যে গল্প আমরা কখনোই বলি না।
Guitar K Kanungo
Dec. 30, 2024 | | views :113 | like:4 | share: 2 | comments :0
ছোটবেলায়
একটা গল্প পড়েছিলাম: ইসলামের
নবী মুহাম্মদ যে পথ দিয়ে
চলাফেরা করতেন, এক দুষ্টু বুড়ি
সেই পথে অসংখ্য কাঁটা
বিছিয়ে রাখতেন। বোঝাই যাচ্ছে, সেই বুড়ি মুহাম্মদকে
পছন্দ করতেন না। তবে কেন
তিনি মুহাম্মদকে পছন্দ করতেন না, সেই কারণটা
অবশ্য খোলাসা করে বলা হয়নি।
যাই হোক, মুহাম্মদ কাঁটা
সরিয়েই সে পথ দিয়ে
অতি সাবধানে চলাফেরা করতেন।
একদিন
মুহাম্মদ পথ চলতে গিয়ে
দেখতে পেলেন, সে পথে কোনো
কাঁটা বিছানো নেই। তিনি বেশ
অবাক হলেন। পরের দিনও একই
ঘটনা ঘটল। এইভাবে কয়েক
দিন পরপর একই ঘটনা
ঘটার পর মুহাম্মদ কিছুটা
চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি
ভাবলেন, "বুড়ি মরেটরে গেল
না তো!" তিনি খোঁজ নিয়ে
বুড়ির বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন।
বুড়ি সত্যিই অসুস্থ—শয্যাশায়ী। কিন্তু বুড়ি মুহাম্মদকে তাঁর
বাড়িতে দেখে খুবই অবাক
হলেন। যার ক্ষতি করার
জন্য তিনি এত ব্যস্ত
ছিলেন, সেই মুহাম্মদ আজ
তাঁর বাড়িতে এসে তাঁকে দেখতে
এসেছেন ! সেইদিন থেকে বুড়ি মুহাম্মদের
প্রতি তাঁর যে হিংসা
ছিল, তা পরিত্যাগ করলেন।
এই গল্পে যে বুড়ির কথা
বলা হয়েছে, তাঁর নির্দিষ্ট কোনো
নাম বলা হয়নি। আগেই
বলেছি, এটি ইসলামের নবী
হযরত মুহাম্মদের জীবন থেকে নেওয়া
একটি জনপ্রিয় ঘটনা। মুহাম্মদ যে কতটা সহনশীল
এবং ক্ষমাশীল ছিলেন, সেটা তুলে ধরার
জন্যই সাধারণত এই গল্পটি বলা
হয়। কিন্তু যেহেতু বুড়ির নামের কোনো উল্লেখ নেই,
সেহেতু এই ধরনের ঘটনা
আদৌ ঘটেছিল কিনা, নাকি পুরো ব্যাপারটা
কারও কল্পনাপ্রসূত, তা নিশ্চিত করে
বলা মুশকিল। তবে এটুকু বলা
যেতেই পারে, বিখ্যাত ব্যক্তিদের ঘিরে নানা ধরনের
কল্পকাহিনী গড়ে ওঠার ঘটনা
নতুন কিছু নয়। ধর্মপ্রচারকদের
ক্ষেত্রে সেই মাত্রা আরো
অনেক বেশি, যেহেতু এখানে অলৌকিকতার সংমিশ্রণের সুযোগও থাকে।
তবে
ইতিহাসে এমন একটি ঘটনা
আছে, যেখানে মুহাম্মদকে খাবারের মধ্যে বিষ মিশিয়ে হত্যা
করার চেষ্টা করা হয়েছিল, এবং
যিনি এই কাজটি করেছিলেন,
তাঁর নামও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ
আছে। তাঁর নাম জয়নাব
বিনতে আল হারিথ। আমাদের
অনেকেরই হয়তো এই নামটির
সঙ্গে পরিচিত নই। খাইবার যুদ্ধের
পরপরই এই ইহুদি রমণী
মুহাম্মদকে খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে হত্যা
করার চেষ্টা করেছিলেন। ঘটনাটি বেশ কৌতূহল উদ্দীপক,
কারণ সেই সময় মুহাম্মদ
একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তি ছিলেন এবং তাঁকে হত্যা
করার চেষ্টা করা সহজ কথা
নয়।
জয়নাব বিনতে আল হারিথ এবং তাঁর পরিবার কয়েক প্রজন্ম ধরে খাইবার অঞ্চলে বসবাস করে আসছিলেন। তাঁরা মূলত ইয়েমেনি বংশোদ্ভূত এবং ইহুদি ধর্মাবলম্বী ছিলেন। জয়নাব ছিলেন তাঁর বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। ৬২৫ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মকালে ছয় শতাধিক নাদির বংশের ইহুদি খাইবারে এসে বসবাস শুরু করে। এরা মুসলমানদের দ্বারা মদিনা থেকে বিতাড়িত হয়ে এখানে এসে বসবাস করেছিল। এদের মধ্যে একজন ছিলেন সালাম ইব্ন আল নাদিরি, যার সঙ্গে জয়নাব পরবর্তীতে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন।
৬২৮ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদের নেতৃত্বে মুসলমানেরা খাইবার অবরোধ করে। এই যুদ্ধে মুসলমানদের আলী বিন তালিব যথেষ্ট বীরত্বের পরিচয় দেন। উনিশ দিন ধরে চলা এই যুদ্ধের প্রথম নয় দিনেই জয়নাব তাঁর স্বামী, পিতা, এবং ভাই, সবাইকে হারান। পরবর্তী দশ দিনে যুদ্ধ বিশেষ কিছু হয়নি, কিন্তু অবরোধ বলবৎ ছিল। মুসলমান বাহিনী বাইরে থেকে সমস্ত পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। এমন অবস্থায় ইহুদিদের পক্ষ থেকে কয়েকজন আত্মসমর্পণের শর্ত নিয়ে মুহাম্মদের সঙ্গে আলোচনা করতে আসে।
আলোচনার
এক ফাঁকে জয়নাব জেনে নেন, মুহাম্মদের
প্রিয় খাবার কী। জয়নাব যখন
জানতে পারলেন, ভেড়ার ঘাড়ের মাংস মুহাম্মদের বিশেষ
পছন্দের, তখন তিনি তাঁর
ভেড়ার পাল থেকে একটা
ভেড়া মেরে তার কাঁধের
মাংসে ভালো করে বিষ
মাখিয়ে সেটাকে রোস্ট করলেন। আত্মসমর্পণের শর্ত নির্ধারণের আলোচনা
শেষ হতেই জয়নাব বিষ
মাখানো ভেড়ার রোস্ট উপহার হিসেবে মুহাম্মদের সামনে হাজির করলেন।
মুহাম্মদ
সামনে রাখা ভেড়ার মাংস
থেকে ছোট্ট একটা টুকরো মুখে
দিলেন। এদিকে, মুহাম্মদের এক সঙ্গী কিছুটা
মাংস চিবিয়ে গিলেও ফেললেন। মুহাম্মদ মাংসটা না গিলে মুখ
থেকে ফেলে দিলেন। তারপর
বললেন, "এই মাংসে বিষ
মেশানো হয়েছে।" এদিকে যিনি মাংসের কিছু
অংশ গিলে ফেলেছিলেন, তাঁর
মধ্যে বিষক্রিয়া দেখা দিতে শুরু
করল। তিনি উঠে দাঁড়াতে
চাইলেন, কিন্তু পারলেন না; তাঁর মুখের
রং বদলে যেতে থাকল।
বিষ মেশানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে একজন একটি
মাংসের টুকরো অদূরে অপেক্ষমাণ এক কুকুরকে খেতে
দিলেন। মাংস খাওয়ার পরপরই
কুকুরটি মারা গেল। উপস্থিত
সবাই নিশ্চিত হয়ে গেল, খাবারে
বিষ মেশানো হয়েছে।
মুহাম্মদ
জয়নাবকে ডেকে পাঠালেন। তারপর
জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি কি এই
খাবারে বিষ মিশিয়েছ?" জয়নাব
বললেন, "জ্বি, মিশিয়েছি।" মুহাম্মদ পাল্টা প্রশ্ন করলেন, "কেন করলে এই
কাজটা?" জয়নাব দৃপ্ত কণ্ঠে বললেন, "আমি আপনাকে একটা
বার্তা দিতে চেয়েছি। আপনি
আমার কাছ থেকে আমার
পিতাকে কেড়ে নিয়েছেন, আমার
স্বামীকে কেড়ে নিয়েছেন, আমার
গোত্রের অন্য মানুষদেরও কেড়ে
নিয়েছেন। আমি আপনাকে হত্যা
করতে চেয়েছি। আমি ভেবেছি, আপনি
যদি সত্যিই একজন নবী হয়ে
থাকেন, তাহলে এই বিষ আপনার
কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
আর আপনি যদি একজন
সাধারণ মানুষ হয়ে থাকেন, তাহলে
এই বিষ আপনাকে হত্যা
করবে।" মুহাম্মদ জয়নাবের যুক্তিকে অস্বীকার করতে পারলেন না,
প্রকাশ্যে কেবল এইটুকু বললেন,
"আল্লাহ সেটা অনুমোদন করবেন
না।"
উপস্থিত মুসলমানেরা জয়নাবের ওপর ক্ষিপ্ত হলেও, মুহাম্মদ তাঁকে হত্যা করার অনুমতি দিলেন না। জয়নাব ফিরে গেলেন। মুহাম্মদ তাঁকে ক্ষমা করলেও জয়নাবের জীবন খুব দীর্ঘায়িত হয়নি। মুহাম্মদের সেই সঙ্গী, যিনি বিষ মাখানো মাংস খেয়েছিলেন, কয়েক বছরের মধ্যে মারা যান। অবশ্য মৃত্যুর আগের সময়টুকু পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েই কাটিয়েছিলেন। বশির আল-বারার মৃত্যুর পর জয়নাবকে তাঁর আত্মীয়স্বজনের হাতে তুলে দেওয়া হয়। রক্তের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে তারা জয়নাবকে হত্যা করে।
শুরুতে
যে বুড়ির কথা বলেছিলাম, মুহাম্মদ
যেমন তাঁকে ক্ষমা করেছিলেন, তেমনি জয়নাব বিনতে আল হারিথকেও ক্ষমা
করেছিলেন, যদিও জয়নাবের অপরাধ
ছিল আরও গুরুতর। ফলত
এই গল্পটাও তাঁর মহানুভবতার আরও
বড় নিদর্শন হয়ে উঠতে পারত,
কিন্তু তা হয়নি। আমাদেরকে
বারবার সেই বুড়ির গল্পই
শোনানো হয়েছে। কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে মুহাম্মদের অসুস্থতার
মধ্যে। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও
অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, মুহাম্মদের
অসুস্থতার পেছনে একটি বড় কারণ
ছিল এই বিষক্রিয়া। মুহাম্মদ
বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন; তিনি বিষ মেশানো
মাংসটা গিলে না ফেললেও,
বিষের কিছুটা লালার মাধ্যমে তাঁর শরীরে প্রবেশ
করেছিল। মৃত্যুশয্যায় মুহাম্মদ প্রায়শই তাঁর জিহ্বা পুড়ে
যাচ্ছে বলে অভিযোগ করতেন।
বিভিন্ন উৎস এ কথা
নিশ্চিত করলেও, জয়নাবের বিষপ্রয়োগের ফলেই তাঁর এ
ধরনের শারীরিক অস্বস্তি হচ্ছিল কিনা, তা বলা মুশকিল।
যদি তা হয়ে থাকে,
তাহলে জয়নাব নবীত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ
করেছিলেন, আর সেই সন্দেহের
একরকম ভিত্তি তৈরি হয়। এই
সন্দেহটা যাতে ছড়িয়ে না
পড়ে, তা তাঁর অনুসারীরা
নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। আমার
ধারণা, এই কারণেই আমাদের
এই গল্পটা শোনানো হয়নি। সেই তুলনায় কাঁটা
বিছানো পথ আর বুড়ির
গল্প অনেক নিরাপদ।