রিচার্ড ডকিন্সের একটি ইন্টারভিউ
সম্পাদক
Nov. 20, 2024 | | views :783 | like:2 | share: 2 | comments :0
রেডিও অনুষ্ঠানের সঞ্চালক: ঈশ্বর তো অপ্রমাণিত হননি। তাহলে কোন যুক্তিতে "ঈশ্বর নেই বলছেন"।
রিচার্ড ডকিন্স: সে তো পরী বা ইউনিকর্ন কিছুই অপ্রমাণিত হয়নি। কিন্তু বিশ্বাস করার স্বপক্ষে কোনও কারণও দেখছি না, তাই বিশ্বাস করি না।
['ইউনিকর্ন' পক্ষীরাজের মত এক কাল্পনিক এক শিংওয়ালা ঘোড়া]
সঞ্চালক: সম্ভবনার কথা তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাহলে আপনি নিজেকে অ্যাগনোস্টিক বা অজ্ঞেয়বাদী বলেন না কেন?
ডকিন্স: ওরকম অদ্ভুত কথা বলতে যাব কেন? তাহলে তো বলতে হয় পক্ষীরাজ ঘোড়া বা হুরী-পরীও সত্যি আছে কিনা আমি জানি না। সম্ভবনার কথা যদি বলেন, তাহলে ঈশ্বর নামক কেউ (কোনও মহিলা, পুরুষ বা বস্তু) আবিষ্কৃত হওয়ার সম্ভবনা এতই কম, যে শতকরা হিসেবে একেরও নীচে, শূন্যই বলা যায়। তাই অজ্ঞেয়বাদ-টাদ না বলে, নিরীশ্বরবাদ-ই সঠিক বলে মনে করি।
টেলিফোনে এক দর্শক: ধর্ম সমাজের উপকার করে, একথা তো মানেন?
ডকিন্স: ধর্মবিশ্বাস সমাজ প্রচুর ক্ষতি, প্রচুর রক্তপাত ঘটিয়েছে। সমাজের উপকার করেছে কোনও সময়, একথা মানলে প্রমাণ হয় না যে ঈশ্বর বলে কিছু আছে। বরং ধর্মের নামে অনেক ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে। এটা তো দেখাই যাচ্ছে।
দর্শক: নাস্তিকরা সমাজের অনেক ক্ষতি করেছে। যেমন হিটলার, স্ট্যালিন। কত হত্যা করেছে।
ডকিন্স: স্ট্যালিন যা করেছেন, তা নাস্তিকতার নামে করেননি। তিনি এক রাজনৈতিক মতাদর্শের বশবর্তী হয়ে করেছিলেন। আর হিটলার তো রোমান ক্যাথলিক ছিলেন, নাস্তিক আবার কোথায়? তিনি 'এথেনিক ক্লেনজিং' বা জাতিগতভাবে হত্যা করে একটি জাতিকে নির্মূল করাতে বিশ্বাসী ছিলেন।
এরপর বেশ মজা হল। ডকিন্স যেই বলতে লাগলেন হিটলারের কথা, বিশদভাবে ওঁর ইহুদিদের প্রতি জাতিঘৃণা, একটি বিশেষ ধর্মগোষ্ঠীর প্রতি গোঁড়া মনোভাবের কথা, টেলিফোনের বক্তা বলে উঠলেন — "যাই হোক, একজন হিটলার তো কিছু প্রমাণ করে না। কত ধার্মিক মানুষ আছেন যারা সৎ...."
তখন ডকিন্স হাসতে হাসতে বললেন — 'হিটলারের কথা তো আপনিই তুলেছিলেন, আমি না। আমিও তো বলছি কোনও বিশেষ নাস্তিক মানুষ যদি অন্যায় কাজ করেও থাকেন, তাতে প্রমাণ হয় না, নাস্তিকতা ভ্রান্ত বিশ্বাস। বরং ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি বহু ধার্মিক বন্ধু আছেন, যাঁরা আদ্যোপান্ত ভালো মানুষ। এতেও ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ হয় না।
এরপর মধ্যপ্রাচ্যের একজন মহিলা ফোনে অনেকক্ষণ কথা বললেন। ডকিন্স সাহেবের বইকে এবং ওঁর নাস্তিকতা প্রচারকে আপত্তিজনক বললেন। তাতে ডকিন্সের প্রতিক্রিয়া —
ডকিন্স: আপনি কি মনে করেন কারোর ব্যক্তিগত মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই?
মহিলা: না, তা নয়।
ডকিন্স: আপনি যেমন আপনার মতে চলেন ও আপনার বিশ্বাস প্রচার করেন, আমিও আমার বিশ্বাস প্রচার করতে পারি তো?
মহিলা: হ্যাঁ, কিন্তু আপনার 'ঈশ্বর নেই' এসব বলাতে আমার ঘোর আপত্তি, আপনি এটা করতে পারেন না। আমি আপনার কথা মানি না (উত্তেজিত)
ডকিন্স: আপনি আমার বইটা পড়েছেন? (দ্য গড ডিল্যুশন)
মহিলা: না।
ডকিন্স: তাহলে আপনার কী করা উচিৎ? বইটা পড়ে আমাকে বলুন — 'এই জায়গাটা আমার ভালো লাগেনি', 'এটা আপনি ভুল লিখেছেন' ...ইত্যাদি। না পড়েই শুধু মানি না, মানি না বলে চেঁচালে হবে?
মহিলা: চুপ।
এরপর আরেকজন (সম্ভবত পাদ্রী) বললেন, 'আমি শুনেছি যে, আপনি নাকি বলেছেন শিশুদের ধর্মাচারণ করানো শিশুদের প্রতি অন্যায়, অত্যাচার? এমনকি তা নাকি 'শিশু নির্যাতন' - এর পর্যায়ে পড়ে?
ডকিন্স: না, ভুল শুনেছেন। আমি বলেছি শিশুদের বোঝবার বয়স হবার আগেই ধর্মীয়-ছাপ্পা মেরে দেওয়া, তাদের কোনও বিশেষ ধর্মগোষ্ঠীর তকমা লাগিয়ে দেওয়া ভুল। অবশ্যই শিশুদের সমস্ত ধর্ম সম্পর্কে জানা উচিৎ। ধর্মের ইতিহাস তো মানব সভ্যতারই ইতিহাস। সমস্ত ধর্মবিশ্বাস সম্বন্ধে জেনে বুঝে বড় হয়ে ইচ্ছে হলে সে একটি বিশেষ ধর্মকে বেছে নেবে বা কোন ধর্মই নেবে না। আর একটা কথা, ধর্মের নামে ভয় দেখানোটা অবশ্যই 'শিশু নির্যাতনের' মধ্যে পড়ে। আমার অনুরোধ শিশুদের কখনোই পাপ, নরক, নরকের অগ্নিকুন্ড ইত্যাদির ভয় দেখাবেন না। এটা অন্যায়।
এরপর সঞ্চালক জিজ্ঞেস করলেন, ধর্ম ছাড়া পৃথিবী কেমন হবে? তা কি কখনও আসবে?
ডকিন্স: নিশ্চয়ই আসবে। ধীরে ধীরে মানুষ সত্যিটা বুঝতে পারলে ক্রমশ ধর্মের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাবে। সৎ হতে হলে, ভালো মানুষ হতে হলে ধার্মিক বা ধর্মবিশ্বাসী হতে হয় না। তবে ধর্ম সম্বন্ধে পড়াশোনা করা দরকার। মানব সভ্যতার ইতিহাস আর ধর্মগুলো অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। এগুলো না জানলে ইতিহাস, সাহিত্য ইত্যাদির রসগ্রহণ করা যাবে না শেক্সপিয়ার কি বোঝা সম্ভব, ধর্মের ইতিহাস না জেনে?
"তুলনামূলক ধর্মশিক্ষা তাই ইতিহাসের অংশ"।
শেষে একজন ফোনে জিজ্ঞেস করলেন — যদি কখনও ঈশ্বরের দেখা পান, তখন কি করবেন? 'সরি' বলবেন? বলবেন 'আমার ভুল হয়েছিল?'
ডকিন্স: কার কথা বলছেন? কোন ঈশ্বর? জিউস? আল্লা? হিন্দুদের শিব? কার দেখা পাবো? হাসতে হাসতে বললেন 'ঐ যে বললাম, এরকম হওয়ার সম্ভবনা এতই কম যে হিসাবের মধ্যেই আসে না'।
প্রশ্নকর্তা: এই সৃষ্টি! এর তো একটা সৃষ্টিকর্তা আছে। সব কিছুরই একটা রূপকার বা স্রষ্টা থাকে।
ডকিন্স: 'সে প্রশ্ন এতদিন ছিল। এখন ডারউইন এর "ন্যাচারাল সিলেকশন" থিওরিতে তো পরিস্কার হয়ে গেছে সৃষ্টির আদি রহস্য। যদি স্রষ্টা থাকে, তাহলে তো স্রষ্টারও স্রষ্টা আছে। তিনি কে? এর তো কোনও শেষ নেই। তর্কের খাতিরে যদি 'ঈশ্বরের' দেখা পাই আপনার কথামত, তাঁর কাছে জানতে চাইব বিজ্ঞানের এখনও অজানা কিছু তত্ত্ব ও তথ্য। আশাকরি তিনি (সেই মহিলা বা পুরুষ বা বস্তু) বলতে পারবেন তার উত্তর।
এটি ছিল একটি রেডিও অনুষ্ঠানে রিচার্ড ডকিন্সের প্রশ্নোত্তর পর্ব।
রিচার্ড ডকিন্স হলেন পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত নিরীশ্বরবাদী এবং ডারউইনের যোগ্য উত্তরসূরি। ওঁর দলে আরও আছেন — ক্রিষ্টোফার হিচেন্স সাহেব, যিনি মাদার টেরিজাকে নিয়ে নির্মোহ আলোচনা করে বিখ্যাত হয়েছিলেন।
রিচার্ড ডকিন্স অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। বিষয়: "জনমানসে বিজ্ঞানচেতনার সঞ্চার / Public Understanding of Science"। ধার্মিক রোমান ক্যাথলিক, মুসলিম সমাজ ও সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের বিরক্তি, ঠাট্টা ও আক্রমণের শিকার হয়েছেন তিনি। পশ্চিমী মিডিয়া তাঁকে 'ডারউইনের পোষা হিংস্র কুকুর' অবধি বলতে কসুর করেনি।
রিচার্ড ডকিন্স জন্মেছেন কেনিয়ায়। নয় বছর বয়সে খেয়াল করেন পৃথিবীর সবাই খ্রিস্টান নয়। আরও নানারকম ধর্মবিশ্বাস, রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান আছে। প্রতেকে নিজের বিশ্বাসটাকেই সঠিক এবং চরম সত্য মনে করে। এটা বুঝতে বুঝতে বছর পনের যখন বয়স, তখন উপলব্ধি করেন যে, 'ব্যক্তিগত ধর্ম একটা অ্যাক্সিডেন্ট' বা কাকতালীয় ব্যাপার। উনি খ্রিস্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন, তাই খ্রিস্টান। নয়ত অন্য কিছু হতেন। ঈশ্বরের চেহারা বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্ন রকম। অতএব তা কল্পনা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।
ভাষান্তর- সুমিত্রা পদ্মনাভন