তুমি কেমন ঈশ্বর, যে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ কর!

Guitar K Kanungo


March 30, 2025 | | views :41 | like:1 | share: 0 | comments :0

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শুরুতে বাসুদেব কৃষ্ণ বলেছিলেন, তিনি এই যুদ্ধে কারো পক্ষ নেবেন না। এই কথা শুনে মহামতি ভীষ্ম বলেছিলেন, তিনি কৃষ্ণকে অস্ত্র ধরিয়েই ছাড়বেন। এখানে একটা কথা বলে নেয়া দরকার, ভীষ্ম ছিলেন সেই গুটিকয়েক মানুষদের একজন, যিনি জানতেন বাসুদেব কৃষ্ণ ভগবান কৃষ্ণের অবতার। ভীষ্ম যে এটা জানতেন, সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে। যজ্ঞের অর্ঘ্য কাকে প্রদান করা উচিত, এই প্রশ্ন উঠতেই ভীষ্ম দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, যদুকুলশ্রেষ্ঠ বাসুদেব কৃষ্ণই এই অর্ঘ্য গ্রহণ করার সবচাইতে যোগ্যতম ব্যক্তি। এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে, কৃষ্ণ কোন রাজ্যের রাজা ছিলেন না। তবুও ভীষ্ম এই প্রস্তাব করেছিলেন, কারণ তিনি জানতেন কৃষ্ণবর্ণের ওই মানুষটি রাজাদের রাজা, ভগবান বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার। ভীষ্ম ছিলেন বিষ্ণুর পরম ভক্ত।

এই যুদ্ধে পান্ডবদের ভরসা ছিল অর্জুনের ক্ষাত্রশক্তির উপর। কিন্তু সেই অর্জুন যুদ্ধ করতে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না। পরম আত্মীয়দের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, বিশেষ করে ভীষ্ম এবং আচার্য দ্রোণের বিরুদ্ধে তো বটেই। সেই যখন মা কুন্তীর হাত ধরে প্রথম হস্তিনাপুরে এসেছিলেন, সেদিন যে মানুষটি হাত বাড়িয়ে তাদের বুকে টেনে নিয়েছিলেন, তিনি পিতামহ ভীষ্ম। অন্যদিকে, আচার্য দ্রোণ নিজের ঔরসজাত সন্তান অশ্বত্থামার চাইতেও যাকে বেশি ভালোবাসতেন, তিনি ছিলেন অর্জুন। অর্জুন ছিলেন তাঁর প্রিয়তম শিষ্য; নিজের সমস্ত অস্ত্রজ্ঞান উজাড় করে শিখিয়েছিলেন এই প্রিয় শিষ্যকে। অর্জুনের চাইতে বড় বীর হয়ে উঠতে পারে এই আশঙ্কায় তিনি নিষাদ একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে নিয়েছিলেন গুরুদক্ষিণা হিসেবে। সেই আচার্য দ্রোণের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে হবে! তাঁদের হত্যা করতে হবে! অর্জুন ভাবতেই পারছিলেন না!

কেশব অর্জুনকে অনেক বোঝালেন। কেন কঠিন হলেও এই কাজটা অর্জুনকে করতে হবে, সেটা বেশ ভালো করে বোঝালেন। গীতার আবির্ভাব ঘটল। তবুও অর্জুন ঠিক নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। এবার কৃষ্ণ তাঁকে বিশ্বরূপ দেখালেন। অর্জুন শেষ পর্যন্ত দ্বিধা কাটিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। কিন্তু যুদ্ধ করতে গিয়ে অর্জুন গীতার সমস্ত উপদেশ বেমালুম ভুলে গেলেন। প্রতিপক্ষ হিসেবে পিতামহ ভীষ্ম এবং আচার্য দ্রোণকে দেখে তাঁর হৃদয় হাহাকার করে উঠল। এদের দুজনের কাউকেই তিনি বধ করতে পারছিলেন না, যদিও দ্রোণের শিখিয়ে দেওয়া সমস্ত জ্ঞান ছাড়াও তাঁর সংগ্রহে ছিল বেশ কিছু দিব্যাস্ত্রের মজুদ। এঁদেরকে ঘিরে সমস্ত স্মৃতি অর্জুনকে একেবারে আবিষ্ট করে ফেলেছিল।

এদিকে দুর্যোধনের নিদারুণ নিগ্রহে অতিষ্ঠ হয়ে ভীষ্ম যুদ্ধক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেন। এখানে বলে নেয়া দরকার, মহাভারতের গুটিকয়েক অতিমহারথী যোদ্ধার মধ্যে ভীষ্ম একজন। পান্ডবদের ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা না করলেও তিনি কুরুক্ষেত্রের ময়দানকে রক্তাক্ত করে তুললেন। পান্ডব শিবিরে রীতিমত হাহাকার পড়ে গেল। অর্জুন কিছুতেই এঁটে উঠতে পারছিলেন না ভীষ্মের সঙ্গে। সেদিন ছিল যুদ্ধের নবম দিন। কৃষ্ণ দেখলেন, এভাবে চলতে থাকলে পাণ্ডবদের পরাজয় অনিবার্য। এরকম একটা অবস্থায় কৃষ্ণ রথ থেকে নেমে এসে রথের চাকা তুলে নিয়ে ভীষ্মকে বধ করতে এগিয়ে গেলেন। কৃষ্ণ পার্থেরই সারথি ছিলেন; পার্থ দ্রুত রথ থেকে নেমে এসে কৃষ্ণের পায়ের উপর আছড়ে পড়লেন একেবারে। মিনতি করে বললেন, তিনি যেন প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে ভীষ্মকে বধ না করেন। এদিকে কৃষ্ণকে এগিয়ে আসতে দেখে ভীষ্ম অস্ত্র ত্যাগ করে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে রথের উপর দাঁড়িয়ে রইলেন। মুখে স্মিত হাসি। তিনি বলেছিলেন, কৃষ্ণকে অস্ত্র ধরিয়ে ছাড়বেন। সেটা তিনি করতে পেরেছেন।

প্রশ্নটা এখানেই ওঠে। কেন তাহলে কৃষ্ণ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যদি সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে না পারেন? তিনি যদি ঈশ্বরের অবতার হয়েই থাকেন, তাহলে তাঁর আগে থেকেই জানা উচিত ছিল, গীতার বাণী ব্যর্থ হবে, অর্জুন ব্যর্থ হবেন এবং এক পর্যায়ে তাঁকে সশরীরে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে। যদি তিনি সেটা আগে থেকে না জেনে থাকেন, তাহলে তো তিনি ভগবানই নন।

এমন একটা প্রশ্ন বাইবেলের ঈশ্বরকেও ঘিরে উঠেছিল। তিনি আদমকে সৃষ্টি করলেন, তারপর সেই আদমকে ইডেন গার্ডেনে ছেড়ে দিলেন। কিছুদিন পর ঈশ্বরের মনে হল, আদম নিঃসঙ্গ বোধ করছে, অতএব তার একজন সঙ্গী দরকার। আদম যে নিঃসঙ্গ বোধ করবেন, সেটা ঈশ্বর আগে থেকেই বুঝতে পারেননি কেন? যাই হোক, তিনি এবার ইভকে বানিয়ে আদমের সঙ্গে বসবাসের জন্য ইডেন গার্ডেনে ছেড়ে দিলেন। সেই গার্ডেনে একটা বৃক্ষ ছিল, যে বৃক্ষের ফল খেতে তিনি বারণ করে দিয়েছিলেন। ইভ সে আদেশ অমান্য করলেন। এখানেও প্রশ্ন উঠতে পারে, ঈশ্বর কি তাহলে আগে থেকে জানতেন না ইভ প্ররোচিত হবেন?

প্রতিজ্ঞা ভীষ্মও করেছিলেন, কিন্তু সে প্রতিজ্ঞা তিনি রক্ষা করেছেন। এমনকি এই কুরুক্ষেত্রের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধটাই শেষ পর্যন্ত হতো না, যদি তিনি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে পিতা শান্তনুর রেখে যাওয়া সিংহাসনটা নিজের দখলে নিতেন। যাই হোক, এইরকম একটা বিপ্রতীপ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল বলেই কৃষ্ণের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে উদ্যত হওয়ার কারণটা জানা জরুরি। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন, কৃষ্ণ আগে থেকেই জানতেন গীতার উপদেশ শোনার পরেও অর্জুন সমস্ত সামর্থ্য নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে পারবেন না এবং তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে সেটা নিজে প্রত্যক্ষ করেছেন। অর্জুনকে আরেকবার উজ্জীবিত করার প্রয়োজন ছিল। রথের চাকা নিয়ে কৃষ্ণ ভীষ্মের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন যতটা না ভীষ্মকে বধ করার উদ্দেশ্যে, তার চেয়ে বেশি অর্জুনকে উজ্জীবিত করার জন্য। অর্জুন উজ্জীবিত হলেন। তিনি কৃষ্ণকে প্রতিজ্ঞা করলেন, এরপর থেকে তিনি ক্ষত্রিয়ের মতোই লড়াই করবেন।

কিন্তু এই উত্তর কি যথাযথ? গ্রহণ করার মতো? নিশ্চয়ই নয়। এই উত্তর গ্রহণযোগ্য, যদি কৃষ্ণকে অর্জুনের একজন মেন্টর হিসেবে দেখি কিংবা আরেকটু এগিয়ে গিয়ে যদি একজন কোচ হিসেবে দেখি। কিন্তু কৃষ্ণকে যদি একজন অবতার হিসেবে দেখি, তাহলে এই উত্তর গ্রহণযোগ্য মনে হবে না। তিনি যখন অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখালেন, তখনই তো অর্জুনের মনোভাব বদলে দিতে পারতেন। তাঁর মনকে সমস্ত মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিতে পারতেন। তিনি সেটা করেননি। এদিকে ভীষ্মকে হত্যা করতে ছুটে যাওয়াটা একটা আকস্মিক ঘটনা এবং ঘটনাটি আকস্মিক বলেই এটা অর্জুনকে উজ্জীবিত করার জন্য করেছেন, এমন ভাবার সুযোগ খুবই কম। তাহলে?

ঠিক এই জায়গায় এসে আরেকটি ঘটনার কথা বলতে হয়, যে ঘটনার কিছুটা আগেই বলা হয়েছে। যুদ্ধের শুরুতে কৃষ্ণ যখন বলেছিলেন, তিনি কোনো পক্ষেই যোগ দেবেন না, তখন ভীষ্ম বলেছিলেন, তিনি কৃষ্ণকে অস্ত্র ধরিয়েই ছাড়বেন। ভীষ্ম সেটা করতে পেরেছিলেন। আবারও প্রশ্ন উঠবে, কৃষ্ণ সেটা হতে দিলেন কেন? কেউ কেউ বলেন, কৃষ্ণ সেটা হতে দিলেন, কারণ তিনি যে ভক্তের ভগবান। ভীষ্ম ছিলেন তাঁর পরম ভক্ত। ভক্তের ইচ্ছাকে মূল্য দিতে গিয়েই তিনি অস্ত্র ধারণ করেছিলেন, নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। কিন্তু এখানেও আরেকটি প্রশ্ন ওঠে। যুদ্ধের শুরুতে ভীষ্মকে যে মাপের যোদ্ধা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, সেই বর্ণনা অনুসারে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন তো বটেই, ভীষ্মের চাইতেও বড় মাপের যোদ্ধা ছিলেন। তারপরও কৃষ্ণ কি ভীষ্মকে বধ করতে পারতেন? পারতেন না - ভীষ্ম মৃত্যুকে জয় করছিলেন। তাঁর হাতে যতক্ষণ অস্ত্র আছে ততক্ষন তাঁকে কেউ বধ করতে পারত না, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণও নন। তাহলে কৃষ্ণ তাঁকে মারতে ছুটে গিয়েছিলেন কেন ?

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929