অজানা জ্বর না ডেঙ্গু? চেনার ও পরিত্রাণের উপায় কি?
পঞ্চানন মন্ডল
Nov. 25, 2024 | | views :284 | like:0 | share: 0 | comments :0
ডাক্তারি পরিভাষায় 'Pyrexia (fever) of Unknown Origin' অর্থাৎ 'অজানা জ্বর'-এর সংজ্ঞা হিসাবে Petersdorf and Beeson বলেছেন -
"A temperature greater than 38.3°C (101°F) on several occasions, accompanied by more than three weeks of illness, failure to reach a diagnosis after one week of inpatient investigation."
তিন সপ্তাহের বেশী সময় ধরে জ্বর, সমস্ত পরীক্ষা করেও যার কারণ জানা যায় না, তাকেই বলে 'অজানা জ্বর'।
ডেঙ্গুর ক্লিনিক্যাল সংজ্ঞাও ভারত সরকারের ইন্টিগ্রেডেড ডিজিজ সারভেইল্যান্স প্রোগ্রামে বলা আছে:-
"২ থেকে ৭ দিনের জ্বর, তার সঙ্গে নীচের যে কোনো দু'টি লক্ষণ-
মাথাব্যথা
পিছনে ব্যথা
পেশীতে ব্যথা
গাঁটে গাঁটে ব্যথা
রাশ
রক্তে শ্বেতকণিকার সংখ্যা কম"
এছাড়াও বলা আছে, যে এলাকায় যে সময় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, সেখানে সেইসময় যে কোনো জ্বরের কেস যদি রক্ত পরীক্ষায় ম্যালেরিয়া নেগেটিভ হয়, তাহলে তাকে ডেঙ্গু বলেই ধরতে হবে (epidemiologically linked Dengue)। সুতরাং ডেঙ্গুর সঙ্গে অজানা জ্বর গুলিয়ে ফেলার কোনো কারণ নেই।
ডেঙ্গু কনফার্মেশনের জন্য মূলতঃ যে পরীক্ষাগুলি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(WHO) এবং ভারত তথা পঃ বঙ্গ সরকার দ্বারা স্বীকৃত, সেগুলি হ'ল -
জ্বর শুরুর পাঁচদিনের মধ্যে ELISA পদ্ধতিতে রক্তে NS1 অ্যান্টিজেনের অস্তিত্ব দেখা।
জ্বর শুরুর পাঁচদিন পরে ডেঙ্গু-স্পেসিফিক ইমিউনোগ্লোবিন M বা IgM -এর অস্তিত্ব দেখা।
পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (PCR) পরীক্ষা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরো বলছে -
"There is no specific treatment for dengue fever. Severe dengue is a potentially lethal complication but early clinical diagnosis and careful clinical management by experienced physicians and nurses often save lives."
অর্থাৎ, ডেঙ্গুর ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন চিকিৎসকের পূর্ণ অধিকার আছে রোগীর মৃত্যু হ'লে মৃত্যুর কারণ হিসেবে তাঁর ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিস লেখার। বিশেষতঃ যেখানে ল্যাবরেটরি অপ্রতুল, ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিসের উপর ভিত্তি করেই চিকিৎসা করতে হয়।
ডেঙ্গুর এখন মোট পাঁচটি সেরোটাইপ। পঞ্চমটি মালয়েশিয়ায় আবিষ্কৃত হয়েছে বেশ ক'বছর হ'ল, ভারতে এখনো অব্দি রিপোর্টেড নয় এই স্ট্রেইন। তবে তার বাহক এডিস নিভিয়াস কিন্তু এদেশে রয়েছে।
ডেঙ্গুর ইতিহাস
ডেঙ্গুর মশা, যার বিজ্ঞানসম্মত নাম এডিস ইজিপ্টি, সাধারণত দিনে কামড়ায়। সুতরাং, শুধু রাতেই নয়, দিনের বেলাতেও আমাদের সাবধানে থাকতে হবে, যাতে মশা না কামড়াতে পারে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ম্যালেরিয়ার জীবানুবহনকারী মশারা সাধারণত রাতে কামড়ায়। এই মশারা যখন ওড়ে, তখন পোঁ পোঁ করে আওয়াজ হয়। ডেঙ্গুর মশাদের ক্ষেত্রে এরকম আওয়াজ হয় না ঠিকই, কিন্তু এদের চেনার উপায় হচ্ছে গায়ে ডোরাকাটা দাগ।
ডেঙ্গু শব্দটি সোয়াহিলি ভাষা ডিঙ্গা থেকে এসেছে। যার অর্থ সাবধানতা। ডেঙ্গু আক্রান্তরা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথার জন্য খুব ধীরে হাঁটাচলা করেন, মনে হয় যেন সাবধানে চলছেন। সেই থেকে এই ডিঙ্গার ব্যবহার। এই অসুখের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে এক চিনা মেডিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়াতে ২৬৫-৪২০ খ্রীষ্টাব্দে ডেঙ্গুর মতো এক অসুখের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথম সুনিশ্চিত ডেঙ্গুর কথা পাওয়া যায় ১৭৮৯ সালে, যার ব্যাখ্যা করেন বেঞ্জামিন রাস। তিনি হাড়ভাঙ্গা রোগ বলে অসুখটির বিবরণ দেন। সুতরাং, ডেঙ্গু বহুদিন ধরেই মানুষকে আক্রান্ত করছে।
ডেঙ্গুর প্রকারভেদ -
ডেঙ্গুর কারণ হল ডেঙ্গু ভাইরাস। যার বাহক হল এডিস ইজিপ্টি মশকী। যার কামড়ে মানুষের রক্তে এই ভাইরাস প্রবেশ করে এবং ডেঙ্গু হয়। এটি একপ্রকারের ফ্লাভি ভাইরাস।
ডেঙ্গু চার প্রকারের হয়।
ডেঙ্গু-১, ডেঙ্গু-২,ডেঙ্গু৩, ডেঙ্গু-৪।
ডেঙ্গু-২ অন্য তিন ভাইয়ের থেকে একটু বেশিই আক্রমণাত্মক। রক্তে এদের সংখ্যা বা যাকে বলে ভাইরাল লোড, খুব বেশি থাকে। তার ফলে,এই ডেঙ্গুর দরুণ অন্যান্য প্রতিক্রিয়া বা জটিলতা বেশি হয়। ১৯৯৬ সালে দিল্লিতে ডেঙ্গু-২ এর এপিডেমিক হয়েছিল।
ডেঙ্গুর লক্ষ্মণ -
আগেই উল্লেখ করেছি ডেঙ্গু হলে জ্বর, গায়ে ব্যাথা, মাথা ব্যাথা, পেট ব্যাথা ও চোখের ভেতরে ব্যাথা হতে পারে। গায়ে ছোট ছোট লাল দাগ দেখা যেতে পারে। যে সমস্ত মহিলাদের জ্বরের সময় মেনস্ট্রুয়াল পিরিয়ডের সময় হয়ে আসে, তাদের রক্তক্ষরণ অনেক বেশি হয়। ডেঙ্গুতে শ্বেতরক্তকণিকা ও অনুচক্রিকা (platelet) কমতে শুরু করে। অনুচক্রিকা কমতে কমতে যদি বিপদ সীমার নিচে চলে যায়, বা অনুচক্রিকা কমার হার যদি অনেকটা হয়, তাহলে চিকিৎসকেরা অনুচক্রিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যাকে বলে platelet transfusion। বাজারে পেঁপে পাতার রসের খুব প্রচলন হয়েছে অনুচক্রিকা বাড়ানোর জন্য। কিছু ওষুধের কোম্পানি ট্যাবলেটের আকারে বাজারে বের করেছে। এ প্রসঙ্গে বলা ভালো, এর প্রয়োগে অনুচক্রিকা বাড়ে, তা নিশ্চিতভাবে এখনো প্রমাণিত নয়।
এর জন্য আরও ক্লিনিক্যাল স্টাডির প্রয়োজন আছে।
এই অনুচক্রিকা কমে যাওয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। যেমন নাক, দাঁতের মাড়ি, পাকস্থলী ইত্যাদি। শরীরে চামড়ার তলায় ছোপ ছোপ লালচে দাগ দেখা যেতে পারে। যার অর্থ চামড়ার তলায় রক্তক্ষরণ হচ্ছে। একে ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার বলে। এই রক্তক্ষরণ চলতে থাকলে দেহে রক্তের পরিমাণ কমে যায় এবং বিভিন্ন অঙ্গে রক্তের সঞ্চালন সঠিক পরিমাণে হয় না। এই ভয়ঙ্কর অবস্থাকে ‘ ডেঙ্গু শক সিনড্রোম’ বলে। এছাড়াও ডেঙ্গুর জন্য পেটে বা ফুসফুসে জল জমতে পারে। যাকে ডেঙ্গু ক্যাপিলারি লিক সিনড্রোম বলা হয়। এর থেকেও শক সিনড্রোম হতে পারে। এছাড়াও, ডেঙ্গির জন্য মানুষের রোগ প্রতিরোধকারী সিস্টেম বা অনাক্রম্যতন্ত্র বিপজ্জনক রূপ নিতে পারে। এই ভয়ঙ্কর জটিলতার নাম ম্যাক্রোফাজ অ্যাক্টিভেশন সিনড্রোম।
কখন হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে?
ডেঙ্গুর NS1 অ্যান্টিজেন পরীক্ষা পজিটিভ এলে।সেইসাথে যদি আপনার পেট ব্যথা হয়, বা খুব বমি হয়, পেটে বা ফুসফুসে জল জমে, অথবা রক্তক্ষরণ হয়।আর অণুচক্রিকার পরিমাণ দ্রুত কমতে থাকে।
ডেঙ্গুর পরীক্ষা
ডেঙ্গু জ্বরের প্রথম এক থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে NS1 অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করলে ডেঙ্গু ধরা পড়তে পারে। সুনিশ্চিত পরীক্ষার জন্য ডেঙ্গু সেরোলজি পজিটিভ আসে জ্বর শুরুর ৬ দিনের পর থেকে।
কী করে বুঝবেন কারো ডেঙ্গু হয়েছে?
কমপক্ষে ৫ দিন ধুম জর থাকবে৷
ওষুধ খেলেও কিছু ক্ষণের জন্য জ্বর কমলেও তা বারে বারে ফিরে আসবে৷
মাথা ও চোখের পিছনদিক-সহ গোটা শরীরে ব্যথা ও দুর্বলতা অনুভব করবেন৷
চামড়ায় র্যাশ হতে পারে৷
বমি, ডায়েরি, সর্দি কাশি হলে বেশিদিন ফেলে রাখবেন না৷ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন৷
হেমারেজিক ডেঙ্গুতে অনেক সময় মাড়ি ও নাক থেকে রক্তপাত হয় ৷
প্রস্রাব ও মলের সঙ্গেও রক্তপাতের সম্ভাবনা৷
হঠাৎ করে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে৷
ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে বাঁচতে, কি কি করবেন?
যেকোনো ভাবেই আপনার এলাকাই মশার বংশবৃদ্ধি রোধ করুন।
আবর্জনা পরিষ্কার করুন ৷পরিবেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন।
জল যাতে না জমে সেদিকে বিশষ নজর রাখুন৷
মশা মারা তেল বা স্প্রে ব্যবহার করুন ৷
খোলা ড্রেন পরিষ্কারের ব্যবস্থা করুন ৷
জ্বর হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন ৷
মশারি ব্যবহার করুন।
অযথা আতঙ্কিত হবেন না।
জ্বর হলে রক্ত পরীক্ষা করুন ৷
ডেঙ্গু সংক্রমণে লিভারের বিভিন্ন এনজাইম বেড়ে যায়। এর ফলে লিভারের বিশ্রাম দরকার। কোনও ভাজা-মশলাদার খাবার, তৈলাক্ত খাবার, বাইরের খাবার অন্তত তিন মাস বর্জন করলে লিভার আবার স্বাভাবিক ভাবে কাজ করতে শুরু করে। খাওয়াদাওয়ায় এই নিয়ন্ত্রণ থাকলে বাড়ি ফিরে ডেঙ্গু রোগী হজমজনিত কোনও সমস্যায় কষ্ট পাবেন না।
যাদের প্রথম বার ডেঙ্গু হয়, তাদের ক্ষেত্রে গায়ে লালচে দাগ বেরোয় জ্বর কমার পরেই। আর তখনই লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে থাকে প্লেটলেট। এটাই রীতি। তাই জ্বর কমে গেল হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া কখনওই উচিত নয়।
এছাড়াও, যাদের আগে ডেঙ্গু হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে জ্বরের সময়েই প্লেটলেট কমে যায়। যাদের প্রথম বার ডেঙ্গু হয়, তাদের কিন্তু গায়ে লালচে দাগ বেরোয় এবং প্লেটলেট কমে জ্বরটা সেরে যাওয়ার পরেই। এটা সবার জানা উচিত।
ডেঙ্গুর সময়ে মেয়েদের কোমরের (পেলভিক অঞ্চলের) বিভিন্ন টিস্যু অতিরিক্ত ফুলে যায়। তাই ডেঙ্গু থেকে সেরে ওঠার ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে মাসিক ঋতুস্রাব শুরু হলে তলপেটে ব্যথা হওয়াটা অস্বাভাবিক কোনও বিষয় নয়। এর জন্য কোনও প্রতিষেধক নিতে হয় না। অনেকের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আবার না-ও হতে পারে। কার হবে, আর কার হবে না, সেটা আগে থেকে বলা সম্ভবও নয়।
বিভ্রান্তি দূর করে কিছু ক্ষেত্রেও রোগ সেরে যাওয়ার পরে অন্তত মাস তিনেক সতর্ক ভাবে থাকতে হবে।
সচেতন থাকুন। সুস্থ থাকুন। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা রাখুন।
(আমি ডাক্তার নই। বিভিন্ন বইপত্র, পত্রপত্রিকা, পুস্তিকা থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে। ভুলত্রুটি থাকলে বিশেষজ্ঞগণ সংশোধন করে দেবেন।)