রামকৃষ্ণের পুনর্জন্ম, একটি যুক্তিবাদী অনুসন্ধান
অভিষেক ঘোষ
May 20, 2025 | | views :3 | like:0 | share: 0 | comments :0
প্রথম পর্ব:
দক্ষিণেশ্বরের পুরোহিত গদাধর, রামকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, স্ত্রী সারদাদেবীকে বলেছিলেন, একশ বছর পর আবার আসবেন অর্থাৎ তাঁর পুনর্জন্ম হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে সারদাদেবী বলেন “ঠাকুরের থাকবে সন্ন্যাসীর বেশ। তিনি যে বাউল বেশে আসবেন বলেছেন। বাউলবেশ - গায়ে আলখাল্লা, মাথায় ঝুঁটি, এতখানা দাড়ি। বললেন, বর্ধমানের রাস্তায় দেশে যাব, পথে কাদের ছেলে বাহ্য করবে, ভাঙা পাথরের বাসন হাতে, ঝুলি বগলে।” কথাগুলি প্রকাশিত হয়েছে উদ্বোধন কার্য্যালয় এর শ্রীশ্রীমায়ের কথায়।
আমরা শুনেছি, ভক্তরা বলে থাকে ব্রহ্মবাক্য নাকি মিথ্যা হবার নয়। তারপর আস্ত ভগবান অবতারদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ গদাধরের বাক্য কখনও মিথ্যা হতে পারে একথা তো ভাবাই বাতুলতা!
আমরা যুক্তিবাদী। সব কিছু যুক্তি ও প্রশ্ন দিয়ে যাচাই করা আমাদের কাজ। তা গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর হয়েছে ১৮৮৬ সালে। অবতারবরিষ্ঠ গদাধরের কথা সেই সঙ্গে ‘জগৎমাতা’ সারদার কথা যদি ব্রহ্মবাক্য হয় তাহলে একশো বছর, অর্থাৎ কিনা ১৯৮৬ সালে তাঁর পুনর্জন্ম হবার কথা। এবং বাউলবেশে, ঝুলি বগলে, বর্ধমানের রাস্তায় ঘুরে বেড়াবার কথা। আজকে ২০২৩ এ তাঁর বয়স হওয়া উচিৎ ৩৭ বছর। কই,আজ পর্যন্ত তো এরকম কোন বাউলকে দেখা গেল না!
এ তো গেল গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের নিজমুখে পুনর্জন্ম নেবার প্রথম অঙ্গীকার। দ্বিতীয় অঙ্গীকারও তিনি করেছেন কিন্তু! অন্নদাঠাকুর, স্বপ্নজীবন গ্ৰন্থে লিখেছেন রামকৃষ্ণ তাকে বলেছেন - “তোমার ভয় নেই, দেহরক্ষার বত্রিশ বছর পর আমি আবার বাংলায় যাচ্ছি। সেই দেহরক্ষার সত্তর বছর পর আবার, এইভাবে আরও এগারো বার অবতীর্ণ হব।” রামকৃষ্ণর এত নিকট ভক্তকে দেওয়া তাঁর কথা কি মিথ্যা হতে পারে! সেই হিসেবে ১৮৮৬ + ৩২ অর্থাৎ ১৯১৮ সালে রামকৃষ্ণের পুনর্জন্ম হবার কথা এবং বর্তমানে তাঁর বয়স হওয়া উচিত নয় নয় করে ১০৫। (কত বছর বেঁচে থাকবেন বলেননি,অবতার মানুষ সবই সম্ভব।)
রামকৃষ্ণ মিশনকে তো এখনও পর্যন্ত তাদের পরম আরাধ্যের নবকলেবর খোঁজার জন্য বিন্দুমাত্র তাগিদ নিতে দেখা গেল না! কারণ কী? রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষ কি স্বয়ং রামকৃষ্ণদেবের কথায় বিশ্বাস করে না? নাকি নব্য জ্ঞানের আলোকের তাঁরা পুনর্জন্ম, জন্মান্তর এসব কিছুতে আস্থা হারিয়েছে? দ্বিতীয়টি least possible, কারণ মিশন কোন ছার জগতের কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই আত্মা, পরলোকবাদ, জন্মান্তরের কথা না বলে নিজেদের ধর্মপ্রচার চালাতে পারবে না। ধর্ম জিনিসটাই দাঁড়িয়ে আছে ইহলোক পরলোক, পাপের ভয়, জন্মান্তরের সুখের ওপর। তাহলে কি প্রথমটিই ঠিক? অবশ্য আরেকটা কারণ হতে পারে মিশন প্রকাশিত বইগুলি মিশনের লোকজনই ভাল করে পড়ে দেখেনি! নাহ, এটাও মনে হয়না। এগুলো পাঠক্রমের অধ্যবসায়ে ওদের পড়তে হয়। তাহলে দাঁড়াল কী? মিশন সব জেনেও, না জানার ভান করে আছে। যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষ লিখছেন - “সারদা মা’র প্রতি রামকৃষ্ণদেবের এই ধরণের বক্তব্যকে বর্তমানে মিশন কর্তৃপক্ষের কাছে অসার মনে হলে মিশন কর্তৃপক্ষের কি নৈতিক দায়িত্ব ছিল না, এই বিষয়ে মতামত স্পষ্টভাবে ভক্তদের কাছে ব্যক্ত করা? নাকি রামকৃষ্ণদেবের নবকলেবর আবির্ভাব বিষয়ে নীরবতার পিছনে ক্রিয়াশীল রয়েছে অর্থ ও কর্তৃত্ব হারাবার শঙ্কা?”
একবার ভেবে দেখুন রামকৃষ্ণ যদি হঠাৎ এই তৃণমূল-বিজেপি অলঙ্কৃত বাংলায় আবির্ভূত হয়ে মিশনের যাবতীয় সম্পত্তির (ইনটেলেকচুয়াল ও ফিজিকাল) অত্যন্ত সঙ্গত অধিকার দাবি করে বসেন তাহলে কী কী হতে পারে! তাই কি মিশন কর্তৃপক্ষ উক্ত ভবিষ্যতবানীটি নিয়ে কথা বলতে নারাজ?
১৯৮৯ সালের ২৭ আগস্ট প্রবীর ঘোষ গিয়েছিলেন বেলুড় মঠে স্বামী ভূতেশানন্দের কাছে এবং এই প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাতে উত্তরের পরিবর্তে তিনি উষ্মা প্রকাশ করেন, তাঁর সচিব উন্মত্তের মত রাগ প্রকাশ করে প্রবীর ঘোষের ওপর। সম্ভবত সব ভক্তিবাদী যুক্তিহীনদের মতই উত্তর দিতে না পারার ব্যর্থতা ক্রোধ হিসেবে প্রকাশ পায়।
দ্বিতীয় পর্ব:
সারদাদেবী ও অন্নদা ঠাকুরকে দক্ষিণেশ্বরের পূজারী বামুন রামকৃষ্ণ বলেছিলেন তিনি আবার জন্ম নেবেন। হ্যাঁ সময়ের হেরফের ছিল, কিন্তু জন্ম যে নেবেন এ’কথা স্থিরনিশ্চিত। রামকৃষ্ণের নামে চলা সংস্থা, রামকৃষ্ণ মিশনের এই নিয়ে কোনরকম মাথাব্যথা দেখি না। অন্য কথায় স্বয়ং রামকৃষ্ণকথিত ব্রহ্মবাক্যকেই তারা অগ্ৰাহ্য করেছে, এবং রামকৃষ্ণের নবকলেবর সন্ধানে সচেষ্টতা দেখায়নি।
রামকৃষ্ণের নবজন্ম নিয়ে মিশন মাথাব্যথা না করলেও অনেকেই কিন্তু করেছে। ১০ জুলাই ১৯৮৭ সালে যোগী যোগানন্দ সর্বতীর্থ নামে এক ব্যক্তি, বর্ধমানের একজিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে এক এফিডেবিট করে দাবি করেন - “ যুগাবতার শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব লীলা সংবরণ করার পর পুনরায় নবকলেবরে সপার্ষদ একশত বৎসর গতে অবতীর্ণ হওয়ার বৃত্তান্ত আমি অপ্রাকৃতিক জ্ঞানচক্ষু দ্বারা প্রত্যক্ষ করিয়াছি এবং তাহাদের বর্তমান স্থুল শরীরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কোন ব্যক্তি বা সংস্থা গ্ৰহণ করলে আমি তাঁহাদের শনাক্ত করিতে সক্ষম, ইহা আমার জ্ঞান মতে সত্য।”
শুধু এফিডেবিট করে থেমে না থেকে তিনি চিঠি লিখেছেন মিশনের গম্ভীরানন্দকে। যোগানন্দের কথায় তিনি দৈব আদেশে রামকৃষ্ণের ইচ্ছা অনুযায়ীই জনগণকে জানাতে চান রামকৃষ্ণ সপার্ষদ জন্মেছেন। তিনি নিজে নাকি গতজন্মে ছিলেন রামকৃষ্ণ পার্ষদ লাটু /অদ্ভুতানন্দ। গানন্দ, মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়াও কলকাতায় প্রবীর ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন যাতে তিনি যুক্তিবাদী সমিতিকে সঙ্গে নিয়ে এই বিষয়ের তদন্তে নামেন।
বলা বাহুল্য তাঁর এই ‘মহতী’ প্রয়াসে রামকৃষ্ণ মিশন গা করেনি।
অন্য এক ব্যক্তি, ইনিও বর্ধমানের বাসিন্দা, যোগী তিমিরবরণ, রামকৃষ্ণ মিশনের সভাপতির কাছে এক লিখিত আবেদন রাখেন, ১৬ নভেম্বর, ১৯৮৭ তে। বিস্তারিত আবেদনটিতে আরও অনেক কথার সঙ্গে, তিনি বলেন রামকৃষ্ণ মিশন যদি মনে করে রামকৃষ্ণের বাক্য ব্রহ্মবাক্য তাহলে তাদের উচিত রামকৃষ্ণের পুনর্জন্ম বিষয়ে অনুসন্ধান করা। তিনি এও জানান, রামকৃষ্ণ কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর যেদিন পঞ্চবটীর ডাল ভেঙে আসনে পড়বে, সেদিন তিনি আবার জন্ম নেবেন,আজ ৬৫ বছর হল ডালটি ভেঙে পড়েছে কিন্তু কোন হিন্দু ধর্মাবলম্বীর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি খেদ প্রকাশ করেন এই বলে যে, “পুনরাবির্ভাবের যদি মূল্যায়ন না হয় তাহলে হয় রামকৃষ্ণ তত্ত্ব মিথ্যা, নয়তো মিশনের আধিকারিকরা দিব্যচক্ষুর অধিকারী নয়, অথবা হয়তো সব জেনেই তারা গদীর মোহে আকৃষ্ট থেকে ঠাকুরকে লোক সমক্ষে প্রতিষ্ঠা করছে না।”
প্রসঙ্গত পঞ্চবটীর ডাল ভেঙ্গে যাওয়া এবং রামকৃষ্ণের পুনর্জন্ম নেবার কথাটি অন্নদাঠাকুর তার আত্মজীবনী ‘স্বপ্নজীবনে’ও বলেছেন। রামকৃষ্ণের পুনর্জন্ম নিয়ে তদন্ত করতে প্রবীর ঘোষ বর্ধমান যান ১৯৮৯ সালে। আশ্চর্যজনক ভাবে এখানে উনি দু’জনের দেখা পান যাদের দাবি তারাই রামকৃষ্ণের পুনর্জন্ম!
প্রথমজন ভোলানাথ অধিকারী, জন্ম ১৯৩৪। একমুখ গোঁফ দাড়ি, কথায় গ্ৰাম্য ছোঁয়া। আলাভোলা ভাব। প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান - “রামকৃষ্ণ-ই যে রামকৃষ্ণ, সেটা আবার রামকৃষ্ণ কেই প্রমাণ করতে হবে! ভারি মজার তো! রামকৃষ্ণ মিশন! আমার নামে মিশন! ওরা তো সব মরছে গু ঘেঁটে। মরুক ওরা ক্ষমতা আর ভোগ নিয়েই। আমাকে নিয়ে গেলে ওদের সব এক একটাকে (ছাপার অযোগ্য)...”
দ্বিতীয়জন নীলমণি বন্দোপাধ্যায়। হোমিওপ্যাথি করেন। ইনিও বর্ধমানের বাসিন্দা। দরিদ্র। রামকৃষ্ণের মত দাড়ি। প্রশ্নের উত্তরে তাঁর গলাতেও একই সুর। “আমি যে গত জন্মে রামকৃষ্ণ ছিলাম এ’কথা প্রমাণ দিতে পারি। নিয়ে আসুন রামকৃষ্ণ মিশনের মাথাদের, আমার নাম ভাঙিয়ে যারা করে কম্মে খাচ্ছে। ওইসব ক্ষমতালোভী, অর্থলোভীগুলোকে আমি বিশ্বাস করি না। ওরা কখনওই আসবে না।” কথাপ্রসঙ্গে তিনি বলেন তিনি যে রামকৃষ্ণ তা জানিয়ে চিঠি লিখেছেন রাজীব গান্ধী, প্রণব মুখার্জি, বরুণ সেনগুপ্ত ইত্যাদিদের। তাঁর বাড়ির ছয় ফুট নীচে নাকি রয়েছে শিব মন্দির, তাতে শিবলিঙ্গ ও মোহর ভর্তি ছয়টা সোনার ঘড়া। বাড়ির দেওয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো তিনটি ছবি। ছবিতে দেখা যাচ্ছে উনি তন্ত্র, মুসলিম ও খ্রীস্টান মতে সাধনা করছেন। “মিশনকে জানাব, তারা এসে পরম সমাদরে ঘড়া সমেত আপনাকে নিয়ে যাবে” বলে বেরিয়ে পড়েন প্রবীর ঘোষ।
এখন যুক্তিবাদীদের খুব ছোট্ট একটি প্রশ্ন রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষের কাছে, “ব্রহ্মবিদ”, “অবতারবরিষ্ঠ” মিশনের পরমারাধ্য রামকৃষ্ণদেবের “দৈববাক্য” কে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে, মিশন কবে রামকৃষ্ণদেবের নবকলেবরকে ‘সপার্ষদ’ মিশনে এনে সশ্রদ্ধায় বরণ করবে? নাকি তারা আগের মতই প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়ে তাদের পরমারাধ্যেরই বাক্যে চূড়ান্ত অবিশ্বাস প্রমাণ করবে? জানার অপেক্ষা রইল।
সহায়ক গ্ৰন্থ;
১.স্বপ্নজীবন
২. অলৌকিক নয় লৌকিক চতুর্থ খন্ড