নরেন্দ্র দাভোলকর

অনিমেষ দত্ত‌


Nov. 21, 2024 | | views :878 | like:0 | share: 0 | comments :0

২০১৩ সালের ২০শে আগস্ট। মহারাষ্ট্রের পুণের বাসিন্দা ৬৭ বছরের এক বৃদ্ধ অভ্যাসমত সেদিনও প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু বাড়ি ফেরা হয়নি সেদিন তাঁর। মাথায় গুলি করে খুন করা হল তাঁকে। ৬৭ বছরের সেই বৃদ্ধের নাম নরেন্দ্র দাভোলকর। ঘটনার তদন্তভার নেয় সিবিআই। ঘটনার প্রায় পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালে নালাসোপারার একটি আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির কারখানা থেকে শরদ কলসকরকে গ্রেফতার করে মহারাষ্ট্র সন্ত্রাস দমন শাখা। কলসকরের বয়ানের ভিত্তিতেই খুনের মূল চক্রী বীরেন্দ্র তাউড়েকেও গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। সিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতেই খুনের কথা স্বীকার করে লিখিত বয়ান দেয় কলসকর। সেই বয়ানের ভিত্তিতেই কলসকরের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় সিবিআই। ধৃত মূল অভিযুক্ত শরদ কলসকর লিখিত বয়ানে বলেছিল, ‘‘খুব কাছ থেকে পর পর দু’বার গুলি চালিয়েছিলাম। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরই এলাকা ছাড়ি।’’ এছাড়া কীভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, নেপথ্যে কারা ছিলেন, ঘটনার দিন ঠিক কী ঘটেছিল, ১৪ পাতার স্বীকারোক্তিতে সেই বর্ণনাও দিয়েছিল কলসকর। খুনের মূল চক্রী কারা? সেই বিষয়েও স্পষ্ট বলেছিল কলসকর, ‘‘একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সদস্য বীরেন্দ্র তাউড়ে আমার মগজ ধোলাই করেন। তাঁদের সংগঠনের আদর্শের পাঠ দেওয়ার পাশাপাশি চলতে থাকে আগ্নেয়াস্ত্র চালানো, বোমা তৈরির প্রশিক্ষণও। তার পর এক দিন বলা হয়, কয়েক জন যুক্তিবাদীকে খুন করতে হবে। সেই তালিকায় আমার দায়িত্ব পড়েছিল দাভোলকরকে খুন করার। আমার উপর নির্দেশ ছিল, মাথায় গুলি করতে হবে, যাতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়।’’

এতক্ষণ যে ঘটনাটার কথা বললাম সেটা কোনো বলিউডের কাঁচা স্ক্রিপ্ট নয়, জলজ্যান্ত একটা খুন! কে এই নরেন্দ্র দাভোলকর? কেন তাঁকে খুন হতে হল? হিন্দুত্ববাদী সংগঠন কেন তাঁকে খুন করল?


১৯৪৫ সালের ১লা নভেম্বর জন্ম হয় নরেন্দ্র দাভোলকরের। বাবা অচ্যুত দাভোলকার। মায়ের নাম তারাবাঈ দাভোলকার। সাত ভাই, তিন বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন নরেন্দ্র। সাতারা শহরের নিউ ইংলিশ স্কুলে পড়েছেন। তারপর তিনি সংলির উইলিংডন কলেজে ভর্তি হন। স্কুল-কলেজের পড়াশোনা শেষ করে নরেন্দ্র সিরাজ মেডিকেল কালেজে ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হন। সবচেয়ে বড়ভাই প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও সমাজবিদ দেবদত্ত দাভোলকার ছিলেন উইলিংডন কলেজের অধ্যাপক। স্বাধীনতার পর মহারাষ্ট্রের অনেক সামাজিক আন্দোলনে তিনি জড়িত ছিলেন। নরেন্দ্রর জীবনে দাদা দেবদত্তের গভীর প্রভাব ছিল। ডাক্তারিতে এমবিবিএস পাস করার পর তিনি শায়লা নাম্নী একজন ডাক্তারকে বিয়ে করেন। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে হামিদ। মেয়ে মুক্তা দাভোলকার।

এরপর ডাক্তারি পাস করে ডাঃ নরেন্দ্র দাভোলকর শুধু ডাক্তারিতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে পারলেন না। আশির দশক থেকেই তিনি অনুভব করেন, ডাক্তারি ছাড়াও তাঁকে আরো বড় কাজ করতে হবে। দেশকে কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্ত করতে হবে। সেই লক্ষ্যেই প্রায় ১২ বছর পর একদিন ডাক্তারি ছেড়ে যোগ দিলেন বিজ্ঞান আন্দোলনে। তিনি 'অখিল ভারতীয় অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি'-তে যোগ দেন। ১৯৮৯ সালে দাভোলকর 'মহারাষ্ট্র অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি' প্রতিষ্ঠা করেন ও তার সভাপতি হন। মহারাষ্ট্রে তৎকালীন সময়ে বিজ্ঞান আন্দোলনের জোয়ার এতটাই ছিল যে একজন ডাক্তারকে উদ্বুদ্ধ করল সেই লক্ষ্যে পাড়ি দেওয়ায়।


ভারতে বিজ্ঞান আন্দোলনের বিভিন্ন ধারা আছে। কিন্তু প্রত্যেকটা ধারার মধ্যে কমন নেচার বা লক্ষ্য কিছু থেকে থাকলে সেটা হল বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ, বিজ্ঞানমনস্কতার বিকাশের চেষ্টা এবং বিজ্ঞানের প্রযুক্তিকে জনকল্যাণে ব্যবহারের জন্য দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন চালানো। মহারাষ্ট্রও তার ব্যতিক্রম নয়। আশির দশক থেকেই মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠতে লাগলো একাধিক বিজ্ঞান সংগঠন, পত্রিকা গোষ্ঠী। ১৯৮২ সালে লোকবিজ্ঞান সংগঠনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হল 'মহারাষ্ট্র বিজ্ঞান যাত্রা'। নাটক, গান, ছবি, মডেল, স্লাইড, সিনেমা ইত্যাদির মাধ্যমে জণগণের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রচার চলল। ১৯৮৯ সালে সেই ধারাবাহিকতায় কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলন গড়ার লক্ষ্যে তৈরি হল সংগঠন 'অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি'। যার মাধ্যমে আসরে এলেন নরেন্দ্র দাভোলকর। এই সমিতি মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানমনস্কতা প্রচারে। সেসময় মহারাষ্ট্রে অলৌকিকতার ছড়াছড়ি। অলৌকিক উপায়ে রোগ সারানো, অলৌকিক উপায়ে জীবনে শান্তি ফেরানো ইত্যাদি দাবি নিয়ে একদল ভণ্ড সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে চলেছে। চলছে লাখ লাখ টাকা রোজগার। মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা না করে তাদের 'অশুভ আত্মায় ভর করেছে' এই দাবি দিয়ে চালানো হচ্ছে শারীরিক অত্যাচার। একই সাথে সাপের কামড়ে অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসা না করে চলত 'বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন পাথর' বিক্রির ব্যবসা। এই সমস্ত অযৌক্তিক অপবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে সোচ্চার হন দাভোলকরেরা। মারাঠী 'সাধন' পত্রিকার মাধ্যমে যুক্তিবাদী বক্তব্য প্রকাশ করা শুরু করেন একই সাথে। অলৌকিক বলে দাবি করা ঘটনাগুলো আসলে যে অলৌকিক নয়, তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাসহ শুরু হয় প্রচার। আগুনের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া বা হৃদযন্ত্র বন্ধ রাখার মধ্যে কোনো অলৌকিকতা নেই, তা হাতে কলমে করে দেখিয়ে মানুষকে সচেতন করার কাজ চলতে থাকে জোরকদমে। আরও আরও মানুষের কাছে পৌঁছে দীর্ঘমেয়াদি প্রচার আন্দোলন এর লক্ষ্যে দাভোলকর শুরু করেন 'বিবেক জাগরণ' প্রকল্প। আলোচনা এবং পথনাটক এর মাধ্যমে বিজ্ঞানমনস্ক ভাবনা ছড়িয়ে দেওয়া যার উদ্দেশ্য। এই কাজে দাভোলকরকে সাহায্য করেন তাঁর বন্ধু নাট্যকর্মী ডাঃ শ্রীরাম।


কুসংস্কার দূরীকরণ এর পাশাপাশি মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে 'পরিবর্তন' নামের একটি প্রতিষ্ঠানও পরিচালনা করতেন তিনি। বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসারের জন্য 'বিবেক বাহিনী' তৈরি করেন। কলেজ ও ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা সেখানে আসতেন। দাভোলকর যুক্তিবাদী সনাল এডামারাকু এবং বিশিষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী জয়ন্ত বিষ্ণু নারকিলকার-এর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এছাড়াও তিনি 'ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান রেশনালিস্ট এসোসিয়েশন'-এর সহসভাপতিও ছিলেন। ১৯৯০ থেকে ২০১০-এর মাঝে দাভোলকর দলিত সমাজের মর্যাদা এবং ভারতীয় জাতিব্যবস্থার অবসানের লক্ষ্যেও আন্দোলন জারি রাখেন।


১৯৫৪ সালে ভারতে লাগু হয়েছিল 'দ্য ড্রাগ অ্যাণ্ড ম্যাজিক রেমেডিজ অ্যাক্ট' (Objectionable Advertisements)। কিন্তু তা দিয়েও যাদুটোনা, তুকতাক ইত্যাদির মোকাবিলা করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই ২০১০ সাল থেকেই অন্ধবিশ্বাস (যাদুটোনা) বিরোধী বিল পাস করানোর জন্য মহারাষ্ট্র সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেন দাভোলকর। সেই লক্ষ্যেই শুরু হল আন্দোলন। এখানেই হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর সাথে সাক্ষাৎ সংঘাত শুরু হল তাঁর। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং শিবসেনার মত রাজনৈতিক দল তাঁর বিরোধিতা করে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো তাঁর প্রস্তাবিত খসড়া বিলকে 'হিন্দু সংস্কৃতি'র বিরোধী বলে ঘোষণা করে। চলতে থাকে মতাদর্শগত সংগ্রাম। তারপরের ঘটনা ওই ২০১৩ সালের ২০শে আগস্ট।


দাভোলকরের খুনের একদিন পর অর্থাৎ ২১শে আগস্ট মহারাষ্ট্র সরকার কুসংস্কার ও তুকতাক বিরোধী অর্ডিন্যান্স জারি করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই অর্ডিন্যান্স অনুসারে তুকতাক, ঝাড়ফুঁক এর মত বুজরুকির জন্য ৭ বছরের জেল হবে। ডাঃ দাভলকার গত ১০ বছর ধরে কুসংস্কার ও তুকতাক বিরোধী আইন প্রণয়নের জন্য আন্দোলন করেছিলেন। কিন্তু তাঁর হত্যার পর মহারাষ্ট্রের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চৌহান এই অর্ডিন্যান্স জারি করার পদক্ষেপ নেন!


দাভোলকরের মতোই হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির হাতে খুন হয়েছেন গোবিন্দ পানসারে, এম. এম. কালবুর্গীর মতো যুক্তিবাদী মানুষেরা। কিছু বছর আগেই আমরা দেখেছি সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে শিরদাঁড়া সোজা রেখে সাংবাদিকতা করার জন্য খুন হতে হয়েছে। আসলে নরেন্দ্র দাভোলকর এবং বাকিরা একই পথের পথিক। আমরা জানি ইতিহাসে বরাবরই বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী মানুষরা নিজেদের সময়ে আক্রমণের মুখে পড়েছেন। কারন তাঁরা প্রত্যেকেই সঙ্গী করেছেন বিজ্ঞানকে। না, শুধুমাত্র প্রযুক্তিনির্ভর পাঠ্যবইয়ের বিজ্ঞান নয়, যুক্তিনির্ভর হাতে কলমে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের প্রগতিশীল দর্শনকে সমাজের প্রত্যেকটা স্তরে নিয়ে যাওয়া, বিজ্ঞানকে পাঠ্যপুস্তকে সীমাবদ্ধ না রেখে তা মানুষের ব্যবহারিক জীবনে পৌঁছে দেবার কাজ নরেন্দ্র দাভোলকরেরা করে গেছেন। তাই হত্যার পরেও আজ নরেন্দ্র দাভোলকর আমাদের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র। শুধুমাত্র শ্রদ্ধা নয়, বরং আমাদের আগামীদিনে পথচলার আদর্শও বটে। আজকেও আমরা অপবিজ্ঞান এর বীজ বুনতে দেখছি প্রত্যহ, কোথাও সরাসরি সরকারি মদতে আবার কোথাও পরোক্ষভাবে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি দ্বারা। আমাদের লক্ষ্য কোনদিকে? যুক্তিনির্ভর প্রগতিশীল সমাজের দিকে? যদি তাই হয়, তবে নরেন্দ্র দাভোলকর আমাদের পথপ্রদর্শক। তাই তাঁকে হত্যার দিনটায় তাঁকে স্মরণ করাটা শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতায় না আটকে রেখে তাঁর আদর্শকে পাথেয় করে এগোলেই তাঁর স্বপ্ন সফল হবে।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929