ডাইনির নামে হত্যাকান্ড ও সংবিধান কী বলে?

অভিষেক দে


Nov. 19, 2024 | | views :733 | like:0 | share: 0 | comments :0

সময়টা ২০০১ সালের সম্ভবত জানুয়ারি মাস। বাঁকুড়ার একটি গ্রামে গিয়েছি বন্ধু কৌশিক এর মামাতো দাদার বিয়েতে। বিয়ের আগের দিন সন্ধেবেলা গ্রামে পৌছে মেতে গেছি বিয়ের অনুষ্ঠানে। পরের দিন খুব ভোরে উঠে বন্ধুর একজন মামার সাথে বন্ধু  কৌশিক এবং আমি বেরিয়েছি শীতের সকালে গ্রাম ঘুরতে। ঘুরতে ঘুরতে এক যায়গায় দেখি অনেক মানুষের ভীড়। ব্যাপার টা কি জানতে আমরা তিনজনে উক্ত স্থানে চলে আসি। দেখি কয়েকজন হোমড়াচোমড়া ব্যাক্তি খুব উত্তেজিত হয়ে কয়েকজন কে যেন কড়াভাষায় কিছু বলছে এবং তাঁদের অনতিদূরে একজন ষাটোর্ধ মহিলা অসহায় ভাবে মাটিতে মাথা নীচু করে কাঁদছেন। বন্ধুর মামা আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে বিষয় টা জেনে এসে আমাদের জানালেন, উক্ত মহিলা নাকি ডাইনি। গ্রামের একজন কে দেখলাম উনি নাকি গুণিন, তিনিই নাকি জানিয়েছেন উক্ত মহিলাটি একজন ডাইনি এবং মহিলার পরিবার কে গ্রামের মাতব্বর দের কাছে পঁচিশ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে এর জন্য নইলে গ্রামে থাকা উক্ত পরিবারটির পক্ষে নাকি  অসম্ভব।


ডাইনির ব্যাপারে গল্পের বইতে আগে অনেক পড়েছি, কিন্ত এভাবে সরাসরি একজন ডাইনি কে দেখে বিষ্ময়ে হতবাক হয়েছিলাম বিষয়টা সেদিন ভালোভাবে না জানার দরুন। জানিনা, ডাইনি ঘোষিত সেই মহিলা এবং তাঁর পরিবারটি আদৌ অতগুলো  টাকা দিয়ে গ্রামে থাকতে পেরেছিলেন কিনা। অনেক পরে জেনেছি ডাইনি বা ডায়েন বলে বাস্তবে কিছুই হয় না,ওসব গল্পগাঁথাতেই সম্ভব। কিন্ত আমি বললেই বা লোকে মানবে কেন? বাড়ির চালে ফনফন করে লাউ গাছ বেড়ে উঠছিল,কড়াও পরেছিল রাশি রাশি। আচমকা গাছ শুকিয়ে মরে গেলো। কেউ কি তবে কু-নজর দিয়েছে গাছে? কে-সে? ডাইনি নয় তো? সদ্য প্রসুতির সন্তান ক্ষিদের জন্য কাঁদছে অথচ মায়ের স্তনে মুখ দিচ্ছে না, কেউ কি মায়ের স্তন ভেড়ে দিয়েছে? সে, ডাইনি নয় তো? ছটফটে শিশুটা কেমন যেন হঠাৎ করেই ঝিমিয়ে গেছে। এটা ডাইনির কু-নজর নয়তো? এই তো গতবছর হারাণ এর মা এর পায়ে ঘা হয়, মলম লাগিয়েও কাজ হয় নি শেষে গ্রামের একজন গুণিনের কাছে জানতে পারলো গ্রামেরই এক ডাইনি, সেই পা এর রোগ টা জিইয়ে রেখেছে। শেষে গুণিন কে দক্ষিণা দিয়ে কিসব শেকড়বাকড় পরে সুস্থ হলো।


শুধু আদিবাসী সমাজ নয়, শিক্ষার সু্যোগ না পাওয়া কিংবা শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত শহুরে মানুষের একাংশও ডাইন বা ডাইনি বা ডায়েন এ গভীরভাবে বিশ্বাস করেন। আদিবাসী সমাজে এই বিশ্বাস হচ্ছে সমুদ্র গভীর। কোনো গ্রামের কোনো গুনিন,জানগুরু, ওঝা,দিখলি, সৎসখা ইত্যাদিরা যদি কোনো মহিলাকে একবার ডাইনি ঘোষণা করে দেয় তাহলে সেই মহিলাকে বাঁচানো খুবই সমস্যার। গ্রামের মোড়ল বা মাতব্বর দের বিধান মতো ঘোষিত ডাইনির পরিবার কে মোটা অঙ্কের জরিমানা দিয়ে তবে গ্রামে থাকতে হয়। কখনওবা ডাইনি বলে যাকে দেগে দেওয়া হয় তাঁকে প্রকাশ্যে নির্মম ভাবে হত্যাও হয়। খবরের কাগজে প্রায়শই এমন খবর আমাদের চোখে পরে। বিভিন্ন দেশের নানান গল্পগাঁথায় ডাইনি নিয়ে প্রচুর কাহিনী রয়েছে এসব গল্পই ধিরে ধিরে আমজনতাকে ডাইনির প্রতি বিশ্বাস করতে বাধ্য করে। বাধ্য করে শেখাতে যে, ডায়েন বা ডাইনিদের কোনো অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক ক্ষমতা-টমতা আছে, এবং ডাইনিরা সমাজের ক্ষতিই করে থাকে। স্টার প্ল্যাস হিন্দি চ্যানেলে তো ডাইনির প্রতি জনগণের বিশ্বাস জাগাতে  ' নজর ' নামে একটা সিরিয়াল পর্যন্ত হয়েছে। এইধরনের সিরিয়াল বা সিনেমার প্রভাব মানবজীবনে অনেক। ডাইনি সন্দেহের বশবর্তী হয়ে না জানি কত অসহায় মহিলারা সামাজের চোখে অপরাধী হয়ে অত্যাচারিত হবে, হচ্ছেও। প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে এসব চললেও কোনো প্রতিবাদ,প্রতিরোধ নেই। এই প্রসঙ্গে একটি লজ্জাজনক ও নৃশংশ ঘটনার কথা আপনাদের শোনাই।


রাঁচির মান্দার ব্লকের কাঞ্জিয়া মারাইটোলি গ্রাম। এই গ্রামেই গত ৭ই অগাস্ট, ২০১৫ সালে পাঁচজন মহিলা কে পিটিয়ে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছে একদল উন্মত্ত গ্রামবাসী।

উক্ত পাঁচজন মহিলার অপরাধ, তারা নাকি " ডাইনি"। রাঁচির এই গ্রামে কেউ ডাইনি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেনা, বরং গভীরে বিশ্বাস করে। ফলে যা হয় সেটা সত্যিই ভয়াবহ।

২০১৪ সালে এই মারাইটোলি গ্রামের পাশেই একজন মহিলাকে ডাইনি ঘোষণা করে  হত্যা করার পরে গ্রামের এক ওঝার নিদান মতে সাইকেলের হ্যান্ডেলে উক্ত মহিলার কাটা মাথা নিয়ে গোটা গ্রাম ঘোরানো হয়।পুলিশ প্রশাসন কে সম্পুর্ন উপেক্ষা করেই। পুলিশ আসায় গ্রামবাসীরা জানায়, খুন করে বেশ করেছি। (তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩ আগষ্ট ২০১৫)।


পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৩ থেকে ২০১৫ র অগাস্ট পর্যন্ত ডাইনি সন্দেহে কিংবা বিশ্বাসে এই গ্রামে ১২৪ জন মহিলা দের নির্মম ভাবে হত্যা হয়েছে। আরেকটি ঘটনা এই প্রসঙ্গে আরেকটি জঘন্য ঘটনার কথা শোনা যাক।


বাঁকুড়া সিমলাপাল অঞ্চলের চূড়ামণি মান্ডি এবং তার পরিবার গত প্রায় দেড়বছর হল গ্রামে ফিরতে পারছেন না। কারণ তিনি নাকি ডাইন বা ডাইনি। গ্রামের একজন

জানগুরুর নির্দেশে, পরিবারটিকে জমিজমা বিক্রি করে জরিমানাও দিতে হয়েছে। কিন্তু তারপরেও তাঁদের ভিটেমাটিতে থাকার অধিকার নেই।

বর্তমানে একটা আদিবাসী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অনুগ্রহে পরজীবির মত বেঁচে আছেন ওনারা। অদ্ভুত এই অবস্থা। প্রশাসন সব জেনেও অন্ধ সেজে বসে আছে।

আশ্চর্য হলেও, রাগ হলেও এটাই আমাদের ভারত।

প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব কান্ড ঘটলেও তারা নির্বিকার।


" ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি " র পুরুলিয়া শাখার সম্পাদক মধুসূদন মাহাতো, দীর্ঘবছর ধরে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া সহ জঙ্গলমহল এলাকায় যুক্তিবাদী বা  সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।  বিশেষ ভাবে ডাইনি সমস্যা সহ আদিবাসী এলাকার আরেকটি সমস্যা নাবালিকা বিবাহের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজ মধুসূদন মাহাতো সহ কয়েকজন মুক্তমনা সহযোদ্ধারা নিরলস ভাবে কাজ করছেন। সম্প্রতি, মধুসূদন মাহাতো, তথ্যের অধিকার আইনে রাজ্যে সরকারের স্টেট ক্রাইম ব্যুরোর কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে কত মানুষকে ডাইনি সন্দেহে হত্যা করা হয়েছে?

সরকার লিখিত ভাবে জানিয়েছে এবিষয়ে কোন তথ্য তাদের কাছে নেই। ভাবা যায়! যেখানে তথ্যই নেই সেখানে প্রতিকার দুরাশা করাটা বোকামো।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশাসনের দারস্থ হয়েও সুবিচার পাননি চূড়ামণি মান্ডি এবং তার পরিবার। এই অবস্থাই কি চলছে, চলবেও? প্রশাসন কি এভাবেই জেগে ঘুমাবে? কিছু আলোচনার সময়ে মধুসূদন মাহাতোর দাবী, কাউকে ডাইনি বলে দেগে দেওয়ার পেছনে একটা গভীর চক্রান্ত আছে। দেখা যাচ্ছে, যেই বছর কম বৃষ্টিপাত বা অনাবৃষ্টির ফলে খরার প্রকোপ দেখা যায় সেবছরই ডাইনির ঘটনা বেশি শোনা যায়। পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার মতন যায়গায় এমনিতেই চাষাবাদ খুব কম হয় বৃষ্টি বা জলের অভাবে। তাই কয়েকজন ধূর্ত ব্যাক্তি এই বিষয় টাকে হাতিয়ার করে। তাঁরা বুজরুক, প্রতারক ওঝা,গুণিন, জানগুরু ইত্যদিদের সাথে মিলে কোনো মহিলা কে ডাইনি ঘোষণা করে দেয় এবং সঙ্গে থাকে মোটা অঙ্কের জরিমানা। স্বাভাবিক ভাবে অনেকেরই সেই টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই বলে চলে অত্যাচার এবং গ্রামে একঘরে করে রাখার বিধান। সোজা কথা, উদ্দ্যেশ্যে, কোনো মহিলাকে ডাইনি বলে দেগে দিয়ে তাঁর কাছ থেকে মোটা টাকা হাতিয়ে নেওয়ার নোংরা চক্রান্ত। যেহেতু গ্রামগঞ্জে আজও ডাইনির ক্ষমতায় বিশ্বাসী (পড়ুন অন্ধবিশ্বাসী) মানুষের অভাব নেই তাই বিশ্বাসীরাও দল কোমড় বেঁধে নেমে পড়ে যাকে ডাইনি ঘোষণা করা হয়েছে তাঁর অথবা তাঁর পরিবারের ওপরে ক্রমাগত চাপ দিতে জরিমানার টাকা দেওয়ার জন্য।


যখন চিকিৎসা বিজ্ঞান কিংবা মনোবিজ্ঞান আজকের মতন এতো উন্নত হয়নি সেসময় অজানা জ্বর বা রোগের প্রাদুর্ভাব কে অনেকে বোঙ্গা বা দেবতার অভিশাপ নয়তো ডাইনির কারসাজি ধরে নিতো। অবস্থা এখনো পালটায় নি। আজও প্রত্যন্ত গ্রামে সু-চিকিৎসার কেন্দ্র নেই। তথাকথিত স্বাধীনতা লাভের ৭৩ বছর পরেও। আজও একশ্রেণীর মানুষের পরনে কাপড় নেই, হাতে রোজগার নেই, সু-চিকিৎসা নেই, পেটে খাদ্য দেওয়ার মতন অবস্থা নেই, পারিস্কার পানীয়জল নেই, বাসস্থান নেই, মাথার ওপরে ছাদ নেই। এই নেই এর রাজ্যে আছে শুধু প্রতারণা, বুজরুকি, ধর্মের সুড়সুড়ি। গলা পর্যন্ত দুর্নীতিতে ডুবে থাকা দেশে নাগরিক অধিকার আজ খর্ব। আমজনতা তাঁদের সংবিধান স্বীকৃত ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। যে দেশে শুধুমাত্র ঘুষ দিয়ে কাজ করাতেই বছরে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়ে যায় সেদেশের জনতা সু-চিকিৎসার সুযোগ না পেলে এবং সচেতনতার অভাবে এসব ওঝা,গুণিন, জানগুরুদের খপ্পরে পরে সর্বসান্ত হয় এবং ডাইনি ঘোষিত বলে অত্যাচারিত,লাঞ্ছিত হয় প্রতিদিন, প্রতিমূহুর্তে। আসলে পুরুষশাসিত সমাজের মাথারা নারী কে কোনো দিনই ' মানুষ ' হিসেবে দেখেনি কিংবা ভাবেনি। সর্বদাই ভেবেছে ভোগের সামগ্রী অথবা সংসার সামলানোর যাবতীয় কাজ করার একটা যন্ত্র।


প্রায় দুশো খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ ডাইনিতত্ত্ব বা ডাকিনিতত্ত্বের রমরমা শুরু হয় এবং দ্রুত ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। ১৬৮৪ খ্রিষ্টাব্দে রেসিন্যান্ড স্কট নামক একজন ব্যাক্তি প্রকাশ করেন ' The Discovery of Witchcraft ' নামের গ্রন্থ টি। উক্ত বইটির মূল আলোচনা ছিল মানসিক রোগীদের ডাইনি বলে ঘোষনা করে সমাজ মিথ্যেই তাঁদের ওপরে অত্যাচার করেছে। স্কট এর বইটি প্রায় সর্বত্রই ধিক্কৃত হয়েছিল সেসময়। এরও আগে ১৪৮৬ সালে খ্রিষ্টান ধর্মে পোপের নির্দেশে ' The Witche's Hammer ' নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে মানসিক রোগীদের ডাইনি বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই গ্রন্থেই বলা হয়েছিল ডাইনিরা সমাজের শত্রু, ওরা অশুভ শক্তি, তারা মন্ত্রতন্ত্র, তুকতাক জানে,সাধারণ মানুষ থেকে পশুপাখি দের ক্ষতি করে, নানান অসুখ তৈরী করে, রক্ত শুষে নেয়। তাই পোপের নির্দেশ ছিলো, ওদের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র পথ ওঁদেরকে জ্যান্ত জ্বালিয়ে শেষ করে দেওয়া হোক। 'The Witche's Hammer ' গ্রন্থটির সময় থেকে বহুযুগ ধরে প্রকাশ্যে মানসিক রোগিণী অর্থাৎ মহিলাদের উপর বারে বারে আঘাত এসেছে যা আজও ক্রমবর্ধমান। এখন হয়তো ডাইনি ঘোষিত কোনো মহিলাকে জীবন্ত জ্বলিয়ে দেওয়া হয়না, কিন্ত যা যা অত্যাচার হয় সেটা কোনো অংশেই কম নয়। রাঁচির মারাইটোলি গ্রামের ঘটনাটি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য, যা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই সমস্যার শেকড় কতটা গভীরে।


National Crime Record Bureau র তথ্য অনুযায়ী, সাল ২০০০ থেকে ২০১৬ র মধ্যে ডাইনি ঘটনায় অত্যাচারিত ও খুন হয়েছেন ২৫০০ জন মহিলা। এতো গেলো সরকারি হিসেবে।  কিন্তু বিভিন্ন মানবধিকার বা যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনষ্ক সংগঠনের দাবী সংখ্যাটা কয়েকগুণ বেশি। ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৬৬০ খ্রীষ্টাব্দ  পর্যন্ত ডাইনি অপবাদে শুধু ইউরোপেই মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল ৮০ হাজার মহিলাকে। এই জঘন্যতম কান্ড শুধু ইউরোপ নয়, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড সহ অনেক দেশেই ছিল যথেষ্ট আকারে।


শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা যাক বিখ্যাত লেখিকা প্রয়াত মহাশ্বেতা দেবীর। উনি দীর্ঘসময় ধরে আদিবাসী দের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের দাবীতে প্রচুর কাজ করেছেন, বিশেষ ভাবে ডাইনির ঘটনা নিয়ে। আরেকজন ব্যাক্তি হলেন ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে মহাশয়। উনিও ডাইনি নামক একুশ শতকের লজ্জাজনক কান্ড নিয়ে যথেষ্ট কাজ করেছেন। কিন্তু ওনার কিছু বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার অবকাশ রয়েছে। যেমন শ্রী বাস্কের  একটি লেখা ' আদিবাসী সমাজের সংস্কার ও কুসংস্কার ' এর এক যায়গায় উনি লিখেছেন- " এটাকে (ডাইনি) কুসংস্কার কিংবা অন্ধ বিশ্বাস যাই বলি না কেন, ভারতবর্ষের প্রায় সব আদিবাসী সমাজেই এই ক্ষতিকারক বিদ্যার চর্চা দেখা যায়। যদিও সকলেই জানে এর প্রয়োগ অসামাজিক তবুও তারা এর মোহমুক্ত হতে পারেনি। আদিবাসী সমাজের  কাছে এটা নিদারুণ অভিশাপ "। 

অর্থাৎ, শ্রীবাস্কের ধারণায়, ডাইনির মত একটা ক্ষতিকারক বিদ্যার চর্চা চলছে। তাঁর মানে উনিও মনে করেন ডাইনি বা ডাইন বা ডায়েন বাস্তবে হয় এবং তাঁদের সত্যিই কোনো অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক ক্ষমতা থাকে। গভীর দুঃখের সাথে জানাতে বাধ্য হচ্ছি ডাইনির প্রতি এমন অন্ধবিশ্বাস থাকলে, যতই মিটিং মিছিল আন্দোলন কিংবা লেখালিখি হোক না কেন সমস্যাটা মোটেই দূর করা সম্ভব নয়। ডাইনির প্রতি গভীর বিশ্বাসও রাখবো আবার এর বিরুদ্ধে কলম চালাবো এটা সোজাসাপটা স্ববিরোধীতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। আরো দুঃখ পাই যখন ব্যাক্তিগত ভাবে পরিচিত কয়েকজন বিজ্ঞান বা যুক্তিবাদী আন্দোলন কর্মীরাও মনে করেন এই পৃথিবীতে সত্যিই ডাইনির অস্তিত্ব রয়েছে এবং তাঁরা নিজের ক্ষমতার বলে সাধারণ মানুষের ক্ষতি করতে পারে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে একদা পত্রপত্রিকায় ঝড় তোলা স্বঘোষিত ডাইনি ইপ্সিতা রায়চৌধুরী' র কথা। ১৯৮৮ সালে উনি সাড়াজাগিয়ে এসেছিলেন। সেসময় পত্রপত্রিকায় ওনাকে নিয়ে গাদা গাদা নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়েছিল। কয়েকটি পত্রিকাতো ওনাকে ভালো ডাইনি আখ্যা দিয়ে প্রশংসায় ভরা লেখা পর্যন্ত লিখেছে।  কিন্তু তারপরে যুক্তিবাদী আন্দোলন কর্মীদের দ্বারা ওনার বুজরুকি ফাঁস হয়। আগষ্ট থেকে ডিসেম্ভর ১৯৮৮ সাল নাগাদ বিভিন্ন পত্রিকায় উনার বুজরুকি ফাঁসের নানান মুখরোচক খবর প্রকাশিতও হয়।


কোনো ওঝা,জানগুরু,গুণিন, সৎসখা, দিখলি ইত্যাদিরা ডাইনি সন্দেহে কোনো মহিলার ওপরে অত্বাচার করলে বা ডাইনি বলে ঘোষণা করলে, তাঁদের জেলে ঢোকাবার জন্য আমাদের দেশে বেশ কয়েকটা ভালো ভালো আইন রয়েছে। কিন্তু আকণ্ঠ দুর্নীতিতে ডুবে থাকা এই দেশে টাকা এবং রাজনীতিক পরিচিতি থাকার সুবাদে অপরাধীরা অনেক বে-আইনি কাজ করে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেরায় শুধুমাত্র জনগণের আইন বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে। সরকার চাইলেই আইন কে মলাটবন্দি অবস্থায় ফেলে না রেখে, জনগণ কে এই বিষয়ে সচেতন করতে পারে। আমজনতা এইসব আইনের ব্যাপারে সঠিক ভবে জানলে নিজেরাই এইসব প্রতারকদের জেলে ঢোকাতে পারেন অনায়াসেই।


" নারী সুরক্ষা ও নির্যাতন প্রতিরোধ বিল-২০১১" নামক এই বিলের ৪ নং সেকশনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, কোনো মহিলাকে ডাইনি ঘোষণা করে গ্রামের অন্য সদস্যদের উস্কালে বা ডাইনি ঘোষিত মহিলার বিরুদ্ধে জনমত তৈরী করে নির্যাতন ও  শাস্তি দিলে অপরাধীদের সর্ব্বোচ্চ সাজা সাত বছরের জেল সঙ্গে কুড়ি হাজার টাকা জড়িমানা। এছাড়া ঝাড়খণ্ড সরকার পাশ করিয়েছে " ডাইনি প্রতিরোধ আইন- ২০১১", ছত্তিশগড় সরকার এনেছে " তোনাহি প্রতদ্ম নিভারণ আইন- ২০০৫ ", বিহার সরকার এনেছে " ডাইনি প্রতিরোধ আইন- ১৯৯৯"।


" অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি "  র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক নরেন্দ্র দাভোলকর, যাকে মৌলবাদী কট্টরপন্থীরা নৃশংশ ভাবে হত্যা করেছিল, তিনি ২০০৩ সাল থেকেই একটা আইন কে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালান। অবশেষে " The Maharashtra Prevention and Eradication of Human Sacrifice and other Inhuman, Evil and Aghori Practices and Black Magic Act 2013 " লাগু হয়। তাছাড়া " The Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954", এবং

" The Drugs and Cosmetics Act 1940 " এর মতন বেশ কিছু কঠোর আইনও এই দেশে রয়েছে।


সাংসদ প্রবর্তিত The Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954, আইনটি ৩০ এপ্রিল ১৯৫৪ সালে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায় এবং ১ মে ১৯৫৪ তে ভারত সরকার কর্তৃক প্রকাশিত সরকারি গেজেটের বিশেষ সংখ্যার দ্বিতীয় অংশের, প্রথম অধ্যায়ের ২৪ নং ক্রমে প্রকাশিত হয়। জম্মু ও কাশ্মীর বাদে ভারতের সর্বত্র এই আইন প্রযোজ্য।


The Drugs Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954 আইনের সংশোধন হয় ১৯৬৩ তে। এই আইনের ৯(এ) ধারা সংযোজন করে বলা হয়েছে, এই আইন ভঙ্গকারীদের Cognizable Offence হিসেবে গন্য করা হবে। অর্থাৎ কেউ কেউ পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের না করলেও পুলিশ কোনোও ভাবে এই অপরাধ সংগঠিত হয়েছে বলে প্রাথমিক জানার ভিত্তিতে কোনো অভিযুক্তকে ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেপ্তার করতে পারে (Notwithstanding anything contained in The Code of Criminal Procedure 1898 an Offence Punishable under this Act shall be Cognizable)..


" The Drugs And Cosmetics Act 1940 "  Amendment GSR 884 (E)..বিভিন্ন সময়ে এই আইন সংশোধন হয়েছে। যেমন,১৯৫৫,১৯৫৭,১৯৬২,১৯৬৪,১৯৬৪ এবং শেষ এমেন্ডমেন্ট হয় ২০০৯ সালে। ১৯ মার্চ ২০০৯ তারিখে ভারতের প্রতিটি দৈনিক পত্রিকায় নোটিশ জারি করেছে কেন্দ্রের ' স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তর '। এই আইনে এবার থেকে শাস্তির পরিমান আজীবন কারাদণ্ড এবং সাথে ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা।


কয়েকজন মুক্তমনা, যুক্তিবাদী মানুষ এই রাজ্যে অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে মহারাষ্ট্রের ধাঁচে একটা জোরালো বা কঠোর আইন প্রণয়ণের দাবীতে দীর্ঘদিন ধরে সরব। ইতিমধ্যে উনারা আইনের খসড়া জমা দিয়েছেন State Law Commission এর দপ্তরে। এনারা যেই আইনটি আনতে চান তার নাম " The West Bengal Prevention of Superstition and Black Magic Practices Bill ২০১৬। " আপাতত এই আইনটি লাল ফিঁতের ফাঁসে আটকে রয়েছে সরকারের উদাসিনতার কারনে।


আইন আছে কিন্তু তার সঠিক প্রয়োগ নেই। গোদীলোভো কোনো রাজনৈতিক দলই চায়না আন্তরিক হতে, তাই তাঁরা ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থেই আমজনতার তথাকথিত ধর্মবিশ্বাস কে আঘাত করতে নারাজ। নইলে সরকার চাইলে কড়া হাতে এইসব অমানবিক ও জঘন্য কাজ অনায়াসেই বন্ধ করতে পারে ব্যাপক আকারে সচেতনতার প্রচার ও প্রাসারের মাধ্যমে সঙ্গে ওঝা,জানগুরু ইত্যদিদের বিরুদ্ধে কড়া শাস্তির ব্যাবস্থা করে। এর সাথেই প্রয়োজন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সু-চিকিৎসার কেন্দ্র গড়ে তোলা। স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরে আজও বহু গ্রামগঞ্জে সু-চিকিৎসার কেন্দ্র নেই, নেই পর্যাপ্ত ওষুধ এবং ডাক্তার। তাই তো অজানা রোগ, জলবাহিত রোগ ইত্যাদিকে  ডাইনির প্রকোপ আখ্যা দিয়ে স্বার্থলোভী ওঝা,গুণিন, জানগুরুদের প্রতারণা অবাধে চলছে।


ডাইনি বলে বাস্তবে কিছুই নেই ওসব গল্পের বই এবং সিনেমা সিরিয়ালেই সম্ভব। এইধারণা কে মনে গেঁথে নিলে এবং আন্তরিক হলে অবশ্যই বন্ধ করা যাবে এই ডাইনির ঘটনা গুলোকে। এর জন্য বিজ্ঞান আন্দোলন কর্মীদের প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে নাটকের মাধ্যমে,  কুসংস্কার বিরোধী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, প্রচার মাধ্যমে, ব্যাপকভাবে ডাইনির বিরুদ্ধে সচেতনতা মূলক অনুষ্ঠানের কর্মসূচি নিতেই হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। সঙ্গে প্রশাসনের উচিৎ নজর রাখা কোনো গ্রামে কাউকে ডাইনি ঘোষণা হওয়ার খবর পেলেই দ্রুত ব্যাবস্থা নেওয়া এবং যে বা যারাই কোনো মহিলাকে ডাইনি আখ্যা দিয়েছে তার বিরুদ্ধে কড়া হাতে ব্যাবস্থা নেওয়া।


পর্ব-২।


গত ৫ জুলাই ২০২১ ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ এ ডাইনি সন্দেহে একজন মহিলাকে হত্যা করা হয়েছে। এর প্রতিবাদ এবং অপরাধীদের কড়া শাস্তির দাবী জানিয়ে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী নবীন পট্টনায়ক কে ইমেল করেছি। খবর পেয়েছি সরকার এখনও নাকি কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। এই সূত্র ধরেই

কথা হচ্ছিল ফ্রিথিংকার এবং সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট মিঃ দিবজ্যোতি সাঁইকিয়ার (Activist Dr Dibyajyoti Saikia) সাথে।

গত ১৪ আগষ্ট ২০১৫ সালে অসম বিধানসভায় পাশ হয়েছে ডাইনি হত্যা প্রতিরোধ আইন। " THE ASSAM WITCH HUNTING (PROHIBITION, PREVENTION AND  PROTECTION) ACT 2015 " অসম বিধানসভায় আলোচনার পর বিলটি গৃহীত হয় এবং ২৯ জুন ২০১৮ সালে সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয়। উক্ত আইনে কোনো মহিলাকে ডাইনি অপবাদ দিলে অভিযুক্তকে ৩ থেকে ৫ বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার থেকে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানার সুপারিশ করা হয়েছে। ডাইনি অপবাদে কাউকে অত্যাচার করা হলে ৫ থেকে ১০ বছর কারাদণ্ড ও এক থেকে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা এবং ডাইনি বলে অপবাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে জনতা জড়িত থাকলে সকলের কাছ থেকে ৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা আদায়ের বিধান থাকছে। ডাইনি অপবাদে খুন করার অভিযোগে ৩০২ ধারায় বিচার হবে। ডাইনি হিসেবে চিহ্নিত করায় কেউ আত্মহত্যা করলে প্ররোচনার দায়ে ৭ বছর থেকে যাবজ্জীবন সাজা ও এক থেকে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হবে। তদন্তে গাফিলতি হলে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে ক্ষেত্রে জরিমানার পরিমাণ হবে ১০ হাজার টাকা। সরকারের দাবি, অসমের এই আইন বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও মহারাষ্ট্রের চেয়েও কড়া হবে। উল্লেখ্য, কিছু সময় আগে ঝাড়খণ্ডের রাঁচির মাণ্ডরে ডাইনি অপবাদে পাঁচ মহিলাকে পিটিয়ে খুন করা হয়। অন্য রাজ্যগুলির প্রত্যন্ত গ্রামে মাঝেমধ্যেই ডাইনি অপবাদে অত্যাচারের অভিযোগ ওঠে।

অসমে পাশ হওয়া আইনে ডাইনি অপবাদে অত্যাচার চালানো, একঘরে করা বা হত্যার ঘটনায় তিন বছর থেকে যাবজ্জীবন সাজার সুপারিশ থাকছে। সেই সঙ্গে উক্ত আইনে হাতুড়ে চিকিৎসকদের বেআইনি অনুশীলন ও সালিশি সভা বন্ধেরও কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে ডাইনি অপবাদে একঘরে হওয়া, জখম হওয়া, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মহিলা বা পুরুষকে ক্ষতিপূরণ এবং ডাইনি-শিকারের বলি হওয়া পরিবারের অনাথ শিশুদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থাও করা হবে।


এই আইনটি লাগু করার পেছনে দিবজ্যোতি সাঁইকিয়ার অবদান অনেক।

অসমে গত ৭ বছরে ডাইনি অপবাদে প্রায় ৭০ জনের বেশি খুন করা হয়েছে। এই ঘটনা বেশি ঘটেছে শোণিতপুর, লখিমপুর, মাজুলি, বড়ো ও সাঁওতাল অধ্যূষিত জেলাগুলিতে। পুলিশ তদন্ত চালিয়ে দেখেছে, অনেক ঘটনার পিছনেই রয়েছে জমি বিবাদ বা ব্যক্তিগত শত্রুতা। রাজ্য পুলিশ ডাইনি হত্যা রোধে বিশেষ অভিযান চালাচ্ছিল। পাশাপাশি বীরুবালা রাভা ও দিব্যজ্যোতি সাঁইকিয়া ডাইনি হত্যা রোধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। কিন্তু, তার পরও এই সব ঘটনা আটকানো যাচ্ছিল না।

দিব্যজ্যোতিবাবু জানান, প্রায় ছ’বছর ধরে তাঁরা ডাইনি হত্যা রোধে কড়া আইনের জন্য সুপারিশ করছিলেন। অসম সরকার বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করে খসড়া বিল তৈরি করে। মন্ত্রিসভা তাতে সম্মতি দেয়। তিনি বলেন, ‘‘ছ’বছরের চেষ্টায় বিল পাশ হওয়ায় আমরা খুশি। কিন্তু, ওঝাদের রমরমা বন্ধ করতে কোনও দল মুখ খুলল না। এটা খুবই মর্মান্তিক। অসম সরকারের হিসেবে, ২০১১ সালে ২৯ জন, ২০১২ সালে ১১ জন, ২০১৩ সালে ১৬ জন ও ২০১৪ সালে ডাইনি অপবাদে ৯ জনকে খুন করা হয়। ২০১৫ সালে বিধানসভায় এআইইউডিএফ বিধায়ক আবদুল রহিম খান, অপরাধীদের জরিমানার টাকা আরও বাড়ানোর প্রস্তাব দেন। অগপ বিধায়ক কেশব মহন্ত বলেন, ‘‘শাস্তি দিয়ে ডাইনি-হত্যার রাশ টানা যাবে না। স্কুলে স্কুলে অন্ধবিশ্বাস রোধে সচেতনতা শিবির ও এই বিষয়টি পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।’’


প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, " নারী সুরক্ষা ও নির্যাতন প্রতিরোধ বিল-২০১১" নামক এই বিলের ৪ নং সেকশনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, কোনো মহিলাকে ডাইনি ঘোষণা করে গ্রামের অন্য সদস্যদের উস্কালে বা ডাইনি ঘোষিত মহিলার বিরুদ্ধে জনমত তৈরী করে নির্যাতন ও  শাস্তি দিলে অপরাধীদের সর্ব্বোচ্চ সাজা সাত বছরের জেল সঙ্গে কুড়ি হাজার টাকা জড়িমানা। এছাড়া ঝাড়খণ্ড সরকার পাশ করিয়েছে " ডাইনি প্রতিরোধ আইন- ২০১১", ছত্তিশগড় সরকার এনেছে " তোনাহি প্রদদ্ম নিভারণ আইন- ২০০৫ ", বিহার সরকার এনেছে " ডাইনি প্রতিরোধ আইন- ১৯৯৯"। " অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি " র প্রতিষ্ঠাতা নরেন্দ্র দাভলকর এর বিশেষ উদ্যোগে " The Maharashtra Prevention and Eradication of Human Sacrifice and other Inhuman, Evil and Aghori Practices and Black Magic Act 2013 " চালু হয়েছে। তাছাড়া " The Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954", এবং

" The Drugs and Cosmetics Act 1940 ", এর মতন বেশ কিছু কঠোর আইনও এই দেশে রয়েছে।


ভারতে এতোগুলো আইন থাকা সত্বেও ডাইনি বলে দেগে দিয়ে হত্যার ঘটনা প্রায়শই খবরের কাগজে স্থান পায়। অন্যান্য রাজ্যে আইন রয়েছে অথচ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে না আছে ডাইনি সন্দেহে অত্যাচার কিংবা হত্যার কোনো তথ্য আর না কঠোর আইন প্রণয়নের কোনো উদ্যোগ।


কয়েকজন মুক্তমনা, বিজ্ঞানমনষ্ক ব্যক্তিরা মহারাষ্ট্রের ধাঁচে এই রাজ্যে একটা কঠোর আইন প্রণয়ণের দাবীতে আইনের খসড়া জমা দিয়েছেন State Law Commission এর দপ্তরে। আইনটির নাম " The West Bengal Prevention of Superstition and Black Magic Practices Bill ২০১৬। " আপাতত এই আইনটি লাল ফিঁতের ফাঁসে আটকে রয়েছে সরকারের উদাসিনতার কারনে।


ডাইনি অপবাদে মাথা কেটে, পুড়িয়ে খুন, গ্রেফতার ১১

অসমের বিভিন্ন জনপদে এখনও রয়ে গিয়েছে ডাইনি সন্দেহে মানুষ খুন করার প্রবণতা। ২০০১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে অসমে ডাইনি সন্দেহে খুন হয়েছেন ১৯৩ জন। এরমধ্যে ৭৯ জন পুরুষ এবং ১১৪ জন মহিলা।

   

এই সময় ডিজিটাল ডেস্ক: অসমের কার্বি আংলঙে ডাইনি সন্দেহে মাথা কেটে, আগুনে পুড়িয়ে খুন করা হল দু'জনকে, তার মধ্যে একজন মহিলা। রমাবতী হালুয়া এবং বিজয় গৌরের 'কালা জাদু'র জন্য গ্রামের মেয়েরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে, এই অভিযোগ তুলে শুক্রবার দু'জনকে খুন করেন রোহিমপুর গ্রামের মানুষ। স্থানীয় সূত্রে খবর পেয়েই শুক্রবার ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার দেবজিৎ দেউরি। ধৃতদের মধ্যে দু'জন মহিলা, উদ্ধার হয়েছে বেশ কিছু অস্ত্র। আজকের যুগে দাঁড়িয়ে কুসংস্কারের বশে এ হেন নৃশংসতা অবাক করছে পুলিশ, প্রশাসনকেও।


দেবজিৎ জানান, গত ২৯ সেপ্টেম্বর রশ্মি গৌর নামে গ্রামের এক কিশোরী অসুস্থ হয়ে মারা যায়। গ্রামবাসীদের একাংশের দাবি, রশ্মি মৃত্যুর আগের দিন রমাবতী ও বিজয়ের নাম করে জানিয়েছিল, তাঁদের 'কালা জাদু'র জন্যই অসুস্থ হয়ে পড়েছে সে। রশ্মির মৃত্যুর তিন দিনের মাথায় গ্রামের আরও এক কিশোরী গ্রামপ্রধানের বাড়ি গিয়ে অসুস্থতার কথা জানায়। তারও দাবি, ওই দু'জনের কালা জাদুতেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে সে।


এর পরই গ্রামবাসীরা চড়াও হয়ে রমাবতী ও বিজয়কে পিটিয়ে মারে বলে অভিযোগ। কাছের পাহাড়ে নিয়ে গিয়ে, রশ্মির কবরের খুব কাছে তাঁদের মাথা কেটে আগুন ধরিয়ে দেয় গ্রামবাসীরা। বৃহস্পতিবার খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিক এবং এগজিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট জিন্টু বোরা। সেখান থেকে পোড়া দেহাংশ ও মাটির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। মামলা দায়ের করে ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, বাকি অভিযুক্তদের খোঁজ চলছে।


অসমের বিভিন্ন জনপদে এখনও ডাইনি সন্দেহে মানুষ খুন করার প্রবণতা রয়েছে। ২০০১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে অসমে ডাইনি সন্দেহে খুন হয়েছেন ১৯৩ জন। এরমধ্যে ৭৯ জন পুরুষ এবং ১১৪ জন মহিলা। গত আগস্ট মাসেও চিরাং জেলায় তিনজনকে ডাইনি সন্দেহে গ্রামবাসীরা পিটিয়ে খুন করার চেষ্টা করে। গুরুতর জখম অবস্থায় তাঁরা প্রাণে বাঁচেন। ডাইনি অপবাদে নৃশংস হত্যাকাণ্ড রুখতে রাজ্য সরকার আইন সংশোধন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজাও ঘোষণা করেছে। গ্রামবাসীদের সচেতন করতে নেওয়া হয়েছে 'প্রহরী' সামাজিক প্রকল্প। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। তারই ফের প্রমাণ মিলল ডোকমোকায়। উল্লেখ্য, বছর দুয়েক আগে এই ডোকমোকাতেই দুই অসমীয়া যুবককে গ্রামবাসীরা ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে খুন করে।

https://eisamay.com/nation/2-brutally-killed-by-villagers-in-assam-in-suspected-witch-hunting-case/amp_articleshow/78453560.cms


ডাইনি সন্দেহে হত্যার প্রতিবাদ ও কঠোর শাস্তির দাবিতে চিঠি


সম্প্রতি, ডাইনি সন্দেহে এক প্রবীণাকে হত্যা করা হয়েছে ওডিশায়। তাঁর ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দেওয়া হয়েছে বলে খবর। মৃতার নাম যমুনা হাঁসদা (৬২)। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আপাতত দুজনকে আটক করা হয়েছে। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তির দাবী জানিয়ে বিজ্ঞানমনষ্ক বন্ধু রথীন মন্ডল সহ অনেকেই ইমেল করেছিল মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক মহাশয় কে। ইমেলের বয়ান-

প্রতি,

নবীন পট্টনায়ক সমীপেষু,

মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী,

ওড়িশা সরকার।

বিষয় - ডাইনি সন্দেহে হত্যার প্রতিবাদ ও কঠোর শাস্তির দাবি।


মহাশয়,

গতকাল ' TheWire ' পত্রিকার মাধ্যমে পড়লাম, আপনার রাজ্যের ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলায় "জাদুবিদ্যা" অনুশীলনের অভিযোগ দিয়ে এক মহিলার শিরশ্ছেদ করা হয়েছে। মৃত ব্যক্তি বলিভোল গ্রামের বাসিন্দা, ৬২ বছর বয়সী যমুনা হংসদা। সূত্র- https://thewire.in/rights/odisha-elderly-tribal-woman-accused-of-witchcraft-beheaded


একজন বিজ্ঞান আন্দোলন কর্মী হয়ে এমন ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।

মহাশয়, এই একুশ শতকেও এমন নিন্দনীয় ঘটনা ভারতের বহু স্থানে প্রায়শই দেখা যায়।  National Crime Record Bureau র তথ্য অনুযায়ী, সাল ২০০০ থেকে ২০১৬ র মধ্যে ডাইনি ঘটনায় অত্যাচারিত এবং খুন হয়েছেন ২৫০০ জন মহিলা। যদিও বে-সরকারি মতে সংখ্যাটা অনেক বেশি।

ডাইনি নামক কুসংস্কারের বিরূদ্ধে কিছু কঠিন আইন রয়েছে আমাদের দেশে। যেমন:- " নারী সুরক্ষা ও নির্যাতন প্রতিরােধ বিল -২০১১ " নামক এই বিলের ৪ নং সেকশনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, কোনাে মহিলাকে ডাইনি ঘােষণা করে গ্রামের অন্য সদস্যদের উস্কালে বা ডাইনি ঘােষিত মহিলার বিরুদ্ধে জনমত তৈরী করে নির্যাতন শাস্তি দিলে অপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা সাত বছরের জেল সঙ্গে কুড়ি হাজার টাকা জড়িমানা। এছাড়া ঝাড়খণ্ড সরকার পাশ করিয়েছে " ডাইনি প্রতিরােধ আইন -২০১১ ", ছত্তিশগড় সরকার এনেছে " তােনাহি প্রতদ্ম নিভারণ আইন- ২০০৫ ", বিহার সরকার এনেছে " ডাইনি প্রতিরােধ আইন- ১৯৯৯ "। এছাড়া, রয়েছে, " The Maharashtra Prevention and Eradication of Human Sacrifice and other Inhuman, Evil and Aghori Practices and Black Magic Act 2013 "। তাছাড়া " The Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954 ", এবং " The Drugs and Cosmetics Act 1940 ", IPC 307, IPC 302 এর মতন বেশ কিছু কঠোর আইনও এই দেশে রয়েছে।

আধুনিক সমাজে এমন কুসস্কারাচ্ছন্ন কর্মকাণ্ড মোটেই কাম্য নয়। আমি একজন বিজ্ঞানমনষ্ক ও সমাজকর্মী মানুষ হয়ে এমন ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।

আশাকরছি আপনি এমন ঘটনার বিরূদ্ধে দ্রুত কড়া ব্যাবস্থা নেবেন এবং প্রকৃত অপরাধীদের কড়া শাস্তি দিয়ে দৃষ্ঠান্ত স্থাপন করন।

ধন্যবাদ সহ,

রথীন মণ্ডল,

পশ্চিম বর্ধমান, বাংলা। 



আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929