সমস্ত লেখাগুলি

বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা -
কিনোক্ষ্যাপা
Nov. 26, 2024 | জীবনী | views:2599 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আধুনিক ভারতে বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে যেসমস্ত পথিকৃৎদের নাম শুরুতেই করতে হয় তাঁদেরই একজন ছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ১৯২০-র দশকে দেশ পরাধীন থাকলেও পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর অবদান দেশ-কাল-সীমানার গন্ডি ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে সমাদর লাভ করেছিল। তখন থেকেই আরেক বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী আইনস্টাইন-এর নামের সাথে উচ্চারিত হয় তাঁর নাম। তারপর থেকে “বোস-আইনস্টাইন তত্ত্ব”, “বোসন” কণা ইত্যাদি নিয়ে বৈজ্ঞানিক মহল থেকে শুরু করে সাধারণ জনমানসে আলোচনার কোনোদিনই কোনও অভাব হয়নি। খামতি যদি থেকে থাকে তাহলে সেটা এই মহান ব্যক্তির অন্যান্য বিভিন্ন গঠনমূলক চিন্তাভাবনা নিয়ে আলোচনার খামতি। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তাঁর মূর্তি গড়া হয়েছে, তাঁর নামে প্রতিষ্ঠান তৈরী করা হয়েছে, কিন্তু সবথেকে বেশী যেটার প্রয়োজন ছিল সেটাই কখনও করা হয়নি। সেটা হল তাঁর অমূল্য চিন্তাভাবনা গুলোকে যত্নের সাথে বাস্তবায়িত করা। বিশেষত, দেশবাসীদের মধ্যে বিজ্ঞান চেতনার মাধ্যম হিসাবে মাতৃভাষা ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তাকে যতটা গঠনমূলক ভাবে তিনি তুলে ধরেছিলেন ঠিক ততটাই অবজ্ঞার শিকার হয়েছে তাঁর এই চিন্তাভাবনা। ফলে বিজ্ঞানচর্চা তো বটেই, বরং গোটা শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই মাতৃভাষার ব্যবহার ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে। এই বিলুপ্তিকে আটকানোর জন্য পদার্থবিদ্যায় তাঁর অবদানের পাশাপাশি যেটা নিয়ে আলোচনা আরও বেশী করে প্রয়োজন সেটা হল “মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা” নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা। সেরকমই একটা চেষ্টা করা হয়েছে এই প্রবন্ধে।


এতবড় একজন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও সত্যেন্দ্রনাথ বসু যে নিদারুণ সারল্যের সাথে একজন প্রকৃত শিক্ষকের মত ছাত্রছাত্রীদের ভালোমন্দকে বুঝেছিলেন সেটা কম মানুষই পেরেছিলেন। বিদেশী ভাষা যে বিজ্ঞানচর্চার পথে আসলে প্রতিবন্ধকতা হিসাবেই কাজ করছে সেকথা তিনি অনুভব করেছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ বসু-ই প্রথম এই ব্যাপারটা নিয়ে সোচ্চার হন যে ছাত্ররা এই বিদেশী ভাষায় নিজেদের মনের ভাব ঠিকভাবে বোঝাতে পারে না। এমন কি এই বিদেশী ভাষায় পড়ানোর ফলে শিক্ষকও বুঝে উঠতে পারেন না যে ছাত্র কতটা শিখে উঠতে পারল। সত্যেন্দ্রনাথ বসু-র নিজের ভাষায় – “বিদেশী ভাষা ছাত্রদের পড়া মুখস্থ করাতে বাধ্য করে, স্বাধীন চিন্তার প্রকাশ হতে দেয় না এবং সৃজনী শক্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবীতে কোন দেশেই বিদেশী ভাষার মাধ্যমে লেখাপড়া শেখানো হয় না, হওয়ার কোনও কারণও নেই” [২) ৯৪]। বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দেখিয়ে তিনি বলেছেন – “আমরা ইতিহাস পড়ি, রুশ, জাপান, মিশর ইত্যাদি দেশের নবজাগরণের খবর পড়ি। কিন্তু যদি বলা যায়, এসব দেশে দ্রুত প্রগতি সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞান শিক্ষা মাতৃভাষায় চালু করার ফলে এবং সেই ভাবে আমাদের দেশে শিক্ষা-নীতিতে পরিবর্তন আনলে, আমরাও তাড়াতাড়ি এগিয়ে চলতে পারবো, তখনই তর্কের ধোঁয়ায় আসল কথা চাপা পড়ে যায়” [১) ২৭৭-২৭৮]। এমনকি আর সময় নষ্ট না করে স্নাতকোত্তর স্তরেও শিক্ষার মাধ্যম যাতে মাতৃভাষা করে দেওয়া হয় তার আর্জিও জানিয়েছিলেন তিনি। ইংরাজী শিক্ষার মোহভঙ্গ ঘটিয়ে তিনি মজার ছলে একটা ভীষণ দামী কথা বলেছিলেন – “দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসের মধ্যে যেমন অনেক গৌরবময় কথা আছে, তেমনি অনেক কলঙ্কের কথাও আছে। কিন্তু সেই সকলের মূল যদি অনুসন্ধান করা যায় তাহলে এই সমস্ত শোচনীয় ঘটনার মূলে অনেক সময় দেখা যাবে ইংরেজী শিক্ষিত গর্বিত ও স্বার্থপর লোকের কীর্তিকলাপ” [১) ১০৮]। কথাটা আজকের দিনেও সমানভাবে প্রযোজ্য।

দেশ যে শুধুমাত্র একটা ভৌগোলিক সীমানা নয়, বরং তার থেকে অনেকটা বেশী কিছু সেটা বুঝতেন বলেই দেশের কিসে ভালো হবে সেটা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন – “এটা ঠিক যে দেশ বলতে যদি দেশের লোককে বুঝায়, শুধু শিক্ষিত বা নায়ক সম্প্রদায় না হয়, যদি মনে হয়, দেশের সাধারণ লোকই দেশ, তবে এরা শিক্ষিত হলেই তো দেশকে উন্নত বলা যাবে, এবং দেশকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করবার জন্য সমূহ শক্তিই তাদের হাতের মধ্যে থাকবে” [১) ১০৭]। তাই দেশের সাধারণ জনগণকে শিক্ষিত করার জন্য উপযুক্ত মাধ্যম হিসাবে তিনি তুলে ধরেছিলেন মাতৃভাষাকে। শুধু বিজ্ঞান নয়, গোটা শিক্ষাক্ষেত্রে মাতৃভাষার প্রয়োগ আর প্রচলন ঘটাতে না পারলে শিক্ষাক্ষেত্রেও তেমন কোনও পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না বলেই তিনি মনে করতেন। এই বিষয়েও তাঁর দূরদর্শীতার পরিচয় পাওয়া যায় যখন তিনি বলেন – “শিক্ষার্থী যদি তার পারিপার্শ্বিক জগতে নিয়ত দেখে ইংরেজীনবীশের বাজার দর বাঙলানবীশের তুলনায় অনেকগুণ বেশী, তাহলে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে, সে বা তার অভিভাবকরা ইংরেজীর দিকে ঝুঁকবেই, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। পারিপার্শ্বিকের এই প্রতিকূল ও বিভ্রান্তিকর প্রভাবকে দূর না করা অবধি মাতৃভাষায় সর্বাঙ্গীণ শিক্ষার উপযোগী ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে না” [১) ১১৫]। একথা আজ সকলেই একবাক্যে স্বীকার করবেন যে শিক্ষাক্ষেত্রে মাতৃভাষা, বিশেষত শহুরে অঞ্চলে, আজ ঠিক এই সমস্যারই সম্মুখীন। গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকেই যাতে মাতৃভাষার মাধ্যমে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া যায় সে ব্যাপারে তাঁর ধারণা ছিল – “... যে প্রথমেই আমরা সারা দেশের কথা না ভেবে যদি আমাদের নিজেদের ঘর তৈরী করি, অর্থাৎ আমরা যে প্রদেশে থাকি সেই প্রদেশের লোকের শিক্ষা এমন ভাবেই বন্দোবস্ত করি যাতে বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রত্যেক শিশুর কাছে পৌঁছায়, তাহলে আমাদের সামনে নতুন যে সমস্ত অসুবিধা দেখা যাচ্ছে সেটা সহজেই চলে যায়” [১) ১০৭]। বলাই বাহুল্য যে ভারতের শাসকশ্রেণী এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ গুলোকে বরাবরই উপেক্ষা করেছে।


মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞানচর্চার ব্যাপারে যাঁরা বরাবরই নিজেদের নাক উঁচু করে এসেছেন তাঁরা নিজেদের স্বপক্ষে দুটো যুক্তি দেখিয়েছিলেন। তাঁদের প্রথম যুক্তি ছিল মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞানচর্চার ফলে নাকি বেকার সমস্যা বাড়বে। এটা এতটাই অবাস্তব একটা কথা যে এটা নিয়ে বিস্তর আলোচনায় যাওয়ার কোনও প্রয়োজনীয়তাই নেই। বেকার সমস্যা বাড়া তো দূরের কথা বরং এই পদক্ষেপের মাধ্যমে অনেক জীবিকা সংস্থানের উপায় হতে পারে। যেমন – মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ফলে অনুবাদে বিশেষজ্ঞ ভাষাবিদ্‌দের প্রয়োজনীয়তা বাড়বে বলেই মনে করেছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ভারতের মত বহু ভাষাভাষীর দেশে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা তথা শিক্ষাদানের একটা পরিবেশের মধ্যে অনুবাদ করার রীতি ও পদ্ধতি শেখানো হলে সেটা নিঃসন্দেহে অনেক জীবিকা সংস্থান ঘটাতে পারত। এছাড়াও, উন্নাসিকদের দ্বিতীয় যুক্তি ছিল বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিভাষার অভাব মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পথে একটা বড় বাধা। তবে এগুলো যে নিছক অজুহাত ছাড়া আর কিছুই নয় সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসু বলেছিলেন – “পরিভাষার প্রয়োজন ক্ষেত্র বিশেষে আছে, ঠিকই, তবে পরিভাষাকে নিমিত্ত করে শিক্ষা পরিকল্পনাকে স্থগিত রাখাও অনুচিত। ... তাছাড়া পরিভাষার উপর যতটা গুরুত্ব আরোপ করা হয় তার আদৌ কোন যুক্তি আছে কিনা ভেবে দেখা দরকার। ... আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রয়োগবিদ্যা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের অনেকাংশ পাশ্চাত্য দেশ থেকে নেওয়া। তারা বৈজ্ঞানিক তথ্য, যন্ত্র বা ধারণাকে যে নামে চিহ্নিত করছে, সেই তথ্য, যন্ত্র বা ধারণাকে আমরা সেই নাম-সমেত গ্রহণ করেছি। সেই নামের প্রতিশব্দ সন্ধান করা অনেকটা টেলিফোনকে দূরভাষ যন্ত্র বলার মতই বাতুলতা। অপরের কাছ থেকে নেওয়া জিনিস অপরের দেওয়া নামেই ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়” [১) ১১৩-১১৪]। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইংরেজী শব্দ ব্যবহারে তাঁর যে কোনও আপত্তি নেই সেকথা স্পষ্টভাবে জানিয়ে তিনি বলেছিলেন – “অনেক সময় বলা হয় যে, ভারতীয় ভাষাগুলিতে উপযুক্ত পরিভাষার অভাব বিজ্ঞানচর্চায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে। আমি বিশুদ্ধবাদী নই; তাই ইংরেজী টেকনিক্যাল ও বৈজ্ঞানিক শব্দের ব্যবহার চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবকে অভিনন্দন জানাই। ... অনেক সময়েই বৈজ্ঞানিক শব্দের তর্জমা পন্ডশ্রমমাত্র হয়ে দাঁড়াবে – রেলওয়ে, রেস্তোরাঁ, কিলোগ্রাম, সেন্টিমিটার, হুইল, লেদ, থার্মোমিটার, বয়লার, কাটার, ইলেকট্রন, অ্যাটম, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস, ডিফারেনসিয়াল কোয়েফিসিয়েন্ট, ইন্টিগ্রেশান – এসব প্রায় সকলেই বোঝেন। পেপার, চেয়ার, টেবিল তো এখন প্রাত্যহিক ব্যবহার্য জিনিস। দৃষ্টান্ত বাড়ানোর দরকার নেই। আশা করি শিক্ষক-ছাত্ররা কোন বিষয় আলোচনার সময় এ ব্যাপারে অনায়াসেই একটা বোঝাপড়া করে নেবেন আর শিক্ষকের দায়িত্ব হবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারের কাজে ভাষা প্রয়োগের এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে হালের অবস্থান্তর সম্পর্কে নিজেকে ওয়াকিবহাল রাখা” [১) ৯৬-৯৭] পরিভাষা প্রসঙ্গে তাঁর সাফ বক্তব্য ছিল – “জলে না নেমে সাঁতার শেখানোর দুরাশার মত, ভাষাকে শিক্ষার বাহন করবার চেষ্টা না করে শুধু পরিভাষা সৃষ্টির চেষ্টা আমার কাছে হাস্যকর বলে মনে হয়েছে” [১) ২৭৭]।


টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত আধুনিক জীবনে বিজ্ঞানের স্থান বিষয়ক আলোচনায় যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু একবার জাপানে গিয়েছিলেন, এবং সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি দেশে ফিরেছিলেন। এমনিতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত জাপান কিভাবে একটা আধুনিক রাষ্ট্র হিসাবে মাথা উঁচু করে উঠে দাঁড়ালো এবং প্রযুক্তির অগ্রগতিতে সারা পৃথিবীকে বিস্মিত করে তুলল সে ব্যাপারে তাঁর কৌতূহল ছিল ভীষণ। জাপান থেকে দেশে ফেরার পর থেকেই বিভিন্ন ভাষণে ও লেখালেখিতে তিনি তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছিলেন, এবং দেখিয়েছিলেন যে কিভাবে মাতৃভাষা বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার প্রসারে প্রতিবন্ধকতা তো হয়ইনা, বরং উল্টে এই কাজে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঐ আলোচনা সভায় জাপানী ছাড়াও দেশ বিদেশ থেকে আগত একাধিক গণিতবিদ, পদার্থবিদ, জীববিদ, দার্শনিক, এবং বিজ্ঞানীর সমাবেশ ঘটেছিল। কিন্তু সকলকেই বলা হয়েছিল যে ইংরেজী বা আরও কয়েকটা বিদেশী ভাষা বুঝতে পারলেও যেহেতু সারা দেশ জুড়ে শিক্ষা চলে জাপানী ভাষায় তাই আলোচনা সভায় সকলকে মূলত জাপানী ভাষা শোনার জন্যই প্রস্তুত থাকতে হবে। অবশ্য অন্যদের বোঝার জন্য এবং উপস্থিত বিদেশী বিজ্ঞানীদের বক্তৃতা জাপানী ভাষায় সেই দেশের মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য দোভাষীর ব্যবস্থা ছিল। সত্যেন্দ্রনাথ বসু অবাক হয়ে দেখেছিলেন যে – “আধুনিক রাষ্ট্রে বিজ্ঞানের প্রয়োগ সম্পর্কে এক বিশেষ জটিল ও বিমূর্ত আলোচনা অনায়াসেই চালানো হল জাপানী ভাষায়” [১) ৮৫]। এছাড়া, তিনি সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও গেছিলেন। সেখানেও তিনি দেখেছিলেন যে পদার্থবিদ্যার আধুনিকতম দিকগুলোও পড়ানো হচ্ছে জাপানী ভাষায়। অনেক ধার করা শব্দ ব্যবহার করলেও সে বিষয়ে জাপানীদের মধ্যে কোনও কুন্ঠাবোধ তাঁর নজরে আসেনি। কলকাতায় বক্তৃতা দিতে আসা এক জাপানী বিজ্ঞানীর সাথে কথা বলেও তিনি একই কথা উপলব্ধি করেন। সেই বিজ্ঞানীর কথায় – “আমরা বিজ্ঞান বিদেশীর কাছে শিখেছি এবং হয়তো এতে সত্যকারের মৌলিক অবদান আমাদের খুব বেশী কিছু নেই – তবে যা আমরা শিখেছি, সবই জাপানীর উপযুক্ত রূপ দিয়ে তাকে আপনার করে নিয়েছি।” [১) ২৭৮] অথচ আমরা যদি ভারতের যে কোনও প্রাদেশিক ভাষার সাথে তুলনা করি তাহলে নিঃসন্দেহে বলা চলে যে জাপানী ভাষা আয়ত্ত করা তুলনামূলক ভাবে কঠিন। জাপানী ভাষায় অক্ষরসংখ্যা কয়েক হাজার। ফলে, আমাদের দেশে মাতৃভাষা আয়ত্ত করতে যেখানে খুব বেশী হলেও বছর দুই সময় লাগে সেখানে জাপানী ভাষা শিখতে সময় লাগে প্রায় ছয় বছর। তা সত্ত্বেও এই ভাষা সেদেশে বিজ্ঞানচর্চার প্রধান মাধ্যম হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে। সুতরাং, বোঝাই যায় যে প্রশ্নটা হল সদিচ্ছার। সমস্যা হওয়া তো দূরের কথা, বরং, জাপানে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা যখন চালু হয়েছিল তখন বিজ্ঞান, দর্শন, কলাবিদ্যা ইত্যাদি বিষয় পড়ানোর জন্য শিক্ষক খুঁজে পেতে একেবারেই অসুবিধা হয়নি। জাপানে গিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসু দেখেছিলেন যে সেখানে ছেলে ও মেয়েদের ক্ষেত্রে স্কুলে যাওয়াটা বাধ্যতামূলক। কম করে নয় বৎসর তাদের শিক্ষালাভ স্কুলে গিয়ে শিক্ষালাভ করতে হয়। পড়াশোনার খরচ বহন করে সেখানকার মিউনিসিপালিটি কিংবা আমাদের দেশের মতই জেলা অথবা রাজ্যসরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এছাড়াও, শিল্পকলা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান এবং উপরের দিকের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও খরচার ভার বহন করে জাপান সরকার। স্বভাবতই তিনি এই ব্যবস্থা দেখে ভীষণভাবে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন এবং চেয়েছিলেন যাতে আমাদের দেশেও এমনটা বাস্তবায়িত হোক। যদিও আমাদের শাসকশ্রেণী কোনোদিনই সে পথে হাঁটেনি। বিনা খরচার শিক্ষাব্যবস্থা তো অনেক দূরের কথা, বরং বিপরীত পথে হাঁটতে হাঁটতে সাধারণ জনগণের আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়ে আজ শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ বেসরকারীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

ভারত আর জাপান এই দুই দেশে মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান আলোচনার সমসাময়িক অবস্থার একটা তুলনা পাওয়া যায় তাঁর জাপান ভ্রমণের অভিজ্ঞতার একটা ঘটনায়। তিনি লিখেছেন – “খবর পেলাম যে, পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলাফল সম্পর্কে দু-জন ভারতীয় বিজ্ঞানীর ইংরাজীতে লেখা একটি বইয়ের জাপানী তর্জমা হয়েছে। আমায় জানানো হল ঐ বইটি বেশ ভালোই বিক্রী হয়েছে ছয় মাসে, প্রায় তিন হাজারের মত। শুধু জাপানী ভাষাই পড়তে পারেন এমন সাধারণ জাপানীরা পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলাফল জানবার জন্য বিশেষ উদ্বিগ্ন এবং হয়ত তাঁরা এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ ভারতীয় মতামতকেই বেশী বিশ্বাস করেন অন্যদের চাইতে। তবু আমাদের দেশে ঐ বিশিষ্ট বিজ্ঞানীরা ইংরাজীতেই লিখে চলেছেন ও তার ফলে তাঁদের দেশবাসীরা শতকরা ৮০ ভাগকেই অজ্ঞ রেখেছেন পারমাণবিক ভস্মপাতের বিপদ সম্পর্কে” [১) ৮৫]। সুতরাং, বর্তমান ভারতে জাদুগুড়া বা জাদুগুড়ার মত অন্যান্য তেজস্ক্রীয় ইউরেনিয়াম খনিতে আদিবাসীরা যে উপযুক্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই খননের কাজ করে চলেছে, তেজস্ক্রীয় নিশ্বাস-জল-খাবার  যে তাঁদের জীবনটাকে প্রতি মুহুর্তে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে – তাতে আর অবাক হওয়া কিসের। ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রীয়তা সম্পর্কে কিছু মানুষকে অজ্ঞ করে রেখে যদি তাঁদের প্রাণের বিনিময়ে পোখরানের মত “জাতীয় গৌরব” অর্জন করা যায় তাহলে আর মন্দ কি। এই তো ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত বিজ্ঞানী এবং আমলাতন্ত্রের মনোভাব! যেখানে বিজ্ঞানচেতনা দূরে থাক, সামান্য মানবিকতা বোধটুকুও নেই। এর বিরুদ্ধেই তো লড়াই ছিল সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মত বিজ্ঞানীদের। খুব কম জনেই তাঁর মত করে উপলব্ধি করে বলেছিলেন যে – “কেবলমাত্র বিদ্যা অর্জন ও জ্ঞানের অগ্রগতিতে সহায়তা করা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ হতে পারে না। জাতি, ধর্ম, মতবাদ, ধনী, দরিদ্র এবং সামাজিক ও বংশমর্যাদা নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষ যে মূলত এক, এই শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রচার করতে হবে। শেষ পর্যন্ত মানুষই যে পরম সত্য আমাদের সেই জ্ঞান হোক” [১) ৮৬]।


একথা সত্য যে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচলনের পিছনে ব্রিটিশ শাসকদের একটা বড় ভূমিকা ছিল। তবে সেটা ছিল সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশদের নিজেদেরই স্বার্থে। ভারতের নিজস্ব অর্থনৈতিক ভিত্তিটাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে একদিকে ব্রিটিশরা নিজের দেশে পুঁজিবাদী উৎপাদনের গতি বৃদ্ধি করার জন্য ভারত থেকে অবাধ কাঁচামাল সরবরাহের ব্যবস্থা করেছিল, আর ব্রিটেনে তৈরী সামগ্রী বিক্রীর একটা বাজার তৈরী করেছিল এই দেশে। তার জন্য যেটুকু গঠনমূলক কাজকর্ম করার দরকার ছিল ঠিক সেটুকুই ব্রিটিশরা করেছিল। কিন্তু অনেকেই তলিয়ে সে কথা ভাবতে চান না। ফলে ইংরেজদের বিভিন্ন ‘অবদান’ সম্বন্ধে সেকালে অনেকের অন্ধ মোহ ছিল। এগুলোর মধ্যে একটা ছিল ইংরেজী ভাষার প্রতি মোহ, যার একটা বিরাট প্রভাব পড়েছিল এদেশের শিক্ষাব্যবস্থায়। এমনকি স্বাধীনতার পরেও শিক্ষাব্যবস্থাকে এই ধরনের প্রভাব থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে নতুন শাসকশ্রেণী উদ্যোগী হয়নি। এই বিষয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর চিন্তাভাবনা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। এমনকি ইংরেজী শিক্ষা কিভাবে কেবল একটা নির্দ্দিষ্ট শ্রেণীরই স্বার্থ রক্ষা করে এসেছে সে কথাও তিনি বলেছেন। তাঁর ভাষায় – “[আমরা] মনে করি বিদেশী ইংরাজ যে ভাবে শাসন করে এসেছে – সেই বোধ হয় নিপুণতার শেষ কথা, তাই ইংরাজ চলে গেলেও ইংরাজী ভাষার মোহ আমাদের কাটে নি। ... অনেকের মনে ধারণা আছে যে, ভারতের ঐক্য – এটা আমরা ইংরাজীর কল্যাণে বুঝতে শিখেছি। কাজেই ইংরাজী শিক্ষা কায়েম করলেই হয়তো সেই ঐক্য জ্ঞান অটুট থাকবে। তাঁরা ভেবে নিয়েছেন, দেশের মধ্যে শিক্ষিত-অশিক্ষিতের স্তর বিভেদ থাকবেই এবং উপরের স্তরে ইংরাজী জানালা দিয়ে যে যে জ্ঞান ঐ জানালা সমীপবর্তীদের উদ্ভাসিত করে তুলবে, তারই কিছু বুদ্ধিমানের মত নিম্নভাগে পরিবেশন করে নিজেদের স্বার্থবৃত্তি অনুযায়ী রঙ্গিন করে নিয়ে বর্ত্তমানে যে ধরনের স্তর বিন্যাস সমাজে আছে তা চিরন্তনী করে রাখতে পারবেন” [১) ২৭৬]। অন্যত্রও বিভিন্ন স্থানে তাঁর বক্তব্যে এরূপ শ্রেণীচেতনার আভাস পাওয়া যায়, এবং তিনি স্পষ্টই এব্যাপারে তাঁর মত পোষণ করে বলেছিলেন যে – “এইভাবে দেশের উন্নতি করা কষ্টদায়ক। তাছাড়া সকলের দায়িত্ব অল্পসংখ্যক লোকের একটি শ্রেণীর উপর চিরকালের জন্য চাপানো উচিত নয়। দেশের লোকের উচিত নিজেদের বোঝা নিজেদের বওয়া। আমরা পনেরো বছরেও এ কাজে বিশেষ এগোতে পারিনি” [১) ১০৮-১০৯]। বর্তমানে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান প্রকল্প তথা স্বপ্নের ‘হিন্দুরাষ্ট্র’-কে বাস্তবায়িত করার জন্য যাঁরা হিন্দি ভাষাটাকে সকল দেশবাসীর উপর চাপিয়ে দিতে চাইছেন তাঁদের পুরোধা মোদী আবার ২০১৮ সালের ১-লা জানুয়ারীতেই ঘোষণা করেছেন যে এই মহান বিজ্ঞানীর জন্মের ১২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে যেন বছর ব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তিনি হয়তো জানেন না যে যাঁরা সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে নাম পরিবর্তনের রাজনীতি করেন তাঁদের উদ্দেশ্যে এই মহান বিজ্ঞানী বলেছিলেন – “আমাদের দাবী হল শিক্ষিতদের উপর। তাঁরা চেষ্টা করুন দেশে নতুন যুগ যাতে আসে। শিক্ষার নতুন বাহন তাঁরা স্থির করুন। প্রদেশে প্রদেশে এমন ধরণের ব্যবস্থা চালু করুন যাতে তাড়াতাড়ি আমাদের দেশ থেকে অশিক্ষা অজ্ঞানতা দূর হয়ে যায়। এই সূত্রে ভাবোন্মাদীদের একটু সাবধান করে দিচ্ছি যে, শুধু একটা নাম খারিজ করে, একটা নাম কেটে দিয়ে, আর একটা নাম চালালেই আমাদের নতুন যুগের আহ্বান সার্থক হয়ে উঠবে না” [১) ১০৯]। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় যে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর এই সাবধানবাণী কোনও কালেই শাসকশ্রেণীর কর্ণগোচর হয়নি। আর বর্তমান শাসকশ্রেণী সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে সাম্প্রদায়িক উস্কানি সমেত নাম পরিবর্তনের যে জঘন্য খেলায় মত্ত তাতে বোঝাই যায় যে অশিক্ষা অজ্ঞানতা দূর করার কোনও সদিচ্ছাই তাঁদের নেই, বরং এই অশিক্ষা অজ্ঞানতার উপর ভর করেই দেশজুড়ে তাঁরা তাঁদের নির্বাচনী রথযাত্রা সম্পন্ন করবেন বলে ঠিক করেছেন।

মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার বিষয়ে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অবদানের আলোচনাটা অসম্পূর্ণ থেকে যায় যদি আমরা বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ-এর কথা না বলি। ব্রিটিশ ভারতে ১৮৯৬ সালে বিজ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইন্ডিয়ান অ্যাসোশিয়েশান ফর দি কালটিভেশান অফ সায়েন্স। কিন্তু তার ষাট বছর পরেও সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং তাঁর মত চেতনাসম্পন্ন বিজ্ঞানীরা উপলব্ধি করেছিলেন যে আধুনিক বিজ্ঞানের শিকরকে আশানুরূপভাবে সাধারণ জনগণের ভিতর গেঁথে দেওয়া যায়নি, এবং এর একটা বড় কারণ হল বিদেশী ভাষা। দেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর কোনওরকম সরকারী উদ্যোগের আগেই ১৯৪৭ সালের ১৮-ই অক্টোবর কলকাতায় একটা মিটিঙে প্রস্তাব আনা হয় যে এমন একটা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হবে যার উদ্দেশ্য হবে মাতৃভাষার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনাকে জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করা। এই মিটিঙে সভাপতিত্ব করেছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। মিটিঙে প্রতিষ্ঠানের নাম ঠিক হয়েছিল – বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, এবং এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের দিন ধার্য হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ২৫-এ জানুয়ারী। এই উপলক্ষ্যে একটা বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছিল, যেখানে বলা হয়েছিল – “বর্তমান জগতে জীবনের প্রতি পদক্ষেপেই আমাদের বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হতে হচ্ছে, অথচ বৈজ্ঞানিক শিক্ষা-দীক্ষা এমনভাবে চালিত হচ্ছে না যাতে আমরা আমাদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানসম্ভার জীবনের দৈনন্দিন কাজে সুচিন্তিতিভাবে ব্যবহার করতে পারি। এর প্রধান অন্তরায় ছিল বিদেশী ভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা।” এই অন্তরায়কে অতিক্রম করার জন্য পরিষদের তরফ থেকে এই বিজ্ঞপ্তি-তে কিছু উদ্দেশ্য ঘোষণা করা হয়েছিল যেখানে মাতৃভাষাকে বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যম হিসাবে তুলে ধরা হয়েছিল। যেমন – “স্কুল ও কলেজের পাঠ্যবস্তু সহজ ও সরল ভাষায় বৈজ্ঞানিক যথাযথতা অক্ষুণ্ণ রেখে বিভিন্ন পরিবেশে সুখপাঠ্য ও চিত্তাকর্ষক করে প্রকাশ করা”, “বাংলা ভাষায় বৈজ্ঞানিক শিক্ষা প্রচার ও প্রসারের জন্য ও তার পথের বাধা-বিপত্তি দূর করার জন্য বাৎসরিক সম্মেলন আহ্বান করা এবং বৎসরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে শিক্ষা-মূলক অথচ জীবনের নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তুর প্রদর্শনী ও তৎসংক্রান্ত বক্তৃতার ব্যবস্থা করা” [২) ৯৯] ইত্যাদি। এই পরিষদের তরফ থেকে বাংলায় ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ নামে একটা পত্রিকা প্রকাশ করার ব্যবস্থা করা হয়। বিজ্ঞান সাহিত্য রচনায় বাংলাকে মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করার ব্যাপারে সত্যেন্দ্রনাথ বসু-র এতটাই আগ্রহ ছিল যে হাইড্রোডায়নামিক্‌স-এর মত পদার্থবিজ্ঞানের কঠিন বিষয়গুলোও তিনি বাংলায় প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। বাংলায় তাঁর প্রথম বিজ্ঞান সংক্রান্ত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল ‘পরিচয়’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায়, ১৯৩১ সালে। এমনকি ক্লাসেও মাঝেমাঝে তিনি বাংলাতে বক্তৃতা দিতেন। একবার সাহা স্মৃতি বক্তৃতাতে কসমোলজিতে সর্বাধুনিক ধারণার কথা তিনি বাংলাতেই আলোচনা করেছিলেন। সুতরাং, শুধু তত্ত্বে নয়, মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চাকে প্রয়োগের স্তরেও তিনি কার্যকরী করেছিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় তাঁর অধিকাংশ বক্তৃতাই হয় সংরক্ষণ করা হয়নি, বা হারিয়ে গেছে। কোনোদিন কোনও তৈরী বক্তৃতা থেকেও তিনি পড়েন নি, ফলে তার পান্ডুলিপি থাকারও কোনও সম্ভাবনা নেই। এই সমস্ত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও যে সামান্য কিছু উৎসের সন্ধান পাওয়া গেছে তার থেকেই “মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা”-র বিষয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা গুলোকে তুলে ধরার একটা চেষ্টা করা হয়েছে এই প্রবন্ধে। এই মহান ব্যক্তিত্বের ১২৫-তম জন্মবার্ষিকীর প্রাক্কালে, আসুন সকলে মিলে তাঁকে স্মরণ করি তাঁর চিন্তাভাবনার মধ্যে দিয়ে, এবং আলোচনা করি কিভাবে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চাকে তত্ত্বের গন্ডি পেরিয়ে প্রয়োগের বাস্তব ক্ষেত্রে নিয়ে এসে জনগণের মধ্যে বিজ্ঞানচেতনার সঞ্চার ঘটানো যায়। তবেই স্বার্থক হবে তাঁকে স্মরণ করাটা।

তথ্যসূত্র –

১) সত্যেন্দ্রনাথ বসু রচনা সঙ্কলন – বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ

২) সত্যেন্দ্রনাথ বোস – শান্তিময় চট্টোপাধ্যায় ও এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়

বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও আদালতের বিতর্কিত রায় – ফিরে দেখা -
কিনোক্ষ্যাপা
Nov. 25, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:881 | likes:0 | share: 0 | comments:0

“যুদ্ধক্ষেত্রের পরে আদালতের কক্ষই হলো সেই স্থান যেখানে ইতিহাসের সবথেকে জঘন্য অন্যায়গুলোর মধ্যে কিছু ঘটেছে।” - মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, ১৯২২ সালের ২৪-এ জানুয়ারী আদালতে দেওয়া বিবৃতি।

“সময় চলিয়া যায়, নদীর স্রোতের প্রায়”। দেশের একেবারে সামনের সারির এক গবেষণা সংস্থা CSIR গত ২১-এ নভেম্বর গর্বের সাথে ট্যুইট করে জানিয়েছে যে একদল বিজ্ঞানী প্রদর্শনী করে দেখিয়েছেন কিভাবে ২০২৪ সালের রামনবমীর দিন অযোধ্যার রামমন্দিরে রামলালার মূর্তির উপরে সূর্যের আলো এসে পড়বে। এই খবরটায় যাঁরা ভীষণ অবাক হয়েছেন, দুই বছর আগের এই খবরটা হয়তো তাঁদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল যে – প্রধানমন্ত্রীর উপদেশ অনুযায়ী ‘শ্রী রাম জন্মভূমি তীর্থ ক্ষেত্র ট্রাস্ট’ এমনভাবে অযোধ্যায় রাম মন্দির তৈরি করবে যাতে প্রতি বছর রামনবমীর দিন রামলালার মূর্তির উপর সূর্য রশ্মি এসে আছড়ে পড়ে (টাইম্‌স অফ ইন্ডিয়া, ১৭ নভেম্বর ২০২০)। তারপর থেকেই সেই ট্রাস্ট এই ব্যাপারে CSIR-এর সাহায্য নিয়ে চলেছে। আরও এক বছর পিছিয়ে যাওয়া যাক। 

৯ নভেম্বর ২০১৯ – বাবরি মসজিদের ধ্বংসাবশেষের উপর রাম মন্দির নির্মাণের অনুমতি দিয়ে রায় জানালো সুপ্রিম কোর্ট। ‘গণতন্ত্র’, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ইত্যাদির মুখে কালি মাখিয়ে অবসান হলো কয়েক দশক পুরোনো এক বিতর্কের। আরও অতীতে যাওয়ার আগে বরং এই বিতর্কিত রায় নিয়ে কিছু কথা হয়ে যাক।


রায়ের শেষে একটা সংযোজনে স্পষ্টই জানানো হয়েছে যে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় অর্থাৎ হিন্দুদের “বিশ্বাস”-এর উপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ তথাকথিত হিন্দুরা যেহেতু “বিশ্বাস” করেন যে বাবরি মসজিদের ঐ নির্দ্দিষ্ট অক্ষ্যাংশ-দ্রাঘিমাংশেই রামলালা-র জন্ম সেহেতু ভগবান শ্রী রাম ঐখানেই জন্মেছেন, এবং তাই “মন্দির ওঁহি বানায়েঙ্গে”। মন্দির ভাঙ্গার আগে RSS-BJP ঠিক এটাই বলে এসেছে। যেমন, ৫ জুন ১৯৮৯-এ একটা চিঠিতে বাজপেয়ী লিখেছিলেন, “রাম ঠিক কোনখানে জন্মেছিলেন সেটা নির্দ্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়”; লালকৃষ্ণ আডবানী ১ অক্টোবর ১৯৯০-এ বলেছিলেন, “এটা যে শ্রী রামের জন্মস্থান সেটা কেউই প্রমাণ করতে পারবেন না”, কারণ এটা বিশ্বাস, আর বিশ্বাসকে কি প্রমাণ করা যায়! RSS-সুপ্রিমো এম.ডি.দেওরাস তো ১১ জুন ১৯৮৯-এ লিখেইছিলেন যে, “এটা এমন বিষয়ই নয় যেখানে আইনব্যবস্থা নিজের সিদ্ধান্ত জানাতে পারে।” কিন্তু তিরিশ বছর পরে তাঁদেরকেও হয়ত অবাক করে দিয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ আদালত! কারণ, “... হ্যায় তো মুম্‌কিন হ্যায়”। তাই সর্বোচ্চ আদালত এই রায়ের মূল্যায়নে জানিয়েছে, “মসজিদ নির্মাণের আগে থেকে এবং পরবর্তীকালে হিন্দুদের সর্বদাই বিশ্বাস ছিল যে, ভগবান রামের জন্মস্থান হলো সেই স্থান যেখানে বাবরি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল, এবং এই বিশ্বাসের পক্ষে লেখ্য ও মৌখিক প্রমাণও আছে।” [দেখুন – Supreme Court Denies Justice]। এখানে লেখ্য প্রমাণ বলতে কিছু ধর্মীয় পুঁথির কথা বলা হয়েছে, যেগুলোর সত্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে RSS-এর পোষা ঐতিহাসিকরা বাদ দিয়ে বাকি সকলেই সন্দিহান, এবং মৌখিক প্রমাণ বলতে বোঝানো হয়েছে সেই “বিশ্বাস”-কে। তবে সবথেকে মজার ব্যাপার হল, সাধারণত প্রথা অনুযায়ী একটা রায়ের শুরুতে রায়দাতাদের নাম উল্লেখ করা থাকে; এক্ষেত্রে যেটা নেই। রায়ের নিচে পাঁচ বিচারপতির সই থাকলেও, রায়ের সংযোজনে যেখানে “বিশ্বাস”-এর উপর জোর দিয়ে পাতার পর পাতা লেখা হয়েছে সেখানে কারও সই নেই! [দেখুন – Secularism at stake ]। প্রশ্ন থেকেই যায় যে তাহলে কি রায়দাতারা কি নিজেরাই নিজেদের এই রায়কে “বিশ্বাস” করেন না?


সবটাই যখন “বিশ্বাস”-এর ভিত্তিতে তখন মামলার খুঁটিনাটি নিয়ে অযথা বাক্যব্যয় করে লাভ নেই। কিন্তু তাও কিছু কথা না বললেই নয়। যেমন, এই মন্দির নির্মাণ নিয়ে বিতর্কের প্রথম সূত্রপাত ঘটেছিল ১৮৮৫ সালে। বাবরি মসজিদের চৌহদ্দির ভিতরে ১৮৫৫ সালে একটা চবুতরা নির্মাণ করা হয়েছিল, এবং প্রার্থনাকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলিমদের বিবাদ বন্ধ করার জন্য চবুতরা আর মসজিদের মধ্যে প্রাচীরও তৈরি করা হয়েছিল। তখন থেকে সেই প্রাচীরের ভিতরে মসজিদে মুসলিমরা প্রার্থনা করেন, এবং বাইরে রাম-চবুতরাতে হিন্দুরা প্রার্থনা করেন। সেই রাম-চবুতরাকে রাম জন্মভূমি হিসাবে দেখিয়ে মন্দির নির্মাণের প্রথম আর্জি শুরু হয় ১৮৮৫-৮৬ সাল নাগাদ। এই সংক্রান্ত সেই সময়ের প্রতিটা মামলায় রাম জন্মভূমি হিসাবে চবুতরাটাকেই বিবেচনা করা হয়েছে, একবারের জন্যও বাবরি মসজিদ এই বিতর্কের মধ্যে আসেনি। হিন্দুত্ব রাজনীতির প্রথম দিককার পথিকৃৎ – সাভারকার, বালগঙ্গাধর তিলক, মদন মোহন মালব্য, বা লালা লাজপত রাই – কাউকেই কখনও শোনা যায়নি বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির নির্মাণের দাবি জানাতে। [দেখুন – Supreme Court Denies Justice ]। মন্দির ভেঙে সেখানে মসজিদ তৈরি হয়েছিল – এই আখ্যানও আসলে সাম্প্রতিক; ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পরে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে ফাটল ধরানোর লক্ষ্যে ঔপনিবেশিক শাসকদের মদতে রচিত বিকৃত ইতিহাসের একটা অংশ। বাবরি মসজিদ তৈরি হয় ১৫২৮ সালে। যদিও, ‘বাবরনামা’-তে মন্দির ভেঙে এই মসজিদ তৈরি হয়েছে বা রাম-জন্মভূমিতে মসজিদ তৈরি হয়েছে – এমন কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না। সপ্তম শতাব্দীর হিউয়েন সাং-ই হোক, বা একাদশ শতকের আলবেরুনী – কারো রচনাতেই অযোধ্যাকে রামজন্মভূমি হিসাবে উল্লেখ করতে দেখা যায় না। তবে সেইসব বাদ দিন! হিন্দু রাষ্ট্রের জনতা ম্লেচ্ছদের লেখা ইতিহাসে বিশ্বাস করবেনই বা কেন! কিন্তু বাবরি মসজিদ যদি সত্যিই মন্দির ভেঙে তৈরি হত তাহলে অন্তত ১৫৭৪ সালে তুলসীদাস রচিত ‘রামচরিতমানস’-এ তার কিছু উল্লেখ বা আভাস নিশ্চই থাকত! তা না হলে যে বলতেই হয় তুলসীদাস ‘সাচ্চা হিন্দু’ ছিলেন না! যাইহোক, সেই আমলের বিভিন্ন সংস্কৃত পুঁথিতে তীর্থক্ষেত্র হিসাবে অযোধ্যার উল্লেখ থাকলেও সেটাকে রামজন্মভূমি হিসাবে উল্লেখ করার নিদর্শন পাওয়া যায় না। যে ‘স্কন্দ পুরাণ’ নিয়ে এতো হৈচৈ সেখানেও অযোধ্যাকে রামজন্মভূমি বললেও নির্দ্দিষ্ট করে অযোধ্যার ঠিক কোনখানে রামলালা জন্মেছিলেন সেই কথা বলা নেই। [দেখুন – ASI's archaeological findings in Ayodhya: Short shrift to facts]। ‘স্কন্দ পুরাণ’-এর রচনা আনুমানিক ১৬০০ সালে। তাহলে ১৫২৮ সালে সত্যিই যদি মন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ তৈরি হতো তাহলে কি সেই কথা বড় বড় অক্ষরে ‘স্কন্দ পুরাণ’-এ লেখা থাকতো না? “আপ ক্রোনোলজি সমঝিয়ে”!


এমনকি একটা আরও মজার প্রশ্ন হল অযোধ্যার রাম-জন্মভূমিতে ঠিক কোন রাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন? এ.কে. রামানুজন-এর বিখ্যাত গবেষণামূলক প্রবন্ধ ‘থ্রি হান্ড্রেড রামায়ণ্‌স’ থেকে জানা যায় যে বীর নায়ক রাম-কে ঘিরে ৩০০-টারও বেশি ভিন্ন ভিন্ন আখ্যান ভারত ও এশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। মূল রামায়ণ বলে কিছু হয় না, এবং বাল্মীকির রামায়ণ হিসাবে যেটা জনপ্রিয় সেটাও আসলে এই ভিন্ন ভিন্ন আখ্যানগুলোর মধ্যে একটা। উদাহরণস্বরূপ, বৌদ্ধ জাতক কাহিনী দশরথ জাতক-এর কথা বলা যেতে পারে। এই আখ্যান অনুযায়ী রাম আর সীতা ভাই-বোন, এবং নির্বাসিত জীবনের পর রাম নিজের বোন সীতাকে বিয়ে করেন। এই আখ্যান উপজাতীয় সমাজের একটা আদিম পর্যায়কে সুন্দরভাবে প্রতিফলিত করে যেখানে একই প্রজন্মের একই পরিবারের ছেলে-মেয়ের মধ্যে যৌন সম্পর্ক ছিল স্বাভাবিক একটা ঘটনা। স্বাভাবিকভাবেই, এই ধরনের গবেষণামূলক প্রবন্ধ RSS-BJP-র পছন্দ নয়। কারণ, এই জাতীয় তথ্য RSS-BJP-র রাম-কেন্দ্রিক রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানায়। RSS-BJP-র ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’ রাম তাঁদের মতোই বর্ণবাদী, নারীবিদ্বেষী। অন্য রাম-এর উপস্থিতি তাঁদের রাম-এর কাছে অস্তিত্বের সংকট হয়ে ওঠে। সেই কারণে হিন্দুত্ব বাহিনীর ক্রোধের সম্মুখীন হওয়ার পরে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরের ইতিহাসের পাঠ্যক্রম থেকে এই প্রবন্ধকে বাদ দেওয়া হয়।


এছাড়া, RSS-BJP-র দাবির উপর ভিত্তি করে ১৯৭০ সাল থেকে অযোধ্যায় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চলছে। আজ পর্যন্ত মন্দির ধ্বংসের কোনো প্রমাণ কেউ দিতে পারেননি। অনেক ‘বিশেষজ্ঞ’ নিজেদের কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ফলাফলের কথা জানিয়েছেন। প্রতিটা ক্ষেত্রেই অভিজ্ঞ প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই প্রতিবেদনগুলির সমালোচনা করে সেগুলোকে খণ্ডন করেছেন। যদিও সেই ‘বিশেষজ্ঞদের’ কাছ থেকে পাল্টা কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। এমনকি এই লজ্জাজনক বিষয়টাও উল্লেখ না করলেই নয় যে ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে এই 

‘বিশেষজ্ঞ’ প্রত্নতাত্ত্বিকদের কয়েকজন মসজিদ ধ্বংস করে রাম মন্দির নির্মাণের হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন!

 ২০০৩ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (ASI) দ্বারা নতুন করে খনন করার নির্দেশ দেয়, যেটা সেই সময়ে সম্পূর্ণরূপে BJP-নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। যাইহোক, এমনকি ASI রিপোর্টেও কোন মন্দির বা তার ধ্বংসাবশেষের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়নি। তবে নিজের প্রভুদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে ASI ২০০৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে মসজিদের ধ্বংসাবশেষের নিচে একটা বিশাল কাঠামোর উপস্থিতির কথা জানিয়ে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিল। খননের সময় ASI-এর আচরণ এবং তার চূড়ান্ত প্রতিবেদনটা ‘আলিগড় হিস্টোরিয়ান সোসাইটি’ সমেত অনেকের দ্বারাই সমালোচিত হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক শিরিন রত্নাগর যথার্থই বলেছেন যে, “পরিস্থিতি, মন্দির নির্মাণের পক্ষে যুক্তির বিষয়বস্তু এবং যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এগুলো গড়ে উঠেছে, তাতে কোনো সন্দেহই নেই যে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যকে পূরণ করার জন্য কিছু ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছেন।” [দেখুন – Archaeology at the Heart of a Political Confrontation, pp. 243]।


সুতরাং, বলাই বাহুল্য যে মসজিদ ভেঙে রাম মন্দিরের নির্মাণের দাবি নোংরা রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই নয়, যার সূত্রপাতও এক ডিসেম্বর মাসে, ১৯৪৯ সালের ২২-এ ডিসেম্বর। ফৈজাবাদ-এর তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার ২৫ এপ্রিল ১৯৫০-এ নিজের লিখিত বয়ানে আদালতকে জানান যে, “মামলার সম্পত্তিটা বাবরি মসজিদ নামে পরিচিত, এবং এটা দীর্ঘদিন ধরে মুসলমানদের উপাসনার উদ্দেশ্যে একটি মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটা শ্রী রাম চন্দ্রজীর মন্দির হিসাবে ব্যবহার করা হয়নি। বরং ২২ ডিসেম্বর ১৯৪৯-এর রাতে, শ্রী রামচন্দ্রজীর মূর্তিগুলি গোপনে এবং অন্যায়ভাবে এর ভিতরে স্থাপন করা হয়েছিল।” [দেখুন – Supreme Court Denies Justice ]। এই রাজনৈতিক নোংরামোর ধারাবাহিকতাই পরিণতি পায় ১৯৮০-র দশকে, ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদ’-এর (VHP) হাত ধরে। আর তখন শুধু বাবরি মসজিদ-ই নয়, সাথে মথুরা ও বারাণসী-র দুটো মসজিদ ধ্বংসের ডাক দেওয়া হয়। এই রাম মন্দির নির্মাণের দাবি যে নিখাদ রাজনীতি সেকথা RSS-BJP-র নেতাদের কথাতেও একাধিকবার প্রকাশ পেয়েছে। 

১১-ই জুন, ১৯৮৯-এ আডবাণী বলেন, “আমি নিশ্চিত যে এসবের কারণে অনেক ভোট পাওয়া যাবে।” ১৮-ই জুন ১৯৯১-এ তিনি স্পষ্টই জানান যে, “আমি যদি রামের তাসটা ঠিকঠাকভাবে না খেলতাম, তাহলে আমি নিশ্চিতভাবে নিউ দিল্লী নির্বাচনী এলাকা থেকে হারতাম।” নিজের আত্মজীবনী ‘মাই কান্ট্রি মাই লাইফ’-এও তিনি এই প্রসঙ্গে লিখেছেন, “উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম আগ্রাসনের ইতিহাসের আলোকে অযোধ্যাকে প্রাসঙ্গিক করে তোলা এবং তারপর এর সাথে সমান্তরালভাবে মন্দির আন্দোলনের বৈধতা খোঁজা।” এমনকি সুষ্মা স্বরাজ পর্যন্ত ১৪-ই এপ্রিল, ২০০০-এ স্বীকার করেন যে রাম-জন্মভূমি আন্দোলন ছিল “নিখাদ রাজনৈতিক এবং এর সাথে ধর্মের কোনো যোগ ছিল না।” [দেখুন – How a Mosque Became a Temple ]।


বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দশ দিন পর ভারত সরকার কর্তৃক যে ‘লিবারহান কমিশন’ গঠন করা হয়েছিল সেই কমিশনের রিপোর্টেই এই নোংরা রাজনীতির যথার্থ মূল্যায়ন করে বলা হয়েছিল, “[মসজিদ ধ্বংসের] প্রস্তুতিটা অসাধারণ রকমের গোপনীয়তার সাথে সম্পন্ন করা হয়েছিল, এবং ধারাবাহিকতা ও নিশ্চিত ফলাফল সমেত সেটা ছিল প্রযুক্তিগতভাবে ত্রুটিহীন। ... মূল বিষয় ছিল ক্ষমতা। গোপন উদ্দেশ্যের সমর্থনে তরুণদের আকৃষ্ট করেছিল এই ক্ষমতা। নেতারা জানেন কিভাবে আবেগকে জাগ্রত করা হয় এবং কিভাবে সেটা প্রতিরোধ করা হয়; দেশের জন্য কোনটা ভালো হতো সেটার বদলে বরং তাঁরা সর্বদা এটাই দেখেন যে তাঁদের নিজেদের জন্য কোনটা ভালো হবে। অযোধ্যাতেও সেটাই হয়েছে।” [পাতা ৩৭৬ (৬১.৩০, ৬১.৩১); অথবা, দেখুন – There Stood a Mosque in Ayodhya, and it was Demolished ]। ২৭ বছর পর দেশের সর্বোচ্চ আদালতের যে বিতর্কিত রায়ের মাধ্যমে এই দীর্ঘ মন্দির-মসজিদ সমস্যার সমাধান ঘটানো হলো সেই রায় প্রসঙ্গেও একই কথা বলা চলে। দেশের জন্য যেটা ভালো হতো সেকথা না ভেবে শাসকশ্রেণীর অন্যায্য দাবির কাছে, ক্ষমতার কাছে মাথা নত করল ন্যায়বিচার।


মসজিদ ধ্বংসের জঘন্য ঘটনা এবং এই সর্বোচ্চ আদালতের এই বিতর্কিত রায় – দুটোরই যে নিন্দা জানানো প্রয়োজন তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু তার পাশাপাশি এটাও বোঝা প্রয়োজন যে ঠিক কোন বৃহত্তর অদৃশ্য ক্ষমতা এই ঘটনাক্রমগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছিল। ১৯৯০-এর অর্থনৈতিক সংকট, IMF-এর হস্তক্ষেপ, তারপর সেই তথাকথিত ‘অর্থনৈতিক সংস্কার’-এর মাধ্যমে বিশ্বের একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ রক্ষার্থে বিদেশী লগ্নির জন্য ভারতের বাজারকে উন্মুক্ত করে দিয়ে নয়া-উদারনৈতিক অর্থনৈতিক শোষণের পথ প্রস্তুত করা, এবং সেইসব থেকে ভারতের মেহনতী জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য ধর্ম আর বিশ্বাসের নামে তাঁদেরকে বিভক্ত করে দেওয়া, যার চূড়ান্ত পরিণাম RSS-BJP-র নেতৃত্বাধীন দক্ষিণপন্থী বাহিনী কর্তৃক বাবরি মসজিদ ধ্বংস – এই ঘটনা গুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে ভুল হবে। সেই সময় কেন্দ্রের গদিতে বসে থাকা কংগ্রেস সরকারের ভূমিকাকেও সামনে আনা প্রয়োজন। প্রথমে শাহ্‌-বানো মামলায় বিতর্কিত রায় ও বাবরি মসজিদের তালা খুলে দিয়ে একটা অশান্তির প্রেক্ষাপট তৈরি করে দেওয়া এবং তারপর নিজের সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে ১৯৯২ সালের ৬-ই ডিসেম্বর মসজিদ ধ্বংসের নারকীয় উল্লাসকে চুপটি করে উপভোগ করা – কংগ্রেস সরকারও নিজের দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। অরুন্ধতী রায় যথার্থই বলেছেন, “৯০-এর দশকের শুরুর দিকে দুটো তালা খুলে দেওয়া হয়েছিল – একটা বাবরি মসজিদের এবং আরেকটা বাজারের [অর্থনীতির উদারীকরণ]। এই দুটো তালা খুলে দিয়ে তাঁরা দুই ধরণের মৌলবাদকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন – একটা ধর্মীয়, আরেকটা অর্থনৈতিক।” [দেখুন – Attempt to Destroy Gujarat Riots Legal Trail]। জনগণের উপর নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতির আক্রমণ আজকে আরও তীব্র হয়েছে, এবং শাসক শ্রেণী আজকের দিনেও হিজাব-হালাল ইত্যাদি কু-তর্কের চিৎকারে জনগণের ন্যায্য দাবির আওয়াজকে দাবিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই এই দুই মৌলবাদকে আবার তালাবন্দী না করতে পারলে তাদের অশুভ আঁতাত থেকে জনগণের মুক্তি নেই।

আজাদি-কা অমৃত্‌ মহোৎসব! এবং আম্বেদকার -
কিনোক্ষ্যাপা
Nov. 24, 2024 | রাজনীতি | views:284 | likes:0 | share: 0 | comments:0

প্রথম দৃশ্য – স্বাধীনতার ৭৫ বছর উপলক্ষে দেশব্যাপী সাজো সাজো রব, পালিত হচ্ছে ‘আজাদি-কা অমৃত্‌ মহোৎসব’, বড় বড় ব্যানার, যেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবি যদিও ঢেকে গিয়েছে ৫৬-ইঞ্চি ছাতির আড়ালে। দ্বিতীয় দৃশ্য – নয় বছরের ছেলে ইন্দ্র-র শেষকৃত্য করছে তার বাবা; ইন্দ্র-র স্কুলের শিক্ষক তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে; ইন্দ্র-র অপরাধ ছিল সে জাতিতে নিচু হয়েও উঁচু জাতির শিক্ষকের জন্য রাখা জলের পাত্র ছুঁয়ে ফেলেছিল। ২০২২ সালের আগস্ট মাসের মন্তাজ্‌টা কিছুটা এইরকম। যখন জাতি-বৈষম্যের নির্মম শিকার হতে হয় সুরেখা ভোতমাঙ্গেদের, সাগর শেজওয়ালদের, কিংবা ইন্দ্রদের তখন একবিংশ শতক নিজের সমস্ত অত্যাধুনিকতাকে পাশে বসিয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। এই অভাগা দেশে ‘গরু’ হয়ে জন্মালেও হয়তো তাঁদের প্রাণরক্ষা হতো। কিন্তু এই মানুষগুলোর অপরাধ হলো তাঁদের জন্ম নিচু জাতের পরিবারে, যে পরিবার বংশপরম্পরায় এই জাতিগত নিপীড়ন বহন করে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে। তাঁদের অপরাধ হলো তাঁরা ‘অবর্ণ’, তাঁদের স্পর্শ করতে নেই; এমনকি তাঁদের ছায়াও মাড়াতে নেই; দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতে তাঁদের অপেক্ষা করতে হয় রাতের অন্ধকারের, যাতে তাঁরা নিজেদের ছায়া সমেত অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে পারেন এবং উঁচুজাতির মানুষরাও নিজেদের শুচিতা রক্ষা করতে পারেন। ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, এবং শূদ্র – এই চার বর্ণের মধ্যে ঠাঁই পাওয়ার সৌভাগ্য তাঁদের হয়নি। আর সৌভাগ্য হলেও তাঁদের সামাজিক অবস্থা নির্ভর করতো তাঁদের বর্ণের উপর। ব্রক্ষ্মার ‘পা’ থেকে উৎপন্ন হলে তার আবার কিসের অধিকার! তার একটাই কাজ ব্রক্ষ্মার ‘মুখ’, ‘বাহু’ ও ‘উরু’ থেকে উৎপন্ন হওয়া ব্রাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয় ও শূদ্রদের সেবা করা। আর এই স্তরবিন্যাস এতটাই ছোঁয়াচে যে এক শূদ্র আরেক শূদ্রের উপরেও নামিয়ে আনতে পারেন জাতিগত নিপীড়ন, যদি তিনি অপেক্ষাকৃত উঁচুজাতির শূদ্র হন। সময়ের সাথে এই সামাজিক ব্যাধি কমা তো দূরের কথা, বরং দেখা যাচ্ছে রাজনীতির ছত্রছায়ায় এই ব্যাধি যেন প্রতিদিন আরও বেড়েই চলেছে। আসুন, কিছু সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক।

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড্‌স ব্যুরো-র বার্ষিক প্রতিবেদন (২৯-এ অগাস্ট, ২০২২) অনুযায়ী এসসি ও এসটি-দের বিরুদ্ধে জাতিগত অপরাধ ২০২১ সালে যথাক্রমে ১.২% ও ৬.৪% বৃদ্ধি পেয়েছে। এসসি-দের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ঘটনার ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানে আছে উত্তর প্রদেশ (২৫.৮২%), রাজস্থান (১৪.৭%), এবং মধ্য প্রদেশে (১৪.১%)। এসটি-দের ক্ষেত্রে শীর্ষে আছে মধ্য প্রদেশ (২৯.৮%), রাজস্থান (২৪%), এবং ওড়িশা (৭.৬%)। নথিভুক্ত মোট অপরাধের মধ্যে মহিলাদের উপর নির্যাতনের সংখ্যাও যথেষ্ট উদ্বেগজনক; শুধুমাত্র ধর্ষণের শতকরা ভাগই হলো এসসি মহিলাদের ক্ষেত্রে ৭.৬৪% এবং এসটি মহিলাদের ১৫%। প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে ২০২১ সালের শেষ পর্যন্ত এসসি ও এসটি-দের বিরুদ্ধে যথাক্রমে নৃশংসতার মোট ৭০,৮১৮ ও ১২,১৫৯-গুলো মামলা তখনও তদন্তের অপেক্ষায়, যার মধ্যে আগের বছরের মামলাও ছিল। সেই বছর এসসি ও এসটি-দের বিরুদ্ধে যথাক্রমে নৃশংসতার মোট ২,৬৩,৫১২ ও ৪২,৫১২-টা মামলা আদালতে বিচারের জন্য এসেছিল, যার মধ্যে ৯৬.০% ও ৯৫.৪% মামলা বছরের শেষ পর্যন্ত বিচারাধীন অবস্থাতেই ছিল। ভারতীয় দণ্ডবিধি-র (আইপিসি) সাথে ‘এসসি ও এসটি (পিওএ) আইন’-এর অধীনে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার শতাংশ এসসি ও এসটি-দের জন্য যথাক্রমে ৩৬% ও ২৮.১%। বিগত বছরগুলোর প্রতিবেদনের দিকে তাকালেও খুব একটা আলাদা কিছু চোখে পড়বে না। সেই একই রাজ্যের নাম, ধর্ষণ-সহ অন্যান্য নৃশংস অপরাধের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা, তদন্তের অনীহা, ন্যায়বিচারের অভাব, শাস্তি প্রদানের বদলে অভিযুক্তদের বেকসুর খালাস বা জামিনে মুক্তি – এই প্যাটার্নটাই খুঁজে পাওয়া যাবে। আর এই পরিসংখ্যানের সবটাই নথিভুক্ত তথ্যের ভিত্তিতে। গণতন্ত্র বা গণমাধ্যম কোনোটাই তাদের নির্দিষ্ট শ্রেণী-গন্ডি ভেঙ্গে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে পৌঁছাতে পারেনি, এখনও। তাই এত বড় দেশের কোন অংশে কোন অঘটন যে জাতপাতের নামে ঘটে চলেছে তার হদিশ মেলা দুষ্কর। গড় হিসাবে প্রতিদিন প্রায় ৪ জন করে দলিত মহিলা ধর্ষিতা হয়ে চলেছেন। যে ‘নির্ভয়া’ কান্ড নিয়ে সারা দেশ তোলপার হয়েছিল, সেই বছরই সারা দেশে নথিভুক্ত তথ্য অনুযায়ী ১৫৭৪ জন দলিত মহিলা ধর্ষিতা ও ৬৫১ জন খুন হয়েছিলেন।

তবে শুধু পরিসংখ্যান দিয়ে পরিস্থিতির গভীরতা নির্ণয় সম্ভব নয়। অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে এসসি-এসটি-দের বিরুদ্ধে নৃশংসতার ঘটনা সচরাচর সংবাদমাধ্যমগুলোতে সম্প্রচারও করা হয় না, কারণ স্থানীয় স্তর থেকে শুরু করে জাতীয় স্তর পর্যন্ত প্রশাসন, সংবাদমাধ্যম সবকিছুই মূলত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দ্বারাই পরিচালিত। সুতরাং, সেখানে দলিতদের উপর সামাজিক নিপীড়ন, দলিতদের বঞ্চনার কাহিনী সর্বসমক্ষে প্রচারিত হবে এমনটা ভাবাও বোধহয় অন্যায়। তাও ২০০৬ সালে মহারাষ্ট্রের খৈরলানজী গ্রামে সুরেখা ভোতমাঙ্গে-র গোটা পরিবারের নৃশংস হত্যার ঘটনা সবাইকে নাড়িয়ে দেয়; সংবাদমাধ্যমও কিছুটা নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়।

 সুরেখা ভোতমাঙ্গে ছিলেন একজন গরীব, দলিত মহিলা, জাতিতে ‘মাহার’, মহারাষ্ট্রের খৈরলানজি গ্রামে যেখানে পরিবারসমেত তিনি থাকতেন সেখানকার অন্যান্য জাতির নিরীখে যার স্থান অনেক নিচে। তাই বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা থেকে চাষের জল সবক্ষেত্রেই পঞ্চায়েত থেকে জুটত বঞ্চনা, নিপীড়ন; যেগুলোর মাত্রা চরমে উঠলে তিনি পুলিশের দ্বারস্থ হন সাহায্য চাইতে। কিন্তু নিচু জাত হয়ে সাহায্যের আবেদন! এতো সাহস হয় কিভাবে? তাই খেসারত দিতে হয় আত্মীয় পরিবারের এক সদস্যকে। আবার পুলিশ। এবার কিছু গ্রেপ্তারী। অভিযুক্তেরা অবশ্য সাথেসাথেই জামিন পেয়ে মুক্ত। এইবার আর কোনো সময় নষ্ট নয়। শিক্ষা দেওয়ার পালা; যেমন রামচন্দ্র দিয়েছিলেন শম্বুককে! উন্মত্ত অভিযুক্তেরা দলবল সমেত (সকলেই উচ্চবর্ণের গ্রামবাসী) ঝাঁপিয়ে পড়ে সুরেখা-র পরিবারের ওপর। সুরেখা, সুরেখা-র সতেরো বছরের মেয়ে প্রিয়াঙ্কা, আর সুরেখা-র ছেলেদুটোকে টানতে টানতে উঠোনে বের করা হয়। ছেলেদের বলা হয় মা আর বোনকে সবার সামনে ধর্ষণ করতে। না শোনায় তাদের যৌনাঙ্গ থেঁতলে দিয়ে তাদের মেরে ফেলা হয়। সুরেখা ও প্রিয়াঙ্কাকে গণধর্ষণ করা হয়, এবং পিটিয়ে হত্যা করা হয়। শোনা যায় তাঁদের প্রাণহীন মৃতদেহের উপরও ধর্ষণ চলেছিল অনেকক্ষণ। দিনটা ২৯শে সেপ্টেম্বর, সাল ২০০৬। তার নয় বছর পরেই বা পরিস্থিতি কিরকম? ২০১৫ সালের ১৬ই মে – বাবাসাহেব আম্বেদকারকে নিয়ে বাঁধা একটি গানের রিংটোন তার মোবাইলে বেজে ওঠে বলে ২৩ বছর বয়সী দলিত যুবক সাগর শেজওয়াল-কে মারধর ও পরে তার শরীরের উপর দিয়ে বাইক চালিয়ে দিয়ে নৃশংসভাবে খুন করা হলো তাকে। আরও সাত বছর পর তথাকথিত স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির কয়েকদিন আগে উঁচু জাতির শিক্ষকের জলের পাত্র ছুঁয়ে ফেলার ‘অপরাধ’-এ শিক্ষক পিটিয়ে খুন করে ফেললেন ৯ বছর বয়সী দলিত কিশোর ইন্দ্র-কে। ইন্দ্র-র লাশের উপর দিয়ে উদ্‌যাপিত হলো ‘আজাদি-কা অমৃত্‌ মহোৎসব’। আদৌ কোনো মাধ্যম দিয়েই কি এই হাজার হাজার বছরের সামাজিক পচনের গভীরতা নির্ণয় করা সম্ভব?


পুকুর, পাতকূয়ো, পানীয় জল, জমি, বিদ্যুৎ ইত্যাদির অধিকার থেকে আজও প্রত্যন্ত এলাকার দলিতরা বঞ্চিত। হরিয়ানার মত জায়গায়, যেখানে একদিকে বিশ্বায়নের রমরমা, সেরমই আরেকদিকে সে রাজ্যের প্রত্যন্ত গ্রামে দলিত বরকে সমস্যায় পড়তে হয় যদি তিনি ঘোড়ার পিঠে চড়ে বিয়ে করতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বছর কয়েক আগে হিসার জেলার দৌলতপুর গ্রামে এক ব্যক্তির হাত কেটে নেওয়া হয়। তাঁর অপরাধ ছিল তিনি উঁচুজাতের কোনো এক জমিদারের জলাধার থেকে জল খাওয়ার ‘সাহস’ দেখিয়েছিলেন। উঁচুজাতের কোনো পরিবারের মেয়ের সাথে নিচুজাতের কোনো ছেলের ভাব-ভালোবাসা অচিরেই ছেলেটির ‘খুন’ ডেকে আনে, এবং এই সত্যটা এতটাই প্রতিষ্ঠিত যে অন্যান্য কোনো কারণে দলিত খুন হলেও সেটা আড়াল করতে একটা প্রেম-ভাব-ভালোবাসার মিথ্যা দৃষ্টিকোণ জড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, যাতে সেই খুনটা সমাজে ‘স্বাভাবিক’ বা ‘বৈধ’ বলে গণ্য হয়; যাকে বলে – Honor killing। আর এই সমস্ত কিছুই ঘটে পুলিশ-প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতে। পুলিশের কাছে সাহায্য পাওয়া যাবে কিনা সেটাও নির্ধারণ করে দেবে সাহায্যপ্রার্থীর ‘জাত’। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এরকম কোনো অত্যাচারের ঘটনা নথিভুক্ত করতে গেলে বিরোধীপক্ষও একটা মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করে থাকে, এবং প্রায় প্রতিক্ষেত্রেই আক্রান্ত ব্যক্তি বা পরিবারের উপর চাপ সৃষ্টি করে তাঁদের বাধ্য করা হয় অভিযোগ প্রত্যাহার করতে। তাই “Scheduled Caste and Scheduled Tribe (Prevention of Atrocities) Act, 1989” আইনটাও বড়ই হাস্যকর হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষতঃ যেখানে আইন-রক্ষক ও ন্যায়দাতাদের মধ্যে থেকেই এই স্বৈরাচারী বর্ণচেতনা এতদিনেও দূর করা যায়নি। উল্টে তাঁরা নিচুজাতিকে পদদলিত করে রাখতে নিজেদের প্রশাসনিক ক্ষমতা অবলীলায় ব্যবহার করে থাকেন। অথচ, যে সামাজিক পার্থক্যকে ঘিরে এতকিছু, সেই সামাজিক পার্থক্য ও জাতপাতের শুচিতার প্রশ্ন কর্পূরের মত উবে যায় যখন উঁচুজাতির গ্রামবাসীরা নিচুজাতির ‘অস্পৃশ্য’ সুরেখা বা প্রিয়াঙ্কাদের অবলীলায় গণধর্ষণ করে খুন করতে পারে, সাগর বা ইন্দ্রদের পিটিয়ে হত্যা করতে পারে। এই জঘন্য জাতি-ব্যবস্থা সম্পর্কে বাবাসাহেব আম্বেদকার-এর করা মন্তব্যটা তাই আজকের দিনেও সমান, হয়তো বা আরও বেশী গুরুত্বপূর্ণ – “There cannot be a more degrading system of social organization than the caste system. It is the system that deadens paralyses and cripples the people from helpful activities.”

ভারতবর্ষের মূলধারার ইতিহাস-চর্চায় ভীমরাও বাবাসাহেব আম্বেদকর-কে কোনোদিনই সেইভাবে যথাযথ স্থান দেওয়া হয়নি। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আম্বেদকরকে একটি গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার এক অদৃশ্য অশুভ প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। তাই আম্বেদকর শুধু দলিতদের নেতা হয়ে রয়ে যান। আর প্রিভিলেজ্‌ড মানুষজনের কাছে তিনি ভারতের সংবিধানের রচয়িতা। জাতি-ব্যবস্থা, ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর যে সংগ্রাম, তাঁর যে সংস্কার-মুক্ত আধুনিক চিন্তাভাবনা ইত্যাদি স্বাভাবিকভাবেই ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী ক্ষমতাসীনদের রচনা করা ইতিহাসের নিচে পিষ্ট হয়ে এসেছে, ‘আম্বেদকর’ আর ‘সংবিধান’ শব্দদুটো একে অপরের সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এও যেন এক দুরভিসন্ধির পরিণাম। জীবনের অন্তিম পর্যায়ে কৌশলে তাঁকে সংবিধানের জনক বানিয়ে দেওয়া হলো, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম সংবিধানের ফাঁকফোকড়-কে ঘিরে ওনার একটা ঋণাত্মক মূল্যায়ন করতে পারে। এই পরিকল্পনার স্রষ্টা যাঁরা, তাঁদের দূরদৃষ্টির প্রশংসা না করে পারা যায় না। কারণ আম্বেদকরকে ঠিক যতটা কোণঠাসা করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, ঠিক ততটাই কোণঠাসা তিনি হয়েছেন, জীবদ্দশাতেও, এবং মৃত্যুর পরেও। আম্বেদকর নিজে যে এই সংবিধানে একেবারেই খুশী ছিলেন না সেটা ২-রা সেপ্টেম্বর, ১৯৫৩-তে, রাজ্যসভায় প্রদত্ত একটা ভাষণে স্পষ্টই বোঝা যায়। তিনি বলেন – “Now, Sir, we have inherited a tradition. People always keep saying to me: ‘Oh, you are the maker of the Constitution.’ My answer is I was a hack. What I was asked to do, I did much against my will.”।  তাই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও যেখানে এই দেশ জাতপাতের ব্যাধিতে আক্রান্ত, সেখানে প্রয়োজন আছে সংবিধানের সংকীর্ণ বৃত্ত থেকে বেড়িয়ে এসে আম্বেদকরের এক পরিপূর্ণ মূল্যায়নের। কারণ, আম্বেদকর এমন একজন শিক্ষক, যিনি আমাদের প্রশ্ন করতে শেখান, যাবতীয় প্রাচীন (কু)সংস্কারের বিরুদ্ধে, সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ টিকে থাকা নিম্নবর্ণের মানুষের উপর উচ্চবর্ণের মানুষের একচেটিয়া শোষণের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে।

এই সামাজিক বৈষম্য ও তাকে ঘিরে এই অত্যাচারের কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে অবশ্যই গিয়ে পড়তে হবে হিন্দুশাস্ত্রের ফাঁকফোকরে। এই বৈষম্য কোনো একদিনে তৈরি হয়নি। হাজার হাজার বছর ধরে এই বৈষম্যকে লালন-পালন করা হয়েছে, আরও হৃষ্টপুষ্ট বানানো হয়েছে। তাই মাত্র কয়েক দশক পুরানো সংরক্ষণ নীতি, যে নীতির প্রয়োজনীয়তা ও প্রয়োগ নিয়ে আজও বিস্তর বিতর্ক হয়ে চলে, সেই নীতিও স্বাভাবিকভাবেই অপারগ এই বিরাট ফাঁক কে দূর করতে। হিন্দুশাস্ত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল ‘মনুস্মৃতি’ অনুযায়ী তাই কোনো শূদ্র যদি ভুল করেও ‘পবিত্র’ বেদমন্ত্র উচ্চারণ করে কিংবা শুনে ফেলে তাহলে তার জিভ ছিঁড়ে নেওয়া হবে, অথবা তার কান গলিত গরম সীসা ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া হবে। সুতরাং, পবিত্র বেদমন্ত্রকে যদি জ্ঞানলাভের প্রাচীনতম আধার হিসাবেই দেখি তাহলে এটা খুবই স্পষ্ট যে শুরু থেকেই সেই আধার সকলের জন্য নয়। শুরু থেকেই সেই আধার একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর জন্য তৈরি, যাতে শিক্ষা এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে আরেক শ্রেণীর উপর যুগের পর যুগ ধরে শোষণ চালানো যায় বিনা বাধায়। তাই চতুর্বর্ণের শুরুতেই যখন উদ্দেশ্য অসৎ, শুরুতেই যখন উদ্দেশ্য মৌলিক অধিকারগুলোর ক্ষেত্রে একটা বাধ্যতামূলক নির্ভরতার সম্পর্ক তৈরি করা এবং সেটাকে সময়ের সাথে বিভিন্ন রূপে লালন করা, ক্ষমতাশীল উচ্চবর্ণের কাছে ক্ষমতাহীন নিম্নবর্ণের বাধ্যতামূলক বশ্যতা স্বীকার করার এক ব্যবস্থা তৈরি করা – তখন এই অত্যাধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে অবশ্যই প্রয়োজন আছে সেই আম্বেদকারকে জানার, যিনি নব্বই বছরেরও বেশি সময় আগে ‘মনুস্মৃতি’ পুড়িয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে তৎকালীন ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

রক্ষণশীল সমাজের কাছে, ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের কাছে আম্বেদকার আজও এক বিরাট বড় চ্যালেঞ্জ। তাঁর “অ্যানিহিলেশন অফ কাস্ট” আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক। এই লেখাটি বক্তৃতার আকারে তিনি তৈরি করেছিলেন ১৯৩৬ সালে। “জাত-পাত তোড়ক মণ্ডল” নামক এক গোষ্ঠীর হয়ে তাঁর সেই বক্তব্য রাখার কথা ছিল, সমাজে বর্ণবৈষম্যের কু-প্রভাব গুলো তুলে ধরার জন্য। কিন্তু সেই বক্তব্যের ধার এতটাই ছিল যে সেটার খসড়া পড়ার পর র‍্যাডিক্যাল হিন্দুদের নিয়ে তৈরি সংস্কারপন্থী সেই গোষ্ঠীও শেষ পর্যন্ত এই বক্তব্য বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও সেই বক্তব্য একেবারে অব্যক্ত থাকেনি। আম্বেদকর নিজ উদ্যোগে সেটা ছাপিয়েছিলেন  “অ্যানিহিলেশন অফ কাস্ট” নামে, এবং বিতরণ করেছিলেন। শাস্ত্রের লেখা কারও কাছে অন্য বার্তা বহন করলে সেটা শাস্ত্রের লেখার দোষ নয়, কারণ শাস্ত্র ও শাস্ত্রের লেখা চিরন্তন সত্য, অবিনশ্বর – এই বস্তাপচা যুক্তি দিয়ে বারেবারেই হিন্দুশাস্ত্র ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছে। তার উত্তরে আম্বেদকর “অ্যানিহিলেশন অফ কাস্ট”-এ লিখেছেন – “It is no use telling people that the shastras do not say what they are believed to say, if they are grammatically read or logically interpreted. What matters is how the shastras have been understood by people.” আরেকধরণের ভাঁওতাবাজী, যেটা প্রায়শই একটু কম রক্ষণশীলরা বর্ণাশ্রম প্রথার ভিত্তি রক্ষার জন্য বলে থাকেন, সেটা হল – বেদ অনুযায়ী এই প্রথা কর্মের ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করে, তাই মানুষের জন্ম তার বর্ণ নির্ধারণ করতে পারেনা। আপাতদৃষ্টিতে খুব প্রশংসনীয় দৃষ্টিভঙ্গি মনে হলেও, এর বাস্তব গ্রহণযোগ্যতাকে অকাট্য যুক্তিতে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন আম্বেদকর। তিনি জানতে চেয়েছিলেন – “How are you going to compel people who have acquired a higher status based on birth, without reference to their worth, to vacate that status? How are you going to compel people to recognize the status due to a man, in accordance to his worth, who is occupying a lower status based on his birth?”

এই প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি। তার একটা বড় কারণ – সদিচ্ছার অভাব। তাই সংরক্ষণ নীতি থাকা সত্ত্বেও, বহুক্ষেত্রে এই নীতির বাস্তব প্রয়োগ ও সেই প্রয়োগ থেকে প্রাপ্ত সুবিধার পরিমাণ শূন্য। সংরক্ষণ নীতির জন্য যোগ্য হতে গেলে একজন দলিতকে হাইস্কুলের গণ্ডি পেরোতে হবে। সেই হিসাবে এই সংরক্ষণ নীতির সুবিধা প্রতি চারজন দলিতের মধ্যে মাত্র একজনই পেতে পারে। বাকি তিনজনকে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক কারণে হাইস্কুল পেরোনার আগেই পেটের চিন্তা করতে হয়। তাই সংরক্ষণ নীতি আদপে ততটা কার্যকর হয়ে ওঠে না, যতটা তার ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা দাবি করেছিল।  তবে যেটা চলে, সেটা হলো এই নীতি কে নিয়ে দর-কষাকষির রাজনীতি। পরিণাম – “যারে তুমি নীচে ফেল, সে তোমারে টানিবে যে নীচে / পশ্চাতে রেখেছো যারে, সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে”। একদা আম্বেদকরও বলেছিলেন – “If the fundamental rights are opposed by the community, no Law, no Parliament, no Judiciary can guarantee them in the real sense of the word.”। এই কথাটা আজও সমান গুরুত্বপূর্ণ, যতটা সেদিন ছিল।

পেরিয়ার রামাস্বামী – বিরল এক ব্যক্তিত্ব -
কিনোক্ষ্যাপা
Nov. 21, 2024 | জীবনী | views:980 | likes:0 | share: 0 | comments:0

সাল ২০২২, তারিখ – ১৭-ই সেপ্টেম্বর, স্থান – কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন এক টেকনোলজি ইন্সটিটিউট, যা আবার An Institute of National Importance-এর তালিকাভুক্তও বটে, সময় – সকাল ১০-টা। শুরু হয়ে গেল কাঁসর-ঘন্টার শব্দ আর সংস্কৃত মন্ত্র সহযোগে বিশ্বকর্মা পুজো। একেবারে হৈহৈ ব্যাপার। সাথে হিন্দুত্ববাদীদের আস্ফালন তো আছেই। কিন্তু মন শান্ত করে ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখলাম এ-তো নতুন কিছুই নয়। এই সাংস্কৃতিক আবহেই তো আমরা – উচ্চবর্ণের হিন্দুরা – বড় হয়ে উঠেছি। আজ ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ নিয়ে আমরা অনেকে বহু আপত্তি প্রকাশ করছি বটে, কিন্তু তিল তিল করে এই হিন্দু রাষ্ট্র গড়ে তোলার কাজে আমরা, আমাদের পূর্বপুরুষরাই তো ইন্ধন জুগিয়েছি। সত্যিটা তো এটাই যে এই ‘হিন্দু রাষ্ট্র’-র বীজটা সেদিনই সংবিধানের মধ্যে পোঁতা হয়ে গিয়েছিল যেদিন স্বয়ং নেহরু-র নেতৃত্বে পরিচালিত উপদেষ্টা কমিটি সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টা অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্তটা প্রত্যাখ্যান করেছিল, এবং উল্টে সকল ধর্মকে সমান হিসাবে বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। Secular শব্দটা ভারতে সেদিনই ‘Sickular’ হয়ে গিয়েছে। যে গণতান্ত্রিক রাজনীতি স্বাধীনতার পরে জন্ম নিয়েছিল তাতে যে ভারত রাষ্ট্র বাস্তবে উচ্চবর্ণের হিন্দু অভিজাত শ্রেণীর ইচ্ছার কাছে, তাঁদের ধর্মের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হবে সেদিন একথা উপলব্ধি করা হয়নি, বা হয়তো জেনেবুঝেই সবটা করা হয়েছে। স্কুলে-কলেজে পুজো-অর্চনা সেই ঐতিহ্যই বহন করে চলেছে। সেই ঐতিহ্যের হাত ধরেই ১৭-ই সেপ্টেম্বর তারিখটা ভারতীয় সংস্কৃতি (পড়ুন হিন্দু সংস্কৃতি) অনুযায়ী বিশ্বকর্মা পুজো হিসাবে উদ্‌যাপিত হয়ে থাকে, পেরিয়ার ই. ভি. রামাস্বামী-র (১৮৭৯-১৯৭৩) জন্মদিন হিসাবে উদ্‌যাপিত হয় না। তবে এখনও আমরা এই ভেবে নিজেদের সৌভাগ্যবান বলে মনে করতে পারি যে এই দিনটা বর্তমান ভারতে বিশ্বকর্মা-র অবতার, ‘Make in India’-র জনক, নরেন্দ্র মোদী-র জন্মদিন হিসাবে তো আর পালন হচ্ছে না! অবশ্য আগামী প্রজন্ম এতটা সৌভাগ্যবান না-ও হতে পারে। তাই তাদের সম্ভাব্য দুর্ভাগ্যের হাত থেকে বাঁচাতে আসুন পেরিয়ার রামাস্বামী-কে নিয়ে একটু সংক্ষেপে চর্চা করা যাক।

এক ধনী ব্যবসায়ী পরিবারে ১৮৭৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন পেরিয়ার রামাস্বামী। দশ বছর বয়সেই প্রথাগত স্কুলশিক্ষা পরিত্যাগ, তরুণ বয়সে স্বল্পকালের জন্য সন্ন্যাস গ্রহণ, শীঘ্রই ধর্মীয় রীতিনীতি থেকে বিশ্বাস হারিয়ে কংগ্রেসে যোগদান মারফৎ সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ, সেখানেও মোহভঙ্গ ও শেষে কংগ্রেসের সাথেও বিচ্ছেদ, তারপর আজীবন সমস্ত রকম নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা – যেন স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটার জন্যই তিনি জন্মেছিলেন। ১৯২৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসের সাথে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটে, যখন ব্যাঙ্গালোর-এ গান্ধী-র সাথে সাক্ষাৎকারের পর তিনি বুঝতে পারেন যে গান্ধী নিজেই অন্তর থেকে বর্ণাশ্রম ধর্মের প্রতি ভীষণভাবে বিশ্বাসী। যদিও ইতিমধ্যে ১৯২৫ সাল থেকেই তিনি শুরু করে দিয়েছিলেন “আত্মসম্মান আন্দোলন” [Self-Respect Movement], যে আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল একদিকে জাতিভেদ আর তার রক্ষক ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে এবং অন্যদিকে নারীদের দমিয়ে রাখার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রচার চালানো ও পদক্ষেপ নেওয়া। সমকালীন জাতীয়তাবাদীরা যেমন ‘স্বরাজ’-কে একটা জন্মগত অধিকার হিসাবে দেখেছিলেন, তেমন পেরিয়ার-এর কাছে সেই জন্মগত অধিকারটা ছিল ‘আত্মসম্মান’। ‘এক মানুষ এক ভোট’-এর রাজনৈতিক গণতন্ত্র যদি ‘এক মানুষ এক মূল্য’-র ভাবনাটাকেই না সুনিশ্চিত করতে পারে তাহলে সেই গণতন্ত্র যে কখনই ভারতের নারী ও পুরুষের স্বাধীনতা, সৌভ্রাতৃত্ব আর সাম্যকে সুনিশ্চিত করতে পারবে না সেই কথাটা পেরিয়ার এবং তাঁর-মত জাতিব্যবস্থা-বিরোধীরা গোড়াতেই উপলব্ধি করেছিলেন। পেরিয়ার মনে করতেন ভারতীয় জনজীবনের প্রতিটা দিকই বেদ, স্মৃতি, শাস্ত্র ও পুরাণ মারফৎ পরিপুষ্ট মনুর নিয়ম এবং বর্ণাশ্রমধর্ম দ্বারা পরিচালিত, যা মতাদর্শগতভাবেই ‘এক মানুষ এক মূল্য’ – এই চিন্তাভাবনার পরিপন্থী।

ব্রাক্ষ্মণ্যবাদ, বর্ণাশ্রমধর্ম, এবং হিন্দুধর্মকেই জাতিব্যবস্থার মূল মতাদর্শ হিসাবে, এবং অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ ও অ-ব্রাক্ষ্মণ শূদ্রদের মুক্তিকে জাতিব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য অপরিহার্য হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন পেরিয়ার।

যাঁরা অস্পৃশ্য তাঁরা প্রথমে ও সর্বাগ্রে মেহনতী জনগণ। এই মেহনতী জনগণকে দাসত্ব এবং ভয় থেকে মুক্ত না করলে ভারতীয়দের স্বাধীনতা আর আত্ম-নির্ভরতার সমস্ত কথাবার্তাই আসলে ফাঁকা আওয়াজ। ‘আত্ম-নির্ভর’ ভারতে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে যতোই ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসভ’ উদ্‌যাপন চলুক না কেন, এই বাস্তব সত্য আজও আমরা উপলব্ধি করতে পারি।

ধর্মের প্রতি, বিশেষ করে হিন্দুধর্মের প্রতি পেরিয়ার-এর সমালোচনার তীব্রতা ছিল মারাত্মক। জনগণ কি খাবে, কিভাবে পোশাক পড়বে, কাদের বিয়ে করবে, পেশা নির্বাচন, পারস্পরিক সম্পর্ক, প্রকাশ্য ব্যবহার, রাজনৈতিক পছন্দ, আরাধনার উপায় – সংক্ষেপে, হিন্দুদের প্রতিটা কাজেই একটা ধর্মীয় সংবেদনশীলতা সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়, আর এই কর্তৃত্ববাদের দূর্গেই কামান দেগেছিলেন তিনি। তাঁর কথায় জাতিভিত্তিক সমাজ গঠনের মূল ভিত্তিই ছিল এই ধর্ম। একইভাবে সতীত্ব বজায় রাখা, সন্তানের জন্মদানে সক্ষমতা প্রমাণ করা ইত্যাদি ব্যাপারে নারীদের উপর চাপ সৃষ্টি করার চিরাচরিত ধর্ম-কেন্দ্রিক ধারণাগুলোকে তিনি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি কখনও ভাবেননি যে পুরুষের শরীর নারীর শরীরের থেকে আলাদা বলে পুরুষ আর নারী বৈশিষ্ট্য আর মেজাজের নিরীখে আলাদা। এছাড়া, নারীরা যাতে সৌন্দর্য্যের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং তাঁরা যাতে নিছক গয়না ঝুলিয়ে রাখার খুঁটিতে পরিণত না হয়ে যান সেই আহ্বানও জানিয়েছিলেন তিনি। পেরিয়ার-এর কাছে বিয়ের সম্পর্ক ছিল ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী মূল্যবোধের একটা ব্যবস্থা। তাঁর কথায় – “যেমনভাবে ব্রাক্ষ্মণ্যবাদ মেহনতী জনগণের একটা বিরাট অংশকে শূদ্র হিসাবে নিন্দা করেছে, ঠিক তেমনভাবে এই মতাদর্শ নারীদেরও বিবাহের দাসত্ব স্বীকার করতে বাধ্য করেছে। .. একজন নারী যতই সতীসাবিত্রী ও আদর্শ স্ত্রী-এর আদবকায়দা মেনে থাকবে ততই সে নিজের দাসত্বকে স্ফূর্তির সাথে মেনে নেবে।”

ব্রাক্ষ্মণ-পারাইয়া, পুরুষ-নারী, ও ধনী-গরীবদের মধ্যেকার বিভেদ, যেখানে দ্বিতীয় শ্রেণীগুলো প্রথম শ্রেণী দ্বারা নিপীড়িত – সমাজের এই তিনটে বিভেদকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে একটা সমানতার আদর্শ ‘সমধর্ম’-র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পেরিয়ার ও তাঁর আত্মসম্মান আন্দোলনের সহকর্মীরা। চাকরিক্ষেত্রে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আনুপাতিক ভিত্তিতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব; বিভিন্ন জায়গা, পবিত্র স্থান, সম্পত্তি, চাকরি ইত্যাদির উপর সাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা; আত্মসম্মান আন্দোলনের সদস্যদের বিবাহের ক্ষেত্রে আইনি বৈধতা নিশ্চিত করা; জাতি বা ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে মন্দিরে পুরোহিত নিয়োগের মতো কাজকে সম্ভব করা ইত্যাদিকে ‘সমধর্ম’ আদর্শের বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল। তাঁর নিজের ভাষায় – “সকল জাতির উচিত শিক্ষা, বুদ্ধিমত্তা ও সংস্কৃতিতে উন্নতি করা, এবং একে অন্যের সাথে সমতা অর্জন করা। ... সকল জাতির উচিত সরকারী পদগুলোকে সমান ভাগে অর্জন করা ... সকল জাতির উচিত একে অন্যের কাছাকাছি আসা এবং সংস্কৃতির একটা সাধারণ স্তর, একটা সাধারণ শিক্ষাগত মর্যাদা অর্জন করা, একটা সাধারণ নৈতিকতার অভিজ্ঞতা লাভ করা।” জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত ভারত রাষ্ট্র যখন ‘secularism’ শব্দটার অর্থ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ থেকে ‘সব ধর্ম সমান’-এ পরিবর্তিত করে সেই মুখোশের আড়ালে একটা নির্দ্দিষ্ট ধর্মের (ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্ম) পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছে, তখন পেরিয়ার-এর এই ‘সমধর্ম’-র আদর্শকে চর্চা করাটা নিঃসন্দেহে সময়ের একটা দাবি।

প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থারও কঠোর সমালোচনা করেছিলেন পেরিয়ার। তাঁর কাছে শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ধর্ম, শাস্ত্র ইত্যাদির উপর অন্ধ-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যুক্তিপূর্ণ চিন্তাভাবনার পরিবেশ গড়ে তোলা এবং তার সাথে পড়ুয়াদের নিজ বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী সচেতনভাবে ও স্বেচ্ছাকৃতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তৈরি করা। তাঁর মতে জনগণ ও দেশের জন্য পড়ুয়াদের মনে আত্মসম্মান, দৃঢ়তা, সাম্য, প্রেম ইত্যাদি বোধগুলোর সঞ্চার ঘটানোই শিক্ষকদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশ করা পড়ুয়ারা স্কুলে না যাওয়া অশিক্ষিত জনগণের থেকে যেকোনো দিক থেকে অনেক ভালো – এই ধারণাটা পেরিয়ার কোনওদিনও গ্রহণ করেননি। তাঁর কথায় – “যেমন একজন ধোপা ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় জানেন না, ঠিক তেমনই বি.এ. ডিগ্রীধারীরাও জানেন না যে কিভাবে ধোপাদের মতো কাপড় কাচতে হয়; একজন মুচি যেমন ব্যাকরণ এবং সাহিত্য জানেন না, ঠিক তেমনই বিদ্বান এবং শাস্ত্রজ্ঞরা জানেন না যে কিভাবে পায়ের জুতো তৈরী করতে হয়... সুতরাং, যাঁরা বি.এ. ডিগ্রী অর্জন করেছেন সেই বিদ্বান আর শাস্ত্রজ্ঞরা কোনওভাবেই ধোপা, নাপিত আর মুচি বা জাগতিক বিষয়ে আরও প্রয়োজনীয় ব্যক্তিদের থেকে বেশী শ্রেষ্ঠ নন। শিক্ষিত ব্যক্তিরা যেটা শিখেছেন সেটা হল একটা নির্দ্দিষ্ট দক্ষতার কোনও একটা কৌশল, কোনও জ্ঞান নয়। এই শিক্ষিতরা বোকা হতে পারেন, স্বার্থপর হতে পারেন, তাঁদের আত্মসম্মান বোধ নাও থাকতে পারে, কিন্তু আবার বিপরীতে স্কুলে না যাওয়া জনগণ উদার, বুদ্ধিমান, এবং আত্মসম্মান বোধ-সম্পন্ন হতে পারেন।” যে শিক্ষাব্যবস্থা নিছক মুখস্থ করে শেখার প্রবণতা তৈরী করে এবং পড়ুয়াদের মধ্যে অনুসন্ধানের মানসিকতা, শিক্ষকদের প্রশ্ন করার সংস্কৃতি তৈরী করেনা, সেই শিক্ষাব্যবস্থাকে ঘৃণা করতেন পেরিয়ার। এই ধরণের শিক্ষাব্যবস্থা যুব সম্প্রদায়ের মনের মধ্যে পারস্পরিক ভালো ব্যবহার এবং নৈতিকতা বোধের জন্ম দিতে পারে না।

পেরিয়ার কে ছিলেন? এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেই দিয়ে গিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন – “একটা আকারে বড় দেশ যদি একটা অপেক্ষাকৃত ছোটো দেশের উপর নিপীড়ন চালায়, তাহলে সেই ছোটো দেশটার পাশে দাঁড়াবো। সেই ছোটো দেশটায় সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্ম যদি সংখ্যালঘুদের ধর্মের উপর নিপীড়ন চালায় তাহলে আমি সেই সংখ্যালঘু ধর্মের পাশে দাঁড়াবো। যদি সেই সংখ্যালঘু ধর্মে জাতপাতের বিভেদ থাকে এবং একটা জাতি যদি আরেকটা জাতির উপর নিপীড়ন চালায় তাহলে আমি নিপীড়িত জাতিটার পাশে দাঁড়াবো। সেই নিপীড়িত জতির কোনো একজন মালিক যদি তাঁর কোনো কর্মীকে নিপীড়ন করেন তাহলে আমি সেই নিপীড়িত কর্মীর পাশে দাঁড়াবো। সেই নিপীড়িত কর্মী যদি বাড়ি ফিরে তাঁর স্ত্রী-কে নিপীড়ন করেন তাহলে আমি সেই নিপীড়িত মহিলার পাশে দাঁড়াবো। সামগ্রিকভাবে নিপীড়ন হলো আমার শত্রু।” 

তাই, একটা আদ্যন্ত নিপীড়নমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা যে এহেন একজন ব্যক্তির অস্তিত্ব, তাঁর আদর্শ ইত্যাদিকে ভুলিয়ে দিয়ে চাইবে সেকথা বলাই বাহুল্য।

তাই আসুন, রাষ্ট্রের সেই চক্রান্তকে ব্যহত করে দেওয়া যাক, অন্ততপক্ষে প্রতি বছর ১৭-ই সেপ্টেম্বর তারিখে তাঁকে স্মরণ করার মধ্যে দিয়ে, এছাড়াও বছরের অন্য যেকোনো সময়ে সুযোগ পেলেই, বা সুযোগ না পেলে সুযোগ তৈরি করে নিয়ে পেরিয়ার রামাস্বামী ও তাঁর কাজকর্মকে নিয়ে আরও বেশী করে চর্চার মাধ্যমে।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86933