সমস্ত লেখাগুলি

আশীর্বাদ ও অভিশাপ -
তন্ময়
May 19, 2025 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:3 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আশীর্বাদ ও অভিশাপ শব্দদুটির কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, আশীর্বাদেও কারও  হিতসাধন হয় না, অভিশাপেও কোনও ক্ষতিসাধন হয় না, তবুও শব্দদুটি মানবসমাজে বহুল প্রচলিত। 

বস্তুনিষ্ঠ বা বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যাহীন, তথ্যভিত্তিক প্রমাণাদিহীন, অলীক কল্পনাজনিত ভাববাদী ধ্যানধারণা প্রসূত এই শব্দদ্বয় আমাদের পাঠ্যক্রমেরও অন্তর্ভুক্ত।

আমরা প্রায় প্রত্যেক্যেই বাংলা বা ইংরাজি ভাষায় অতীব গুরুত্বপূর্ণ ‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ’ রচনাটি পড়েছি। কিন্তু আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি যে বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিতে এই বাক্যবন্ধটির বিশ্লেষণ করলে বাক্যবন্ধটিই অর্থহীন হয়ে পড়ে।

অনেকে বলতেই পারেন, বাক্যবন্ধটিতে  ‘হিতকর’ এবং ‘ক্ষতিকর’ অর্থে ‘আশীর্বাদ’ ও ‘অভিশাপ’ শব্দদুটি ব্যবহার করা হয়েছে, অন্যকোনও উদ্দেশ্য নেই।

আমি বলব, তাও যদি হয় সেটাও ভুল এবং অবশ্যই উদ্দেশ্য আছে। উদ্দেশ্য হল প্রকৃত সত্য থেকে মানুষের নজর ঘুরিয়ে দেওয়া।

বিভিন্ন বস্তু ও ঘটনার কার্যকরী নিয়মগুলি জানার অভিযানই হল বিজ্ঞান। বিজ্ঞান কথার অর্থ পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রমাণ দ্বারা নির্নীত ও শৃঙ্খলিত বিশেষ জ্ঞান। বিজ্ঞান সদা জিজ্ঞাসু, সত্যসন্ধানী এবং মূলত নৈর্ব্যক্তিক।


তাই বিজ্ঞান নয়, রাষ্ট্রের ভুমিকার পর্যালোচনা করতে হবে, বিজ্ঞানীদের ভুমিকা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন গরীব ও প্রান্তিক মানুষের জীবন যাত্রার মান বাড়াতে সদর্থক ভূমিকা পালন না করে যদি নানা রকম অসুবিধা ও দুর্ভোগের সৃষ্টি করে তবে তার দায় রাষ্ট্রের, বিজ্ঞানের নয়। বিজ্ঞানীরা যদি সামাজিক দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়ে কর্পোরেটদের হাতের পুতুল হয়ে সমাজের ক্ষতিসাধন করেন তবে তার দায় বিজ্ঞানীদের, বিজ্ঞানের নয়।


তাই, “বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ” কথাটাই ভুল। বিজ্ঞান হল গবেষণালব্ধ _জ্ঞানভাণ্ডার। সেই জ্ঞানভাণ্ডারে ডুব দিয়ে কে কোন উদ্দেশ্য সাধন করবে তার দায়দায়িত্ব বিজ্ঞানের ওপর চাপানো হবে কেন?

ভাষা সাম্রাজ্যবাদ: বিজেপি ও বিবেকানন্দ -
তন্ময়
Dec. 3, 2024 | যুক্তিবাদ | views:588 | likes:0 | share: 0 | comments:0

"নানা ভাষা,নানা মত,নানা পরিধান

বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান।"

মাননীয় অতুল প্রসাদ সেন মহাশয়ের কালজয়ী গানের এই দুটি লাইনের বারতা আজ প্রশ্নের মুখোমুখি। 


নানারকমের ভাষার সমন্বয় ও গুরুত্বের ধারণাকে নস্যাৎ করে সমগ্র বিশ্বের দরবারে দেশ ও জাতির পরিচয় তুলে ধরতে এক ভাষা নীতি প্রনয়ণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে আরএসএস, বিজেপি।

যেহেতু ১৯৫০ সালে দেবনগরী মুদ্রণে হিন্দিকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় তাই ২০১০ সালে গুজরাট হাইকোর্টে দায়ের হওয়া জনস্বার্থ মামলায় হিন্দিকে জাতীয় ভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার আবেদন সংবিধান অনুসারে বাতিল করে আদালত। আদালতের রায় অনুযায়ী হিন্দিকে সরকারি ভাষা বলা গেলেও জাতীয় ভাষা কোন ভাবেই বলা যায় না। 


তবে আবার নতুন উদ্যমে শুরু হয়েছে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত। 

“Hardline Hindu nationalist groups like the Vishwa Hindu Parishad and the Rashtriya Swayamsevak Sangha make no secret of their support for a homecoming campaign designed to return non Hindus to the fold. More than 80% Indians are Hindu,but Prabian Togadiya of the VHP says his organisation's goal is a country that is hundred percent Hindu.”


হিন্দুত্ববাদীরা মনে করেন ভারতকে একশো শতাংশ হিন্দুদের দেশ করতে হবে এবং তার সাথে একটি ভাষা গ্রহণ করতে হবে যা সারা ভারতে প্রতিটি মানুষের মধ্যে যোগসুত্র তৈরি করবে।

স্বামীজি বলিয়াছেন “এমন একটি মহান পবিত্র ভাষা গ্রহণ করিতে হইবে,অন্য সমুদয় ভাষা যাহার সন্ততি স্বরূপ। সংস্কৃতই সেই ভাষা। ইহাই ভাষা সমস্যার একমাত্র সমাধান।”


সংস্কৃত-এর পরিবর্তে হিন্দুত্ববাদীদের লক্ষ্য হিন্দি। কারণ হিন্দি হল গো বলয়ের জনগোষ্ঠীর মিশ্রিত মাতৃভাষা। সংস্কৃত ভারতে প্রচলিত হিন্দি সহ অনেক ভাষার মাতৃস্বরূপ। হিন্দির সাথে সংস্কৃত ভাষার উচ্চারণের বহু মিল বিদ্যমান। তাই বিবেকানন্দের চাহিদার সংস্কৃতের সাথে আরএসএস এর চাপানো হিন্দির খুব একটা পার্থক্য নেই। লক্ষ্য তো একই। এক জাতির এক ভাষা। তাছাড়া রাজনৈতিক জগত এবং সাংস্কৃতিক জগতে হিন্দির বিপুল প্রভাব।তাই ভাষা সমস্যার সমাধানে বিস্তর আলোচনার শেষে

সরকারি ভাষা কমিটির চেয়ারপার্সন অমিত শাহ দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন এখন সময় এসেছে গোটা দেশে একটি রাষ্ট্র ভাষা প্রচলন করা। সেই মহান পবিত্র ভাষা হল হিন্দি। তিনি মনে করেন সমগ্র দেশকে একসূত্রে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষমতা আছে হিন্দির মধ্যে। বহুদিন আগে থেকেই বিজেপি হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। ভাষা কমিটির চেয়ার পার্সন অমিত শাহ সেই দাবি মেনেই এক দেশ, এক জাতি এবং এক ভাষার পক্ষে সওয়াল করেন।


বিবেকানন্দ আক্ষেপ করে বলেছিলেন - “তোমরা সংস্কৃত ভাষায় পন্ডিত হও না কেন? তোমরা ভারতের সকল বর্ণের মধ্যে সংস্কৃত শিক্ষা বিস্তারের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করো না কেন? আমি তোমাদিগকে ইহাই জিজ্ঞাসা করতেছি। যখন এইগুলি করিবে তখনই তোমরা ব্রাহ্মণের তুল্য হইবে। ভারতে শক্তি লাভের ইহাই রহস্য।”


হিন্দির জনপ্রিয়তা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে এই ব্রাহ্মন্য শক্তি লাভের উদ্দেশ্যেই সম্প্রতি সরকারি ভাষা সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট সরকারি বিজ্ঞাপনের বাজেটের অর্ধেকের বেশি হিন্দি বিজ্ঞাপনে খরচ করার প্রস্তাব দিয়েছে। হিন্দি বিজ্ঞাপন বড় করে প্রথম পাতায় এবং ইংরেজি বিজ্ঞাপন ছোট করে ভেতরের বা শেষের পাতায় দেওয়ার কথাও বলা রয়েছে।

ভারতে সকল বর্ণের জন্য নবম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের হিন্দি ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক করতে চান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। জাতীয় শিক্ষানীতির প্রস্তাবিত খসড়ায় সেটারই উল্লেখ রয়েছে। সরকারি কাজকর্ম যাতে পুরোপুরিভাবে হিন্দি ভাষায় করা যায় তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের তোড়জোড় শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।


ভারতবাসীর উদ্দেশ্যে স্বামীজী উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করেছেন – “ভারতে সংস্কৃত ভাষা ও মর্যাদা সমার্থক। সংস্কৃত ভাষায় জ্ঞান লাভ  হইলে কেউই তোমার বিরুদ্ধে কিছু বলিতে সাহসী হইবে না। কারণ সংস্কৃত শিক্ষায়, সংস্কৃত শব্দগুলির উচ্চারণ মাত্রই জাতির মধ্যে একটা গৌরব, একটা শক্তির ভাব জাগিবে।”

সরকারি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে মোদিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে এখন সেই সময় এসেছে যখন আনুষ্ঠানিক ভাষাকে ভারতের ঐক্যের জন্য গুরুত্ব দিতে হবে। ভারতের নাগরিকরা নিজেদের মধ্যে শুধু হিন্দিতে কথা বলবে। 

হিন্দি ভাষা হবে হিন্দু জাতির গৌরব, হিন্দি ভাষায় জ্ঞান  লাভ হইলে মানুষ মধ্যে শক্তির ভাব জাগ্রত হবে। যে শক্তিকে মোকাবিলা করার সাহস পাবে না কেউই।


তাই আইন আসতে চলেছে হিন্দু রাষ্ট্রে হিন্দি ভাষা না শিখলে বঞ্চিত হতে হবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের যেকোনো চাকরিতে। এমনকি যে সকল অফিসার এবং কর্মী হিন্দিতে কাজ করতে অস্বীকার করবেন বা এড়িয়ে যাবেন তাদের পারফরম্যান্স রিপোর্টে লেগে যাবে কালো দাগ।


মন্ত্রকের এই রিপোর্ট গত সেপ্টেম্বর মাসেই পৌঁছে গেছে রাষ্ট্রপতির কাছে। ভারতীয়দের রাষ্ট্র ভাষা হিন্দি হবে। আপনি বাধ্য হবেন হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের কাছে মাথা নত করতে। নচেৎ লোটা-কম্বল গুটিয়ে  চলে যেতে হতে হবে নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে। এরকমই ইঙ্গিত দিলেন উত্তরপ্রদেশের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির জোট সঙ্গী ভারতীয় শোষিত হামারা আম দলের প্রধান  মৎস্য মন্ত্রী সঞ্জয় নিশাদ। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, “ভারতের সংবিধান বলে ভারত হল হিন্দুস্তান যার অর্থ হিন্দি ভাষাভাষীদের জায়গা। যার হিন্দি বলতে পারে না তাদের জন্য হিন্দুস্তানে জায়গা নেই তাদের উচিত এই দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়া।”

এক দেশ, এক জাতি, এক ভাষার মধ্যে নিহিত ফ্যাসিস্ট সংস্কৃতি। আমরা এই সংস্কৃতির বিরুদ্ধে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে সংগ্রাম জারি রাখব।

বিভেদের বীজ ও স্থাপত্য ধ্বংস: বিজেপি ও বিবেকানন্দ -
তন্ময়
Nov. 27, 2024 | রাজনীতি | views:1013 | likes:0 | share: 0 | comments:0

কিছুদিন আগে 'রাজপুত উত্তম সভা' আয়োজিত দশেরার অনুষ্ঠানে মিরাটের সারতানা বিধানসভার দুবারের প্রাক্তন বিধায়ক হিন্দু কট্টরপন্থী সঙ্গীত সোম বলেন,শুধুমাত্র একটি সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা বাড়ছে এবং এটি বন্ধ করতে ভবিষ্যতে রাজপুত সম্প্রদায়কে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হবে। এই দাবি অবশ্য নতুন নয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী নেতৃবৃন্দ এই আহ্বান জানিয়েছেন। 


'গণবাণী'তে প্রকাশিত 'হিন্দু মুসলমান' নামক একটি প্রবন্ধে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন,"..ন্যাজ যাদেরই গজায় তা ভেতরেই হোক বা বাইরেই হোক তারাই হয়ে ওঠে পশু।...মানুষ আর পশুতে পরিণত হয়েছে,তাদের চিরন্তন আত্মীয়তা ভুলেছে।...মনে হল পশুর ন্যাজ খসছে আর মানুষের গজাচ্ছে।"


বহুবছর আগে বিদ্রোহী কবি এই উক্তি করলেও তা আজও প্রাসঙ্গিক। চতুর্দিকে এই ন্যাজ গজানো রামভক্তের দল বিভেদের আগুনে মনুষ্যত্বের চিরন্তন আত্মীয়তাকে পুড়িয়ে ছারখার করে চলেছে। 


বিবেকানন্দ বলেছিলেন," মুসলমানগন যখন ভারতবর্ষে প্রথমে আসে, তখন ভারতে এখনকার অপেক্ষা কত বেশি হিন্দুর বসবাস ছিল আর তাহাদের সংখ্যা কত হ্রাস পাইয়াছে। ইহার কোনো প্রতিকার না হইলে হিন্দু দিন দিন আরো কমিয়া যাইবে। শেষে আর কেউ হিন্দু থাকিবে না।...... অতএব ওঠো, জাগো, পৃথিবীর আধ্যাত্মিকতা রক্ষা করিবার জন্য বাহু প্রসারিত কর।" 

বিজেপির তাত্ত্বিকেরাও একই ধারণা পোষণ করেন। তারা মনে করেন খ্রিস্টান ও মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। 


তাই জাতীয় স্বার্থকে সুরক্ষিত রাখতে মৌলবাদ বিরোধী সাধারণ মানুষের চতুর্দিকে রচিত হল পরাধীনতার দেওয়াল। ক্ষমতার সার্চলাইট নিয়ম করে ঘুরতে শুরু করল। আমরা সকলেই নজরবন্দী হলাম।

ফরাসী দার্শনিক মিশেল ফুকোর মতে,আধুনিক মানুষ আইনের নিশ্ছিদ্র বেড়ার ভেতর জন্মগ্রহণ করে। মানুষের দেহ ও মন দুটোই সর্বক্ষণিক নজরদারি মধ্যে আইনি নিয়ন্ত্রণে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।

আমরা অবরুদ্ধ, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবাধিকার সব অবরুদ্ধ। কারণ ওরা সর্বক্ষণ নজর রাখছে।

ফুকো মনে করেন, ক্ষমতাতন্ত্রে বিচিত্রবিধি উপবিধি সন্দেহপ্রবণ পরিদর্শনের আওতায় স্কুল ব্যারাক হাসপাতাল ওয়ার্কশপ এর অবয়বে নজরদারির মধ্যে চলে আসে ব্যক্তির জীবন।


পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে শ্রমজীবী জনতা নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত এতো ঐতিহাসিকভাবেই সত্য। পাশাপাশি এটাও ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে পুঁজিবাদ যখন ফ্যাসিবাদের দিকে অগ্রসর হয় তখন চিন্তার জগতে অধ্যাত্মবাদ, ধর্মীয় উন্মাদনা, উগ্র জাতীয়তাবাদের স্টিমরোলার চালানো হয়। আর এই উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় উন্মাদনা থেকে সংখ্যালঘুদের ওপর চলে নজরদারি। চলে আক্রমণ। 


লেনিন আর স্তালিন এর দর্শন থেকে আমরা শিখি, পুঁজিবাদ তার প্রথম যুগে গণতন্ত্র এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর যতটা গুরুত্ব আরোপ করেছিল, সাম্রাজ্যবাদী স্তরে এসে সেই পুঁজিবাদ এখন গণতন্ত্রকে,ব্যক্তি স্বাধীনতার গলা টিপে ধরছে। মিলিটারি এবং বুরোক্রেসির উপর নির্ভরশীল হচ্ছে। বুর্জোয়া গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতার ঝান্ডা প্রতি মূহুর্তে পদদলিত কর্দমাক্ত করছে।


ফুকো বলেছেন, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র প্রতিটি মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতি মুহূর্তে ওপর নজর রাখার জন্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অসংখ্য প্রতিষ্ঠান বানিয়ে তোলে। এসব প্রতিষ্ঠান মানুষের ব্যক্তি ও সমাজ ও রাজনৈতিক সমস্ত আচরণের কিছু মাপকাঠি নির্ধারণ করে দেয় সেই মাপকাঠি লঙ্ঘন করলে শাস্তি পেতে হয়।


গো-রক্ষা সমিতি, হিন্দু বহেন বেটি বাঁচাও সংঘর্ষ কমিটির মতো অসংখ্য প্রতিষ্ঠান তৈরী করেছে আরএসএস, বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। তীব্র নজরদারি চালাচ্ছে সংখ্যালঘুদের ওপর। মাপকাঠি লঙ্ঘন হলে নেমে আসছে শাস্তির খাড়া। 


হিন্দু সমাজের ধর্মান্তকরণে আশঙ্কিত হয়ে স্বামীজি বলেছেন “এই দেখ না, হিন্দুদের সহানুভূতি না পেয়ে মাদ্রাজে হাজার হাজার পেরিয়া খ্রিস্টান হয়ে যাচ্ছে। মনে করিসনি কেবল পেটের দায়ে খ্রিস্টান হয়, হয় আমাদের সহানুভূতি পায় না বলে। অনাথ মেয়ে হাতে পড়লে তাদের আগে নিতে হবে। নইলে খ্রিস্টানরা সেগুলিকে নিয়ে যাবে।”

তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন,...আর কোনও লোক হিন্দু সমাজ ত্যাগ করলে সমাজে শুধু একটি লোক কম পড়ে তা নয় একটি করিয়া শত্রু বৃদ্ধি হয়।

শত্রু বৃদ্ধি কি কেউ কখনও চায়? হিন্দুত্ববাদীরাও চায়নি। তাই শুরু হল শত্রুদের ওপর আক্রমণ এবং প্রয়োজনে হত্যা।

হিন্দুদের ধর্মান্তরকরণ করে খ্রিস্টান করা হচ্ছে শুধুমাত্র এই সন্দেহে হিন্দু মৌলবাদী শক্তি বজরঙ দল পুড়িয়ে মারে গ্রাহাম স্টেইন্স এবং তার ৬ আর ১০ বছরের দুই পুত্রকে। মুসলমান ছেলেরা হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত করছে সন্দেহে খোলা হয় একটি হেল্পলাইন। একটি ফোন নাম্বার দিয়ে হিন্দুদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে আসা হয় এমন ঘটনা ঘটলেই যেন হেল্পলাইনে জানানো হয়। আরএসএস ফয়সালা করবে। 


সংবিধানকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মেয়েদের মনে ভীতির সৃষ্টি করা হল। নিজে পছন্দ মত বিয়ে নৈব নৈব চ। চলল কড়া নজরদারি। 


ফ্রিজে গরুর মাংস রাখার অভিযোগে মহম্মদ আখলাখকে বাড়িতে ঢুকে পিটিয়ে মারা হল। গুরুতর আহত হলেন তার মা ও সন্তান। শ্রমিক মোহাম্মদ আফরাজুলকে রাজস্থানে পুড়িয়ে খুন, গোরক্ষকদের তাণ্ডবে পহেলু খান বা উমের খানের মৃত্যু, হরিয়ানায় কিশোর জুনেইদ খানকে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা, ট্রাকে করে গোমাংস নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে জম্বু কাশ্মীরে উধমপুরে ট্রাক ড্রাইভার জাহিদ রসুলকে নৃশংস নিধন করা হল। হিমাচল প্রদেশ,হরিয়ানা সহ প্রায় সারা দেশে বিশেষ করে ভাজপা যেসকল রাজ্যে ক্ষমতায় আছে সেইসকল রাজ্যগুলিতে সাম্প্রদায়িকতার আগুনে ধ্বংস হতে শুরু হল মনুষ্যত্ব, মানবতা। 

ভারতে মুসলিম, খ্রিস্টান এর মতো সংখ্যালঘুরা যেভাবে ক্রমাগত আক্রান্ত হচ্ছে সেটা বিবিসি বাংলাকে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন মহারাষ্ট্রের সাবেক পুলিশ প্রধান মীরন বোরওয়ানকার। 


তিনি বলেছিলেন,"ইদানিং আমি অনুভব করছি সংবিধান যে সবাইকে নিয়ে চলার কথা বলে তা এদেশে তা মানা হচ্ছে না। সংখ্যালঘু সমাজ যে অস্বস্তিতে আছে সেটাই তো দেখা যাচ্ছে। তাদের উপর হামলা হচ্ছে কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাদের সাহায্য করছে না।


“ইয়ে তো স্রেফ ঝাঁকি হ্যায়,কাশী মথুরা বাকি হ্যায়।” সংখ্যাগুরুবাদের আধিপত্য কায়েমের উদ্দ্যেশ্যে ক্ষমতার আস্ফালনে উন্মত্ত করসেবকদের দ্বারা বাবরি মসজিদ গুড়িয়ে দেওয়ার পর হিন্দুত্ববাদীদের নগ্ন উল্লাস। 


কাশ্মীর ভ্রমণকালে ক্ষীর ভবানী মন্দির দর্শনের পর স্বামীজী তার মনের ভাব যে বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শিষ্যার কাছে প্রকাশ করেছিলেন সেটা হল -"মা ভবানী এখানে সত্যই কতকাল ধরিয়া প্রকাশিত রহিয়াছেন। পুরাকালে যবনেরা আসিয়া তাহার মন্দির ধ্বংস করিয়া যাইল অথচ এখানকার লোকগুলো কিছু করিল না। তাই আমি যদি থাকিতাম তবে কখনো উহা চুপ করিয়া দেখিতে পারিতাম না।”

চুপ করে বসে ছিলেন না হিন্দুত্ববাদীরা। ঊনবিংশ শতাব্দীতে হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষ থেকে দাবি উঠল যে ষোড়শ শতাব্দীতে বাবরের আমলে যেখানে মসজিদ গড়া হয়েছে সেই অযোধ্যায় বহুকাল পূর্বে বাবরি মসজিদের জায়গায় রামের মন্দির ছিল। তাই মসজিদ ভেঙে রামের মন্দির গড়ার সলতে পাকানো শুরু করেছিলেন স্বাধীনতার আগে থেকেই। শুধু অপেক্ষা করছিলেন অনুকূল সময়ের। 


মৃত্যুকে উপেক্ষা করে ধর্মরক্ষার তাগিদে স্বামীজি বলেছিলেন "তোমরা যে শত শতাব্দীর অত্যাচার সহ্য করিয়া এখনও অক্ষতভাবে দাঁড়াইয়া আছো, তাহার কারণ তোমরা সযত্নে এই ধর্মরক্ষা করিয়াছো। এই ধর্মরক্ষার জন্য তোমাদের পূর্বপুরুষগণ সাহস পূর্বক সকলই সহ্য করিয়াছিলেন এমনকি মৃত্যুকে পর্যন্ত আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত ছিলেন। বৈদেশিক বিজেতাগণ আসিয়া মন্দিরের পর মন্দির ভাঙিয়াছে কিন্তু এই অত্যাচার স্রোত যেই একটু বন্ধ হইয়াছে আবার সেখানে মন্দিরের চূড়া উঠিয়াছে।"


স্বামীজী আরও বলিয়াছেন,"অনেক গ্রন্থপাঠের যাহা না শিখিতে পারো, সোমনাথ মন্দিরের মত দাক্ষিনাত্যের অনেক প্রাচীন মন্দির তোমাদিগকে অধিকতর শিক্ষা দিতে পারে, তোমাদের জাতির ইতিহাস সম্বন্ধে গভীরতায় অন্তর্দৃষ্টি দিতে পারে। লক্ষ্য করিয়া দেখো, ওই মন্দির শতশত আক্রমণের ও শতশত পুনরুত্থানের চিহ্ন ধারণ করিয়া আছে, বারবার নষ্ট হইতেছে, আবার সেই ধ্বংসাবশেষ হইতে উত্থিত হইয়া নূতন জীবন লাভ করিয়া পূর্বের মতো অচল অটলভাবে বিরাজ করিতেছে।


রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ রামমন্দির সম্পর্কে একই মত পোষণ করে। হিন্দুত্ববাদী এই সংগঠনের মতে শ্রীরাম অযোধ্যায় অচল অটলভাবে বিরাজ করছেম, কিন্তু পূর্বের মত নয়। শ্রীরাম মন্দির সেখানেই নতুন জীবন লাভ করবে। ভব্য রাম মন্দির নির্মাণ শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। 


অনুকুল সময় আসতেই এক মূহুর্ত সময় নষ্ট করেনি রামভক্ত হনুমানেরা। দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি শেষে জয় শ্রীরাম' হুঙ্কার ছেড়ে ১৯৯২ সালের ৬ ই ডিসেম্বর মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল ঐতিহাসিক সৌধ বাবরি মসজিদ।'


ধর্ম রক্ষা করেছিল রাম ভক্তরা। বাবরি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ হইতে উত্থিত হয়ে রাম মন্দিরের নতুন জীবন লাভের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন।

গভীর আক্ষেপের সাথে বিবেকানন্দ বলেছিলেন "যদি তুমি অন্য কোনও দেশে গিয়া মুসলমানদিগকে বা অন্য ধর্মাবলম্বীগণকে তোমার জন্য একটি মন্দির নির্মাণ করিয়া দিতে বল, দেখিবে তাহারে কিরূপ সাহায্য করে। তৎপরিবর্তে তোমার মন্দির এবং পারে তো সেই সঙ্গে তোমার দেহমন্দিরটিও ভাঙিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিবে। এই কারণেই পৃথিবীর পক্ষে এই শিক্ষার বিশেষ প্রয়োজন.. ভারতের নিকট পৃথিবীতে এখনো বড় পরধর্মসহিষ্ণুতা শুধু তাহাই নয়,পরধর্মের প্রতি গভীর সহানুভূতি শিক্ষা করিতে হইবে।”


ধর্মীয় রাষ্ট্রের জিগিরে মাতোয়ারা মৌলবাদীদের কাছে পরধর্মের প্রতি গভীর সহানুভূতি অর্থাৎ পরধর্মসহিষ্ণুতা নিছক কথার কথা। ধর্মীয় উন্মাদনা থাকবে,অস্ত্রের ঝনঝনানি থাকবে কিন্তু সন্ত্রাসের লেশমাত্র থাকবে না এটা সোনার পাথরবাটি। হিন্দুর শত্রু মুসলিম আর মুসলিমের শত্রু হিন্দু এই প্রকার সাম্প্রদায়িক প্রচারের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় বিরোধের সৃষ্টি দীর্ঘদিন ধরে করে চলেছে হিন্দুত্ববাদী শক্তি।

ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র কায়েমের উদ্দেশ্যে আরএসএস, বিজেপি, বজরং দল থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী শক্তি সর্বশক্তি প্রয়োগ করে উগ্র মুসলিম বিদ্বেষী মানসিকতার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। 


১৯২২ সালে হিটলার একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন- "একজন খ্রিষ্টান হিসেবে ঈশ্বর তথা পরিত্রাতাকে আমি একজন যোদ্ধার রূপে দেখতে পাই। আমি দেখতে পাই এমন এক মানুষকে তিনি একদা একাকী অল্পকিছু অনুচর পরিবৃত হয়ে ইহুদীদের চিহ্নিত করেন এবং তারপর বহু মানুষকে একত্রিত করে ইহুদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্ররোচিত করেন এবং যিনি ঈশ্বর সাক্ষী, দুঃখভোগী নন, বরঞ্চ একজন মহান যোদ্ধা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। খ্রিষ্টধর্মের একান্ত অনুরাগী হিসেবে এবং একজন মানুষ হিসেবে আমিই সেই অংশটি পড়ি যেখানে প্রভু অবশেষে শক্তিশালী রূপ পরিগ্রহ করছেন আর চাবুক হাতে নিয়ে ঈশ্বরের মন্দির থেকে শয়তানদের কশাঘাত পূর্বক বিতাড়ন করছেন। ইহুদি বিষের বিরুদ্ধে কী সুমহান সেই যুদ্ধ। আজ ২ হাজার বছর পরেও তীব্র আবেগ মথিত করে আমি আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারছি যে এই কারণেই তাকে ক্রুশের উপর রক্ত ঝরাতে হয়েছে। একজন খ্রিষ্টান হিসাবে আমি নিজেকে ধোকা দিতে পারি না।সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করার দায় আমার উপরেও বর্তায়।"


হিটলারের এই বক্তব্য থেকে যিশুর জায়গায় রাম,ইহুদির জায়গায় মুসলমান এবং খ্রিস্টধর্মের জায়গায় ব্রাহ্মণ্যধর্ম বসালেই কি অদ্ভুত মিল পাওয়া যায় সেকালের হিটলার মুসোলিনির সাথে একালের আরএসএস,বিজেপির।

মহাকাব্যের রাম হিন্দুত্ববাদীদের হাত ধরে প্রবেশ করেন রাজনীতির মহাকাব্যে। ফ্যাসিস্ট রাজনীতির আঙিনায় নাৎসিবাদীদের যিশু আর হিন্দুত্ববাদীদের রাম মিলেমিশে একাকার।


ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে জয় শ্রীরাম হয়ে ওঠে একটি রাজনৈতিক স্লোগান। এক পৌরাণিক চরিত্র 'রাম'কে নিয়ে উন্মাদনা সৃষ্টি আসলে আমাদের দেশে সংখ্যাগুরু আধিপত্যকারী ধর্মীয় গোষ্ঠীর আধিপত্যবাদ। সংখ্যালঘু বা অন্যান্য জনগোষ্ঠীকে দমন করার এক ফ্যাসিস্ট কৌশল। 

ফ্যাসিস্ট সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা বিস্তারের মাধ্যমে ধর্ম ও রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য তার জনমত তৈরি করা। 

বিবেকানন্দের মতানুসারে,আমাদের ধর্মই আমাদের তেজ,বীর্য,এমনকি রাষ্ট্রিয় জীবনের মূল ভিত্তি। আমি এখন এই বিচার করিতে যাইতেছি না যে,ধর্মেই আমাদের রাষ্ট্রিয় জীবনের ভিত্তি স্থাপন করার পরিণামে আমাদের কল্যাণ বা অকল্যাণ হইবে;ভালো হউক বা মন্দ হউক,ধর্মে আমাদের রাষ্ট্রিয় ভিত্তি রহিয়াছে,তোমরা উহা ত্যাগ করিতে পার না। চিরকালের জন্য উহাই তোমাদের রাষ্ট্রিয় জীবনের ভিত্তিস্বরূপ রহিয়াছে,সুতরাং আমাদের ধর্মে আমার যেমন বিশ্বাস আছে,তোমাদের যদি তেমন নাও থাকে,তথাপি তোমাদিগকে এই ধর্ম অবলম্বন করিয়া থাকিতে হইবে। তোমরা এই ধর্মে বন্ধনে চির আবদ্ধ। যদি ধর্ম পরিত্যাগ করো তবে তোমরা চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া যাইবে। ধর্মই আমাদের জাতির জীবনস্বরূপ, ইহাকে দৃঢ় করিতে হইবে।


ইতালির পুনর্জাগরণের আধ্যাত্মিক শক্তি,ঐক্য আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ম্যাৎসিনিরও চিন্তাধারা ছিল ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির মিশিয়ে দেওয়া।  ইতালির একত্রীকরণ হওয়ার সময়ে তিনি বলেছিলেন যে ধর্ম ছাড়া কোনও জাতীয়তাবাদ বা রাজনীতি সফল হবে না। 

হিটলার,মুসোলিনি,গোয়েবলস,ম্যাৎসিনি প্রমুখেরাই তো আরএসএস ও বিজেপির পথপ্রদর্শক।তাই ধর্মের সাথে রাজনীতির একত্রীকরণের ভাবনা তাদের মতাদর্শের মধ্যে নিহিত।

পুঁজি আর শ্রমের দ্বন্দ্বকে ভুলিয়ে এই রাজনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য এক ধর্ম রাষ্ট্র সৃষ্টির পরিকল্পনা।

সেই পরিকল্পনা বাস্তবে রূপায়িত করতেই লাগাতার এবং লাগামছাড়া বিভেদের বীজ বপন এবং স্থাপত্য ধ্বংসের কর্মসূচী।

বৈজ্ঞানিক মেজাজ এবং দাভেলকার -
তন্ময়
Nov. 24, 2024 | জীবনী | views:285 | likes:0 | share: 0 | comments:0

দ্রুম, দ্রুম। দু’খানা গুলি। একটা মাথার পেছন দিক থেকে আর আরেকটা পড়ে যাওয়ার পর ডান চোখে। নরেন্দ্র দাভেলকারকে এইভাবেই গুলি করে হত্যা করেছিলেন হিন্দুত্ববাদীরা।

সমাজে বৈজ্ঞানিক মেজাজ তৈরীর প্রক্রিয়ায় ডঃ নরেন্দ্র দাভেলকারের অদম্য সাহসী ভূমিকায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মেজাজ হারিয়ে ফেলেছিলেন মৌলবাদী শক্তি। বিজ্ঞান আন্দোলনের একজন অগ্রণী সৈনিককে খুন করে সমগ্র বিজ্ঞান আন্দোলনকে হারিয়ে দেওয়ার উগ্র বাসনায় উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল হিন্দুত্ববাদী ‘সনাতন প্রভাত’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে। “one gets what one deserves.” অর্থাৎ, “তার যা পাওনা ছিল সেটাই তিনি পেয়েছেন।” এটাই ছিল পত্রিকা গোষ্ঠীর মনোভাব। ওরা জানেন না যে মস্তিষ্ককে কারাগারে বন্দী করে বা মস্তিষ্কে গুলি করে একটা মানুষকে আটকানো যেতে পারে কিন্তু তার চিন্তাধারাকে আটকানো যায় না। তা আরও ছড়িয়ে পড়ে। 

রাষ্ট্র শক্তি সর্বদা মানুষের চেতনা ও মানসিকতাকে প্রভাবিত এবং নিয়ন্ত্রিত করতে অত্যন্ত সক্রিয়। একমাত্র শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের ব্যাপকতা আর সক্রিয়তা পারে রাষ্ট্র শক্তির এই আগ্রাসী মনোভাবকে প্রতিহত করতে। সেই লক্ষ্যেই তিনি কুসংস্কার মুক্ত বিজ্ঞানমনস্ক সমাজগড়ার জন্য বিজ্ঞান আন্দোলনের পাশাপাশি সমাজে বহমান নানাবিধ সমস্যার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন। তবে শুধু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্ষান্ত হতেন না বরং মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে রাষ্ট্র শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতেন। 

জাতপাত, অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, দলিতদের সমানাধিকারের পক্ষে, মারাঠা বিশ্ববিদ্যালয়কে সংবিধান প্রণেতা বাবাসাহেব আম্বেদকারের নামাঙ্কিত করতে যেমন দাভেলকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তেমনি প্রতিটি গ্রামে একটি করে পানীয় জলের কুপের দাবিতে, প্রান্তিক মানুষদের মদ্যপানের আসক্তি দূর করতে, সশক্তিকরণ ও আত্মমর্যাদা জাগ্রত করার লক্ষ্যে, জলদূষণ রুখতে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচীতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। 

ব্যক্তিজীবন বা সামাজিক জীবন সার্বিকভাবে সুস্থ ও সুন্দর করে গড়ে তোলার প্রয়াস জারি রাখতে প্রকৃতি ও সমাজের প্রতিটি ঘটনার পেছনে কার্যকারণ সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা খুব জরুরী। আর এইজন্য চাই প্রশ্ন করার আর প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার বৈজ্ঞানিক মেজাজ। ততটুকুই গ্রহণীয় যতটুকুর সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে, এই বৈজ্ঞানিক মেজাজ তৈরী করার কাজটা সুচারুভাবে করেছিলেন তিনি।

মানুষের সাথে বন্ধুর মত মিশে, মানুষের জীবনসংগ্রামের সাথী হয়ে, মানুষকে বিজ্ঞান সচেতন করে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে সামিল করার প্রয়াস প্রতিটি বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের কাজ। আর এই কাজে ঔদ্ধত্য নয়, সাহসী এবং বিনয়ী হতে হবে। সেই বিনয় আর সাহস সঙ্গী করে দাভেলকার গড়ে তুলেছিলেন মহারাষ্ট্র অনিস অর্থাৎ মহারাষ্ট্র অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি। ব্যাক্তি ও পারিবারিক জীবনে আপাদমস্তক কুসংস্কার বর্জন করা মানুষটি সমাজ জীবনেও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে চালিয়ে গিয়েছিলেন আপোষহীন লড়াই। বেশ কয়েকজন কুসংস্কারের প্রচারক গুরুবাবাজিদের ভন্ডামি ফাঁস করার জন্য তাদের চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। চলমান বিজ্ঞান ভ্যানের মাধ্যমে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রচার ও প্রসারের অনন্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। সর্বোপরি তৈরী করেছিলেন কুসংস্কার ও জাদুবিদ্যা বিরোধী আইনের সেই ঐতিহাসিক খসড়া যা সারা ভারতে যুক্তিবাদী মানুষের সংগ্রামের পাথেয়। 

 যুগে যুগে কোনো যুক্তিশীল চিন্তাধারার মানুষদের কাজ কখনও সহজ হয়নি। ওনার কাছেও এই কাজ সহজ ছিল না। বহু বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। বক্তৃতা বন্ধের চক্রান্ত, ম্যাগাজিন বিক্রি না করার ফতোয়া এমনকি প্রাণনাশের হুমকি নিয়েই আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অকুতোভয় মানুষটির পুলিশি সুরক্ষাও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

যদিও শেষ পর্যন্ত প্রাণ রক্ষা হয়নি। দাভেলকার এবং তারপরও আরও কয়েকজন যুক্তিবাদী প্রগতিশীল মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।

প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ, বিজ্ঞানী থেকে সমাজের সর্বস্তরের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিক। বিজ্ঞানীরা সোচ্চারে বলেছিলেন, “we, scientists now join our voices to Theirs (the writers) to assert that the Indian people will not accept Such attacks on reason, science and our plural culture. we reject the destructive narrow view of India that seeks to dictate what people will wear, think, eat and who they will love. we appeal to all other sections of society to raise their voice against the assault on reasons and scientific temper we are witnessing in India today.”

ডাক্তারি পেশার পাশাপাশি দাভেলকারদের এই ‘Scientific temper’ অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক মেজাজ তৈরির প্রক্রিয়া আমাদের কাছে শিক্ষনীয়। তাই এই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের। আমরা এই দায়িত্ব পালনে বদ্ধপরিকর।


বস্তুর চেতনাসঞ্চার -
তন্ময়
Nov. 23, 2024 | বিজ্ঞানমনস্কতা | views:283 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বস্তু থেকে চেতনার সৃষ্টি না চেতনা থেকে বস্তুর - এই নিয়ে বিতর্ক বহুদিনের। লোকায়ত মতে চেতনা দেহেরই গুন,দেহের বাইরে চেতনার অস্তিত্ব নেই। ভাববাদীরা এক্ষেত্রে প্রশ্ন তুলেছেন চেতনা যদি দেহেরই গুন হয় তবে মৃত দেহও তো দেহ তাহলে সেই দেহে তো চেতনা নেই অতএব চেতনা দেহের গুণ নয়, চেতনা দেহাতিরিক্ত শক্তি যা মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময় থেকেই ছিল এবং এই চেতনা থেকেই সবকিছুর সৃষ্টি। ঈশ্বরের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে চেতনা থেকে বস্তু সৃষ্টির ধারণাটাই প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। 

চেতনা যদি বস্তুর থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক ভিন্ন সত্তা না হয় তবে তো চৈতন্যময় ঈশ্বরের ধারনাই অমূলক হয়ে যায়।

কিন্তু চেতনা থেকে যদি সকলপ্রকার বস্তুর সৃষ্টি হয় তবে তো মহাবিশ্বের সমস্ত শক্তি বা বস্তুর মধ্যেই চেতনার অস্তিত্ব থাকবে, সেই চেতনা যতই সূক্ষ্ম হোক না কেন? মাটি থেকে কোনও কিছুর সৃষ্টি হলে মাটির সামান্যতম উপস্থিতি থাকবে না? সেটা কি সম্ভব? না,সম্ভব নয়। সৃষ্টির মূল উপাদানকরণ থেকে সৃষ্ট প্রত্যেকটির বস্তুর মধ্যেই সেই প্রাথমিক উপাদান পরিলক্ষিত হবে, এটাই বাস্তব। সৃষ্টির আদিতে চৈতন্যের উপস্থিতি অর্থাৎ চৈতন্যস্বরূপ চরম বা পরম সত্তার অনুসারীরা বলেন, প্রত্যেক বস্তুর মধ্যেই চেতনা বর্তমান। সেই চেতনা ব্যক্ত হয়নি, অব্যক্ত অবস্থায় আছে।এই চেতনার মান শূন্য। এই শূন্য কোনও সংখ্যাহীনতা নয়, তাই চেতনাহীন নয়।


 অদ্ভুত এই দাবী। চেতনার মান যদিই শূন্যই হয় তবে চেতনার অস্তিত্ব থাকতে পারে কি? শূন্য এককভাবে কোনও কিছুর অস্তিত্বহীনতাই বোঝায়। আরবি শব্দ “সাফাইর” বা “সাফাইরা” শব্দের পরিবর্তিত রূপ হল ইংরেজির “শূন্য”। “সাফাইর” বা “সাফাইরা” শব্দের অর্থ “সেখানে কিছু ছিল না”। সংস্কৃত শব্দ “শুণ্যেয়া”র অর্থ “খালি” বা “ফাঁকা”। তাহলে কি দাঁড়াল? দাঁড়াল এই যে চেতনার মান শূন্য কথাটার অর্থ চেতনার অস্তিত্বহীনতা।


 বস্তুবাদী মতানুসারে দেহ গঠনের মূল উপাদানগুলির মধ্যে চেতনার অস্তিত্ব থাকে না। উপাদানগুলির প্রত্যেকটাই নিস্প্রান, জড় অর্থাৎ অচেতন। কিন্তু এই জড় পদার্থের যখন বিশেষ পরিবর্তন সাধিত হয় তখন এক নতুন গুণ বা ধর্মের উদ্ভব হয়, ইহাই চেতনা। উদাহরণ হিসেবে বস্তুবাদীরা মদশক্তির কথা উল্লেখ করেন। যে সকল দ্রব্যের মিশ্রণে মদ তৈরি হয়, সেইসকল দ্রব্যের একটির মধ্যেও স্বতন্ত্রভাবে সেই শক্তি নেই নেই যে শক্তি মদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ মদ পান করলে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় সেই উত্তেজনা মদ তৈরির উপকরণগুলি পৃথক পৃথকভাবে বা একত্রে খেলেও সৃষ্টি হবে না। কিন্তু সেই উপকরণগুলিকে যখন বিশেষ তাপমাত্রায় বিশেষভাবে (অর্থাৎ উপকরণগুলির পরিমাণের বিজ্ঞানসম্মত অনুপাতে) মিশ্রিত করা হয় তখন যে তরল পানীয়ের সৃষ্টি হয় তার মধ্যে এক নতুন গুণের সৃষ্টি হয়, সেটাই মদশক্তি।


এই মদশক্তিকে উদাহরণ ধরেই বলা যায়, যে সকল জড়বস্তুর সমন্বয়ে শরীরের গড়ে ওঠা সেইসকল জড়বস্তুর মধ্যে স্বতন্ত্র বা মিলিত অবস্থায় চেতনার কোন লক্ষ্মণ না থাকলেও সেগুলিরই কোন এক বিশেষ পরিবর্তনের ফলস্বরুপ উদ্ভব ঘটেছে চেতনা নামক এক সম্পূর্ণ নতুন গুণের। 

এই গুণের অস্তিত্ব দেহ বা শরীর ছাড়া সম্ভব নয়। বস্তু ও চেতনা গুনগতভাবে বিপরীত ধর্মী, কিন্তু বিচ্ছিন্ন নয়। বস্তুর অস্তিত্ব ব্যতীত চেতনার অস্তিত্ব থাকতে পারে না।

 তাই বিপরীত ধর্মী হলেও বস্তু ও চেতনার মধ্যে একটা ঐক্যও বর্তমান। এটাই বৈপীরিত্যের ঐক্য।


 এখানে একটা প্রশ্ন জাগে যে বস্তু ও চেতনার মধ্যে ঐক্য থাকলে তো সকল বস্তুর মধ্যে চেতনা বর্তমানের ধারণাটা মান্যতা পেয়ে যায়? এই প্রশ্নের উত্তর হবে যে বস্তুর অস্তিত্ব ব্যতীত চেতনার অস্তিত্ব থাকতে পারে না কিন্তু অবশ্যই চেতনার অস্তিত্ব ব্যতীত বস্তুর অস্তিত্ব থাকতে পারে। তাহলে আর ঐক্য হল কোথায়? এখানে বস্তু বলতে সকল প্রকার বস্তুর কথা ভেবে নিলে অযৌক্তিক হবে। এখানে বস্তু বলতে ক্রম সমন্বয়ী বস্তুর ভিত্তিতে গড়া দেহ বা শরীরের কথা ধরতে হবে। 

 

এত আলোচনা সত্ত্বেও প্রশ্ন উঠতে পারে, চেতনা যদি শুধুমাত্র দেহের গুণ হয় তাহলে মৃতদেহে চৈতন্য বর্তমান থাকে না কেন? ভাববাদীরা দেহ বলতে জড়দেহ ভেবে নিয়েছেন। মৃতদেহ যেহেতু জড়দেহ তাই সেই দেহতে স্বাভাবিকভাবে চেতনার অস্তিত্ব থাকতে পারে না। দেহ মাত্রেই অনুভব বা চিন্তা করতে সক্ষম নয়। যেহেতু জৈব বিবর্তনের মধ্য দিয়ে চেতনার উদ্ভব হয়েছে সেহেতু কেবলমাত্র জৈবিক জীবিত দেহই এই গুণসম্পন্ন হয়। যে দেহে প্রাণ বর্তমান সেই দেহ জীবিত, মৃতদেহে প্রাণ বর্তমান থাকে না তাই মৃতদেহে চেতনার অস্তিত্ব খোঁজা অবাস্তব।


প্রশ্ন উঠতে পারে, উদ্ভিদেরও তো প্রান আছে, তাহলে কি উদ্ভিদেরও চেতনা আছে? হ্যা,আছে তবে উদ্ভিদের চেতনা আর প্রাণীর চেতনার মধ্যে পার্থক্য আছে। এই পার্থক্য হল অনুভূতি ও প্রতিবর্ত ক্রিয়ার সাথে চিন্তার পার্থক্য।উদ্ভিদের চেতনা হরমোন দ্বারা নির্ধারিত হয় বলে উদ্ভিদ শুধুমাত্র অনুভূতির মাধ্যমে ও প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় সাড়া দিতে পারে কিন্তু যেহেতু উদ্ভিদের স্নায়ুকোষ নেই তাই চিন্তা করতে পারে না।   

বিবর্তনের ঐতিহাসিক ও দ্বান্দ্বিক বস্তুগত বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে বস্তু থেকে চেতনার উদ্ভবের কার্যকারন সম্পর্কের ব্যাখ্যা অবৈজ্ঞানিক। গতিশীলতা ও পরিবর্তনশীলতা হল বস্তুর ধর্ম। অনুন্নত থেকে উন্নত, সরল থেকে জটিল ক্রমে বিবর্তনের ধারার মধ্য দিয়েই বস্তুর রূপান্তরিত বা পরিবর্তিত পরিমান স্বরূপ চেতনার উদ্ভব। বস্তুর বিকাশ ব্যতীত চেতনার সৃষ্টির দাবী অযৌক্তিক। 


চেতনার উৎস সম্পর্কে চেতনা বিষয়ক এবং জীব বিজ্ঞানীদের কয়েকটি ব্যাখ্যা সম্পর্কে আলোচনা করা যাক, “All three media-genetic evolution, phenotypic plasticity and memetic evolution-have contributed to the design at human consciousness, each in turn, and at increasing rates of speed”. (ডেন্নেট,আমেরিকার চেতনা বিষয়ক বিজ্ঞানী)  

 “Convert attention is the virtual movement of deep processing from one item o another. The cortex needs to control that virtual movement … is does so by constructing an attention schema- a constantly updated set of information that describes what convert attention is doing moment by moment-by moment and what its consequences are”. (বিজ্ঞানী গ্রাজিয়ান)

“It is quite certain that human consciousness did not arise fullfledged with the human species, but is only the most highly evolved end point of a long evolutionary history”. (আরনেস্ট মেয়ার, জার্মান জীববিদ)। 


বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক ঘটনাসমুহের (সাম্য ও বিপর্যয়) থেকে উদ্ভূত দ্বন্দ্বের ফলস্বরূপ অভিযোজিত বা সৃষ্টি সম্বন্ধীয় পরিব্যক্তির মাধ্যমে চেতনার সৃষ্টি হয়। অনেকে বলেন, বিবর্তনের দীর্ঘ পরিক্রমায় উপজাত বস্তু (বাই প্রোডাক্ট অফ এভলিউশন) রূপে চেতনাকে পাওয়া যায়।   


সকল আলোচনা বিশ্লেষণ করে আমরা বস্তু থেকে চেতনার উৎপত্তির যে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী ব্যাখ্যাটি হাজির করতে পারি তা হল, ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় বস্তুজগতের গুনের পরিমানগত বৃদ্ধি গুণাত্মক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিকাশের স্তরের নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে এক নতুন গুণসম্পন্ন বস্তুর সৃষ্টি করে যার মধ্যে চেতনা পরিলক্ষিত হয়।এরূপ ক্ষেত্রে অজড় বস্তুতে উত্তরণের মধ্য দিয়ে জড় বস্তুটির নিরাকরণ ঘটে।


বিখ্যাত দার্শনিক এঙ্গেলসের উক্তি দিয়ে এই অধ্যায়ের শেষ করি, তিনি বলেছেন - “আমরা যে প্রত্যক্ষ বস্তুজগতের অন্তর্গত তাই একমাত্র বাস্তব। আমাদের চিন্তা বা চেতনাকে যতই ইন্দ্রিয়াতীত বলে মনে হোক না কেন, তাহা আসলে একটি বস্তুময় দৈহিক অঙ্গ মস্তিষ্কেরই উপপাদ। বস্তু চেতনার উপপাদ নয়, চেতনা নিজেই প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ উপপাদমাত্র”।

কর্পোরেট রাষ্ট্র ও শিক্ষাব্যবস্থা -
তন্ময়
Nov. 21, 2024 | রাজনীতি | views:286 | likes:0 | share: 0 | comments:0

যে রাষ্ট্র কর্পোরেট পুঁজির নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে এবং কর্পোরেট পুঁজিকে নিরাপত্তা প্রদান করে সেই রাষ্ট্রের অপর নাম কর্পোরেট রাষ্ট্র। ফ্যাসিস্ট শক্তি বিজেপি কর্পোরেট রাষ্ট্রেরই সমর্থক তা তাদের দেশ চালনার অর্থনৈতিক নীতির অভিমুখ দেখলেই বোঝা যায়। সরকারি ক্ষেত্রগুলো সংকুচিত করার সাথে সাথে ঢালাও বেসরকারিকরণ সেই নীতিরই অংশ। অন্যান্য ক্ষেত্রের পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রেও রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায় প্রাইভেট উদ্যোগের পথ প্রশস্ত করার লক্ষ্যেই প্রনয়ণ জাতীয় শিক্ষানীতির। 

জাতীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের আগামী পরিকল্পনা হচ্ছে শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় গুটিয়ে আনার জন্য ধীরে ধীরে সরকারি বিদ্যালয় থেকে হাত তুলে নেওয়া।

গত ১৬ ই এপ্রিল আসামের মুখ্যমন্ত্রী শিক্ষকদের নিয়োগপত্র তুলে দেওয়ার অনুষ্ঠানে ফাঁস করেছিলেন এই সত্যটা। তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন যে আগামী এক দশক পর আর সরকারি বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব থাকবে না। অর্থাৎ ফেলো কড়ি, মাখো তেল। টাকা দাও, পন্য (শিক্ষা) নাও। যাদের যথেষ্ট পয়সা নেই তাদের শিক্ষার অধিকারও নেই।

“ইউনাইটেড ডিস্ট্রিক্ট ইনফরমেশন সিস্টেম ফর এডুকেশন” বিভাগ থেকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে সারা দেশে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে মোট ৫১০০০ সরকারি বিদ্যালয়(৪.৭৮ শতাংশ)। ওই বছরে বেসরকারি বিদ্যালয় বৃদ্ধি পেয়েছে ১১৭৩৯ টি।

মৌলিক অধিকার “শিক্ষা” আজ বাজারের পণ্য। 

টাইমস অফ ইন্ডিয়া, রাইজিং কাশ্মীর, হিন্দুস্থান টাইমস, কাউন্টার ভিউ, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী উত্তরাখণ্ডে মোট ১৫০০ কাশ্মীরে ১২০০ গুজরাটে ৫০০ ওড়িশায় ১২০০ হরিয়ানায় ২৫০০ ত্রিপুরায় ৯০০ উত্তরপ্রদেশে ২৬০৭৪ মধ্যপ্রদেশে ২২৯০৪ টি বিদ্যালয় একত্রীকরণ এবং বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বন্ধ করে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে আরও কয়েক হাজার বিদ্যালয়। এর মধ্যে ওড়িশায় আরও ১৪০০০টি এবং মধ্যপ্রদেশে আরও১০০০টি বিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা উল্লেখযোগ্য।

জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী রাজ্য সরকারগুলিকে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের একত্রীকরনের মাধ্যমে স্কুলের সংখ্যা হ্রাস করতে হবে। একই সঙ্গে খবরে প্রকাশ স্কুল একত্রীকরণ ও বন্ধ করে দেওয়ার পর অবশিষ্ট স্কুলের অর্ধেক পরিচালিত হবে "Mission School of Excellence" নামে একটি প্রকল্পের অধীনে। 'বিশ্ব ব্যাঙ্ক' এবং 'এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কের' যৌথ নিবেশের মাধ্যমে চলবে এই প্রকল্প।

এর থেকেই স্পষ্ট হয়, শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ধীরে ধীরে হাত তুলে নিচ্ছে সরকার। উৎসাহ পাচ্ছে বেসরকারী সংস্থাগুলো। 

২০২১ এর ৭ই সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্কুলের শিক্ষকদের শিক্ষাদান প্রক্রিয়া উন্নত করা প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে তিনি শিক্ষা ক্ষেত্রে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সরকারী স্কুলগুলোকে বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়ার জন্য পিপিপি মডেল অনুসরণ করার কথা বলেন।

ব্যাতিক্রম হতে পারল না কেরালার বামপন্থী সরকার। মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারিকরণের খসড়া পরিকল্পনা পেশ করেন পার্টির রাজ্য সম্মেলনে। এই বিষয়ে একটি প্রশ্নের জবাবে পার্টির রাজ্য সম্পাদক বালাকৃষ্ণান জানান সিপিএম বেসরকারিকরণের বিরোধী নয়, যদি সেটা সরকারি নিয়ন্ত্রণে হয়। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, গেরুয়া সব রঙ আজ একাকার কর্পোরেটের নির্দেশিত পথে পা মেলাতে।

শিক্ষার চৌকাঠে পা আটকে শুধু অগণিত নিম্নবিত্ত মানুষদের।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929