আমাদের চারিপার্শ্বের সব ঘটনাই লৌকিক, বাস্তবিক। অলৌকিক বলে কিছু হয় না, সবই লৌকিক। যৌক্তিক মননশীলতাতেই এটির স্বরূপ আমাদের মাঝে স্থাপিত হতে পারে।
আজ পর্যন্ত একজনকেও পেলাম না, যিনি নিজেকে ভাবেন ধর্মান্ধ।
প্রত্যেকে মনে করেন, অন্যে ধর্মান্ধ, অন্যে যুক্তিবাদের কিছু বোঝেন না, অন্যে স্বার্থপর। তিনি কিন্তু যুক্তির পরাকাষ্ঠা। যুক্তিবাদের ধারক বাহক। তিনি সংস্কারহীন, ধর্মান্ধতামুক্ত, সৎপথের অনুসরণকারী।
তিনি যে যুক্তিবাদী, তার প্রমাণ তিনি কুসংস্কার মানেন না। কুসংস্কার কাকে বলে? ঐ যে পরীক্ষার দিনে ডিম খেতে নেই। এর তিনি যুক্তিসম্মত কারণ আবিষ্কার করেছেন।
আবার আরেক ধরণের যুক্তিবাদী আছেন, তারা ডিম খেয়েও দেখেন, যে তাতে না কি পরীক্ষায় ভাল ফল করেছেন। যুক্তিবাদী এসব বালখিল্য পরীক্ষা করতে যাবেন?
একজন ভাবলেন যে সাপে কাটলে ওঝার মন্ত্র তন্ত্রে কোনো কাজ হয় না। সাপে কাটা রোগী তার হাতে মারা পড়ল। কাজেই ওঝার কাছে যাওয়াটা কুসংস্কার।
ভাল কথা, এবার চিন্তা করুন।
কাউকে সাপে কাটলো, তাকে ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো, কোনো কারণে, হতে পারে বিষহীন কামড় বা কামড়েও বিষ না ঢালা প্রভৃতি কারণে, বেঁচেও গেল। তাহলে কি ওঝাগিরি সায়েন্টিফিক হয়ে গেল? যুক্তিবাদে স্বীকৃতি পেয়ে গেল? সেইরকম, ডিমভক্ষণেও পরীক্ষালব্ধ ফল ভাল হলে ডিমভক্ষণও তো সায়েন্টিফিক হয়ে গেল, তাই না? এই যুক্তিতে ডিম খেয়ে পরীক্ষা দিতে গিয়ে ফেল করলে, ডিম না খেয়ে যাওয়ার প্র্যাক্টিসও তো তাহলে বিজ্ঞানসম্মত হয়ে যায়, তাই না?
আসলে যুক্তিবাদের কতকগুলি উপাত্ত আছে। যেগুলির একদিক বিচার করে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। সত্যে উপনীত হতে গেলে তার বিপরীত প্রান্তেও দৃষ্টিনিক্ষেপিত করার প্রয়োজন হয়। বলা ভাল, তার চারিদিক দেখতে হয়।
র্যাশান্যালিজম যেমন মানুষপ্রাণীর ধর্ম,
এ্যাণ্টির্যাশান্যালিজমও তেমনি মানুষপ্রাণীর মধ্যেই দেখা যায়। এজন্যই মানুষের মাঝে ধর্মপ্রাণদের অনেকে যুক্তিবাদী বলে মনে করেন। ভূতে অবিশ্বাসীদের যেমন যুক্তিবাদী ভাবা হয়, ভগবানে বিশ্বাসীদেরও তেমনই যুক্তিবাদী বলে স্বচ্ছন্দে মেনে নেওয়া হয়। অন্ধবিশ্বাসের মুখোশ হলো এ্যান্টির্যাশান্যালিজম যা অনেক সময়েই যুক্তিবাদের ছদ্মবেশে ঘোরাঘুরি করে।
যুগ যুগ ধরে ধর্মগুরুদের মিথ্যাচার সমাজে অসত্যকে সত্যের প্রতিষ্ঠা দেয়।
একটা উদাহরণ দিলে, বিষয়টি আরও স্পষ্ট হতে পারে। যেভাবেই হোক, একজন বিশেষ প্রতিষ্ঠা পেলেই, তার সমস্ত কাজের ভিত্তিতে যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠিত করার লোকের অভাব হয় না। এমনকি তার কাজের সমর্থনের পিছনে অলৌকিক কিছু ঘটনার অবতারণা করা হলেও শিক্ষিত সমাজে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরিবর্তে সমাদৃত হতে দেখা যায়, অথচ এই পৃথিবীর নিয়ম হলো অলৌকিক কিছু হয় না। এ জগতে অলৌকিকতার কোনো স্থান নেই। সমস্তই লৌকিক। একজন ধর্মগুরু প্রৌঢ় বয়সে বিয়ে করতে চান একটি বালিকাকে। এজন্য তিনি জানান এটি স্বয়ং ঈশ্বরের নির্দেশ। সমস্ত লোক তাকে সমর্থন করলেও, তিনি নিজে তো জানেন, কতবড় মিথ্যার আশ্রয় তিনি নিয়েছেন। তার অনুসরনকারীরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন তাঁকে দেখে অথচ তিনি নিজে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করলে, মানুষের সেই বিশ্বাসকে পুঁজি করে এইরকম মিথ্যাচার করতে পারতেন না। গুরু নিরীশ্বরবাদী হলেও শিষ্যরা কিন্তু ঈশ্বরে পুরোমাত্রায় বিশ্বাসী।
আসলে নিত্যনৈমিত্তিক কাজের মাধ্যমে এই বিশ্বাসের যাপন ঘটে চলে অষ্টপ্রহর। এর শিকড় আষ্টেপৃষ্ঠে জমাট বাঁধে ব্যক্তিমনে, জীবনে, জীবনশৈলীতে। তার থেকে বেরোনোর কথা তার মননে আসতেই পারে না। তখন তার এই মেকি মূল্যায়ণের সমর্থন খোঁজে তার ধর্মাদর্শে, তার ধর্মগ্রন্থে, ঠিক যেখানে শুরু তার ধর্ম প্রণেতার মিথ্যাচার, বৃত্ত যেখান থেকে শুরু হয়েছিল, বর্তমান উপস্থিত হয় ঠিক সেই বিন্দুতেই। এজন্য সমস্ত ধর্মের গ্রন্থেই মিথ্যাচার, অজ্ঞানতা, অনিষ্ঠা, অনীতিগুলি নির্মিত হলেও ধরা পড়ে না ভক্তের ভক্তিভিত্তিতে বেড়ে ওঠা জীবনাদর্শে। কী শিক্ষিত, কী অশিক্ষিত, এই যুক্তি-অন্ধত্ব সকলের মধ্যেই প্রকট। এই অন্ধকার ভেদ করে আলো আসতে দেরী আছে। অনেক দেরী আছে।
কাজেই এই সময়কে ধরাছোঁয়ার মধ্যে আনতে হলে, আমাদের জোর দিতে হবে মানুষের মন থেকে অলৌকিকতাবাদকে দূর করার কাজে। অলৌকিক যেখানেই খবর পাওয়া যাবে সেখানেই ছুটতে হবে।
সম্প্রতি আমি খবর পেলাম হুগলী জেলার প্রান্তে জিরাট কবুরা গ্রামে একটি ঝিল আছে, যেখানে না কি সন্ধ্যার পর পাম্পসেট চালানো যায় না। এমনকি দিনের বেলা চালিয়ে দিলেও সন্ধ্যা নামতে না নামতেই পাম্পসেটটি বন্ধ হয়ে যায় আপনা আপনিই। তো আমি আর কী করতে পারি, তাকে বললাম, আপনি নিজে দেখেছেন? উনি জানালেন, না উনি দেখেননি। এমনকি প্রত্যক্ষদ্রষ্টা কারুর নামও জানাতে পারলেন না। শেষে উনি নিজেই উপলব্ধি করলেন, এতদিন ঠিকমত খবর না নিয়ে উড়ো কথায় বিশ্বাস করে ভ্রান্ত ধারণায় ছিলেন। পাম্পসেট বন্ধ কেন হবে তার যুক্তিসঙ্গত কারণ আন্দাজ করতে পারলেন না। অলৌকিক উপায়ে হয়তো হতে পারে বলেই তার ধারণা। এবার অনুরোধ করলাম, তাহলে যারা দাবী করেন তাদের কাউকে আমাদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে বলুন। শত প্রচেষ্টাতেও একজনকেও পাওয়া গেল না, যিনি এই চ্যালেঞ্জ নিতে চান। অর্থাৎ এতদিন শোনা কথা শুনেই এসব অলৌকিকে বিশ্বাস করছিলেন তারা, কিন্তু চ্যালেঞ্জ নেওয়ার কথা উঠতেই কেউ রাজী হলেন না, কারণ তারা আসলে কেউই দেখেননি, শুধুমাত্র শুনেই বিশ্বাস করেছেন, যাচাই করে দেখেননি। বাস্তব পরীক্ষা নিরীক্ষা কথা উঠতেই স্বীকারই করে নিলেন, অমন আবার হয় না কি? হয়তো কোনো কারণে কারুর পাম্পসেট কোনো একবার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তার ভয়, তার অন্ধবিশ্বাস থেকেই গুজব রটেছিল, না যাচাই করেই এতদিন তারাও সেকথাই বলে চলছিলেন, আজ বুঝলেন এমন ঘটনার দাবী করাটা ঠিক নয়। এর কোনো বাস্তব ভিত্তিই নেই।
আমাদের যুক্তিবাদী আন্দোলনের প্রসারের কার্যধারায় তাই অলৌকিকতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলাটাই প্রাথমিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যেখানেই অলৌকিক কিছুর কথা জানা যাবে, বুঝিয়ে দিতে হবে এগুলো গুজবমাত্র, সত্য ভিত্তি নেই। চ্যালেঞ্জ নিতে বললেই তাদের উপলব্ধিতে আত্মীকৃত হবে যে আসলে অলৌকিক বলে কিছু হয় না। অলৌকিক ছিল না, অলৌকিক থাকবেও না। ধর্মগুরুদের অলৌকিক কাজগুলি আসলে কৌশলের আশ্রয়ে বাস্তব কোনো উপায়েই সম্পাদন করা। অর্থাৎ প্রতিটি অলৌকিক কাজের পিছনেই আছে লৌকিক প্রকৌশল, বাস্তব কারণ, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় তার স্বরূপ অনুধাবন করাটাই একমাত্র সঠিক পথ।
যুক্তিবাদী আন্দোলনে তাই অলৌকিকতাবাদকে মানুষের মন থেকে মুছে দেওয়ার জন্য বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা, ঘটনাগুলি যেখানে যেখানে করে দেখানো সম্ভব, সেখানে সেখানে লৌকিক উপায়টি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়াই পথ।
যুক্তিবাদের তাই নীতি: অলৌকিক নয়, লৌকিক।