পৃথিবীতে অক্সিজেনের উৎপত্তি নিয়ে এক ফেসবুকের বন্ধু প্রশ্ন করেছিলেন। সেই সূত্র ধরেই অক্সিজেনের উৎপত্তি নিয়ে একটা কোয়ালিটেটিভ আলোচনা করছি। খুব বেশি টেকনিক্যাল জারগণের মধ্যে না গিয়ে অল্প কথায় বোঝাবার চেষ্টা করছি।
প্রশ্ন যদি এটা হয় পৃথিবীতে অক্সিজেনের উৎপত্তি কোথা থেকে বা কী থেকে? তার উত্তর হবে একটাই সেটা হলো জল থেকে। জলের একটি অণু যথাক্রমে দুটি হাইড্রোজেন ও একটি অক্সিজেন পরমাণুর সমন্বয়ে গঠিত। এবার জলের অণু ভাঙতে পারলেই আমরা অক্সিজেন পেয়ে যাব।
পৃথিবী সৃষ্টির পরে পরে যখন পৃথিবীতে কোন প্রাণ ছিল না তখন পৃথিবীতে অক্সিজেন অণু এসেছে সূর্যালোকের উপস্থিতিতে জলীয়বাষ্পের বিয়োজনের জন্য যেটাকে আমরা ইংরেজিতে photo dissociation of water molecule বলি। পৃথিবীর প্রথমদিকে বায়ুমন্ডলে ওজোন স্তর ছিল না কারণ অক্সিজেনও ছিল না ফলে অতিবেগুনি রশ্মির জন্য জলীয় বাষ্প ভেঙে অক্সিজেন উৎপত্তি হয়। সময়ের সাথে সাথে খুবই ধীরে ধীরে বাতাসে অক্সিজেন অণুর পরিমাণ বাড়তে থাকে। অতিবেগুনি রশ্মির উপস্থিতিতে জলের বিয়োজন পদ্ধতি একটি ধীর পদ্ধতি। যদিও অনেক সময় পাওয়ায় (কোটি বছর) বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ ওজোন স্তর সৃষ্টি ও প্রাণীর উৎপত্তিতে ভূমিকা রাখার জন্য যথেষ্ট হয়। পরে যখন সালোকসংশ্লেষকারী ব্যাকটেরিয়া বা অণুজীবের উৎপত্তি হয় ক্লোরোফিল অণুর উপস্থিতিতে সূর্যালোক থেকে শক্তি ধরে জল বিয়োজনের ফলে অক্সিজেনের উৎপাদন আলাদা এক মাত্রা ধারণ করে। খুব সরলভাবে বললে অতিবেগুনি রশ্মির উপস্থিতিতে জলের photo dissociation cross section এর মান খুব বেশি নয়, ফলে এটি একটি ধীর পদ্ধতি। অন্যদিকে ক্লোরোফিলের উপস্থিতিতে জল বিয়োজন পদ্ধতির হার অনেক দ্রুত। যার ফলস্বরূপ আমরা বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের যা পরিমাণ দেখি তা সমুদ্রে উপস্থিত ক্লোরোফিলধারী বিভিন্ন অণুজীবরা দায়িত্ব নিয়ে উৎপাদন করে বহুকোষী প্রাণ সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।
এইতো মোটামুটি খুব হালকাভাবে বোঝা গেলো পৃথিবীতে অক্সিজেনের উৎপত্তির কারণ। এইবার মনে প্রশ্ন আসে যে পৃথিবীতে জল এলো কোথা থেকে?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আমাদেরকে পৃথিবী সৃষ্টির আগের মুহূর্তে যেতে হবে। সৌরজগৎ সৃষ্টির সবথেকে ভালো ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন বিখ্যাত গণিতবিদ ও পদার্থবিদ Pierre-Simon, marquis de Laplace, তিনিই প্রথম নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রকে অন্যভাবে উপস্থাপন করেন এবং বলের ধারণাকে পাল্টে মহাকর্ষ ক্ষেত্রের ধারণা দেন। তিনি সৌরজগৎ উৎপত্তির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিখ্যাত নেবুলার স্বীকার্যের (nebular hypothesis) জন্ম দেন। এই নেবুলার স্বীকার্য যা এখন মোটামুটি ভাবে একটি তত্ত্বে উপনীত ও বিজ্ঞানী সমাজে সর্বজনবিদিত। এই স্বীকার্য অণুসারে আদি সৌরজগৎ একটি গ্যাস ও ধূলিকণার ঘূর্ণায়মান চাকতি ছিল, বিভিন্ন অংশ মাধ্যাকর্ষণের জন্য একত্রিত হয়ে সূর্য ও যথাক্রমে অন্যান্য গ্রহ সৃষ্টি করেছিল। এইবার আমরা যদি গ্যাস ও ধূলিকণার উপাদানের দিকে তাকাই এই উপাদানের মুখ্য অংশ হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম এবং এর সাথেও অল্প পরিমানে উপস্থিত থাকে বিভিন্ন সরল জৈব, অজৈব যৌগসমূহ ও ক্ষুদ্র বরফকুচি ও জলীয় বাষ্প। গ্যাসের চাকতি থেকে পৃথিবী সূর্য অন্যান্য গ্রহ সৃষ্টি হওয়ার সময় প্রচুর পরিমাণে বড় বড় বরফের চাঁই সৃষ্টি হয় যার কিছু অংশ এখনও ধূমকেতু হয়ে এবং rockey object হয়ে asteroids belt-এ ঘুরে বেরাচ্ছে। পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম দিকে এই বড় বড় বরফের উল্কা পৃথিবীতে এসে পড়ে এবং পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল জল যুক্ত করে। পরে পৃথিবী শীতল হলে এগুলো ঘনীভূত হয় সমুদ্রের সৃষ্টি করে। এই গেল মোটামুটি হালকা ভাবে পৃথিবীতে জলের উৎপত্তি।
এখানে একটা ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয় Napoleon যখন Laplace এর কাজ দেখে জিজ্ঞাসা করে যে আপনার এই গাণিতিক কাজে ঈশ্বরের জায়গা কোথায়? তখন তিনি যে বিখ্যাত উত্তর দেন সেটি হল
“Sir, I have no need of that hypothesis.”
(Napoleon asked Laplace where God fit into his mathematical work, and Laplace famously replied “Sir, I have no need of that hypothesis.”)
আমরা আবার প্রশ্ন করতে পারি সৌরজগতের শুরুর দিকে যে গ্যাসের চাকতি ছিল তাতে জল এলো কোথা থেকে?
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমরা তারার মৃত্যু নিয়ে কথা বলব। বড় বড় তারাদের আয়ু অসীম নয়, তা আমরা বলতে পারি আমাদের মানুষের আয়ুকালের সাপেক্ষে সত্যিই অসীম। তারাদের মধ্যস্থ জ্বালানি শেষ হলে একসময় তাদেরও মৃত্যু হয়। তারার ভিতরে সাধারণত হাইড্রোজেন হিলিয়ামে পরিণত হয় এবং নিউক্লিয় সংযোজন এর কারণে উৎপন্ন শক্তিতে তারা জ্বলতে থাকে। (এছাড়াও কার্বন-নাইট্রোজেন-অক্সিজেন চক্রের মাধ্যমে কিছু তারা শক্তি উৎপাদন করতে পারে এটি এখন আমরা আলোচনার মধ্যে আনছিনা)! এবার যখন তারার মধ্যে হাইড্রোজেন শেষ হয়ে আসে, তারা তাঁর তীব্র বেঁচে থাকার ইচ্ছার জন্য হিলিয়ামকেও সংযোজন করে অন্যান্য ভারী মৌল তৈরি করতে শুরু করে এবং এই পদ্ধতি চলতে থাকে যখন না সে লোহার নিউক্লিয়াস তৈরি করা শুরু করে। লোহা তৈরি হয়ে গেলে মৃত্যু পথযাত্রী তারার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকা হয়ে যায়। কারণ লোহা হল এমন একটি মৌল যাকে বেচারা তারা আর সংযোজন করে অন্য মৌলে রূপান্তরিত করতে পারে না। তার জীবন মোটামুটি ভাবে ওখানেই শেষ হয় এবং তারার ভর অণুযায়ী তারাদের মৃত্যু বিভিন্নভাবে হয় যার গভীরে যাচ্ছি না। কিন্তু মোটামুটি ভাবে বললে এরপরে বিস্ফোরণের মাধ্যমে তারার মৃত্যু হয় এবং তারা মধ্যস্থ বিভিন্ন মৌল ও গ্যাস মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। পরে ওই উপাদান সমূহ মহাকর্ষের কারণে একত্র হয় এবং বিভিন্ন গ্যাস, জৈব ও অজৈব যৌগ, জল, বরফ ইত্যাদি সমন্বিত গ্যাসের মেঘ তৈরি করে মহাকাশে ভেসে বেড়ায়। যেহেতু তারার বিস্ফোরণের ফলে উৎপন্ন গ্যাসে অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন ইত্যাদি সহ অন্যান্য মৌলসমূহ থাকে এবং শীতল হওয়ার সময় তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিক্রিয়া হয়ে যে সমস্ত উপাদান তৈরি হয় তা নতুন গ্যাস ও ধূলিকণার মেঘ তৈরি করে। মোটামুটি ভাবে এই হল মহাকাশীয় গ্যাসের মেঘে জল থাকার কারণ।
এইভাবে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে সময়ের চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে বিগ ব্যাং অব্দি চলে যেতে হবে, যার সম্পর্কে জ্ঞান আমার একদমই নেই তাই এই গল্প এখানেই শেষ করে নোটে গাছ মুড়িয়ে পালাচ্ছি।
বিশদে জানতে আমি একটি বই সাজেস্ট করব। সেটি হল Carl Sagan’s এর লেখা Pale Blue Dot।