট শুধু কষ্টই ; সে ব্যক্তি দুঃখ কষ্টের নিষ্পেষণে অভিভূত হয়ে পড়ে। কিন্তু যে ব্যক্তি দুঃখ কষ্টের ভিতর একটা অনির্বচনীয় আনন্দের আস্বাদ পেয়েছে - তার কাছে suffering একটা গৌরবের জিনিষ, সে দুঃখ কষ্টের চাপে মুমূর্ষু না হয়ে আরও শক্তিমান ও মহীয়ান হয়ে ওঠে।
সে গাইছে রবিঠাকুরের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হতে,
যত দেব প্রাণ বহে যাবে প্রাণ
ফুরাবে না আর প্রাণ।
এত কথা আছে এত গান আছে
এত প্রাণ আছে মোর,
এত সুখ আছে এত সাধ আছে
প্রাণ হয়ে আছে ভোর।
সেই একজন আর কেউ নন, স্বয়ং সুভাষচন্দ্র, আমাদের নেতাজি। ( তরুণের স্বপ্ন, পৃ : ৮, ১৫) দুঃখের মধ্যে সত্য-শিব-সুন্দর -কে উপলব্ধির মহান সনাতন আধ্যাত্মিক চেতনা তমসাচ্ছন্ন পথে আলো দেখিয়েছে তাঁকে। এই সেই সত্য, রামমোহনের ভাবনায় যা ধরা পড়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হতে স্বামী বিবেকানন্দ কর্মবীর মানুষগণ সকলেই এই মহত্তম ভাবে মশগুল।
রামমোহন লিখছেন,
অনিত্য বিষয় কর সর্ব্বদা চিন্তন।
ভ্রমেও না ভাব হবে নিশ্চয় মরণ।
বিষয় ভাবিবে যত,
বাসনা বেড়িবে তত,
ক্ষণে হাস্য ক্ষণে খেদ, তুষ্টি রুষ্টি প্রতিক্ষণ।
অশ্রু পড়ে বাসনার,
দম্ভ করে হাহাকার,
মৃত্যুর স্মরণে কাঁপে কাম ক্রোধ রিপুগণ।
অতএব চিন্ত শেষ,
ভাব সত্য নির্বিশেষ,
মরণসময়ে বন্ধু, একমাত্র তিনি হন।
ভজ অকাল নির্ভয়ে।
পবন তপন শশী ভ্রমে যাঁর ভয়ে।
সর্ব্বকাল বিদ্যমান,
সর্ব্বভূতে যে সমান,
সেই সত্য তাঁরে নিত্য ভাবিবে হৃদয়ে।
'সেই সত্য তাঁরে নিত্য ভাবিবে হৃদয়ে ' - ভারী সুন্দর এই কথাখানি। বারবার শুনতে ইচ্ছা করে। সৎ-চিৎ -আনন্দ তথা সচ্চিদানন্দের উপলব্ধি ধরা পড়েছে রামমোহনের এই লেখায়। সত্য -শিব -সুন্দর ভাস্বর হয়ে উঠে তাঁর প্রকাশ ও ভাবনায়। শঙ্করাচার্যের 'ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবঃ ব্রহ্মৈব নাপরঃ’ কবিতা হয়ে ধরা পড়ে তাঁর বর্ণনায়। জগৎ তথা পার্থিবতা অনিত্য ( মিথ্যা তথা প্রতিভাসিক সত্তা ), একে অতিক্রম করে আমাদের যেতে হবে সেই পরমসত্যের দিকে অর্থাৎ 'ক্ষণে হাস্য ক্ষণে খেদ, তুষ্টি রুষ্টি প্রতিক্ষণ' ছেড়ে চলো যাই নিজ নিকেতনে সত্যশিবসুন্দরের দ্বারে। ঋষি শ্রী অরবিন্দের ভাষায় '... towards a Divine।ife'. ঋষি বাক্যে, 'স্ব অহম্', ঐতরেয় উপনিষদের ভাষায়, 'প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম', আর সাধক রামপ্রসাদের গানে,
আপনাতে আপনি থেকো মন
তুমি যেও না কো কারো ঘরে,
যা চাবি তা বসে পাবি
শুধু খোঁজো নিজ অন্তঃপুরে।
সত্যম্-শিবম্-সুন্দরম্ যেমন পরমসত্তার তিনটি অভিন্ন প্রকাশ; জ্ঞান -কর্ম -ভক্তি তেমনই অভিন্ন কেবল আঙ্গিকের তফাৎ। যে রাজা রামমোহন রায় চূড়ান্ত কর্মযোগী, তিনিই আবার তাঁর কবিতায় ধরা পড়েন জ্ঞানযোগী ও ভক্তিযোগী রূপে। যোগ একই তফাৎ কেবল আঙ্গিকে। সুভাষচন্দ্রের নেতাজি হয়ে ওঠা তাঁর জ্ঞান ও ভক্তিযোগেরই এক পরম প্রকাশ, অন্যরূপে অন্যভাবে। রাজা রামমোহন হতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র সবাই একই যোগসূত্রে গাঁথা, তফাৎ কেবল আঙ্গিকে, ভাবে, প্রকাশে। কূপমণ্ডকতা, ধর্মীয় বিকৃতির চোরা বালিতে তলিয়ে যেতে বসা সনাতন হিন্দুজাতিকে টেনে তুলেছিলেন রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ এবং একই পথের পথিকগণ। তাঁদের ত্যাগ, তিতিক্ষা আমাদের কল্পনারও অতীত। সবকিছু হারানোর মধ্যে পেয়েছিলেন সবটুকু আনন্দ। অসীমের পানে চেয়েছিলেন বলে অনায়াসে ডিঙিয়ে ছিলেন সসীমতাকে। উপনিষদীয় সত্য সাকার হয়েছিল তাঁদের জীবনচরিতে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বলছেন- গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, " স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়: পরোধর্ম ভায়াবহ:"। আমি এই উক্তিতে বিশ্বাস করি। (তরুণের স্বপ্ন, পৃ: ১১)
তিনি বলছেন, ভারতীয় জাতি একাধিকবার মরেছে - কিন্তু মৃত্যুর পর পুনর্জীবন লাভ করেছে। তার কারন এই যে, ভারতের অস্তিত্বের সার্থকতা ছিল এবং এখনও আছে। ভারতের একটা বাণী আছে যেটা জগৎসভায় শুনাতে হবে; ভারতের শিক্ষার ( culture) মধ্যে এমন কিছু আছে যাহা বিশ্বমানবের পক্ষে অতি প্রয়োজনীয় এবং যা গ্রহণ না করলে বিশ্বসভ্যতার প্রকৃত উন্মেষ হবে না। শুধু তাই নয়, - বিজ্ঞান, শিল্প, কলা, সাহিত্য, ব্যবসায়, বাণিজ্য - এ সব ক্ষেত্রেও আমাদের জাতি জগৎকে কিছু দেবে ও কিছু শেখাবে। তাই ভারতের মণিষীগণ কত তমোময় যুগের মধ্যেও নির্নিমেষ নয়নে ভারতের জ্ঞানপ্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন। তাঁদের সন্তুতি আমরা, আমাদের জাতীয় উদ্দেশ্য সফল না ক'রে কি মরতে পারি? (ঐ: ১৪)
এরপর লেখা বাহুল্য, আমার আঙ্গুলগুলি আপনা হতেই থেমে যায়...
তথ্যসূত্র :
১. পশ্চিমবঙ্গ, রামমোহন সংখ্যা, তথ্যসংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ
২. শ্রী অরবিন্দের দর্শন মন্থনে - সুনীল রায়
৩. রামকৃষ্ণ কথামৃত
৪. তরুণের স্বপ্ন : সুভাষচন্দ্র বসু