ড. বিপান চন্দ্র বলেছেন, “Rammohan Roy was the brightest star in the Indian sky dring the first half of the 19th century.” (মডার্ণ ইন্ডিয়া, পৃষ্ঠা - ১২৮)
সত্যিই তাই, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, ভারতের নবজাগরণের অগ্রদূত রাজা রামমোহন রায় ছিলেন ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতের আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। এটা ঠিক যে তিনি ধর্মীয় প্রভাব মুক্ত চেতনার অধিকারী নন, কিন্তু তিনিই প্রথম ভারতীয়, যিনি নির্ভয় ধর্মীয় কুসংস্কার, পৌত্তলিকতা, আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্বতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ভাবজগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন। তাঁর কাজেও সেই ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে।
কে জানত সম্ভ্রান্ত নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ রামকান্ত রায়ের মধ্যম পত্নী তারিণীর কণিষ্ঠ পুত্রটি ভারতের নবজাগরণের অগ্রদূত হয়ে উঠবেন! পূর্বপুরুষ কৃষ্ণকান্ত ছিলেন রাজকর্মচারী। সেই সূত্রে তাঁদের পদবী রায় হয়। পনেরো-ষোলো বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করেন। তাঁর এই গৃহত্যাগের পিছনে ছিল নিষ্ঠাবান পিতার সাথে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার দ্বন্দ্ব।
তিনি নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কার নামে জনৈক সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের কাছে সংস্কৃত শেখেন। এছাড়া তিনি ইংরেজি, গ্রীক, ফরাসি, আরবি, হিব্রু প্রভৃতি ভাষাতেও ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন ডিগবির সাথে পরিচিতির সুবাদে তিনি দেওয়ান পদে কর্মরত হন। কর্মসূত্রে তিনি বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন। সেখান থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। ইংরেজি ভাষায়ও বিশেষ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। এইবার শুরু হল তাঁর প্রকৃত লড়াই।
কলকাতার প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, রাজচন্দ্র দাস, রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার প্রমুখের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে রামমোহনের। এইসকল ব্যক্তিদের নিয়ে গড়ে তোলেন আত্মীয় সভা (১৮১৫)। একেশ্বরবাদের প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসভা গড়ে তুললেন, যা দুবছর পর ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজ নামে পরিচিত হয়। ব্রাহ্ম সমাজ যে ধর্মমতে বিশ্বাস করতে শুরু করে তা হল ব্রাহ্ম ধর্ম। নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা করেন ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বীরা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সকল ধর্মাবলম্বী মানুষের জন্য ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণের সুযোগ ছিল। একেশ্বরবাদী ভাবধারা প্রসারে তিনি ফরাসি ভাষায় লেখেন তুয়াফৎ উল মুয়াহিদ্দিন গ্রন্থটি। এছাড়া ঈশ, কঠ,কেন, মন্ডুক,ও মান্ডুক্য নামক উপনিষদের অংশ বঙ্গানুবাদ করেন। প্রতিষ্ঠা করেন বেদান্ত কলেজ।
ছেলেবেলায় দাদার মৃত্যুর পর মাতৃসমা প্রিয় বৌদিদির সহমরণে ব্যথিত রামমোহন প্রতিজ্ঞা করেন যে সহমরণ প্রথার বিরুদ্ধে তিনি লড়বেন। এই প্রথা তিনি বন্ধ করবেনই। তিনি সাধ্যমত বল ও যুক্তিপূর্ণ তর্ক দ্বারা সহমরণে বাধা দিতে থাকেন।
সহমরণের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি ‘প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। রক্ষণশীল সমাজ পাল্টা ‘বিধায়ক ও নিষেধকের সম্বাদ’ রচনা করলে রামমোহন এই বিষয় আরও দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। এরপর তিনি দ্বারকানাথ-সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি স্মারকলিপি বড়োলাটের নিকট পেশ করেন। পাল্টা রক্ষণশীল সমাজ সহস্রাধিক ব্যক্তির স্বাক্ষর সম্বলিত একটি প্রতিবাদ পত্র পেশ করে। অবশেষে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেটিঙ্ক ১৭ নম্বর রেগুলেশন দ্বারা সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। রামমোহনের জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি লেখা হয় ইতিহাসে। ছেলেবেলার প্রতিজ্ঞা পূরণ করলেন তিনি।
রামমোহন গৌড়ীয় ব্যাকরণ, বেদান্তগ্রন্থের মত বেশকিছু গ্রন্থ রচনা করেন। বাংলায় ‘সম্বাদ কৌমুদী’ ও ফরাসি ভাষায় ‘ মীরাৎ-উল-আকবর ‘ নামে দুটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার স্বপক্ষে তিনি আন্দোলন গড়ে তোলেন। শুধু তাই নয়, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য, দেশীয় পণ্যের ওপর অধিক পরিমাণে শুল্ক আরওপ, মজুরি আইন, বিচার বিভাগীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। ইংরেজ শাসনের সময়েও তিনি ইংরেজ রাজকর্মচারীদের অসদাচরণের প্রতিবাদ জানাতে কখনও দ্বিধা করেননি।
রাজা রামমোহন রায় ছিলেন পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান ও ইংরেজি ভাষায় শিক্ষার সমর্থক। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড আর্মহার্স্টকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি এ দেশে গণিত, প্রকৃতিবিজ্ঞান, রসায়ন ও পাশ্চাত্য দর্শন শেখানোর দাবি জানান। জেনারেল অ্যাসেম্বলি ইনস্টিটিউশন (স্কটিশ চার্চ কলেজ) হেয়ার স্কুল-সহ বেশকিছু ইংরেজিমাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠায় তাঁর পরোক্ষ সহযোগিতা ছিল। বেদান্ত কলেজের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত ছিল পদার্থবিদ্যা ও সমাজবিজ্ঞান।
রাজা রামমোহন রায়ের মূল্যায়ন করতে গিয়ে কোনও কোনও ঐতিহাসিক তাঁর সীমাবদ্ধতার উল্লেখ করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে স্ব-বিরোধিতার অভিযোগ এনেছেন। তাদের সেই মূল্যায়ন সম্পূর্ণ অযৌক্তিক নয়, তবে সেসবের খুব সামান্যই গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।
রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল ব্রাহ্মসমাজ। নারীর শিক্ষা ও স্বাধীনতা রক্ষার আন্দোলন, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ রদ, অসবর্ণ বিবাহ প্রচলনের আন্দোলনের পথ প্রদর্শক ছিলেন তিনি। এদেশে পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা ও ইংরেজি শিক্ষার সূচনা তারই ঐকান্তিক উদ্যোগের ফল।
“Rammohan Roy inaugurated the modern age in India” রবীন্দ্রনাথের উক্তিটি যথার্থ।