বাংলায় বিজ্ঞান অক্ষয়

সমূদ্র সেনগুপ্ত


Nov. 20, 2024 | | views :879 | like:0 | share: 0 | comments :0

বিদ্যাসাগর তাঁর লেখা "জীবনচরিত" বইটার পরিশিষ্ট অংশে "দুরুহ ও সঙ্কলিত নুতন শব্দের অর্থ" শিরোনামে একটি তালিকা দিলেন। এর মধ্যে বৈজ্ঞানিক পরিভাষা যেমন আছে, তেমনই অন্যান্য শব্দও আছে। দু চারটে নমুনা পেশ করা যাক। Botany (উদ্ভিদবিদ্যা), Optics (দৃষ্টিবিজ্ঞান), Telescope (দূরবীক্ষণ), Satelite (পারিপার্শ্বিক, উপগ্রহ) ইত্যাদি। একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, বঙ্কিম কথিত "টেক্সট বুক রাইটার" বিদ্যাসাগর মশাই কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকদের মধ্যে জনপ্রিয় বিজ্ঞান পাঠ প্রচারের জন্য এসব লেখেন নি, তার মূল লক্ষ্য কিন্তু সেই শিশু শিক্ষা। [সূত্র: সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ও অন্যান্য সম্পাদিত বিদ্যাসাগর গ্রন্থাবলী]

অক্ষয়কুমার দত্ত (যিনি ইংরেজিতে নিজের নাম লিখতেন Ukkhoy Coomar Dutt)-কে নিয়ে লিখতে গিয়ে বিদ্যাসাগরের নাম টেনে আনার কারণ হল ওনার কৃতজ্ঞতা স্বীকার। "পদার্থবিদ্যা: জড়ের গুণ ও গতির নিয়ম" বলে যে বইটি উনি লিখলেন শকাব্দ ১৭৭৮ সালে সেই বইয়ের মুখবন্ধে (বিজ্ঞাপন) উনি লিখছেন, "এই পুস্তক মুদ্রিত হইবার সময়ে শ্রীযুত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অমৃতলাল মিত্র মহাশয়েরা অনুগ্রহ পূর্বক দেখিয়া দিয়াছেন।" 

অক্ষয়কুমারের ভাষার ওপর বিদ্যাসাগরের প্রভাব সম্পর্কে যে জনশ্রুতি চালু আছে সেটি খন্ডন করতে গিয়ে কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য বলেছেন, "অক্ষয় দত্তের বাংলা রচনাতে ঈশ্বর গুপ্তর নিকট হাতে খড়ি হয়। তবে অক্ষয় দত্ত যে বরাবর গুরুর রচনা পদ্ধতি নকল করিয়াছিলেন তাহা নহে। তিনি খানিকটা বিদ্যাসাগরি রীতির দিকে আকৃষ্ট হইয়াছিলেন। কিন্তু তাহা বলিয়া বিদ্যাসাগরের ও মাছি মারা গোছের নকল করেন নাই। অক্ষয় দত্ত যে রূপ প্রতিভা সম্পন্ন ছিলেন, তিনি যে কাহারও নকলে চলিবেন, ইহা কোনোমতেই সম্ভবপর ছিল না। তাঁহার রচনায় ঔদার্য, অকপট আন্তরিকতা এবং মনের ভাব অকাতরে ব্যক্ত করিবার ক্ষমতা বাঙ্গালার অতি অল্প লেখকই প্রদর্শন করিয়াছেন" [সূত্র: পুরাতন প্রসঙ্গ]।

পদার্থবিদ্যা প্রসঙ্গে ফেরা যাক। ইংরেজি ভাষায় রচিত বিভিন্ন বই অবলম্বনে রচিত এই পুস্তিকাটি লেখার সময় অক্ষয় কুমার সেকালের রীতি অনুযায়ী সাধুভাষাতেই লিখলেন কিন্তু তাতে বামুনের ঘরের চাল কাঁচকলা সৈন্ধব লবণের গন্ধ প্রায় নেই বললেই চলে। একটু খানি পড়া যাক, "জড় পদার্থের যে গুণ থাকাতে, কোন দ্রব্য নষ্ট হয় না, তাহার নাম অনশ্বরত্ব। সকল বস্তুকেই পুনঃ পুনঃ বিভাগ করিয়া অত্যন্ত সূক্ষ্ম করা যাইতে পারে, কিন্তু তাহার কনামাত্রও কোন ক্রমে ধংস হয় না। জল, পারদ প্রভৃতি বস্তু বাষ্প হইয়া আমাদের অদৃশ্য হয় কিন্তু তাহার অণুমাত্রও একেবারে নষ্ট হইয়া যায় না। বাষ্প, জল ও বরফ এ তিনই এক পদার্থ; বরফ দ্রব হইয়া জল হয়, এবং জল উষ্ণ হইয়া বাষ্প হয়। বরফে যতগুলি পরমাণু থাকে, তাহা বাষ্প রূপে  পরিণত হইলে,সে বাষ্পে ও ততগুলি থাকে, তাহার একটি পরমাণুর ও ধ্বংস হয় না।"

আজ যদি আমরা লিখতে বসি, তাহলে এই অনুচ্ছেদের ক্রিয়াপদগুলোকে চলিত ভাষায় আর বড়জোর ওই "দ্রব" শব্দটা কে গলে যাওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু পাল্টাতে পারবো না, এতটাই ঝরঝরে ছিল অক্ষয়কুমারের ভাষা, এতটাই আধুনিক। মলিকিউল আর এটম এর পরিভাষা হিসেবে অনায়াসে অণু আর পরমাণু ব্যবহার করছেন উনি। বইয়ের অন্যত্র স্বর্ণ, রৌপ্য লিখলেও প্লাটিনামকে "প্লাটিনম" লিখছেন, কোনো উদ্ভট অপ্রচলিত পরিভাষা ব্যবহার করেন নি। 

পরিভাষা নিয়ে তাঁর এই অবদান কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় লিখছেন, "স্বর্গীয় অক্ষয়কুমার দত্ত ও ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সময় হইতে বাঙ্গালা ভাষায় বৈজ্ঞানিক সন্দর্ভ লিখিবার চেষ্টা হইতেছে। এ বিষয়ে উক্ত মহাত্মাদ্বয়ই প্রথম পথপ্রদর্শক।" [সূত্র: শক্তিব্রত ভৌমিক সম্পাদিত: আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রচনা সংকলন]। 

ওই প্ল্যাটিনম এ একটিবার ফেরত আসা যাক। এবিষয়ে দত্ত মশাই এর উত্তরসুরি রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, "বারবার ব্যবহারের দ্বারাই শব্দ বিশেষের অর্থ আপনি পাকা হয়ে উঠে, মুলে যেটা অসঙ্গত, অভ্যাসে সেটা সঙ্গতি লাভ করে" [সূত্র: মানস প্রতিম দাস: বাংলায় বিজ্ঞানের পরিভাষা ও অক্ষয় কুমার দত্ত]। রাজশেখর বসুও এই কৃত্রিম পরিভাষা আমদানির বিপক্ষে ছিলেন। তাঁর মত অনুযায়ী অক্সিজেন এর বদলে অম্লজান লিখলে ভাষা মোটেও পুষ্ট হবে না। 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১), অক্ষয় কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৮৬), রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী (১৮৬৪-১৯১৯), প্রফুল্লচন্দ্র রায় (১৮৬১-১৯৪৪), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), রাজশেখর বসু (১৮৮০-১৯৬০), সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১৮৯৪-১৯৭৪)দের ধারা ধরে দুঃখিনী বাংলা মায়ের বাংলা ভাষায় আমরা যারাই একটু আধটু বিজ্ঞান চর্চার চেষ্টা করি তাদের কাছে আজকের দিনটা'র একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে। ভদ্রলোক কিঞ্চিৎ পিউরিট্যান ছিলেন, মদ্যপানের বিরুদ্ধে ও আমিষ ভক্ষণের বিরুদ্ধে লিখে গেছিলেন, কিন্তু বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চায় ওনার অবদান সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। 

বিশেষ জ্ঞানকে কুক্ষিগত করে রেখে, মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে একটা জাতির কোনোদিন উন্নতি হতে পারে না, তাকে সর্ব সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হলে মাতৃ ভাষায় চর্চা করতে হবেই। লিখতে বসে পরিভাষা খুঁজতে গিয়ে যখন বিরক্তি আসে, মনে হয় ধুত্তর এত খেটে কি হবে, ইংরেজি/ল্যাটিন/গ্রীক শব্দগুলো বাংলা হরফে লিখে দিলেই তো গোল মিটে যায় তখনই দত্তকুলোদ্ভব এই মেধাবী মানুষটি যিনি সারাটা জীবন মস্তিকের চর্চা করলেন, দুঃখজনকভাবে শেষ বয়সে যিনি সেই মস্তিষ্কের অসুখেই আক্রান্ত হয়ে পড়েন, নিঃসঙ্গ হয়ে গেলেন, আশেপাশের লোক তাঁকে পাগল বলে আখ্যা দিল, সেই মানুষটার নাম স্মরণ করে ঝাঁপিয়ে পড়ি। অন্যেরা দেখে, হাসে আর বলে, "যতসব পাগলের কান্ড"। 

অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে, বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা করতে গিয়ে আসুন, সব পাগল আমরা আজ ওঁর জন্মদিনে একজোট হই।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929