বস্তুর চেতনাসঞ্চার

তন্ময়


Nov. 23, 2024 | | views :283 | like:0 | share: 0 | comments :0

বস্তু থেকে চেতনার সৃষ্টি না চেতনা থেকে বস্তুর - এই নিয়ে বিতর্ক বহুদিনের। লোকায়ত মতে চেতনা দেহেরই গুন,দেহের বাইরে চেতনার অস্তিত্ব নেই। ভাববাদীরা এক্ষেত্রে প্রশ্ন তুলেছেন চেতনা যদি দেহেরই গুন হয় তবে মৃত দেহও তো দেহ তাহলে সেই দেহে তো চেতনা নেই অতএব চেতনা দেহের গুণ নয়, চেতনা দেহাতিরিক্ত শক্তি যা মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময় থেকেই ছিল এবং এই চেতনা থেকেই সবকিছুর সৃষ্টি। ঈশ্বরের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে চেতনা থেকে বস্তু সৃষ্টির ধারণাটাই প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। 

চেতনা যদি বস্তুর থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক ভিন্ন সত্তা না হয় তবে তো চৈতন্যময় ঈশ্বরের ধারনাই অমূলক হয়ে যায়।

কিন্তু চেতনা থেকে যদি সকলপ্রকার বস্তুর সৃষ্টি হয় তবে তো মহাবিশ্বের সমস্ত শক্তি বা বস্তুর মধ্যেই চেতনার অস্তিত্ব থাকবে, সেই চেতনা যতই সূক্ষ্ম হোক না কেন? মাটি থেকে কোনও কিছুর সৃষ্টি হলে মাটির সামান্যতম উপস্থিতি থাকবে না? সেটা কি সম্ভব? না,সম্ভব নয়। সৃষ্টির মূল উপাদানকরণ থেকে সৃষ্ট প্রত্যেকটির বস্তুর মধ্যেই সেই প্রাথমিক উপাদান পরিলক্ষিত হবে, এটাই বাস্তব। সৃষ্টির আদিতে চৈতন্যের উপস্থিতি অর্থাৎ চৈতন্যস্বরূপ চরম বা পরম সত্তার অনুসারীরা বলেন, প্রত্যেক বস্তুর মধ্যেই চেতনা বর্তমান। সেই চেতনা ব্যক্ত হয়নি, অব্যক্ত অবস্থায় আছে।এই চেতনার মান শূন্য। এই শূন্য কোনও সংখ্যাহীনতা নয়, তাই চেতনাহীন নয়।


 অদ্ভুত এই দাবী। চেতনার মান যদিই শূন্যই হয় তবে চেতনার অস্তিত্ব থাকতে পারে কি? শূন্য এককভাবে কোনও কিছুর অস্তিত্বহীনতাই বোঝায়। আরবি শব্দ “সাফাইর” বা “সাফাইরা” শব্দের পরিবর্তিত রূপ হল ইংরেজির “শূন্য”। “সাফাইর” বা “সাফাইরা” শব্দের অর্থ “সেখানে কিছু ছিল না”। সংস্কৃত শব্দ “শুণ্যেয়া”র অর্থ “খালি” বা “ফাঁকা”। তাহলে কি দাঁড়াল? দাঁড়াল এই যে চেতনার মান শূন্য কথাটার অর্থ চেতনার অস্তিত্বহীনতা।


 বস্তুবাদী মতানুসারে দেহ গঠনের মূল উপাদানগুলির মধ্যে চেতনার অস্তিত্ব থাকে না। উপাদানগুলির প্রত্যেকটাই নিস্প্রান, জড় অর্থাৎ অচেতন। কিন্তু এই জড় পদার্থের যখন বিশেষ পরিবর্তন সাধিত হয় তখন এক নতুন গুণ বা ধর্মের উদ্ভব হয়, ইহাই চেতনা। উদাহরণ হিসেবে বস্তুবাদীরা মদশক্তির কথা উল্লেখ করেন। যে সকল দ্রব্যের মিশ্রণে মদ তৈরি হয়, সেইসকল দ্রব্যের একটির মধ্যেও স্বতন্ত্রভাবে সেই শক্তি নেই নেই যে শক্তি মদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ মদ পান করলে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় সেই উত্তেজনা মদ তৈরির উপকরণগুলি পৃথক পৃথকভাবে বা একত্রে খেলেও সৃষ্টি হবে না। কিন্তু সেই উপকরণগুলিকে যখন বিশেষ তাপমাত্রায় বিশেষভাবে (অর্থাৎ উপকরণগুলির পরিমাণের বিজ্ঞানসম্মত অনুপাতে) মিশ্রিত করা হয় তখন যে তরল পানীয়ের সৃষ্টি হয় তার মধ্যে এক নতুন গুণের সৃষ্টি হয়, সেটাই মদশক্তি।


এই মদশক্তিকে উদাহরণ ধরেই বলা যায়, যে সকল জড়বস্তুর সমন্বয়ে শরীরের গড়ে ওঠা সেইসকল জড়বস্তুর মধ্যে স্বতন্ত্র বা মিলিত অবস্থায় চেতনার কোন লক্ষ্মণ না থাকলেও সেগুলিরই কোন এক বিশেষ পরিবর্তনের ফলস্বরুপ উদ্ভব ঘটেছে চেতনা নামক এক সম্পূর্ণ নতুন গুণের। 

এই গুণের অস্তিত্ব দেহ বা শরীর ছাড়া সম্ভব নয়। বস্তু ও চেতনা গুনগতভাবে বিপরীত ধর্মী, কিন্তু বিচ্ছিন্ন নয়। বস্তুর অস্তিত্ব ব্যতীত চেতনার অস্তিত্ব থাকতে পারে না।

 তাই বিপরীত ধর্মী হলেও বস্তু ও চেতনার মধ্যে একটা ঐক্যও বর্তমান। এটাই বৈপীরিত্যের ঐক্য।


 এখানে একটা প্রশ্ন জাগে যে বস্তু ও চেতনার মধ্যে ঐক্য থাকলে তো সকল বস্তুর মধ্যে চেতনা বর্তমানের ধারণাটা মান্যতা পেয়ে যায়? এই প্রশ্নের উত্তর হবে যে বস্তুর অস্তিত্ব ব্যতীত চেতনার অস্তিত্ব থাকতে পারে না কিন্তু অবশ্যই চেতনার অস্তিত্ব ব্যতীত বস্তুর অস্তিত্ব থাকতে পারে। তাহলে আর ঐক্য হল কোথায়? এখানে বস্তু বলতে সকল প্রকার বস্তুর কথা ভেবে নিলে অযৌক্তিক হবে। এখানে বস্তু বলতে ক্রম সমন্বয়ী বস্তুর ভিত্তিতে গড়া দেহ বা শরীরের কথা ধরতে হবে। 

 

এত আলোচনা সত্ত্বেও প্রশ্ন উঠতে পারে, চেতনা যদি শুধুমাত্র দেহের গুণ হয় তাহলে মৃতদেহে চৈতন্য বর্তমান থাকে না কেন? ভাববাদীরা দেহ বলতে জড়দেহ ভেবে নিয়েছেন। মৃতদেহ যেহেতু জড়দেহ তাই সেই দেহতে স্বাভাবিকভাবে চেতনার অস্তিত্ব থাকতে পারে না। দেহ মাত্রেই অনুভব বা চিন্তা করতে সক্ষম নয়। যেহেতু জৈব বিবর্তনের মধ্য দিয়ে চেতনার উদ্ভব হয়েছে সেহেতু কেবলমাত্র জৈবিক জীবিত দেহই এই গুণসম্পন্ন হয়। যে দেহে প্রাণ বর্তমান সেই দেহ জীবিত, মৃতদেহে প্রাণ বর্তমান থাকে না তাই মৃতদেহে চেতনার অস্তিত্ব খোঁজা অবাস্তব।


প্রশ্ন উঠতে পারে, উদ্ভিদেরও তো প্রান আছে, তাহলে কি উদ্ভিদেরও চেতনা আছে? হ্যা,আছে তবে উদ্ভিদের চেতনা আর প্রাণীর চেতনার মধ্যে পার্থক্য আছে। এই পার্থক্য হল অনুভূতি ও প্রতিবর্ত ক্রিয়ার সাথে চিন্তার পার্থক্য।উদ্ভিদের চেতনা হরমোন দ্বারা নির্ধারিত হয় বলে উদ্ভিদ শুধুমাত্র অনুভূতির মাধ্যমে ও প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় সাড়া দিতে পারে কিন্তু যেহেতু উদ্ভিদের স্নায়ুকোষ নেই তাই চিন্তা করতে পারে না।   

বিবর্তনের ঐতিহাসিক ও দ্বান্দ্বিক বস্তুগত বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে বস্তু থেকে চেতনার উদ্ভবের কার্যকারন সম্পর্কের ব্যাখ্যা অবৈজ্ঞানিক। গতিশীলতা ও পরিবর্তনশীলতা হল বস্তুর ধর্ম। অনুন্নত থেকে উন্নত, সরল থেকে জটিল ক্রমে বিবর্তনের ধারার মধ্য দিয়েই বস্তুর রূপান্তরিত বা পরিবর্তিত পরিমান স্বরূপ চেতনার উদ্ভব। বস্তুর বিকাশ ব্যতীত চেতনার সৃষ্টির দাবী অযৌক্তিক। 


চেতনার উৎস সম্পর্কে চেতনা বিষয়ক এবং জীব বিজ্ঞানীদের কয়েকটি ব্যাখ্যা সম্পর্কে আলোচনা করা যাক, “All three media-genetic evolution, phenotypic plasticity and memetic evolution-have contributed to the design at human consciousness, each in turn, and at increasing rates of speed”. (ডেন্নেট,আমেরিকার চেতনা বিষয়ক বিজ্ঞানী)  

 “Convert attention is the virtual movement of deep processing from one item o another. The cortex needs to control that virtual movement … is does so by constructing an attention schema- a constantly updated set of information that describes what convert attention is doing moment by moment-by moment and what its consequences are”. (বিজ্ঞানী গ্রাজিয়ান)

“It is quite certain that human consciousness did not arise fullfledged with the human species, but is only the most highly evolved end point of a long evolutionary history”. (আরনেস্ট মেয়ার, জার্মান জীববিদ)। 


বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক ঘটনাসমুহের (সাম্য ও বিপর্যয়) থেকে উদ্ভূত দ্বন্দ্বের ফলস্বরূপ অভিযোজিত বা সৃষ্টি সম্বন্ধীয় পরিব্যক্তির মাধ্যমে চেতনার সৃষ্টি হয়। অনেকে বলেন, বিবর্তনের দীর্ঘ পরিক্রমায় উপজাত বস্তু (বাই প্রোডাক্ট অফ এভলিউশন) রূপে চেতনাকে পাওয়া যায়।   


সকল আলোচনা বিশ্লেষণ করে আমরা বস্তু থেকে চেতনার উৎপত্তির যে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী ব্যাখ্যাটি হাজির করতে পারি তা হল, ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় বস্তুজগতের গুনের পরিমানগত বৃদ্ধি গুণাত্মক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিকাশের স্তরের নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে এক নতুন গুণসম্পন্ন বস্তুর সৃষ্টি করে যার মধ্যে চেতনা পরিলক্ষিত হয়।এরূপ ক্ষেত্রে অজড় বস্তুতে উত্তরণের মধ্য দিয়ে জড় বস্তুটির নিরাকরণ ঘটে।


বিখ্যাত দার্শনিক এঙ্গেলসের উক্তি দিয়ে এই অধ্যায়ের শেষ করি, তিনি বলেছেন - “আমরা যে প্রত্যক্ষ বস্তুজগতের অন্তর্গত তাই একমাত্র বাস্তব। আমাদের চিন্তা বা চেতনাকে যতই ইন্দ্রিয়াতীত বলে মনে হোক না কেন, তাহা আসলে একটি বস্তুময় দৈহিক অঙ্গ মস্তিষ্কেরই উপপাদ। বস্তু চেতনার উপপাদ নয়, চেতনা নিজেই প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ উপপাদমাত্র”।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929