পশ্চিমবঙ্গে মৃত্যুভোজ নিবারণ আইন প্রণয়ণের দাবী
সম্পাদক
Nov. 19, 2024 | | views :39 | like:2 | share: 2 | comments :0
গত ২৮ জুলাই ২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গে "মৃত্যুভোজ (Death Feast) নিবারণ আইন" প্রণয়নের আবেদন জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী, আইন মন্ত্রী সহ সমস্ত বিধায়ক দের ইমেল করেছেন "ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি"র কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি এবং পুরুলিয়া শাখা সম্পাদক, মধুসূদন মাহাতো।
এখানে প্রশ্ন উঠবে কেন এই আইন প্রণয়ণের দাবী? মধুসূদন মাহাতো জানাচ্ছেন, কারও আত্মীয় মারা গেলে মৃত ব্যক্তির আত্মার উদ্দ্যেশ্যে আয়োজিত শ্রাদ্ধকে কেন্দ্র করে আমন্ত্রিত ব্যক্তি (বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী ইত্যাদি) এবং আত্মীয় এবং ব্রাহ্মণদের যে ভোজ (Feast) খাওয়ানো হয়, সেটাই মৃত্যুভোজ (Death Feast)।
অভিধানে আধ্যাত্মবাদ শব্দের অর্থ, আত্মা সম্পর্কিত বা সম্বন্ধীয় মতবাদ। বিজ্ঞান কিন্তু গডেশ্বরাল্লহ, আত্মা, অলৌকিক ইত্যাদির অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। কারন, বিজ্ঞানের দরবারে কোনো কিছু তখনই প্রতিষ্ঠিত হয় যখন সেটা বিজ্ঞানের- পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ এবং সিদ্ধান্ত এই তিন সহজ সরল ধাপে উপনিত হয় বা সাফল্য (পাশ) লাভ করে। এমনটা আগেও হয়েছে কল্পিত প্রস্তাবনা বা হাইপোথিসিস। অর্থাৎ কোনো ঘটে যাওয়া ঘটনা দেখে যদি মনে হয় (সন্দেহ জনক কিছু রয়েছে) গবেষণা চালানো প্রয়োজন, তাকেই বলা হয় হাইপোথিসিস। এখান থেকেই বিজ্ঞানের ঘরে প্রবেশ করার পক্রিয়া শুরু হয়।
আত্মা নামক বিষয়টি এখনও পর্যন্ত হাইপোথিসিস এ নিজের পা টাই রাখতে পারেনি, বাকি তিন ধাপ তো অনেক দুরের কথা। এখনও পর্যন্ত এমন কিছু ঘটনা ঘটেনি যা ইঙ্গিত করে আত্মার অস্তিত্বকে। এখনও সেই রকম কিছু ঘটেনি যার জন্য বিজ্ঞান পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ চালিয়ে দেখবে,তারপর আসবে একটা সিদ্ধান্তে। আত্মার কোনো কার্যপ্রলাপ এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞান কে প্রভাবিত করতেই পারেনি তাই বিজ্ঞান আজও মাথা ঘামায়নি যে আত্মার অস্তিত্ব আদৌ আছে, নাকি নেই। আত্মা শুধুমাত্র আমাদের মনোজগৎ এর কল্পনা ছাড়া অন্য কিছুই নয় যেখানে জ্ঞানের আলো জ্বালালেই তেঁনারা ভ্যানিশ।
যুক্তিবাদী সাজবার ভণ্ডামো হতে পারে কিন্তু বিজ্ঞানের কোনো শাখায় কেউ পড়াশোনা করলে কিন্ত বিজ্ঞানমনষ্ক, যুক্তিবাদী হয়ে যায়না। এটা একটা হয়ে ওঠার ব্যাপার যেটা সবাই পারে না। এর জন্য প্রয়োজন আন্তরিকতা এবং জিজ্ঞাসু মন। তাই কোনো নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত বিজ্ঞানী অথবা কোনো ধর্মগুরুরা যতই প্রচার করুক, যতই তত্ত্বকথা শোনাক -"বিজ্ঞান, গডেশ্বরাল্লহ, অলৌকিক, আত্মার অস্তিত্ব কে স্বীকার করে নিয়েছে" তবুও কোনোদিনই এসব প্রমাণিত হবে না বিজ্ঞানের দরবারে।
দেখা গেছে, অনেকসময় গ্রামবাসীদের একাংশের চাপে পরে মৃতের পরিবার এই ভোজের আয়োজন করতে গিয়ে নিজেদের জমানো সম্পদ খুইয়ে কিংবা ফসলি জমি বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে যায়। এই অহেতুক খরচের ফলে পরিবারগুলি তাদের সদস্যদের সঠিক মতন চিকিৎসা ও সন্তানদের পড়াশোনার খরচ জোগাতে পারেন না এমনকি তাদের বাড়িঘরও তৈরি করতে ব্যর্থ হন। তাই এই কুরীতি বা কুপ্রথা বন্ধ হওয়া একান্তই প্রয়োজন এবং এরজন্য সারাদেশে আইন আনা ভীষণ জরুরী।
ভারতে প্রথম মৃত্যুভোজ নিবারণে আইন এনেছে রাজস্থান রাজ্য। আইনটির নাম - "রাজস্থান প্রিভেনশন অফ মৃত্যুভোজ অ্যাক্ট -১৯৬০" { (Rajasthan Prevention of Mrityu Bhoj Act, 1960)। Notification No. F(25)/LJ/A/59 dated .8.2.1960 (Published in Rajasthan Gazette Extraordinary Part 4 A Dated 10.2.1960) [Received the assent of the President on the 3rd day of February 1960] An act to provide for the prevention of Mrityu Bhoj }
এই আইনে মৃত্যুভোজ নিবারণে জেলা প্রশাসনকে অত্যাবশ্যক কার্যকরী ভূমিকা নিতে বলা হয়েছে। এই অাইন অনুসারে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।
১) উক্ত আইনের ৩ নং ধারায় বলা হয়েছে - কেউ মৃত্যুভোজ আয়োজন করতে পারবে না এবং কেউ এই ভোজে যোগদানও করতে পারবে না। এই নিষেধ অমান্য করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।
২) এই আইনের ৪ নং ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি মৃত্যুভোজে উৎসাহ দিলে বা কোনরূপ সহযোগিতা করলে ১ বছর কারাদন্ড অথবা ১০০০ টাকা জরিমানা বা উভয়ই হতে পারে।
৩) ধারা ৫ অনুসারে, এলাকার জনপ্রতিনিরা মৃত্যুভোজের খবর জানলে তা নিকটবর্তী প্রশাসক বা পুলিশ আধিকারিক জানাবে এবং সেই অনুযায়ী প্রশাসক ও পুলিশ মৃত্যুভোজের আয়োজন বন্ধ করবে এবং আয়োজনের সমস্ত জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করবে। তারপরও যদি মৃত্যুভোজ করে থাকে, তবে ধারা ৬ অনুসারে ১ বছর কারাবাস অথবা ১০০০টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডই দিতে পারে।
৪) ধারা ৭ অনুসারে, কোন জনপ্রতিনিধি যদি মৃত্যুভোজের খবর জেনেও তা নিকটবর্তী প্রশাসক বা পুলিশ আধিকারিককে না জানিয়ে গোপণ করার চেষ্টা করে, তবে তাদেরও তিনমাস কারাদন্ড অথবা ১০০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডই হতে পারে।
৫) ধারা ৮ অনুসারে, কোন ব্যবসায়ী বা দোকানদার, মহাজন বা কোন ব্যক্তি যদি মৃত্যুভোজ করতে টাকা বা জিনিসপত্র ঋণ বা ধার দেয়, তবে আইন অনুসারে তা ফেরতযোগ্য বা পরিশোধযোগ্য হবে না। এমনকি তাদেরও ১ বছর কারাদন্ড অথবা ১০০০ টাকা জরিমানা হবে।
উক্ত আইনে কয়েকটি ফাঁকফোকর, স্ববিরোধীতা (যেমন জরিমানার অঙ্ক এবং শাস্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করা সহ কয়েকটি বিষয়) থাকলেও আইনটির অনেক গুরুত্ব রয়েছে। মধুসূদন মাহাতো আরো জানিয়েছেন- আত্মা-পরমাত্মা যেহেতু সব অলীক কল্পনা তাই, মৃত ব্যাক্তির কাল্পনিক আত্মার উদ্দ্যেশ্যে শ্রাদ্ধ একটি কুসংস্কার মাত্র। শ্রাদ্ধ হচ্ছে ব্রাহ্মণদের দ্বারা তাঁদের যজমান দের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাওয়ার দারুন কুবুদ্ধি। সম্ভব হলে অঙ্গদান করার অঙ্গিকার করুন। শ্রাদ্ধের নামে ভুরিভোজ এ অর্থের অপচয় বন্ধ করে সেই টাকায় কোনো গরিবের বাড়িতে সারা মাসের রেশন টা পাঠিয়ে দিন। এতে আপনার পুণ্য জাতীয় কিছু হবে কিনা জানা নেই, তবে মনে একটা অনাবিল শান্তি পাবেন। একটা ভালো কাজ করার শান্তি, যা টাকা দিয়ে কিন্তু কেনা যায় না।