বাচ্চা মানুষ করার এককুড়ি টিপস
সৌম্যকান্তি পান্ডা (বিশিষ্ট শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ)
Nov. 19, 2024 | | views :877 | like:0 | share: 0 | comments :0
১. শিশুর জন্মের পর প্রথম ৭-১০ দিনে জন্মের সময়ের ওজনের ৮-১০ শতাংশ ওজন কমে যায়। এটা একদম স্বাভাবিক। বিশেষত যে সব শিশু সঠিক সময়ের আগে (৩৭ গর্ভ-সপ্তাহের আগে) জন্মায় তাদের ক্ষেত্রে এই ওজন কমে যাওয়ার পরিমান বেশি হয়।
২. শিশুকে চড়া রোদের তলায় রাখবেন না। সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি ত্বকের ক্ষতি করতে পারে।
৩. গর্ভাবস্থায় শরীরে প্রচুর জল জমে যায় ভেবে অনেকে মা'কে চড়া রোদে বসিয়ে আর জল কম খেতে দিয়ে শোকানোর চেষ্টা করেন। এটা করবেন না। জলের অভাবে বুকের দুধের পরিমান কমে যেতে পারে।
৪. নবজাতক মধু খেয়ে মিষ্টভাষী হয় না। বরং এতে পেটে জীবাণু সংক্রমণ হতে পারে।
৫. পেচ্ছাব করার আগে কান্না মানেই মূত্রনালীর সংক্রমণ নয়। মূত্রথলি ভর্তি হয়ে গেলে বাচ্চা অস্বস্তির কারনে কাঁদতে পারে। পেচ্ছাব হয়ে গেলে এই কান্না ঠিক হয়ে যায়। পেচ্ছাব হওয়ার সময় কান্না নিয়ে বরং চিন্তা থাকে। বুঝতে না পারলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৬. শিশুকে জন্মের কয়েক ঘন্টা পর থেকেই তেল মাখানো যেতে পারে। কম ওজনের অপরিনত বাচ্চার ঠান্ডা হয়ে যাওয়া আটকাতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা নিতে পারে। সুগন্ধীবিহীন নারকেল তেল দিয়েই হাল্কা মালিশ করতে পারেন।
৭. সরষের তেল মাখানো যাবে না। সরষের তেল রান্না করা-মাছ ভাজার জন্য। বাচ্চাকে মাখানোর জন্য নয়। "সরষের তেল দিয়ে বাচ্চার ঠান্ডা কম লাগে আর নারকেল তেল দিলে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ শুরু হয়ে যায়"--ভুল ধারনা। বরং সরষের তেলের ইরিট্যান্ট থেকে বাচ্চার র্যাশ বেরোতে পারে।
৮. নাভীর নাড়ি খসে না পড়া অব্দি স্পঞ্জিং করুন।জন্মের ২৪ ঘন্টা পর থেকেই স্পঞ্জিং শুরু করা যায়। নাড়ি খসে গেলে স্নান করান। প্রথমে ২-৩ দিন ছাড়া করালেও ক্ষতি নেই। মাথায় সবার শেষে জল লাগাবেন।মুছে ফেলবেন সবার আগে। ঠান্ডা লেগে যাওয়ার ভয়ে স্নান বন্ধ করবেন না। অপরিষ্কার ত্বকে সংক্রমণ হতে পারে।
৯. পাউডার জাতীয় কিছু দেবেন না। বোরিক অ্যাসিড মেশানো কোনও কসমেটিকস দেওয়া নৈব নৈব চ। কাজল দেবেন না। চোখে তো নয়ই, মুখের কোথাওই দেওয়া ঠিক নয়। কাজল দিয়ে সব 'নজর' আটকে গেলে এত খরচ করে হাসপাতাল বানানোর দরকার পড়ত না।
১০. প্রথম ছ'মাসে শুধুই বুকের দুধ। 'পেট ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে,বাচ্চা খিদেয় শুকিয়ে যাচ্ছে, বুকে দুধ নেই' এগুলো অধিকাংশ সময় ভুল ধারনা। যে বাচ্চা দিনে ন্যূনতম ৬-৭ বার পেচ্ছাব করছে, দুধ খেয়ে ২-৩ ঘন্টা ঘুমোচ্ছে এবং ওজন বাড়ছে, তার বুকের দুধের খেতে সমস্যা হচ্ছে না। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া বাইরের দুধ দেওয়া যাবে না।
১১. দুধ তোলা মানেই বমি নয়। সুস্থ স্বাভাবিক বাচ্চাও সারাদিনে ৮-১০ বার বা তারও বেশিবার দুধ তুলতে পারে। ওজন ঠিক থাকলে এবং অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতা না থাকলে দুধ তোলা নিয়ে ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। প্রত্যেকবার দুধ খাওয়ার পরে ঢেকুর তোলান, মাথার দিক উঁচু করে শোওয়ান। বমির সাথে তফাত করতে না পারলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন বলাই বাহুল্য।
১২. দুধ খাওয়ার পরে পরেই অল্প অল্প করে সারাদিনে ১৫-২০ বার পায়খানা করাও অস্বাভাবিক নয়। এটা অনেকটা রাস্তার ট্রাফিকের মত। পাকস্থলীতে খাবার এলেই সংকেত যায় রাস্তা পরিষ্কার করার। ফলস্বরূপ বৃহদন্ত্রের মধ্যে জমে থাকা মল বেরিয়ে যায়।
১৩. এবং গ্যাস! মাথায়ও ওঠে না, হাঁটুতেও নামে না।
১৪. দুগ্ধপোষ্য শিশুর অর্ধতরল পায়খানা লিভারের দোষে নয়। লিভার টনিক খাইয়ে লিভারকে শক্তিশালী করে ডাম্বেল তোলার উপযুক্ত করা যাবে ভাবলে ভুল করছেন।
১৫. সামান্য কয়েকটি গুরুতর অসুখ ছাড়া বুকের দুধ কখনোই বন্ধ করার দরকার হয় না। মায়ের সামান্য জ্বর-সর্দি-কাশি এসবের জন্য তো নয়ই।
১৬. এক বছর বয়সের আগে গরুর দুধ না দেওয়াই ভালো। বাজারচলতি প্যাকেটের গুঁড়ো খাইয়ে টলার-স্ট্রংগার-শার্পার করা যায় না। মাথায় রাখুন, রবি ঠাকুর আর আইনস্টাইনের সময় এগুলো বাজারে ছিল না।
১৭. কলা বা টক জাতীয় ফল খেয়ে ঠান্ডা লাগে না। বরং তার মধ্যে থাকা প্রচুর পরিমান খনিজ পদার্থ, ভিটামিন ও অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
১৮. মোটা হওয়া মানে স্বাস্থ্য হওয়া নয়। মুটিয়ে যাওয়া কিংবা হাড় জিরজিরে হয়ে যাওয়া দুটিই অস্বাস্থ্য। দুনিয়ার যাবতীয় ফাস্ট ফুড আর প্যাকেটের খাওয়ার খাইয়ে শিশুকে জ্যান্ত ফুটবল বানাবেন না।
১৯. এক বছর বয়েসের পর স্বাভাবিকভাবেই শিশুর বৃদ্ধিহার কমে আসে। ওজন বাড়ছে না ভেবে জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করবেন না। এতে শিশুটি খাবার দেখেই আতঙ্কিত হয়ে পড়তে পারে।
২০. নিয়ম মেনে ভ্যাকসিন দিন। নিজে নিজে বা পাড়ার কোয়াকের পরামর্শে মুড়ি মুড়কির মত অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়াবেন না। মনে করিয়ে দিই, শুধু ভারতে বছরে ৫৮০০০ শিশু অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাক্টিরিয়ার আক্রমণে মারা যায়। শিশুকে যত্ন করা মানে সারাদিন আঁচলে ঢেকে রাখা নয়। দুবার আছাড় খাক, তিনবার হাঁটু ছড়ুক, ধুলোমাটি একটু ঘাঁটুক.. প্রকৃতির সাথে বেড়ে ওঠাটাও একটা শিক্ষা।
https://thedoctorsdialogue.com/few-tips-of-child-parenting/