ভারতের মিসিং উইমেন

অনুজ বিশ্বাস


Nov. 21, 2024 | | views :614 | like:0 | share: 0 | comments :0

প্রাচীন ভারতে নদীমাতৃক-মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার হাত ধরে সভ্যতার যাত্রা শুরু হয়। প্রাক বৈদিক যুগ থেকেই মাতৃতান্ত্রিক সমাজে নারী সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করলেও পরবর্তীতে পেশীশক্তির দ্বারা রচিত "বীর ভোগ্যা বসুন্ধরা" মতবাদ এর হাত ধরে ক্ষমতা হস্তান্তরের পালা শুরু হয়। এরপর এল মনুসংহিতা, মাতৃতন্ত্রের সর্বনাশ হয়ে গেল, মাতৃজাতি বারবনিতায় পরিণত হল। বর্তমান যুগে শিক্ষিত উন্নত দেশগুলোতে দেখা যায় নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে সামান্য বেশি। আধুনিক মানুষ তথা হোমো-স্যাপিয়েন্স এর মধ্যে টিকে থাকার ক্ষমতা বা Survival Ability সাধারনত মহিলাদের বেশি, তাই মহিলাদের গড় আয়ুও পুরুষের চেয়ে বেশি হয়। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় নারী ও পুরুষের অনুপাত প্রায় সমান সমান হলেও পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে একাধিক বিশ্বযুদ্ধ ও অন্যান্য রাজনৈতিক গোলযোগের কারণে বহু কোটি মানুষের মৃত্যু হয় যার অধিকাংশই ছিলেন পুরুষ। রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠার পর সারা বিশ্বের সামগ্রিক জনসংখ্যা বিচার করলে দেখা যায় নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেশি। ১৯৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে নারী পুরুষের অনুপাত ছিল প্রায় ১ : ০.৯৪৫, অর্থাৎ প্রতি ১০০০ জন মহিলা প্রতি পুরুষের সংখ্যা ৯৪৫ জন প্রায়।

এই অব্দি সবকিছু দিব্যি ঠিকঠাক ছিল। গন্ডগোল বাঁধলো গত শতকের আশির দশকে। একজন দেশদ্রোহী, দেশত্যাগী বাঙালী গবেষক লক্ষ্য করলেন এক আশ্চর্য জিনিস....ভারতের মেয়েরা কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। দেশের বহু রাজ্যে মেয়েদের সংখ্যা শোচনীয় ভাবে কমতে শুরু করেছে। সবচেয়ে উপদ্রুত রাজ্য গুলি হল বিহার, উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, গুজরাত, মহারাষ্ট্র ও মধ্য প্রদেশ; তথাকথিত “আর্য্যাবর্ত”। সাবিত্রী সীতার দেশ থেকে মেয়েদের হরণ করছে কোনও এক অজানা রাক্ষসের দল। আরও গবেষণায় দেখা গেল এটা শুধু ভারতের ছবি নয়, চীন -মধ্যপ্রাচ্য -উত্তর আফ্রিকা- দক্ষিণ এশিয়া সর্বত্র এক চিত্র। দেখাগেল সারা পৃথিবীতে যা থাকা উচিৎ তার চেয়ে ১০কোটি মহিলা কম, যার মধ্যে শুধু ভারতেই সংখ্যাটা প্রায় ৪ কোটির কাছাকাছি। এরাই Missing Women..কোথায় গেলেন তাঁরা? হঠাৎ করে উবে গেল এতগুলো মানুষ? কিন্তু কিভাবে?

গবেষণায় বেরিয়ে এল এক ভয়াবহ, গা ঘিনঘিন করা জান্তব সত্য....আল্ট্রাসনোগ্রাফি বা আল্ট্রাসাউন্ড। আল্ট্রা সাউন্ড করে খুঁজে বার করা হচ্ছে কন্যাভ্রূণ এবং শুধু মেয়ে হওয়ার অপরাধে তাদের মাতৃগর্ভেই খুন করা হচ্ছে। সারাবিশ্বে হুলুস্থুল পড়ে গেল। কারণটা নীচের পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট –

রাষ্ট্রপুঞ্জের World Population Prospectus ২০১৯ অনুসারে বর্তমান ভারতে প্রতি ১০০০ জন পুরুষে নারীর সংখ্যা মাত্র ৯৪৩ জন। ১৯০১ সালে ব্রিটিশ ভারতে ১০০০ জন পুরুষে নারীর সংখ্যা ছিল এযাবৎ কালের মধ্যে সর্বোচ্চ, ৯৭২ জন। এরপর সংখ্যাটা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। ১৯১১ সালে ৯৬৪; ১৯২১ সালে ৯৫৫; ১৯৩১ সালে ৯৫০ হয়ে ১৯৮১ সালে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৯২৭ জন, যা ইতিহাসে সর্বনিম্ন। ১৯৬৫ সাল নাগাদ ভারতে বাণিজ্যিক ভাবে আল্ট্রাসাউন্ড এর ব্যবহার শুরু হয়। তারপর থেকেই লক্ষ্যণীয় ভাবে মেয়েদের সংখ্যার কমতে থাকে। ১৯৮৫-৯০ সালের মধ্যে অবস্থা চরমে ওঠে।

দেশব্যাপী ছড়াতে থাকা এই সামাজিক ক্যান্সার দেশের একশো কোটি মানুষের চোখ এড়িয়ে গেলেও সেই দেশত্যাগী বাঙালী গবেষকের চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না। যদিও বাঙালী গবেষক তখন দেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে হার্ভার্ডের ল্যামন্ট ইউনিভার্সিটিতে অর্থশাস্ত্রের অধ্যাপনা করেছেন। সব দেখেশুনে তিনি আর থাকতে পারলেন না। কিন্তু তিনি তাঁর দেশের মানুষকে ভালো করেই চেনেন। তিনি জানেন, এই পোড়া দেশে কেউ তাঁর কথা গ্রাহ্য করবেনা। তাই যেখানে বললে কাজ হতে পারে সেখানেই তিনি কলম ধরলেন। এই বাঙালী অর্থনীতিবিদ প্রথমে নিউ ইয়র্কের বুক রিভিউ তে এ’বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লেখেন, যা পরবর্তীকালে British Medical Journal (Vol. 304, Issue 6827 dtd 7th March, 1992, Pp 587-588) এ একটা বিস্ফোরক গবেষণাপত্র হিসাবে বেরোয় "Missing Women: Social Inequality Outweighs Women's Survival Advantage in Asia and North Africa" নামে। 

সারা বিশ্বে আলোড়ন পড়ে যায়। রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে চলতে থাকা এক সুপরিকল্পিত নারকীয় গনহত্যার নৃশংস কাহিনী বে-আব্রু হয়ে পড়ে।

 দেশে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়। ভারত সরকার বাধ্য হয় ব্যবস্থা নিতে। ১৯৯৪ সালে জারি হয় Pre-Conception and Pre-Natal Diagnostic Techniques (PCPNDT) Act বা Prohibition of Sex Selection আইন। এর ফলে গর্ভস্থ ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য করা হয় এবং দেশের সমস্ত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গর্ভস্থ ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ বন্ধ করার নোটিশ টাঙানো বাধ্যতমূলক করা হয়।

যদিও এই আইন প্রণয়নের ফলে লাভের লাভ আজও বিশেষ হয়নি তবুও যেটুকু হয়েছে তাই বা কম কি? আজ ভারত তথা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে মানুষের লিঙ্গ অনুপাত আগের তুলনায় অনেক ভালো। জন্মের আগে লিঙ্গ নির্ধারণ অপরাধ ঘোষিত হয়েছে। কোটি কোটি মেয়ের প্রাণ বাঁচিয়েছেন এই যুগন্ধর বাঙালী, যাঁর নাম অমর্ত্য সেন। জন্ম জন্মান্তরের জন্য ভারতবর্ষ তাঁর কাছে চির ঋণী হয়ে থাকবে।

আমরা এই সর্বভারতীয় লজ্জার কথা জানি না, আর জানলেও তাকে কর্পোরেট আর গণতন্ত্রের কার্পেট দিয়ে ঢেকে রাখতে সদা সচেষ্ট থাকি। উত্তর ভারতীয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে গেঁথে যাওয়া মনুবাদী সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় কলঙ্ক এই কন্যা ভ্রূণ হত্যা। এরা মৃণ্ময়ী রূপে আদ্যাশক্তির আরাধনা করে আর গর্ভের দুর্গাকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ দেয়না। এমনকি দেশের সরকারও ভ্রূণ হত্যাকে পরোক্ষ সমর্থন জানিয়ে নিজের মত ন্যারেটিভ তৈরি করে। ২০১৬ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী শ্রীমতী মানেকা গান্ধী গর্ভস্থ সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ বাধ্যতমূলক করার পক্ষে সওয়াল করেন। ২০১৬ সালের ফেব্রয়ারি মাসে All India Regional Editors' Conference এ তিনি বলেন ".... the women should be compulsorily told that whether it is a boy or a girl child whom she is going to give birth"... প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতে এমন প্রস্তাব লোভনীয় কিন্তু ভারতের জন্য কখনোই নয়। অন্তঃস্বত্তা মহিলা নাহয় জানলেন তাঁর গর্ভস্থ ভ্রূণ ছেলে না মেয়ে, কিন্তু যদি মেয়ে হয় তখন সেই মেয়েটিকে সমাজের হায়েনা দের হাত থেকে কিভাবে রক্ষা করা হবে সেবিষয়ে মন্ত্রী মহোদয়া একটি কথাও খরচ করলেন না। তিনি সুকৌশলে এড়িয়ে গেলেন আমাদের আজন্ম লালিত মনুবাদী মানসিকতা। পুত্র সন্তানের লোভে আমরা মাতোয়ারা হতে গিয়ে আমাদের মনে এমন এক কদর্য আত্মশ্লাঘা তৈরী হয়েছে যে নিজের অজান্তেই আমরা সৃষ্টির পথ বন্ধ করতে উদ্যত হয়েছি। আর্য্যাবর্তের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। এখানে মেয়েরা সামাজিক ব্যবসার পণ্য। উত্তর ভারতীয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের বৌদ্ধিক মানদণ্ডের কোন জায়গা নেই, অর্থই শেষ কথা বলে।

স্বাধীনতার পরে মনুবাদী চিন্তাধারা কে প্রসারিত করার দায়িত্ব নেয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। সঙ্ঘের প্রাণপুরুষ গুরু গোলবলকার তাঁর Bunch of Thoughts বইতে ভারতীয় নারীর আধুনিক প্রগতিশীল চিন্তাধারা কে নস্যাৎ করে, সংস্কারের দোহাই দিয়ে তাদের পরিষ্কার ভাবে পুরুষের ভোগ্যপণ্য হিসাবে উপস্থাপন করে ব্রাহ্মণ্যবাদী দের জন্য সমাজের সর্বস্তরের নারীর গর্ভে সন্তান উৎপাদন এক পবিত্র কর্তব্য বলে উল্লেখ করেন। তিনি মনে করেন উত্তর ভারতীয় উন্নত ব্রাহ্মণের ঔরসে দক্ষিণ ভারতীয়, তথাকথিত নিম্ন বর্ণের মহিলার গর্ভে যে সঙ্কর প্রজাতির সন্তান জন্ম নেবে তার মাধ্যমেই নিম্ন বর্ণের জিনগত উন্নতি সম্ভব। এর ফলে নিম্নবর্গের মানুষের মধ্যে কন্যাভীতি তৈরি হয়। উচ্চবর্ণের লম্পটদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে নিজের মেয়েকে রক্ষা করতে পারার অপারগতা থেকেই সমাজের নিম্নবর্ণের মধ্যেও কন্যা ভ্রূণ হত্যা করার প্রবণতা তৈরি হয়। অন্যদিকে মনুসংহিতা অনুসারে উচ্চবর্ণের বিবাহে পণ দেওয়া আবশ্যিক। এখানেও কন্যাসন্তান ক্রমশ পিতার বোঝা হয়ে ওঠে। এপ্রসঙ্গে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ওয়াই.কে. সভারওয়াল মন্তব্য করেন, "Investing in a daughter, They say, is like 'watering your neighbour's lawn' "... আর্য্যাবর্তের মানুষ ভাবে “পুরুষ হল উৎপাদক, মহিলা হল উপভোক্তা”। এমন মধ্যযুগীয় মানসিকতা আজও আমাদের জাতীয় লজ্জা।

আজ উঠতে বসতে অমর্ত্য সেন কে গালিগালাজ করা, তাঁকে দেশদ্রোহী, শহুরে নকশাল বলাটা আমাদের নতুন রাজনৈতিক প্রোপাগন্ডা। উনি নোবেল পেয়েছেন বটে, কিন্তু 'ভারতের জন্য কী করেছেন?' এই প্রশ্নে একজন নতুন ভোটারও নিজের ফেসবুক ওয়াল ভরিয়ে ফেলে। সেদিন অমর্ত্য সেন ওই প্রবন্ধ না লিখলে আজকের অনেক অষ্টাদশী যুবতী হয়তো পৃথিবীর আলোই দেখতে পেত না। যে মানুষের ঋণ সারা বিশ্ব জন্ম জন্মান্তরেও শোধ করতে পারবে না সেই মানুষের যোগ্যতা নিয়ে আজকের হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির অশিক্ষিত গ্র্যাজুয়েটরা প্রশ্ন করে, অনেকাংশেই রাষ্ট্রীয় মদতে। এ কেবল ভারতবর্ষেই সম্ভব।।

তথ্যসূত্র:

১. অমর্ত্য সেনের মূল প্রবন্ধের ওয়েবলিঙ্ক: https://www.bmj.com/content/304/6827/587

২. MS Golwalkar, Bunch of Thoughts, Ch. Call to the Motherhood, Pp. 283-287., The Organizer, January 2, 1961, Pp. 5, 16.

৩. অন্যান্য সকল তথ্য ও পরিসংখ্যান ইন্টারনেটে সহজলভ্য।

অনুজ বিশ্বাস, কৃষ্ণনগর, নদীয়া।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929