নাস্তিকতা - একটি পর্যালোচনা

পার্থ সারথি চন্দ্র


Dec. 3, 2024 | | views :939 | like:6 | share: 5 | comments :0

১৬৩৩ সাল। পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে - বাইবেল বিরোধী এই সত্য কথা বলার অপরাধে তৎকালীন চার্চ খ্যাতনামা বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকে অভিযুক্ত করলো ‘ধর্মদ্রোহিতার’ অভিযোগে। গ্যালিলিও তখন প্রায় অন্ধ, বয়সের ভারে ন্যুব্জ। অসুস্থ ও বৃদ্ধ বিজ্ঞানীকে জোর করে ফ্লোরেন্স থেকে রোমে নিয়ে যাওয়া হলো, হাঁটু ভেঙ্গে সবার সামনে জোড় হাতে ক্ষমা প্রার্থনা করিয়ে বলতে বাধ্য করা হয় এতদিন গ্যালিলিও যা প্রচার করেছিলেন, তা ধর্মবিরোধী, ভুল ও মিথ্যা। বাইবেলে যা বলা হয়েছে সেটিই আসল, সঠিক। পৃথিবী স্থির অনড় - সৌর জগতের কেন্দ্রে। গ্যালিলিও প্রাণ বাঁচাতে তাই করলেন। পোপ ও ধর্মসংস্থার সম্মূখে গ্যালিলিও যে স্বীকারোক্তি ও প্রতিজ্ঞা-পত্র স্বাক্ষর করেন, তা বিজ্ঞান সাধনার ইতিহাসে ধর্মীয় মৌলবাদীদের নির্মমতার এবং জ্ঞান সাধকদের কাছে বেদনার এক ঐতিহাসিক দলিল।

শোনা যায়, এর মধ্যেও একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ গণিতজ্ঞ-জ্যোতির্বিদ স্বগতোক্তি করেছিলেন - ‘তার পরেও কিন্তু পৃথিবী ঠিকই ঘুরছে’। ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ নিয়েই গ্যালিলিওর মৃত্যু হয় ১৬৪২ সালে, নিজ গৃহে, অন্তরীণ অবস্থায়। শুধু গ্যালিলিওকে অন্তরীণ করে নির্যাতন তো নয়, ব্রুনোকে তো পুড়িয়েই মারলো ঈশ্বরের সুপুত্ররা। তারপরো কি সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর ঘোরা ঠেকানো গেল?


শুধু গ্যালিলিও বা ব্রুনো নয়, ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, হাইপেশিয়া, এনাক্সোগোরাস, ফিলিপ্রাস প্যারাসেলসাস, এনাকু সিমন্ড, লুসিলিও ভানিনি, টমাস কিড, ফ্রান্সিস কেট, বার্থৌলোমিউ, লিগেট, ইবনে খালিদ, যিরহাম, আল দিমিস্কি, ওমর খৈয়াম, ইবনে সিনা, ইবনে বাজা, আল কিন্দী, আল রাজি কিংবা ইবনে রুশদ সহ অনেককেই ধর্মান্ধদের হাতে নিগৃহীত এবং নির্যাতিত হয়ে নিহত হতে হয়।


মানব সভ্যতার সূচনা পর্বে ধর্ম ছিল জাদুবিদ্যাকেন্দ্রিক। মানব গোত্রের প্রধান পুরোহিত, যাজক, পয়গম্বরা ছিলেন আসলে জাদু ও তন্ত্রে পারদর্শী। বহুকাল আগে, জঙ্গলে বসবাসকারী মানুষের এক গোত্রের কথা চিন্তা করা যাক। গোত্রের সব মানুষের সামনে একজন সামান্য জ্বলন্ত আগুনে ছুঁড়ে দিলেন মুঠোভর্তি কালো গুঁড়ো। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র বিস্ফোরণে আগুনের শিখা উপরে উঠে গেল। দর্শকদের কাছে ঘটনাটি গণ্য হলো অপ্রাকৃত এবং অসাধারণ হিসেবে। এবং এই ‘অতিপ্রাকৃত ঘটনা’ সবার সামনে ঘটানোর জন্য সামান নিজেকে দাবি করলেন সবার চেয়ে আলাদা একজন, বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে। এই থেকেই অতি প্রাচীনকালে উৎপত্তি হয়েছিল দেবতা, ভূত ও ভগবানের। তাদের তুষ্ট করতে শুরু হয়েছিল পুজো, বলিদান, উৎসর্গ উপাচারের মতো রীতি পালনের। সৃষ্টি হয়েছিল ধর্মের। তৈরি হয়েছিল জাত-পাত। প্রাচীন ভারতে এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন চার্বাকরা। যাঁরা এইসব অযৌক্তিক, ব্যাখ্যাহীন, অজ্ঞানতায় মোড়া, কুসংস্কার সর্বস্ব কাণ্ডকারখানায় মজে থাকতেন তাদের জ্ঞানের অপর্যাপ্ততা আছে বলে মনে করতেন চার্বাকরা।


ভাবা হয়েছিল যত সময় এগোবে, শিক্ষার প্রসার হবে, জ্ঞানের বিকাশ হবে এই সব কুসংস্কার, অলৌকিকতা থেকে মুক্ত হবে মানুষ। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস সে পথে হাঁটেনি। খোলামকুচির মত উড়ে গেছে চার্বাকদের তত্ত্ব। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সৃষ্টি করা আধুনিক উপকরণকে গ্রহণ করলেও, তার আলোকে ঈশ্বরতত্ত্ব থেকে মুক্ত হতে পারেনি মানুষ। নিজের কাজ দিয়ে, আবিষ্কার দিয়ে এক ধাক্কায় জ্ঞানের জগতকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এমন বহু মানুষ ছিলেন নাস্তিক। কিন্তু তাতে কার কি? ধর্মান্ধ ও কুসংস্কারগ্রস্থ, স্থবির সমাজ, রাষ্ট্র বা গোষ্ঠী তাকে হয় নির্বাসনে পাঠিয়েছে না হয় হত্যা করেছে। যত দিন যাচ্ছে ততই আরও ধর্মোন্মাদ, কুসংস্কারমুখী হয়ে পড়ছে মানুষ। তৈরি হচ্ছে এক অদ্ভুত মনুষ্যমন যেখানে অন্য ধর্মের, অন্য মতের মানুষের কোনও ঠাঁই নেই। তাই উপাসনালয় বানিয়ে পুজোপাঠের শেষ নেই। অন্ত নেই তার ধুমধাম আর জাঁকজমকের। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতের ভোটবাজার এখনও নির্ভর করে ধর্মের মেরুকরণের উপরই। তাই মন্দির না মসজিদ, সেটাই আগামী ভারতের সবচেয়ে বড় ভাবনা।


কীভাবে অন্ধবিশ্বাস নির্ভর ব্যবস্থা টিকে আছে, কীভাবে আমরা এই অন্ধবিশ্বাসগুলো বংশ পরম্পরায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিই, তা বুঝতে হলে সামাজিক জীববিজ্ঞানের আধুনিক গবেষণাগুলোকে বুঝতে হবে। রিচার্ড ডকিন্স তার ‘সেলফিশ জিন’ বইয়ে আর সুজান ব্ল্যাকমোর তার ‘মিম মেশিন’ বইয়ে কীভাবে বিশ্বাস বংশপরম্পরায় টিকে থাকে অনেক আকর্ষণীয় উদাহরণ হাজির করেছেন।


‘নাস্তিক’ শব্দটির মানে যে ঈশ্বর ও ধর্মে অবিশ্বাস করে। ‘আস্তিক’ মানে যে ঈশ্বর ও ধর্মে বিশ্বাস করে। বিষয়টি যদি এটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকতো, তাহলে আমাকে এই আলোচনার অবতারণা করতে হত না।

"কেবলং শাস্ত্রমাশ্ৰিত্য ন কর্তব্য বিনির্ণয়।

যুক্তিহীন বিচারেণ ধর্মহানিঃ প্ৰজায়তে।।"

- এটা আমার বচন নয়, শাস্ত্রীয় বচন। আমি নাস্তিক। শাস্ত্র আমার জীবন নিয়ন্ত্রণ করে না। অর্থাৎ আমি বস্তুত অশাস্ত্রীয় মানুষ। যুক্তিহীন ধর্মকথা মান্য করে পুণ্যলাভের বাসনা আমার নেই। বরং শাস্ত্রমতে যুক্তিহীন বিচারে ধর্মের ক্ষতিসাধন হয় বল আমি বিশ্বাস করি। এটাই আমার বিশ্বাস, আমার ধর্মানুভূতি। কল্পনাবিলাসে নাস্তিকরা অভ্যস্ত নয়।


ধর্ম আসলে কী? চুম্বকের ধর্ম যেমন আকর্ষণ করা, মানুষের ধর্ম তেমনি বিশ্বমানবতা, মানুষের প্রতি প্রেম এবং ভালোবাসা৷ এরকম হলে কোনও আপত্তি ছিল না। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে, পরস্পরের মধ্যে শ্রেষ্টত্বের লড়াই শুরু হয়৷ কার ঈশ্বর সত্য, কার ধর্ম সত্য - এই সব কোন্দলে এখনও পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষের জীবন চলে গেছে, অনেক রক্ত ঝরেছে৷ তাই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, মানব ধর্মের এবং মানবতার বিরুদ্ধে৷ আমাদের কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই, সেটা থাকার কোনো দরকারও নেই৷ মহাবিশ্ব পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রানুসারেই চলে, এখানে সৃষ্টিকর্তা বলে কিছুর প্রয়োজন নেই৷ স্টিফেন হকিং সেটা ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর বইতে৷ ঈশ্বরের কোনো প্রমাণও এখন পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি৷ যেদিন কেউ ঈশ্বরের প্রমাণ দিতে পারবে, আমার আস্তিক হয়ে যেতে আপত্তি থাকবে না। চ্যাপম্যান কোয়েন বলেছেন, “ঈশ্বর খুবই ভঙ্গুর, বিজ্ঞানের ছোট্ট একটি ফুলকি অথবা একটু সাধারণ জ্ঞানই তাকে শেষ করে ফেলতে সক্ষম।” বিজ্ঞানী স্টিফেন ভাইনবার্গের একটি চমৎকার উদ্ধৃতি এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, “ধর্ম মানবতার জন্য এক নির্মম পরিহাস। ধর্ম মানুক বা নাই মানুক, সবসময়ই এমন অবস্থা থাকবে যে ভালো মানুষেরা ভালো কাজ করছে, আর খারাপ মানুষেরা খারাপ কাজ করছে। কিন্তু ভালো মানুষকে দিয়ে খারাপ কাজ করানোর ক্ষেত্রে ধর্মের জুড়ি নেই।”


মৃত্যুর পরে আমাদের শরীর মাটিতে মিশে যায়৷ যেহেতু আমি মানে হচ্ছে, আমার মস্তিষ্ক, যেখানে আমার সব স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে, আবেগ ভালোবাসা সব কিছুর কেন্দ্র যেটা, সেই মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলেই আমার অস্তিত্ব সেখানেই শেষ৷ সেই মগজ যখন মাটিতে মিশে যায়, আমরা আবার আমাদের প্রকৃতিতে ফিরে যাই৷


দুই ধরনের নাস্তিক রয়েছেন। দুই দলই মনে করেন ধর্ম মানব সমাজের জন্য ক্ষতিকর৷ এদের একদল মনে করেন ধর্ম এমনিতেই ধ্বংস হয়ে যাবে সময়ের প্রয়োজনে, তার জন্য কিছু করার প্রয়োজন নেই৷ আরেক দল মনে করেন, ধর্মকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা করতে হবে৷ আঘাত করতে হবে৷ তবে সেটা কোন শারীরিক আঘাত নয়, লেখার মাধ্যমে নিজেদের যুক্তি তুলে ধরে, কোনো মতবাদকে ভুল ও মিথ্যা তা দেখিয়ে দেয়া৷


'সেক্যুলার' শব্দের মানে কি সত্যিই সকল ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা? অন্তত রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের দেশে এখন এটাই প্রচার করা হয়। বিভ্রান্তি সে কারণেই। আসলে কিন্তু ‘সেক্যুলারিজম’ শব্দটির অর্থ - ‘সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা’ নয়, বরং এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে একটি মতবাদ, যা মনে করে -  রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক রাখা উচিত। 'আমেরিকান হেরিটেজ' ডিকশনারিতে 'Secularism' শব্দটিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে – “The view that religious considerations should be excluded from civil affairs or public education.” এ সংজ্ঞা থেকে বোঝা যাচ্ছে, ধর্মকে রাষ্ট্রের কাজের সাথে জড়ানো যাবে না - এটাই সেক্যুলারিজমের মোদ্দা কথা। ধর্ম অবশ্যই থাকতে পারে, তবে তা থাকবে জনগণের ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে - ‘ব্যক্তিগত’ বিষয় হিসেবে; ‘জনসাধারণের’ ব্যাপার স্যাপারে তাকে জড়ানো যাবে না। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু সেক্যুলারিজমের প্রকৃত সংজ্ঞা অনুধাবণ করতে পেরেছিলেন ভালোভাবেই। তিনি রাষ্ট্রীয় কার্যাবলী থেকে ধর্মকে পৃথক রাখাই সঙ্গত মনে করতেন, জাতীয় জীবনে সব ধর্মের প্রতি উদাসীন থাকাটাই তার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হতো। তিনি বলেছিলেন, “ধর্ম বলতে যে ব্যাপারগুলোকে ভারতে কিংবা অন্যত্র বোঝানো হয়, তার ভয়াবহতা দেখে আমি শঙ্কিত এবং আমি সবসময়ই তা সোচ্চারে ঘোষণা করেছি। শুধু তাই নয়, আমার সবসময়ই মনে হয়েছে এ জঞ্জাল সাফ করে ফেলাই ভালো। প্রায় সব ক্ষেত্রেই ধর্ম দাঁড়ায় ধর্মান্ধতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা, মূঢ়তা, কুসংস্কার আর বিশেষ মহলের ইচ্ছার প্রতিভূ হিসেবে।”


আসলে অভিধানে 'Secular' শব্দটির অর্থও করা হয়েছে এভাবে - ‘Worldly rather than spiritual’। সেক্যুলারিজমের অন্যান্য প্রতিশব্দগুলো হলো - Worldly, Temporal কিংবা Profane। শব্দার্থগুলো খুব ভালোভাবে খেয়াল করলে বোঝা যাবে, এর অবস্থান ধর্ম কিংবা আধ্যাত্মিকতার দিকে নয়, বরং এর একশ আশি ডিগ্রি বিপরীতে। সেজন্য, সেক্যুলারিজমের বাংলা প্রতিশব্দ অনেকে খুব সঠিকভাবেই করেন - ‘ইহজাগতিকতা’।


সেক্যুলারিজমের মূল সুরটি আত্মস্থ করার পরিবর্তে চলছে ছদ্ম-ধর্মনিরপেক্ষতা জাহির করার মহড়া। এ প্রসঙ্গে প্রবীর ঘোষ তার ‘সংস্কৃতি, সংঘর্ষ ও নির্মাণ’ বইয়ে লিখেছেন – “বিপুল প্রচারে সাধারণ মানুষ পরিচিত হয়েছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দের সাথে। জেনেছে, ধর্মনিরপেক্ষতা কথার অর্থ হলো - ‘সব ধর্মের সমান অধিকার’। বিপুল সরকারি অর্থব্যয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দের এই যে ব্যাখ্যা হাজির করা হচ্ছে এবং এরই সাথে সম্পর্কিতভাবে আমাদের দেশের মন্ত্রী, আমলা ও রাজনৈতিকেরা মন্দিরে মন্দিরে পুজো দিয়ে বেড়াচ্ছেন, গুরুদ্বোয়ারায় নতজানু হচ্ছেন, মসজিদে গির্জায় শ্রদ্ধা জানিয়ে আসছেন। দীপাবলি, ঈদ, বড়দিন ইত্যাদিতে রাষ্ট্রনায়কেরা বেতার, দূরদর্শন মারফৎ শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে অর্থ সাহায্য দিলে আয়কর থেকে রেহাইয়ের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন।

 

সাধারণের ভালো লাগছে - ‘সব ধর্মের সমান অধিকার’ মেনে নিয়ে মন্ত্রী, আমলা, রাজনীতিকদের সমস্ত ধর্মের কাছে নতজানু হতে দেখে। উদার হৃদয়ের মানুষ হিসেবে নিজেদের ভাবতে ভালো লাগছে জনগণের – হুঁ-হুঁ বাবা, আমাদের দেশ ধর্মনিরপেক্ষ। এখানে সব ধর্মই সমান অধিকার ও শ্রদ্ধা পায় মন্ত্রী আমলাদের। মন্ত্রীরা এরই মাঝে জানিয়ে দেন সমস্ত ধর্মের সমান অধিকার বজায় রাখতে, দেশের ‘ধর্মনিরপেক্ষতার মশাল’ জ্বালিয়ে রাখতে হবে।

 

‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটিকে নিয়ে কী নিদারুণভাবে অপব্যাখ্যা করে সাধারণ মানুষের মগজ ধোলাই করা হচ্ছে ভাবা যায় না। ‘নিরপেক্ষ’ শব্দের অর্থ কোনো পক্ষে নয়। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দের অর্থ তাই ‘কোনো ধর্মের পক্ষে নয়’- অর্থাৎ, সমস্ত ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক বর্জিত। 'Secularism' শব্দের আভিধানিক অর্থ - একটি মতবাদ - যা মনে করে রাষ্ট্রনীতি, শিক্ষানীতি প্রভৃতি ধর্মীয় শাসন থেকে মুক্ত থাকা উচিত।

 


কিন্তু এ কী! এদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে আমরা কী দেখাচ্ছি? সেক্যুলার রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানেও এদেশে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়। কোনো প্রকল্পের উদ্বোধন বা শিলান্যাস করা হয় মন্ত্রোচ্চারণের প্রদীপ জ্বালিয়ে, পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করা হয় নারকেল ফাটিয়ে। রাজনীতির ব্যবসায়ীরা ‘সেক্যুলারিজম’- এর নামে নানা ধর্মকে তোল্লাই দিয়ে সর্বধর্মের সমন্বয় ও সংহতির বাধা গৎই এতদিন বাজিয়ে এসেছেন।”


সেক্যুলারিজম বহু শতাব্দী ধরে (আমাদের উপমহাদেশে) যে ভাবে আচরিত এবং রূপান্তরিত হয়ে আসছে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতাকে’ই যদি তার ঠিক বঙ্গানুবাদ বলে ধরে নেই, তবে শুধুমাত্র সব ধর্মের সহাবস্থানেই তার অর্থ পুরোপুরি ধরা পড়ে না। এ কথা সত্য যে, ধর্মনিরপেক্ষতায় তার প্রয়োজন আছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়, ধর্ম থেকে চিন্তার মুক্তিতেই ধর্মনিরপেক্ষতা পূর্ণতা পায়। ইতিহাসের পরিক্রমায় দেখা যায়, খুব কম মানুষই পারে আজন্ম লালিত ধ্যান ধারণাকে পরিত্যাগ করে স্বচ্ছভাবে চিন্তা করতে, খুব কম মানুষই পারে স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। খুব কম মানুষের মধ্যে থেকেই শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে আসেন প্রবীর ঘোষ কিংবা পেরিয়ার স্বামী।


বেশিরভাগ ড্যানিশ এবং সুইডিশ ধর্ম দ্বারা সংজ্ঞায়িত ‘সিন’ বা 'পাপ' নামক কোনো ব্যাপারে বিশ্বাসী নন অথচ দেশ দু’টিতে অপরাধ প্রবণতার হার পৃথিবীর সকল দেশের তুলনায় সর্বনিম্ন। এই দুই দেশের প্রায় কেউই চার্চে যায় না, পড়ে না বাইবেল। তারা কি অসুখী? ৯১ টি দেশের মধ্যে করা এক নিরীক্ষি অনুযায়ী, সুখী দেশের তালিকায় ডেনমার্কের অবস্থান প্রথম, যে ডেনমার্কে নাস্তিকতার হার মোট জনসংখ্যার প্রায় শতকরা আশি ভাগ। স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় মাত্র ২০ শতাংশের মতো মানুষ ঈশ্বরের বিশ্বাস করেন, তারা মনে করেন ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিশ্বাস করেন, মৃত্যুর পরের জগতে। আর বাকিরা স্রেফ কুসংস্কার বলে ছুঁড়ে ফেলেছেন এ চিন্তা।


ঈশ্বরহীন এইসব সমাজের অবস্থা তবে কেমন? সমাজের অবস্থা মাপার সকল পরিমাপ - গড় আয়ু, শিক্ষার হার, জীবন যাপনের অবস্থা, শিশুমৃত্যুর নিম্নহার, অর্থনৈতিক সাম্যাবস্থা, লিঙ্গ সাম্যাবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা, দুর্নীতির নিম্নহার, পরিবেশ সচেতনতা, গরীর দেশকে সাহায্য সবদিক দিয়েই ডেনমার্ক ও সুইডেন অন্যান্য সকল দেশকে ছাড়িয়ে সবচেয়ে উপরে। তবে পাঠকদের আমি এই বলে বিভ্রান্ত করতে চাই না যে, এইসব দেশে কোনো ধরনের সমস্যাই নেই। অবশ্যই তাদেরও সমস্যা আছে। তবে সেই সমস্যা সমাধানের জন্য তারা যৌক্তিক পথ বেঁছে নেন, উপর থেকে কারও সাহায্যের অপেক্ষা করেন না, কিংবা হাজার বছরের পুরোনো গ্রন্থ ঘেঁটে সময় নষ্ট করেন না।


অনেকে বলেন, দিন দিন যা দেখছি, সেদিন বেশি দূরে নয় যখন নাস্তিকতা একটি ধর্মে পরিণত হবে। আমি বলি, উঁহু, নাস্তিক্যবাদ কোনো ধর্মতত্ত্ব নয়। ধর্মতত্ত্ব ঈশ্বর ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। যেখানে ঈশ্বর নেই, সেখানে ধর্মতত্ত্বের ভিত্তি নেই। ধর্ম তাকেই বলি, যা ঈশ্বরবিশ্বাস ও ঈশ্বর প্রদত্ত অনুশাসনকে বোঝায়। নাস্তিক্যবাদে ঈশ্বর অনুপস্থিত। নাস্তিক্যবাদীরা ঈশ্বর ও ঈশ্বরের নামে অনুশাসনকে অস্বীকার ও বিরোধিতা করে। নাস্তিক্যবাদীরা মনে করেন মানুষকে সুপথে চালিত করতে রাষ্ট্রীয় অনুশাসন ও বিজ্ঞানই যথেষ্ট। ধর্ম মানে কয়েকটি ভুর্জপত্রে লিখন নয়, যা মেনে চললেই ধার্মিক হওয়া যায় আর না মানলেই নরকের কীট! মানুষের ধর্ম - মানুষের মানবিক গুণ, যা মানুষকে অন্য প্রাণীর থেকে আলাদা করে। আসলে নাস্তিক বলে আলাদা করে ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো কিছু আছে বলে মনে হয় না। তবে নাস্তিক, নির্ধার্মিক, অজ্ঞেয়বাদী, সংশয়বাদী - এদের মধ্যে কোনো প্রথাগত বিভেদ নেই, যা আছে তা হল সব বুদ্ধিগত এবং অহিংসতা।


পৃথিবীজুড়ে আস্তিকদের ধর্মচর্চা, ঈশ্বরচর্চার পাশাপাশি চিরকালই বিপরীত স্রোত হিসেবে থেকেছে অবিশ্বাস এবং যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নাস্তিক্যবাদ। এক সময় পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়া কমিউনিজম-এর প্রভাবে নাস্তিকদের সংখ্যা বাড়লেও বর্তমানে তা নিম্নমুখী। কলেজ স্ট্রিটের কানাগলি থেকে প্রকাশিত ‘বিজ্ঞান ও নাস্তিকতা’ নামে অতি চটি একটি পত্রিকায় লেখক ভবানীপ্রসাদ সাহু বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে নাস্তিকদের একটা সংখ্যাতত্ত্ব  প্রকাশ করেছিলেন ২০০৫ সালে। এতে বলা হয়েছে ১৯৯২ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যার ২০.৪ শতাংশ ছিল নাস্তিক বা ঘোষিত নিরীশ্বরবাদী। ১৯৯৬ সালে সেই সংখ্যা হয় ১৯ শতাংশ এবং ২০০২ সালে তা পৌঁছোয়  ১৫ শতাংশে। এই মুহূর্তে উইকিপিডিয়া খুলে 'উইন-গ্যালপ ইন্টারন্যাশনালের' করা সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে ২০১২ সালে নাস্তিকের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশে, ২০১৫ সালে  ১১ শতাংশে এবং ২০১৭ সালে ৯ শতাংশে। 


সবার ফেসবুকে উপছে পড়া ভক্তি, সবার হোয়াটসঅ্যাপে ধর্মের ডিজিটাল বাণী। এর মধ্যেখানেই বকচ্ছপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নাস্তিকতার পাঠ নিয়ে বসা মানুষটা। বন্ধু-বান্ধব আত্মীয় স্বজন মায় পরিবারের মধ্যেও সে একা। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে এক সময় ইতু পুজো, নানা রকমের ষষ্ঠী, সন্তোষী মার ভক্ত পরিবার কিভাবে যেন জড়িয়ে পড়েছে গোপাল ঠাকুরের পুজোয়। পাড়ার মোড়ে দিব্যি জমে গেছে গোপালের সিংহাসন, মুকুট, পোশাক, বিছানা, মশারি বিক্রির দোকান। সেক্টর ফাইভে সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করা জিন্স আর টপ পরা মেয়েটা হাতে দিব্যি বেঁধে রেখেছে লাল বিপত্তারিনীর সুতো। বাবার বার বলে সোমবার উপোষ করছে ১৯-২০র ছেলেরা। অথচ এই বঙ্গেই এক সময় ভূত-ভগবান-শয়তান-এর বিরুদ্ধে কোমর কষে লড়াইয়ে নেমেছিলেন গণ বিজ্ঞান আন্দোলনের মানুষজন।

আত্মীয়-স্বজন, সমাজ-সংসারের দাবি সামলাতে গিয়ে ব্যক্তিগত মতামত, স্বাধীনতার পরিসর কমেই যাচ্ছে নাস্তিক কুলের। কারণ, তার জন্য কোনও স্বস্তির জায়গা নেই। কালিপুজোর সময় শব্দবাজির অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে ঠিক কোথায় গেলে শান্তি মিলবে, তা যেমন সারমেয়রা বুঝতে পারে না, এ অবস্থা অনেকটা যেন তাই। গোটা পৃথিবী জুড়ে, গোটা দেশ, এ পাড়া-সে পাড়া, এমনকি ঘরের ভেতর যেভাবে অতিভক্তির আধিক্য বাড়ছে, তাতে নাস্তিকরা বিপন্ন বইকি। এ বিপন্নতা যাঁরা একটু অন্যভাবে বাঁচতে চান তাদেরও।

এখন প্রকাশ্যেই নাস্তিকতার পক্ষে লেখালেখি হচ্ছে - যে বিষয়টা একসময় কল্পনাও করা যেত না। নিজেকে নাস্তিক সাজিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে থাকার মধ্যে কোন সার্থকতা নেই। এই নিরন্তর লড়াই চলছে, চলবে। যতদিন না পৃথিবী থেকে ধর্মান্ধতা দূর করা যাবে, যতদিন না ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসের নামে মানুষকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া বন্ধ না হবে, যতদিন না মানুষ প্রকাশ্যে তার হৃদয়ে জমে থাকা কথাগুলো বলতে পারবে - ততদিন এই আন্দোলন-সংগ্রাম চলবে। সেই স্বপ্নের লাল সূর্য উদিত হতে আর বেশি দিন সময় লাগবে না।

আমাদের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা এবং মানবতা শিশুকাল অতিক্রম করে গেছে বহু আগেই। এখন আর আমরা রূপকথার কল্পিত পরম পিতা নিয়ে মোহিত নই, যে পরম পিতা ‘ডাবের ভেতর জল কেন’ থেকে শুরু করে বিগব্যাং কিংবা ব্ল্যাকহোল পর্যন্ত সবকিছুর পেছনে একমাত্র গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হিসেবে হাজির হবেন আর আমাদের প্রয়োজনের অলীক ত্রাণকর্তা হিসেবে নিজেকে পরিচিত করাবেন। সময় এগিয়েছে অনেক, আমরা নিজেরাই এখন নিজেদের দায়িত্ব নিতে সক্ষম, মানুষ নিজেই আজ নিজের ভাগ্যবিধাতা। আমরা আর রূপকথার জাল বুনে নিজেদের প্রবোধ দিতে চাই না, বরং বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক জ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে এখন জীবন সাজাতে চাই। লেখাটা শেষ করব একজন প্রখ্যাত ব্যক্তির হীরকখণ্ড দিয়ে, “The true atheist will stay silent. To give a theist someone to debate is to harbour his delusion further.” - Charles Darwin.

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929