রসায়ন নোবেল পুরস্কার ২০২২
শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়
Nov. 23, 2024 | | views :282 | like:0 | share: 0 | comments :0
ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষার হলঘরে বসে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা দিচ্ছে। আপনি পরীক্ষা-নিয়ামক। নিয়ম অনুযায়ী, উপস্থিত প্রতিটি পরীক্ষার্থীর সই নিয়ে রাখতে হবে নির্দিষ্ট কাগজে। এবং এই কাজটা করতে হবে পরীক্ষা চলাকালীনই আর ওদের পরীক্ষাকে কোনোভাবে বিঘ্নিত না করে। প্রয়োজন যেহেতু আছে, তাই আপনার এই কাজটা চলবে পরীক্ষা-ব্যবস্থার সঙ্গে একই সাথে, কিন্তু সমান্তরালে নয়। সমান্তরালে চলছে, এমন বললে এটা আলাদা কোনো পরীক্ষা বলে বোঝাতে পারে। আর তাই বিজ্ঞানের ভাষায়, যা মূলপদ্ধতির সঙ্গে সমান্তরালে চলছে না, তার চলাচল মূল পদ্ধতির সঙ্গে অভিলম্ব বরাবর, নব্বই ডিগ্রি কোণ করে। গ্রীকভাষা থেকে গৃহীত শব্দানুযায়ী, এমন দুটো পদ্ধতিকে একে অপরের 'অর্থোগোনাল' (orthogonal) বলা হয়।
এখন এই দুই অর্থোগোনাল পদ্ধতির সঙ্গে আমরা রসায়নের কিছু বিক্রিয়ার তুলনা করব। কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়া মানুষ নিজের ইচ্ছায় ল্যাবরেটরিতে ঘটাতে পারে। বিরাট সংখ্যক রাসায়নিক বিক্রিয়া প্রতিদিন প্রতি মূহুর্তে কোষে কোষে ঘটিয়ে চলেছে প্রকৃতি আপন-খেয়ালে। কখনো কখনো সভ্যতার অগ্রগতির স্বার্থে আমরা সেইসব কোষীয় বিক্রিয়ার ফলাফলের সুযোগ নিই। এই যেমন ধরুন ইস্ট দিয়ে ফার্মেন্টেশন ঘটানো, প্রাকৃতিক উৎসেচকের সাহায্যে ওষুধ তৈরির কয়েকটা ধাপ এগিয়ে নেওয়া, এইরকম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোষের মধ্যে থাকা মালমশলার যদি সামান্য একটু পরিবর্তন ঘটানো যায় তবে তার ফলাফলটা বেশ ভালো করে কাজে লাগানো যাচ্ছে। প্রাকৃতিক উপায়ে বিক্রিয়া চালালে হয়ত যতটা জিনিস আমাদের চাই, যেভাবে চাই, ততটা সেভাবে পেতাম না। তখন দরকার প্রাকৃতিক মালমশলার উপরে এঞ্জিনিয়ারিং করার। তার জন্য ল্যাবরেটরিতে ফ্লাস্কের মধ্যে আমরা তেমন রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটতে দেখি, তেমনটা ঘটাতে হবে জ্যান্ত কোষের মধ্যে, তার সবরকম জৈব-রাসায়নিক বিক্রিয়া চলাকালীন।
এখন প্রথম অনুচ্ছেদে আরেকবার ঘুরে আসুন। মূল পরীক্ষার জায়গায় আপনি যদি আমাদের কোষে ঘটে চলা জৈব-রাসায়নিক বিক্রিয়া রাখেন এবং ছাত্রছাত্রীদের ঐ সই করার পদ্ধতির বদলে ল্যাবরেটরিতে ফ্লাস্কে ঘটানো কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ার পদ্ধতিকে চিন্তা করেন, তবেই ঐ এঞ্জিনিয়ারিং, যাকে বলে কেমিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং, সেইটা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করানো যাবে।
অর্থাৎ কোষের বিক্রিয়া আর মানুষের ঘটানো বিক্রিয়া একে অন্যের অর্থোগোনাল হওয়া চাই। দুটোই যেন স্বাধীনভাবে ঘটানো যায়, কেউ কাউকে প্রভাবিত না করে। জীবন্ত কোষে ঘটানো এই এঞ্জিনিয়ারিং বিক্রিয়াটারই আরেকটা নাম, বায়ো-অর্থোগোনাল বিক্রিয়া।
তার মানে ছাত্রছাত্রীরা যখন পরীক্ষা দিচ্ছে, তখন তাদের দিয়ে সই করানোর পদ্ধতিটা হতে হবে এক ধাপের, এক পাতার, একটা সইয়ের। বারবার বিভিন্ন পাতায় বিভিন্ন স্থানে যদি তাদের স্বাক্ষর নিতে যাই, তবে তাদের মনঃসংযোগ নষ্ট হতে পারে। একই ব্যাপার খাটে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে। জীবন্ত কোষে যখন নিজস্ব জৈব-রাসায়নিক বিক্রিয়া চলছে, তখন মানুষ সেই কোষের মধ্যে থাকা একটা জৈব যৌগের বিরাট অণুর কিছু গঠনগত পরিবর্তন ঘটাতে চায়। যেমন, তার দরকার বিরাট একটা কোষীয় অণুকে আরেকটা উজ্জ্বল রঙের বাইরের কোনো অণু দিয়ে যুক্ত করা (যাকে ফেসবুকে বলে 'ট্যাগ করা' tagging)। কেন? না, সেরকম করলে সেই অণুটাকে উপযুক্ত মাইক্রোস্কোপ দিয়ে চোখে চোখে রাখার সুবিধা হয়। দেখা যায় যে ব্যাটা কোষ থেকে কোষে কোন রাস্তা ধরে ছোটে। আর এই থেকে অণুটার কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে বলিষ্ঠ ধারণা মেলে। সেইরকম ট্যাগ করার কায়দাটা হতে হবে এক ধাপের, যাতে ষাঁড়ের মত বড় অণুটা প্রায় বুঝতেই না পারে যে তার গায়ে শালিক পাখির মত ছোট কোনো অণু আটকানো হয়েছে! আর এইখানেই চলে আসে "ক + খ = গ + ঘ" -মার্কা রাসায়নিক বিক্রিয়ার গুরুত্ব।
আমাদের ছোটোবেলার বইতে তীরচিহ্ন দিয়ে যতই লেখা থাক যে 'ক'-এর সঙ্গে 'খ'-এর বিক্রিয়া ঘটালে 'গ' আর 'ঘ' তৈরি হয়, বাস্তবে ল্যাবরেটরিতে ঘটা বিক্রিয়াগুলো এত সহজ হয় না। এক-একটা তীরচিহ্নের খোঁচার পিছনে অন্তত হাজারখানেক রসায়নবিদের সারা জীবনের ঘাম-ঝরানো খাটনি লুকিয়ে থাকে। রসায়নবিদ্যার শুরু থেকে আজ অবধি মানুষ তার নিজের কাজের প্রয়োজনে যত রাসায়নিক বিক্রিয়া আবিষ্কার করেছে, তার সিংহভাগের ফলাফলই নির্ভর করে বিক্রিয়ার সময়ে উপস্থিত গুচ্ছের শর্তের উপর। চটপট লাল রঙের তরল আর নীল রঙের কঠিন বিক্রিয়া করে সবুজ রঙের গ্যাস আর হলুদ রঙের কঠিন হয়ে গেল, আর কোথাও কোনো গণ্ডগোল হল না; সব জিনিস যত পরিমাণে যেমনটা চাই ঠিক তেমনটা পেলাম, এমন ভাগ্য কদাচিৎ হয়, এমনটা লিখলেও বোধ করি বাড়িয়ে বলা হবে! আগে থেকে বলা মুশকিল কোন্ অবস্থায় কিসের বাড়তি বা খামতিতে কি ফলাফল দেবে। অনেক পর্যবেক্ষণের পরে একটা গড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে এই এই পরিস্থিতিতে এই এই ফল আসে, আর সেটাই বিক্রিয়াটার প্রতিষ্ঠিত প্রোটোকল-রূপে বৈজ্ঞানিক পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়।
একমাত্র এক শ্রেণীর বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে মানুষ একটু নিশ্চিন্তে ফলাফল কী হবে তার ঘোষণা আগ বাড়িয়ে করতে পারে। সেটার কারন মানুষের এতদিনের পরমাণু এবং অণু, তাদের রাসায়নিক বন্ধন-সংক্রান্ত গণিত-নির্ভর বিশদ গবেষণা। এই ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অণুর, বিশেষতঃ কিছু জৈব অণুর বাইরের কাঠামো জুড়ে, অণু-গঠনকারী পরমাণুগুলোর মধ্যে ইলেকট্রনের চলাচলের দিক আগে থেকে বলা সম্ভব। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটা অণু থেকে আরেকটা অণুতে, বা একটা অণুর মধ্যে, এই ইলেকট্রনের চলাচল যেন গাড়ির একটা চাকার মত বলে মনে হয় - দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, কিন্তু 'যাবে না ফিরে' নয়, ফিরে যাবে।
আর জন্ম নেবে দুটো অণুর সংযোগে নতুন একটা অণু, অথবা একটা অণু বদলিয়ে আরেকটা অণু। এই শ্রেণীর বিক্রিয়ার সাধারণ নাম পেরিসাইক্লিক বিক্রিয়া।
'পেরি', অর্থাৎ কিনা, 'পেরিফেরি' (periphery) বা পরিসীমা, যা বরাবর চাকার মত, অর্থাৎ cyclically, ইলেকট্রনের যাতায়াত ঘটে। এইসব পেরিসাইক্লিক বিক্রিয়ার মজা হচ্ছে, এক ধাপে যা ঘটনা ঘটার ঘটে যায়। তাছাড়া এও দেখা যায় যে একই অণুতে তাপ দিলে ইলেকট্রনের চলাচল যেমন হয়, আলো ফেললে চলাচল ঠিক তার উল্টো রাস্তায় ঘটে। এই পেরিসাইক্লিক বিক্রিয়াগুলোরই বিশেষ একটা রকমফের হচ্ছে ক্লিক রিয়্যাকশন, যেন মাউসের এক ক্লিকে একখানা বিক্রিয়া ঘটানো যায় (অথবা, এখন এও বলা চলে যে সব পেরিসাইক্লিক বিক্রিয়াই আসলে ক্লিক বিক্রিয়া)। ক্লিক বিক্রিয়ায় যেন অণু বা অণুগুলো প্রস্তুত থাকে আগেভাগেই, তারপর নির্দেশ পাওয়া মাত্র 'জো হুজুর ' বলে সেলাম ঠুকে নিজেদের সাজিয়ে নতুনভাবে পেশ করে আমাদের সামনে।
সুতরাং এ বোঝাই যাচ্ছে, বায়ো-অর্থোগোনাল বিক্রিয়া যদি জীবন্ত কোষে ঘটাতেই হয়, তবে তার জন্য ক্লিক-বিক্রিয়া ব্যতীত ভালো বিকল্প আর কিছু নেই। শার্পলেস আর মেল্ডাল বহু বছর ধরে গবেষণা করে এই ক্লিক-রসায়নের ভিত্তি মজবুত করেছেন। 'ক্লিক-কেমিস্ট্রি' নামটা শার্পলেসেরই 'শার্প ব্রেন' থেকে বেরিয়েছিল বাইশ বছর আগে। আর বার্তোজ্জি এই বিক্রিয়াকে 'বায়ো-অর্থোগোনাল' বিক্রিয়ারূপে জ্যান্ত কোষে কাজে লাগিয়েছেন। 'বায়ো-অর্থোগোনাল' শব্দটা আবার বার্তোজ্জিই প্রথম ব্যবহার করেন। জীবকোষের মধ্যে বিক্রিয়া চালাতে গেলে ল্যাবরেটরির ফ্লাস্কের মত নিয়ম খাটালে তো আর চলবে না। তাই বার্তোজ্জিকেও বহু বছর খেটেখুটে বায়ো-অর্থোগোনাল বিক্রিয়ার শর্তগুলো নির্বাচন করতে হয়েছে।
এখন এবং ভবিষ্যতেও এই শ্রেণীর বিক্রিয়া ঘটিয়ে নতুন জৈব-যৌগ নির্মাণ, শরীরের মধ্যে অনেক অণুর ইমেজিং পদ্ধতি, ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি করা সম্ভব হচ্ছে এবং হবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, একুশ বছর আগে এই শার্পলেসই অ্যাসিমেট্রিক সিনথেসিস (বিশুদ্ধ জৈব-যৌগ নির্মাণের একপ্রকার পদ্ধতি) আবিষ্কার করে রসায়নে নোবেলজয়ী হয়েছিলেন।