সম্প্রতি আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের কুমিল্লায় একটি মন্দিরে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থের অবমাননা করা হয়েছে বলে কি ঘটনায় না ঘটল। হাজার হাজার উন্মুক্ত উগ্রবাদী মানুষ কয়েকদিন ধরে ঢাকা, কুমিল্লা, ফেনি, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলা চালাল, কয়েকটি গ্রামে অগ্নিসংযোগ এর ঘটনা ঘটল,এমনকি দাঙ্গায় কয়েকজন নিরহী মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ঘটনায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় একাধিক মামলা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কথা তো ছেড়েই দিলাম কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন ছোট বড় মাঝারি নিউজ চ্যানেল এবং সংবাদপত্রের শিরোনামের কল্যানে গোটা বিশ্ববাসীর জানতে আর বাকি রইল না, যে কেন গোটা বাংলাদেশ জুড়ে এমন অভাবনীয় অনভিপ্রেত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
এই সব কান্ডকারখানা দেখে শুনে আপনার কি মনে হয় না যে, মানুষ বড় না ধর্ম বড়? একজন ধর্মান্ধ গোঁড়া আপাদমস্তক ধর্ম ব্যবসায়ী ব্যক্তির নিকট অবশ্যই তার নিজের ধর্ম বড়। কিন্তু যারা শিক্ষিত, প্রগতিশীল, যুক্তিবাদী, মানবদরদী, মানবতাবাদী, নাস্তিক, তারা কখনও ধর্মকে মানুষের উপরে স্থান দিতে পারে না।
মানুষ তার বুদ্ধিমত্তার জোরে প্রমান করেছে মানুষই এই পৃথিবীর একমাত্র শ্রেষ্ঠ জীব। সেই মানুষই মাঝে মধ্যে উগ্র হয়ে ওঠে, প্রচন্ড হিংস্র হয়ে ওঠে। কারন মানুষ অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি।
আজ থেকে কয়েক শতাব্দী আগে কবি বড়ু চণ্ডীদাস বলে গেছেন; মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক বাণী―
"সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’।
মধ্যযুগে বসে বাংলারই এক কবি সমগ্র বিশ্বের জাতিকে শুনিয়েছেন বিশ্ব মানবতার অমর কবিতা। যেখানে কোনো ঈশ্বর-আল্লা-গড-ভগবান নয়, মানুষেরই স্থান সবথেকে উপরে। মানুষই বড়। মানুষের থেকে কোনো কিছুই বড় হতে পারে না।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার সাম্যবাদী কবিতায় সব ধর্মের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। তিনি দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, এই ভাবে―"গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।"
নজরুল ছিলেন সব ধর্মীয় চেতনার ঊর্ধ্বে। অন্তরে তিনি না ছিলেন হিন্দু না ছিলেন মুসলিম। ‘তিনি সবার ঊর্ধ্বে ছিলেন মানবতার কবি। "জাতের বজ্জাতি" কবিতায় তিনি ধর্ম ব্যবসায়ীদের সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বলছেন―
জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছ জুয়া,
ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয়তো মোয়া।
হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি – ভাবলি এতেই জাতির জান,
তাইত বেকুব, করলি তোরা এক জাতিকে একশ’-খান।
এখন দেখিস ভারত জোড়া পঁচে আছিস বাসি মড়া,
মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত-শেয়ালের হুক্কাহুয়া।
যে জাত-ধর্ম ঠুনকো এত, আজ নয় কা’ল ভাঙবে সে ত,
যাক্ না সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ, নাই পরোয়া।"
নজরুলের স্পষ্ট উক্তি জাত, ধর্ম লুপ্ত হয়ে গেলেও এই পৃথিবীর মানুষের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না। হাজার খানেক জাত, হাজার খানেক ধর্মের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কোনো দরকার নেই। ধর্ম ছাড়াও সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকা যায়। দুঃখের বিষয় হলেও একথা সত্যি যে, আমাদের দেশে নজরুল ইসলামের লেখার যথাযথ মূল্যায়ন এখনও পর্যন্ত হয়নি।
আমরা লেখাপড়া শিখি। বিদ্যা বুদ্ধি অর্জন করি। কিন্তু সেই অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগায় না। বিখ্যাত দার্শনিক ও রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন―"আমি ক্লাসে এত করিয়া ছাত্রদের পড়াইলাম, যে পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপরে পড়িয়া চন্দ্রগ্রহণ হয়। তাহারা তা পড়িল, লিখিল, নম্বর পাইল, পাস করিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হইল যখন আবার সত্যি সত্যি চন্দ্রগ্রহণ হইল তখন চন্দ্রকে রাহু গ্রাস করিয়াছে বলিয়া তাহারা ঢাক, করতাল, শঙ্খ লইয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল। ইহা এক আশ্চর্য ভারতবর্ষ।"
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের উপলব্ধিতে কোনো ভুল ছিল না। আমরা ক্লাসে শিখি এক, আর প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার করি আরেক। সেটাই হল বর্তমান শিক্ষিত যুব সমাজের অন্যতম দুর্বলতা। সেই দুর্বলতার সুযোগে ধর্মান্ধ উগ্রবাদ শুধু এপার বাংলা ওপার বাংলায় সীমাবদ্ধ নয়, গোটা বিশ্বের কোনায় কোনায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কবি কালিদাস তার কবিতায় মানুষেরই জয় ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন―
"মানুষই দেবতা গড়ে, তাহারই কৃপার পরে করে দেবমহিমা নির্ভর। "কবি কালিদাস রাযের উক্তিকে বর্তমানের শিক্ষা দীক্ষা, সভ্যতায় এগিয়ে থাকা মানুষজন বোধহয় কেউই অযৌক্তিক বলে এড়িয়ে যেতে পারবে না। এমন কি বড় বড় ধর্মগুরুরা পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, কবির উক্ত বক্তব্য অতিরঞ্জিত নয়। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? হিংসার ঘটনাই বা ঘটছে কেন?
ধর্ম নিয়ে কেন এতো টানাটানি? ধর্ম নিয়ে মারামারি কাটাকাটি লড়াই ঝগড়ার অন্ত নেই। আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে সংঘর্ষে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার সিংহভাগ মৃত্যু হয়েছে ধর্মের কারনে। ধর্মকে যখনই মানুষের উপরের স্থানে বসানোর চেষ্টা হয়েছে তখনই বিশ্ব সাক্ষী থেকেছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের। ধর্মের কারনে কত গ্রাম, কত নগর, কত জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার 'গোরা’ উপন্যাসে ধর্ম প্রসঙ্গে বলেছেন―"একটা বিড়াল পাতের কাছে এসে ভাত খেলে কোনও দোষ হয় না, অথচ একজন মানুষ সে ঘরে প্রবেশ করলে ভাত ফেলে দিতে হয়। মানুষের প্রতি মানুষের এমন অপমান এবং ঘৃনা যে জাতিভেদে জন্মায় সেটাকে অধর্ম না বলে কি বলব? মানুষকে যারা এমন অবজ্ঞা করতে পারে, তারা কখনোই পৃথীবিতে বড়ো হতে পারে না। অন্যের অবজ্ঞা তাদের সইতেই হবে।"
এই পৃথিবীতে এমন মানুষেই সংখ্যায় বেশি যারা ধর্মের নামে অধর্মের কাজই বেশি করে। সে জ্ঞাত ভাবেই হোক বা অজ্ঞাতসারেই হোক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'ধর্মমোহ' নামক অবিস্মরণীয় একটি কবিতায় সমগ্র মানব জাতিকে সতর্ক করে বলেছেন যে―"ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে/ অন্ধ সে জন শুধু মারে আর মরে।"
রবি ঠাকুরের সেই অমর বাণীকে তোয়াক্কা না করে লক্ষ লক্ষ ধর্মান্ধ নিজের নিজের ধর্মকে রক্ষা করতে মারামারি কাটাকাটি করে গোটা বিশ্বের শান্ত পরিবেশকে অশান্ত, বিষাক্ত করে তুলছে। কবে তারা বুঝবে মানুষের জীবনের চেয়ে ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থ বড় হতে পারে না! কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থের ''মানুষ' কবিতায় লিখে গেছেন―
"মানুষেরে ঘৃণা করি’
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি’ মরি!
ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ’ নাও জোর ক’রে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন্থ’-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে,
পূজিছে গ্রন্থ’ ভন্ডের দল! ―মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ’; ―গ্রন্থ’ আনেনি মানুষ কোনো।"
পৃথিবীর সমগ্র মানুষ যেদিন বুঝতে পারবে কোনো ধর্ম নয়, ধর্ম থেকে মানুষ বড়। সেদিনই ধর্ম নিয়ে হানাহানি, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ইতি ঘটবে। সর্বকালের সেরা মানবদরদী কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায় একটি উক্তি দিয়ে এই লেখা শেষ করছি― “সমস্ত ধর্মই মিথ্যা,―আদিম যুগের কুসংস্কার। বিশ্বমানবতার এতবড় পরম শত্রু আর নেই।”